somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

হুমায়ুন আহমেদ এর আত্মজীবনী-ফাউনটেনপেন (৭-৮)

০৭ ই মে, ২০১০ রাত ৯:৩৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

দৈনিক কালের কন্ঠের ফিচার পাতা "শিলালিপি" তে হুমায়ুন আহমেদ এর আত্মজীবনী-ফাউনটেনপেন ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশ করা হচ্ছে।আমিও এখানে ধারাবাহিক ভাবে তারই কপি-পেষ্ট করব।
*পর্ব ১-২
*পর্ব ৩-৪
*পর্ব ৫-৬


৭.
জি্বন এবং পক্ষীকথা

নুহাশ পল্লীর মাঠে বসে আছি। সময় সকাল ১০টা। আমার সঙ্গে আছেন সিলেটের হ্যারল্ড রশীদ। তিনি একজন সংগীত পরিচালক, চিত্রকর এবং শখের জ্যোতির্বিদ। তিনি আমাকে বৃহস্পতির চাঁদ এবং শনিগ্রহের বলয় দেখাতে এসেছেন। নিজের টেলিস্কোপ নিয়ে এসেছেন। রাতে টেলিস্কোপ সেট হবে।
আমরা রাতের জন্য অপেক্ষা করছি। অপেক্ষার জায়গাটা সুন্দর। বেদি দেওয়া জাপানি বটগাছের নিচে বসেছি। আমাদের ঘিরে আছে ছয়টা চেরিগাছ। দুইটাতে ফুল ফুটেছে। নীল রঙের স্নিগ্ধ ফুল। চারদিকে নানান ধরনের পাখি ডাকছে। পাখির বিষয়ে আমার তেমন আগ্রহ নেই। সব পাখি চিনিও না। তাদের কিচিরমিচিরে ভোরবেলা জেগে উঠতে হয়। কাঁচা ঘুম ভাঙানোয় এদের ওপর খানিকটা রাগও করি। দুইটা কাঠঠোকরা পাখি আমাকে ভোরবেলায় অস্থির করে তোলে। এরা কাঠের ইলেকট্রিক পোলে গর্ত করে বাসা বানিয়েছে। সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে এরা বাসা থেকে বের হয়। আমি যে ঘরে ঘুমাই তার কাঁচের জানালায় ঠোকর দেয়। মনে হয় জানালা ফুটো করতে চায় কিংবা আয়নায় নিজেকে দেখতে চায়। আরেকটি সম্ভাবনা আছে_হয়তো এদের ঠোঁট কুট কুট করে। প্রচণ্ড শক্তিতে গ্লাসে ধাক্কা দিলে ঠোঁটে আরাম হয়।
পাখি দুইটির বজ্জাতির গল্প হ্যারল্ড রশীদের সঙ্গে করলাম। তিনি বললেন_আচ্ছা, আপনার নুহাশ পল্লীতে এত পাখি, আপনি কি কখনো এখানে মৃত পাখি দেখেছেন?
আমি বললাম_পাখির বাসা থেকে পড়ে মরে গেছে এমন দেখেছি।
পূর্ণবয়স্ক মৃত পাখি?
আমি বললাম_না।
পূর্ণবয়স্ক মৃত পাখি যে কোথাও দেখা যায় না এই বিষয়টা আমি জানি। অনেক বছর আগে ঞরসব বা জবধফবৎং উরমবংঃ পত্রিকায় একটা লেখা পড়েছিলাম_'ডযবৎব ঃযব ফবধফ নরৎফং মড়?' সেখানেও মৃত পাখির বিষয়টাকে রহস্য বলা হয়েছে।
হ্যারল্ড রশীদ দাড়িতে হাত বুলাতে বুলাতে বললেন_মৃত পাখিদের জি্বন খেয়ে ফেলে, তাই আমরা মৃত পাখি দেখি না।
_বলেন কি!
জি্বনের খাবার হলো হাড়। পাখির হাড় তারা খেয়ে ফেলে।
হ্যারল্ড রশীদের কথা গসপেল মনে করার কোনো কারণ নেই। আমি সঙ্গে সঙ্গে সাদাত সেলিম সাহেবকে টেলিফোন করলাম। উনি একজন পক্ষীবিশারদ। বর্তমানে ঢাকা ক্লাবের প্রেসিডেন্ট। টেলিফোনে সহজে তাঁকে পাওয়া যায় না। আমার ভাগ্য ভালো, সঙ্গে সঙ্গে পেয়ে গেলাম। আমি বললাম_বিশাল নুহাশ পল্লীকে পক্ষীর অভয়াশ্রম বলা যায়। আমি কেন এখানে মৃত পাখি দেখি না?
সাদাত সেলিম যে জবাব দিলেন তা হ্যারল্ড রশীদের জবাবের চেয়েও অদ্ভুত। তিনি বললেন, পাখিদের একটা সিক্সথ সেন্স আছে। এরা কখন মারা যাবে তা বুঝতে পারে। বুঝতে পারামাত্র দলবল ছেড়ে গহীন অরণ্যের দিকে যাত্রা করে। লোকচক্ষুর অন্তরালে গহীন অরণ্যে তাদের মৃত্যু হয় বলেই আমরা লোকালয়ে মৃত পাখি দেখি না।
পক্ষী বিষয়ে সাদাত সেলিমের চেয়েও অনেক অদ্ভুত কথা একজন বলে গেছেন, তাঁর নাম বাবর। তিনি মোগল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা। বাবর তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ 'বাবরনামা'য় লিখেছেন, তাঁর সংগ্রহে একটি তোতা পাখি ছিল। তোতা পাখি কথা বলত, যা শুনত তা-ই বলত। তবে এই পাখির রক্ষক একদিন সম্রাটকে বলল, পাখিটা যে সব কথা শুনে শুনে বলে তা নয়, সে নিজ থেকেও কথা বলতে পারে। একদিন পাখিটা বলল, আমার নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। ঢাকনাটা খুলে দাও।
আরেক দিনের কথা, সম্রাট দলবল নিয়ে যুদ্ধযাত্রা করেছেন। সঙ্গে তোতা পাখিও আছে। পথে এক জায়গায় তোতা পাখির রক্ষক ক্লান্ত হয়ে অপেক্ষা করছে। সবাই চলে গেছে। তখন পাখিটা বলল, সবাই চলে গেছে, আমরা বসে আছি কেন? আমরা কেন যাচ্ছি না?
সম্রাট বাবর তাঁর জীবনীতে গালগল্প ফাঁদবেন বলে মনে হয় না। তিনি সেই সময়কার হিন্দুস্তানের নিখুঁত বর্ণনা তাঁর গ্রন্থে দিয়ে গেছেন। পাখির যে রক্ষক সম্রাটকে এই কথা বলেছে তার নাম আবুল কাসিম জালায়ের। সম্রাট লিখেছেন_এ আমর অত্যন্ত বিশ্বস্ত।
নানান ধরনের পাখি সম্পর্কে বাবর লিখে গেছেন। তার কয়েকটা উদাহরণ_

লুজা
মাথা থেকে লেজ পর্যন্ত এর গায়ে কয়েক রকমের রং। গলায় কবুতরের গলার মতো চকচকে রং আছে। এ পাখি পর্বতের চূড়ায় বাস করে।

ফিং
বিশাল পাখি। এদের এক একটি ডানা লম্বায় মানুষ সমান। এর মাথা ও গলায় কোনো লোম নেই। এর গলায় থলের মতো একটা কিছু ঝোলে। এর পিঠ কালো, বুক সাদা। এ পাখি মাঝেমধ্যেই কাবুলে দেখা যায়। একবার আমাকে একটা ফিং পাখি ধরে এনে দিল। পাখিটা পোষ মানল।

কোকিল
দৈর্ঘ্যে কাকের সমান, কিন্তু দেহ কাকের চেয়ে সরু। গান গায়। হিন্দুস্তানের বুলবুল। আমরা যেমন বুলবুল ভালোবাসি হিন্দুস্তানের লোকেরা তেমনি কোকিল ভালোবাসে। ঘন গাছের বাগানে থাকে।
অদ্ভুত আরেক পাখির কথা আমি দাদাজানের কাছে শুনেছি। তিনি এই পাখির নাম বলেছেন 'মউত পাখি'। যখন কোনো বাড়িতে কারো মৃত্যু ঘনিয়ে আসে তখন এই পাখি নাকি নিশিরাতে বাড়ির চালে এসে বসে অদ্ভুত গলায় ডাকতে থাকে। আমার সবচেয়ে ছোট ফুফুর মৃত্যুর দুই রাত আগে নাকি এমন একটা পাখি দাদাজানের বাড়ির টিনের চালে এসে বসে ডাকতে শুরু করে। আমার এই ফুফুর নাম মাহমুদা। মাত্র ১৩ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু হয়। আমার মা সব সময় বলেন, এমন রূপবতী কিশোরী তিনি তাঁর জীবনে দেখেননি।
পক্ষীবিশারদ সাদাত সেলিমের মতে, পাখি নিজের মৃত্যুর অগ্রিম খবর পায়। এই ক্ষেত্রে অন্য প্রাণীদের মৃত্যুর খবরও তাদের কাছে থাকার কথা।
পক্ষী প্রসঙ্গে এখানেই ইতি। এখন চলে যাই অন্য প্রসঙ্গে। অমাবস্যার রাত। আকাশভর্তি তারা। হ্যারল্ড রশীদ তাঁর টেলিস্কোপ তারাদের দিকে তাক করেছেন।
আমরা প্রথম দেখলাম লুব্ধক নক্ষত্র। আকাশের উজ্জ্বলতম তারা। ইংরেজি নাম সিরিয়াস। অতি প্রাচীন এক সভ্যতার নাম মায়া সভ্যতা। মায়ারা বলত তারা এসেছে লুব্ধক নক্ষত্রের পাশের একটি নক্ষত্র থেকে। লুব্ধক নক্ষত্রের পাশে কোনো নক্ষত্র এত দিন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। এখন জ্যোতির্বিদরা একটি নক্ষত্র আবিষ্কার করেছেন।
লুব্ধকের পরে আমরা দেখলাম একটা সুপার নোভা। তারপর দেখা হলো সপ্ত ভগিনী তারা গুচ্ছ (ঝবাবহ ংরংঃবৎং)। বৃহস্পতি ডুবে গিয়েছিল বলে বৃহস্পতি বা তার চাঁদ দেখা গেল না। শনিগ্রহের অবস্থান বের করতে হয় বৃহস্পতি গ্রহ থেকে। যেহেতু বৃহস্পতি নেই আমরা শনি দেখতে পারলাম না, তবে ঘড়ৎঃয ংঃধৎ খুব খুঁটিয়ে দেখলাম।
নর্থ স্টারের বাংলা নাম ধ্রুব তারা। রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত গান আছে_'তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুব তারা।' সূর্য পূর্ব দিকে ওঠে পশ্চিমে অস্ত যায়। আকাশের সব তারা পশ্চিম দিকে ওঠে পূর্ব দিকে অস্ত যায়। একমাত্র ব্যতিক্রম নর্থ স্টার বা ধ্রুব তারা। এই তারা আকাশে স্থির হয়ে থাকে। নাবিকরা এই তারা দেখে দিক ঠিক করেন। আমাদের দেশের নৌকার মাঝিরাও এই তারা খুব ভালো করে চেনে।
তারা দেখা চলছে, হঠাৎ আমাদের আসরে চকচকে কালো রঙের এক কুকুর উপস্থিত হলো। হ্যারল্ড রশীদ বললেন, হুমায়ূন ভাই, এই কুকুরটা জি্বন।
আমি বললাম, আপনার সমস্যা কী বলুন তো। সকালে বলেছেন মরা পাখি সব জি্বন খেয়ে ফেলে। এখন বলছেন, কালো কুকুর জি্বন।
হ্যারল্ড রশীদ বললেন, আমি বই পড়ে বলছি।
_কী বই?
বইয়ের নাম 'জি্বন জাতির অদ্ভুত ইতিহাস'।
কে লিখেছেন? প্রকাশক কে?
এসব মনে নেই।
বইটা কি আছে আপনার কাছে?
না।
আমি ঢাকায় ফিরে এসেই নুহাশ চলচ্চিত্রের এক কর্মকর্তাকে বাংলাবাজারে পাঠালাম, সে যেভাবেই হোক 'জি্বন জাতির অদ্ভুত ইতিহাস' গ্রন্থ জোগাড় করবে।
দুপুরবেলা সে জানাল, পাঁচটা ইতিহাস সে পেয়েছে। সব কিনবে কি না।
আমি বললাম, সব কিনবে।
সে বিকেলে পাঁচটা বই নিয়ে উপস্থিত হলো। আমি দেখলাম প্রতিটি বই হলো চীন জাতির ইতিহাস। সে চীনের ইতিহাসের সব বই কিনে নিয়ে চলে এসেছে।
যাই হোক, শেষ পর্যন্ত 'জি্বন জাতির বিস্ময়কর ইতিহাস' বইটি পাওয়া গেছে। মূল বই আরবি ভাষায়। লেখক আল্লামা জালালুদ্দিন সুয়তী (রহ.), অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ হাদীউজ্জামান। আরেকটি বই পাওয়া গেছে 'জি্বন ও শয়তানের ইতিকথা'। এটিও আল্লামা জালালুদ্দিন সুয়তী (রহ.)-এর লেখা। বই দুইটি পড়ে জি্বন জাতি সম্পর্কে যা জেনেছি তার সারমর্ম_

জি্বন শব্দের অর্থ
গুপ্ত, অদৃশ্য, লুকানো, আবৃত।

জি্বন জাতির শ্রেণী বিভাগ
ক. সাধারণ জি্বন।
খ. আমির : মানুষের সঙ্গে থাকে।
গ. আরওয়াহ : মানুষের সামনে আসে।
ঘ. শয়তান।
ঙ. ইফরীব্ব (শয়তানের চেয়েও বিপজ্জনক। এদের দেখা পেলে আযান দিতে হবে)।

জি্বন কিসের তৈরি?
পবিত্র কোরান শরীফে বলা হয়েছে, "আমি আদমের আগে, জি্বনকে সৃষ্টি করেছি 'লু'-র আগুন দিয়ে।" (সুরাহ আল হিজর, আয়াত ২৭)
হজরত ইবনে আব্বাস (র.) এই আয়াতের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন 'লু'-র আগুনের অর্থ খুবই সুন্দর আগুন। হজরত উমার বিন দীনার (র.) বলেছেন, জি্বন জাতি সৃষ্টি করা হয়েছে সূর্যের আগুন থেকে।

জি্বনদের প্রকারভেদ
তিন শ্রেণীর জি্বন আছে।
১. এরা হাওয়ায় উড়ে বেড়ায়। খাদ্য গ্রহণ করে না, নিজেদের মধ্যে বিয়ে হয় না। সন্তান উৎপাদন করে না।
২. এরা মানুষের সংস্পর্শে আসে, খাদ্য গ্রহণ করে। বিয়ে করে। সন্তান উৎপাদন করে।
৩. সাদা রঙের সাপ এবং সম্পূর্ণ কালো কুকুরও জি্বন।

জি্বনদের খাদ্য
নবীজি (স.) বলেছেন, তোমাদের খাদ্য এমন সব হাড় যার প্রতি আল্লাহর নাম নেওয়া হয়েছে, তাই জি্বনের খাদ্য। (তিরমিযী)
(আমরা শুনি জি্বনরা মিষ্টি খেতে পছন্দ করে। তার কোনো উল্লেখ পাইনি।)

জি্বনদের সঙ্গে মানুষের বিয়ে
এই নিয়ে আলেমদের মতভেদ আছে। একদল বলেছেন জি্বন যেহেতু সম্পূর্ণ অন্য প্রজাতির কাজেই তাদের সঙ্গে মানুষের বিয়ে অবৈধ।
আলেমদের আরেক দল বলছেন, পবিত্র কোরান শরীফে আল্লাহ শয়তানকে বলেছেন, 'তুই মানুষের সম্পদে ও সন্তানে শীরক হয়ে যা।' (সুরা বনি ইসরাইল, আয়াত ৬৪)
সন্তানে শারীক হতে হলে বিবাহ বাঞ্ছনীয়। কাজেই জি্বনের সঙ্গে মানুষের বিয়ে হতে পারে।
মানুষ এবং জি্বনের যৌনক্রিয়ায় যেসব সন্তান জন্মায় তারাই হিজড়া। {হজরত ইবনে আব্বাস (রা.)} এদের আরবি নাম খুন্নাস।

পাদটীকা
নিউজিল্যান্ডের এক বাড়িতে দুইটা ভূত ধরে বোতলবন্দি করা হয়েছে। একটি অল্প বয়সী দুষ্টু ভূত। অন্যটি শান্ত-ভদ্র ভূত। দুইটি ভূতই ইন্টারনেটের মাধ্যমে নিলামে তুলে বিক্রি করা হয়েছে।

৮.
বন্দুক-মানব

গানম্যানের বাংলা করলাম 'বন্দুক-মানব'। ঘন বাংলা হয়নি, পাতলা বাংলা হয়েছে। 'গানম্যানে' যে কঠিন ভাব আছে, 'বন্দুক-মানবে' তা নেই। এখানে মানব শব্দটাই প্রাধান্য পেয়েছে। বন্দুক হয়েছে গৌণ। বাংলা ভাষার এ এক মজার খেলা।
অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি যেমন, মন্ত্রী-মিনিস্টার, দেশের প্রধান, রাজনৈতিক নেতাদের সরকার গানম্যান দেয়। গানম্যানরা শাদা পোশাকে থাকে। তাদের পকেটে থাকে আধুনিক মারণাস্ত্র।
বিজ্ঞাপনে দেখি লাইফবয় সাবান জীবাণু থেকে সুরক্ষা দেয়। গানম্যানরাও গুরুত্বপূর্ণ মানুষদের সুরক্ষা দেয়।
এক সকালের কথা। থাকি 'দখিন হাওয়া'র ফ্ল্যাটে। সম্পূর্ণ একা। একজন বাবুর্চি ছিল, সে রাত একটা-দুটায় আমি ডিনার খাই দেখে কাউকে কিছু না বলে (এবং তার পাওনা বেতন না নিয়ে) চলে গেছে। আমি হাতমুখ ধুয়ে এক কাপ চা বানিয়ে পত্রিকা নিয়ে বসেছি, তখন ঘরে সুশ্রী চেহারার এক যুবক ঢুকল। তার গায়ের শার্ট দামি, প্যান্ট দামি, জুতো জোড়াও চকচক করছে। তার গা থেকে সেন্টের গন্ধ আসছে। আমি বললাম_কী ব্যাপার?
যুবক বলল, স্যার, আমি গানম্যান।
গানম্যান খুব ভালো কথা। আমার কাছে কী?
স্যার, আমি আপনার গানম্যান।
পানি খেতে গিয়ে লোকে বিষম খায়, আমি চায়ে চুমুক দিয়ে বিষম খেলাম। চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে বললাম, কোথাও কোনো ভুল হয়েছে। আমার কোনো গানম্যান নেই। থাকার কথাও না।
কোনো ভুল হয় নাই স্যার। এই যে আমার পরিচয়পত্র। পুলিশ হেডকোয়ার্টার থেকে আপনাকে একটা চিঠিও দেওয়া হয়েছে। এই যে চিঠি।
চিঠি পড়ে দেখি ঘটনা সত্যি। সরকার আমার জন্য গানম্যানের ব্যবস্থা করেছে। গানম্যান সার্বক্ষণিকভাবে আমার সঙ্গে থাকবে। আমাকে সুরক্ষা দেবে। আমি বললাম_হলি কাউ!
গানম্যান বলল, কী বললেন বুঝতে পারলাম না।
আমি বললাম, বুঝতে হবে না। ঘরে সিগারেট নেই বলে সিগারেট খেতে পারছি না। তুমি এক প্যাকেট সিগারেট কিনে আনতে পারবে?
অবশ্যই পারব স্যার।
গানম্যান সিগারেট কিনতে গেল, আমি পরিস্থিতি নিয়ে ভাবতে বসলাম। গানম্যান নিয়ে ঘোরার মধ্যে আত্দশ্লাঘার বিষয় আছে। নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ ভাবা এবং অন্যের কাছে গুরুত্বপূর্ণ করা। এই পরিস্থিতিতে আমি কী করব বুঝতে পারছি না। গানম্যানের আনা সিগারেট টেনেও মাথা পরিষ্কার হলো না। আমি পুলিশ হেডকোয়ার্টারের সঙ্গে যোগাযোগ করে বিনয়ের সঙ্গে বললাম, আমি একজন লেখক মানুষ। লেখক ঘুরবে ঝোলা নিয়ে, ঝোলায় থাকবে কাগজ-কলম। লেখক কখনো গানম্যান নিয়ে ঘুরবে না। আপনি গানম্যান উঠিয়ে নিন।
কয়েক দিন থাকুক। তারপর আপনার কথামতো উঠিয়ে নেব।
কয়েক দিন শুনে রাজি হলাম, সেই কয়েক দিন তিন বছর পর্যন্ত গড়াল। যা-ই হোক, প্রথম দিনের কথা বলি। দুপুর তিনটার দিকে গানম্যান বলল, স্যার, দুপুরে খাওয়ার ব্যবস্থা কী?
খাওয়ার কোনো ব্যবস্থা নাই। পাশের ফ্ল্যাট থেকে খাবার আসে। আজ মনে হয় ভুলে গেছে। মাঝেমধ্যে তারা খাবার পাঠাতে ভুলে যায়।
আমরা দুপুরে খাব না?
তেহারির দোকান থেকে দুই প্যাকেট তেহারি নিয়ে আসো।
আপনার কি গাড়ি আছে?
গাড়ি আছে। ড্রাইভার নাই। রিকশা করে চলে যাও।
গানম্যান চিন্তিত ভঙ্গিতে তেহারি আনতে বের হলো।
সন্ধ্যার কথা। বন্ধুবান্ধব আসবে। ওল্ড ফুলস ক্লাবে আড্ডা বসবে। আমার বসার ঘরের দরজা সব সময় খোলা থাকে। হিমু তার ঘরের দরজা খোলা রাখে, আমি হিমুর বাবা। আমারও ঘরের দরজা খোলা রাখা উচিত।
আজ দরজা বন্ধ। দরজার পাশে চেয়ার নিয়ে গানম্যান বসে আছে। তার চোখমুখ কঠিন।
দরজার বেল বাজল। গানম্যান দরজা খুলে বলল, হাত উপরে তুলুন, বডি চেক। ভয় পাবেন না। রুটিন চেক। হুমায়ূন স্যারের সিকিউরিটির বিষয়।
আমার কাছে এসেছে ছেলেবেলার বন্ধু ডাক্তার করিম (অ্যাটমিক এনার্জি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান)। সে হাত তুলল। বডি চেক করা হলো। গানম্যান বলল, আপনার ব্যাগে কী? ব্যাগ খুলুন, ব্যাগে কী আছে দেখব।
করিম ভয়ে ভয়ে বলল, আপনি কে?
আমি হুমায়ূন স্যারের গানম্যান। এখন বলুন, আপনি কে, কোত্থেকে এসেছেন, কেন এসেছেন?
করিম বলল, আমি পাঁচতলায় এসেছিলাম আলমগীর রহমানের কাছে। ভুলে ছয়তলায় চলে এসেছি। হুমায়ূন আহমেদকে আমি সেভাবে চিনি না।
একটা চৈনিক প্রবাদ আছে_'হাঁচি, কাশি এবং প্রেম কারো কাছ থেকে লুকানো যায় না।' আমি এই তিনটির সঙ্গে আরেকটি যুক্ত করেছি_'হাঁচি, কাশি, প্রেম এবং গানম্যান কারো কাছ থেকে লুকানো যায় না।' কিছুদিনের মধ্যে সবাই জেনে গেল আমার সঙ্গে একজন দুর্ধর্ষ গানম্যান আছে। বন্ধুবান্ধবদের বাসায় আসা আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেল।
দশ দিনের মাথায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এল। আমি গানম্যানকে বললাম, আমার দরজা সব সময় খোলা থাকবে, কাউকে চেক করা যাবে না। অতিথিদের নাম-ঠিকানা লেখা যাবে না। আমি যখন বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেব তখন সামনে দিয়ে হাঁটাহাঁটি করা যাবে না।
গানম্যান নতুন রুটিনে দ্রুত অভ্যস্ত হয়ে গেল। সে আমার পাশে একটা ঘরে ঘুমায়, সকালে ঘুম থেকে উঠে নাশতা খেয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুম থেকে উঠে গোসল সেরে দুপুরের খাবার খেয়ে আবার ঘুম। ঘুম ভাঙার পর সে আমার লেখা গল্প-উপন্যাসের বই হাতে নিয়ে চোখমুখ শক্ত করে পড়ে। যেন পরীক্ষার পড়া মুখস্থ করছে। সাহিত্য নিয়ে মাঝেমধ্যে কিছু আলোচনাও হয়। যেমন_'স্যারের এই বইটা তেমন ভালো হয় নাই। এন্ডিংয়ে ঝামেলা আছে।'
আমাদের দুজনের জীবনচর্যায় মিল পাওয়া গেল। সে তার ঘরে একা থাকে, আমিও আমার ঘরে একা থাকি। সে সারা দিন ঘুমায়, আমি সারা দিন লিখি। সন্ধ্যার পর থেকে সে বই পড়ে, আমিও বই পড়ি। গভীর রাত পর্যন্ত সে হিন্দি সিরিয়াল দেখে। গভীর রাত পর্যন্ত আমিও ভিসিআরে সিনেমা দেখি।
গানম্যানের নিঃসঙ্গতা কাটল, আমার একজন বাবুর্চি জোগাড় হলো। গানম্যান বাজার করে আনে, দুজনে মিলে কোটাবাছা করে। রান্না চাপায়। একদিন মজার এক দৃশ্য দেখলাম, রান্নাঘরে গানম্যান লেপটা দিয়ে বসে কচুর লতি বাছছে। পাশেই লোডেড পিস্তল।
কোরবানির ঈদে সে ছুটি নিয়ে দেশে গেল না। আমাকে একা ফেলে যাবে না। ঈদের দিন আমাকে কে দেখবে? আমি কোরবানি দেব না শুনে সে মুষড়ে পড়ল। আমি বললাম, মাংস কাটা, রান্না করা, এসব কে করবে? ঘরে কেউ নাই। বাবুর্চি ছুটি নিয়ে চলে গেছে।
স্যার, আমি তো আছি। টাকা দিন, খাসি কিনে নিয়ে আসি। আরেকটা কথা, আপনার অনুমতি ছাড়াই পাশের বাসার মাজহার স্যারের গরুতে একটা নাম দিয়ে দিয়েছি।
তাকে নিয়ে ঈদের নামাজ পড়তে গিয়ে আরেক যন্ত্রণা। সিজদায় গিয়েছি, টুপ করে শব্দ হলো। তাকিয়ে দেখি পকেট থেকে গানম্যানের পিস্তল জায়নামাজে পড়ে গেছে। মুসলি্লরা তাকিয়ে আছেন আতঙ্কিত চোখে।
গানম্যানদের প্রতিমাসেই গাজীপুরে পিস্তল শুটিংয়ের পরীক্ষা হয়। একবার পরীক্ষা দিয়ে আমার গানম্যান খুব মন খারাপ করে ফিরল।
আমি বললাম, কী হয়েছে?
সে বলল, পরীক্ষা খারাপ হয়েছে। হাতের টিপ নষ্ট হয়ে গেছে।
কচুর লতি বাছলে হাতের টিপ তো নষ্ট হবেই।
তার পরও স্যার অসুবিধা নাই। আপনার ওপর কোনো হামলা হলে পঁচিশ গজের ভেতর যে আসবে তারেই শুট করে ফেলে দেব। একটা হামলা হোক, দেখেন স্যার কী করি?
গানম্যান হামলার আশায় দিন কাটাতে লাগল। সন্ত্রাসী হামলা হলো না, তবে অন্য ধরনের হামলায় জীবনসংশয় হলো। এই হামলার নাম হার্ট অ্যাটাক। ল্যাবএইড হাসপাতালে ভর্তি হলাম। আমাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে, গানম্যান সঙ্গে যাবে। ডাক্তার বললেন, অসম্ভব! আপনি যেতে পারবেন না।
গানম্যান বলল, অবশ্যই আমাকে যেতে হবে। ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে যদি স্যারের ওপর হামলা হয় কে সামলাবে? আপনারা সামলাবেন? জবাবদিহি তো আপনাদের করতে হবে না। আমাকে করতে হবে।
আমাকে সিডেটিভ দেওয়া হয়েছিল। গানম্যান এবং ডাক্তারদের তর্কবিতর্ক শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুম ভাঙল অনেক রাতে। চোখ মেলে দেখি, আমি পর্দাঘেরা ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে আছি। আমার পাশে গানম্যান দাঁড়িয়ে। তার চোখ মমতায় আর্দ্র। সে বলল, স্যার আমি আছি। কোনো রকম দুশ্চিন্তা করবেন না। কেউ এসে হামলা করুক দেখেন কী করি?
তার মমতাভেজা কণ্ঠ বলে দিল সে গানম্যান না, বন্দুক-মানব।
পাদটীকা
জমিকে লালাউ গুল জিনহে খেয়াল নেহি
ও লোগ চান্দসিতারোঁ কি বাৎ করতে হ্যায়।
খয়াল কানপুরী

পৃথিবীর বুকের ফুলফল লতাগুল্মে যার চোখ নেই, সে-ই শুধু আকাশের চন্দ্র এবং নক্ষত্রের গল্প করে।
১৩টি মন্তব্য ৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করা সকলের দায়িত্ব।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৩৮



এগুলো আমার একান্ত মতামত। এই ব্লগ কাউকে ছোট করার জন্য লেখি নাই। শুধু আমার মনে জমে থাকা দুঃখ প্রকাশ করলাম। এতে আপনারা কষ্ট পেয়ে থাকলে আমি দায়ী না। এখনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

তাবলীগ এর ভয়ে ফরজ নামাজ পড়ে দৌড় দিয়েছেন কখনো?

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:২৬


আমাদের দেশের অনেক মসজিদে তাবলীগ এর ভাইরা দ্বীন ইসলামের দাওয়াত দিয়ে থাকেন। তাবলীগ এর সাদামাটাভাবে জীবনযাপন খারাপ কিছু মনে হয়না। জামাত শেষ হলে তাদের একজন দাঁড়িয়ে বলেন - °নামাজের... ...বাকিটুকু পড়ুন

ফেতনার সময় জামায়াত বদ্ধ ইসলামী আন্দোলন ফরজ নয়

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ১১:৫৮



সূরাঃ ৩ আলে-ইমরান, ১০৩ নং আয়াতের অনুবাদ-
১০৩। তোমরা একত্রে আল্লাহর রজ্জু দৃঢ়ভাবে ধর! আর বিচ্ছিন্ন হবে না। তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ স্মরণ কর।যখন তোমরা শত্রু ছিলে তখন তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

=নীল আকাশের প্রান্ত ছুঁয়ে-৭ (আকাশ ভালোবেসে)=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৬ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:১৯

০১।



=আকাশের মন খারাপ আজ, অথচ ফুলেরা হাসে=
আকাশের মন খারাপ, মেঘ কাজল চোখ তার,
কেঁদে দিলেই লেপ্টে যাবে চোখের কাজল,
আকাশের বুকে বিষাদের ছাউনি,
ধ্বস নামলেই ডুবে যাবে মাটি!
================================================
অনেক দিন পর আকাশের ছবি নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

পানি জলে ধর্ম দ্বন্দ

লিখেছেন প্রামানিক, ০৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৫২


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

জল পানিতে দ্বন্দ লেগে
ভাগ হলোরে বঙ্গ দেশ
এপার ওপার দুই পারেতে
বাঙালিদের জীবন শেষ।

পানি বললে জাত থাকে না
ঈমান থাকে না জলে
এইটা নিয়েই দুই বাংলাতে
রেষারেষি চলে।

জল বললে কয় নাউযুবিল্লাহ
পানি বললে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×