গত বছর এই সময়...
রাতে ঘুমিয়েছিলাম দেরি করে। রাতে ঘুম ভাঙায় তাই খুব বিরক্ত লাগছিল। পাশের রুমে ভাইয়া আর মা কথা বলছিল। প্রথমে ভেবেছিলাম, ফজর আজ বুঝি তাড়াতাড়িই হল। ঘড়িতে দেখি তখন তিনটা বাজে। এত রাতে কিসের কথা... কান খাড়া করতেই শুনতে পেলাম খবরটা... ছোট চাচা মারা গেছেন।
ছোট চাচা মারা গেছেন! অবশেষে! অবশেষে বলাটা কি ঠিক হচ্ছে? মৃত মানুষ সম্পর্কে ওভাবে বলা কি ঠিক? এও তো সত্যি, গত সুদীর্ঘ পনের বছর তাঁর জীবনটা খুব অর্থবহ মনে হয় নি। কোমরের নিচ থেকে অবশ ছিল চাচার শরীর। স্নায়বিক জটিলতা। খুব ছোটবেলায় মনে আছে, চাচা পুরো পরিবার সহ আসতেন বাসায়। আমাদের বাসা থেকে পিজিতে দেঁৗড়াদেঁৗড়ি চলত। তখনের কথা বেশি কিছু মনে নেই, শুধু মনে আছে তানিয়া আপুর কাছ থেকে লবণ মরিচ দিয়ে পেয়ারা খাওয়া শিখেছিলাম। আর ছোট ফয়সালটা ভীষণ কান্না করত চাচীকে জড়িয়ে ধরে, 'আম্মা, ঠ্যাঙে উঠমু...'
আরেকটু বড় হয়ে দেখেছি চাচা মাঝে মধ্যে বাবার সাথে ঢাকায় আসতেন। ঠুক ঠুক করে লাঠিতে ভর দিয়ে হাঁটতেন। আমি ভাবতাম বুড়ো হয়ে গিয়েছে।
স্নায়ুবিক জটিলতাটুকু জটিল প্রকারের ছিল। পুরোটা বুঝি নি কখনও, শুধু বুঝেছি শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে থাকা চাচার স্নায়ুগুলো শুকিয়ে যাচ্ছিল খুব দ্রুত। প্রথম বিসর্জন ছিল পা দু'টো। তারপরে শরীরের অন্যান্য অংগ প্রত্যংগ। শেষ এক বছর কথাও বলতে পারতেন না। নির্বাক কিন্তু জ্বলজ্বলে চোখে তাকিয়ে থাকতেন কেবল।
চাচার মৃত্যু সংবাদ শুনে সে রাত আর ঘুমাতে পারি নি... পনেরটা বছর ধুঁকে ধুকে অবশেষে মারা গেলেন? কারও কি খুশি হওয়া উচিৎ? অন্তত স্বস্তির নি:শ্বাস ফেলা কি উচিৎ?
ধাধাঁময় লেগেছে আমার... চাচী কিশোরী বয়স থেকেই চাচার সংসারে। দীর্ঘ পনের বছর ধরে চাচার সেবা করে গেলেন, নিজের সবটুকু দিয়ে। বিনিময়ে একটুকু না পেয়ে। তবু, চার মাস পরে যখন তাকে নতুন করে জীবন শুরু করার জন্য আবার বিয়ের কথা বলা হল, তখন তিনি কাঁদতে কাঁদতে অজ্ঞান হয়ে গেলেন। খুব অবাক হয়েছি আমি, বৃক্ষ তো এখানে চাচীর হওয়ার কথা ছিল, চাচীকে ছাড়া কি বাঁচতেন চাচা? তবু লতাগুল্ম সরিয়ে নেয়ার পরে চাচী এভাবে ভেঙে পড়লেন কেন? এটা কি ভালবাসা না স্রেফ অভ্যস্ততা? ভালবাসা কারে কয়?
বাবাকে দেখেও প্রশ্ন জেগেছে একই। মানুষটা জীবনে অনেক কষ্ট করেছেন। স্বচ্ছল, নিরাপদ অবস্থায় আদর্শের কথা বলা যায়, সততার কথা বলা যায়। মাত্র দশ বছর বয়সে বাবা হারিয়ে যাকে জীবন সংগ্রাম শুরু করতে হয়েছে অপরিচিতের বাসায় লজিং থেকে, সেই মানুষটাকে সত্যিকারের জীবন পরীক্ষা দিতে হয়েছে অনেক, আমি জানি। তাই হয়তো কখনও কাঁদতে দেখিনি বাবাকে। কষ্টগুলো পাথরের বাঁধ দিয়ে বেঁধে রাখা শিখেছেন বলেই হয়তো। জেনে শুনে কাউকে কষ্ট দিতে দেখি নি। কষ্ট পাওয়া কাকে বলে জানেন বলেই হয়তো। কখনও বকা দিতে দেখিনি বাবাকে। তীব্র উপলব্ধি থেকে উঠে আসা কথাগুলো সততার সাথে বলেন। জীবন থেকে শিখে নিজেকে শুধরে নিয়েছেন বলেই হয়তো।
চাচার মৃত্যুর পরের দিন সারাদিন বাবা চুপচাপ ছিল। খুব কম কথা বলছিলেন। খাওয়ার সময় হঠাৎই খুব কথা বলা শুরু করলেন। ছোট বেলার গল্প। চাচা আর বাবা, দাদা ভাই বেঁচে থাকার দিনগুলোতে যখন একসাথে থাকতেন তখন কি করতেন সেই সব গল্প। আর দশটা সাধারণ শিশুর মত নিষ্পাপ দুষ্টোমিতে ভরা শৈশবের গল্প। দু'জনে ষড়যন্ত্র করে ছোট ফুপিকে খেপিয়ে তুলতেন। দাদা ভাইয়ের অনুপস্থিতিতে হুক্কায় টান দিয়ে সে কি কাশি! বিকেল বেলা ঘুড়ি উড়াতে যেতেন। দু'জনের দু'টো গরু ছিল। প্রতিযোগিতা করে গরুগুলোর যত্ন চলতো...
ঠিক ওই পর্যায়ে আমি কখনও বাবাকে যেভাবে কাঁদতে দেখিনি ওভাবে কাঁদতে দেখলাম...
এক সাথে এক ভাবে শুরু হওয়া দু'জনের জীবন কি নির্মম সয়ংক্রিয়তায় দুই পথে চলে গেল...
আমার কেবলই মনে হচ্ছিল... ভালবাসা কারে কয়? কষ্ট কাকে বলে? জীবনকে অর্থবহ হতে হলে কি করতে হয়?
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে ডিসেম্বর, ১৯৬৯ সন্ধ্যা ৭:০০