somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বর্ণহীন কষ্টেরা...

০৭ ই আগস্ট, ২০০৬ রাত ১২:১৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ছোট চাচাকে শেষ দেখেছিলাম 2001 এর কোরবানীর ঈদের সময়। শীর্ণ শরীর বিছানার সাথে লেপ্টে ছিল। হাড়ে চামড়ায় একাকার। সাদা ধবধবে ঢিলাঢিলা পাঞ্জাবীর ভিতরে আরও ছোট লাগছিল চাচাকে। চোখগুলো অস্বাভাবিক রকমের উজ্জ্বল। ওই চোখগুলো, একদম বাবার মত চোখগুলো। চেহারার আরও কিছু কিছু দিক একদম বাবার মত। বাবার চেয়ে দু'বছরের বড় হওয়া সত্ত্বেও চুল দাড়ি সব একদম কাল কুচকুচে। চোখের দিকে তাকালেই বোঝা যায় কেমন অস্থিরতায় ভুগছেন মানুষটা। কেমন একটা অব্যক্ত আকুতি চোখগুলোতে। তীব্র যন্ত্রনাময়। তাকিয়ে থাকা যায় না... সেবার ঈদের দিন সকালে চাচার শুকনো শীতল হাতগুলো ধরে বসেছিলাম। পাঁজরের হাড় গুনতে গুনতে বুকে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলাম। চাচা নির্লিপ্ত চোখে ছাদের কড়িকাঠ গুণছিলেন। হঠাৎই দেখলাম জ্বলজ্বলে চোখের কোণ বেয়ে চিকচিকে পানির ধারা। সে কি অসহ্য অসহায়ত্ব... আর পারি নি। ছুটে গিয়েছিলাম বাড়ির পাশের শান্ত ঝিলটার তীরে। পানির আয়নার নিজেকে দেখতে থাকা বাঁশ ঝাড়ে একান্ত নিজের জায়গাটায় গিয়ে বসেছিলাম গুমড়ে ওঠা ঝড়টুকু থামাতে।

গত বছর এই সময়...
রাতে ঘুমিয়েছিলাম দেরি করে। রাতে ঘুম ভাঙায় তাই খুব বিরক্ত লাগছিল। পাশের রুমে ভাইয়া আর মা কথা বলছিল। প্রথমে ভেবেছিলাম, ফজর আজ বুঝি তাড়াতাড়িই হল। ঘড়িতে দেখি তখন তিনটা বাজে। এত রাতে কিসের কথা... কান খাড়া করতেই শুনতে পেলাম খবরটা... ছোট চাচা মারা গেছেন।

ছোট চাচা মারা গেছেন! অবশেষে! অবশেষে বলাটা কি ঠিক হচ্ছে? মৃত মানুষ সম্পর্কে ওভাবে বলা কি ঠিক? এও তো সত্যি, গত সুদীর্ঘ পনের বছর তাঁর জীবনটা খুব অর্থবহ মনে হয় নি। কোমরের নিচ থেকে অবশ ছিল চাচার শরীর। স্নায়বিক জটিলতা। খুব ছোটবেলায় মনে আছে, চাচা পুরো পরিবার সহ আসতেন বাসায়। আমাদের বাসা থেকে পিজিতে দেঁৗড়াদেঁৗড়ি চলত। তখনের কথা বেশি কিছু মনে নেই, শুধু মনে আছে তানিয়া আপুর কাছ থেকে লবণ মরিচ দিয়ে পেয়ারা খাওয়া শিখেছিলাম। আর ছোট ফয়সালটা ভীষণ কান্না করত চাচীকে জড়িয়ে ধরে, 'আম্মা, ঠ্যাঙে উঠমু...'

আরেকটু বড় হয়ে দেখেছি চাচা মাঝে মধ্যে বাবার সাথে ঢাকায় আসতেন। ঠুক ঠুক করে লাঠিতে ভর দিয়ে হাঁটতেন। আমি ভাবতাম বুড়ো হয়ে গিয়েছে।

স্নায়ুবিক জটিলতাটুকু জটিল প্রকারের ছিল। পুরোটা বুঝি নি কখনও, শুধু বুঝেছি শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে থাকা চাচার স্নায়ুগুলো শুকিয়ে যাচ্ছিল খুব দ্রুত। প্রথম বিসর্জন ছিল পা দু'টো। তারপরে শরীরের অন্যান্য অংগ প্রত্যংগ। শেষ এক বছর কথাও বলতে পারতেন না। নির্বাক কিন্তু জ্বলজ্বলে চোখে তাকিয়ে থাকতেন কেবল।

চাচার মৃত্যু সংবাদ শুনে সে রাত আর ঘুমাতে পারি নি... পনেরটা বছর ধুঁকে ধুকে অবশেষে মারা গেলেন? কারও কি খুশি হওয়া উচিৎ? অন্তত স্বস্তির নি:শ্বাস ফেলা কি উচিৎ?

ধাধাঁময় লেগেছে আমার... চাচী কিশোরী বয়স থেকেই চাচার সংসারে। দীর্ঘ পনের বছর ধরে চাচার সেবা করে গেলেন, নিজের সবটুকু দিয়ে। বিনিময়ে একটুকু না পেয়ে। তবু, চার মাস পরে যখন তাকে নতুন করে জীবন শুরু করার জন্য আবার বিয়ের কথা বলা হল, তখন তিনি কাঁদতে কাঁদতে অজ্ঞান হয়ে গেলেন। খুব অবাক হয়েছি আমি, বৃক্ষ তো এখানে চাচীর হওয়ার কথা ছিল, চাচীকে ছাড়া কি বাঁচতেন চাচা? তবু লতাগুল্ম সরিয়ে নেয়ার পরে চাচী এভাবে ভেঙে পড়লেন কেন? এটা কি ভালবাসা না স্রেফ অভ্যস্ততা? ভালবাসা কারে কয়?

বাবাকে দেখেও প্রশ্ন জেগেছে একই। মানুষটা জীবনে অনেক কষ্ট করেছেন। স্বচ্ছল, নিরাপদ অবস্থায় আদর্শের কথা বলা যায়, সততার কথা বলা যায়। মাত্র দশ বছর বয়সে বাবা হারিয়ে যাকে জীবন সংগ্রাম শুরু করতে হয়েছে অপরিচিতের বাসায় লজিং থেকে, সেই মানুষটাকে সত্যিকারের জীবন পরীক্ষা দিতে হয়েছে অনেক, আমি জানি। তাই হয়তো কখনও কাঁদতে দেখিনি বাবাকে। কষ্টগুলো পাথরের বাঁধ দিয়ে বেঁধে রাখা শিখেছেন বলেই হয়তো। জেনে শুনে কাউকে কষ্ট দিতে দেখি নি। কষ্ট পাওয়া কাকে বলে জানেন বলেই হয়তো। কখনও বকা দিতে দেখিনি বাবাকে। তীব্র উপলব্ধি থেকে উঠে আসা কথাগুলো সততার সাথে বলেন। জীবন থেকে শিখে নিজেকে শুধরে নিয়েছেন বলেই হয়তো।

চাচার মৃত্যুর পরের দিন সারাদিন বাবা চুপচাপ ছিল। খুব কম কথা বলছিলেন। খাওয়ার সময় হঠাৎই খুব কথা বলা শুরু করলেন। ছোট বেলার গল্প। চাচা আর বাবা, দাদা ভাই বেঁচে থাকার দিনগুলোতে যখন একসাথে থাকতেন তখন কি করতেন সেই সব গল্প। আর দশটা সাধারণ শিশুর মত নিষ্পাপ দুষ্টোমিতে ভরা শৈশবের গল্প। দু'জনে ষড়যন্ত্র করে ছোট ফুপিকে খেপিয়ে তুলতেন। দাদা ভাইয়ের অনুপস্থিতিতে হুক্কায় টান দিয়ে সে কি কাশি! বিকেল বেলা ঘুড়ি উড়াতে যেতেন। দু'জনের দু'টো গরু ছিল। প্রতিযোগিতা করে গরুগুলোর যত্ন চলতো...

ঠিক ওই পর্যায়ে আমি কখনও বাবাকে যেভাবে কাঁদতে দেখিনি ওভাবে কাঁদতে দেখলাম...

এক সাথে এক ভাবে শুরু হওয়া দু'জনের জীবন কি নির্মম সয়ংক্রিয়তায় দুই পথে চলে গেল...

আমার কেবলই মনে হচ্ছিল... ভালবাসা কারে কয়? কষ্ট কাকে বলে? জীবনকে অর্থবহ হতে হলে কি করতে হয়?
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে ডিসেম্বর, ১৯৬৯ সন্ধ্যা ৭:০০
২২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কোরআন কী পোড়ানো যায়!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ২০ শে মে, ২০২৪ সকাল ১০:৩৮

আমি বেশ কয়েকজন আরবীভাষী সহপাঠি পেয়েছি । তাদের মধ্যে দু'এক জন আবার নাস্তিক। একজনের সাথে কোরআন নিয়ে কথা হয়েছিল। সে আমাকে জানালো, কোরআনে অনেক ভুল আছে। তাকে বললাম, দেখাও কোথায় কোথায় ভুল... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেঞ্চুরী’তম

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ২০ শে মে, ২০২৪ সকাল ১১:১৪


লাকী দার ৫০তম জন্মদিনের লাল গোপালের শুভেচ্ছা

দক্ষিণা জানালাটা খুলে গেছে আজ
৫০তম বছর উকি ঝুকি, যাকে বলে
হাফ সেঞ্চুরি-হাফ সেঞ্চুরি;
রোজ বট ছায়া তলে বসে থাকতাম
আর ভিন্ন বাতাসের গন্ধ
নাকের এক স্বাদে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরানের প্রেসিডেন্ট কি ইসরায়েলি হামলার শিকার? নাকি এর পিছে অতৃপ্ত আত্মা?

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ২০ শে মে, ২০২৪ সকাল ১১:৩৯


ইরানের প্রেসিডেন্ট হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয়ে নিহত!?

বাঙালি মুমিনরা যেমন সারাদিন ইহুদিদের গালি দেয়, তাও আবার ইহুদির ফেসবুকে এসেই! ইসরায়েল আর।আমেরিকাকে হুমকি দেয়া ইরানের প্রেসিডেন্টও তেমন ৪৫+ বছরের পুরাতন আমেরিকান হেলিকপ্টারে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভণ্ড মুসলমান

লিখেছেন এম ডি মুসা, ২০ শে মে, ২০২৪ দুপুর ১:২৬

ওরে মুসলিম ধর্ম তোমার টুপি পাঞ্জাবী মাথার মুকুট,
মনের ভেতর শয়তানি এক নিজের স্বার্থে চলে খুটখাট।
সবই যখন খোদার হুকুম শয়তানি করে কে?
খোদার উপর চাপিয়ে দিতেই খোদা কি-বলছে?

মানুষ ঠকিয়ে খোদার হুকুম শয়তানি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আসবে তুমি কবে ?

লিখেছেন সেলিম আনোয়ার, ২০ শে মে, ২০২৪ দুপুর ১:৪২



আজি আমার আঙিনায়
তোমার দেখা নাই,
কোথায় তোমায় পাই?
বিশ্ব বিবেকের কাছে
প্রশ্ন রেখে যাই।
তুমি থাকো যে দূরে
আমার স্পর্শের বাহিরে,
আমি থাকিগো অপেক্ষায়।
আসবে যে তুমি কবে ?
কবে হবেগো ঠাঁই আমার ?
... ...বাকিটুকু পড়ুন

×