এরকম ঘটনা অহরহ ঘটে। মন ভরিয়ে দিয়ে। ইউনি ওয়াক দিয়ে অন্যমনস্ক ভাবে হাঁটার সময় হঠাৎ পরিচিত শব্দ শুনে সম্ভিত ফিরে পাই। সালাম। সালামের জবাব দেই। মুসলিম ছেলেদের দেখে বোঝার উপায় নেই। সাধারনত মুসলিম ছেলেরা একটু ঢিলাঢালা পোশাক পড়ে আর দাড়ি রাখে। আজকাল এমিনাম চাচার চ্যালারাও সব ঢিলা ঢালা জোব্বা মার্কা পোশাক পড়ে। হিমুরাও দাড়ি কামায় না। তাই সালামটা আসতে হয় ছেলেদের কাছ থেকে।
মুসলিম মেয়েদের চেনা সহজ। হিজাব দেখে। একজন হিজাবী আরেকজন হিজাবীকে দেখলেই মনে হয় "নিজের" কাউকে পায়। ব্যাপারটা মজার। আমি খেয়াল করেছি, সে হিজাব পরিহিতা কালো আফ্রিকান হোক, সাদা ইউরোপীয়ান হোক, ভারতীয় বা মধ্য প্রাচ্যের হোক... মন ভরে যায়। হাসি চলকে উঠে। সালাম বিনিময় চলে। যেন অদৃশ্য কোন ওয়েভলেংথে ভাব বিনিময় হয়ে যায় নিমিষে, যেটা আর কেউ দেখতে পায় না, কেউ না।
এখানেই ইসলামের অপূর্ব সৌন্দর্য যেটা মুসলিম দেশে বড় হওয়া মুসলিমদের বোঝা কঠিন।
কারণ প্রচুর। ইসলাম শিখতে হবে সরাসরি কোরআন আর সুন্নাহ থেকে। নিজে নিজে। কিন্তু ইসলাম যখন আরবি ভাষাহীনদের কাছে গেল, তুরস্ক, ভারতীয় উপমহাদেশ, মধ্য এশিয়ার মত দেশগুলোতে, তখন আস্তে আস্তে আরবি না জানা থাকার কারণে কোরআন আর সুন্নাহ তথা ইসলামের জ্ঞানটা সীমিত হয়ে গেল বিশেষ কিছু মানুষের মধ্যে। তাদের সবাই যে অসৎ তা বলছি না, আলহামদুলিল্লাহ প্রচুর সৎ আলেমরা নিজের সবটুকু দিয়ে ইসলামের সঠিক চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু এ রকম মুসলিম্ও এসে গেছে, যারা আরব স্টাইলের পোশাকের বদৌলতে ইসলামের ব্যাখ্যা করার চাবি কাঠি নিজের হাতে নিয়ে নিয়েছে। তারা বাইরের পোশাক আশাকে চলনে বলনে নুরানী ভাব এনে, ভিতরে ইসলামের উদারতার একটু্ও প্রবেশ করতে না দিয়ে অদ্ভূত সংকীর্ণতায় স্থানীয় সংস্কৃতির খারাপ দিকগুলো ইসলামের সাথে মিলিয়ে ঝিলিয়ে বাজে খিচুরি রাঁধে। তাদের থেক্ওে আর এক ধাপ বিকৃতি-প্রসেসের মাধ্যমে আসে সাধারণ মানুষের ইসলামী জ্ঞান। এ জন্যই ভাত নরম হয়ে যা্ওয়ায় বউকে পিটিয়ে ছাল তুলে ফেল্ওে ইসলামের চাদরের আড়ালে লুকিয়ে ছাড়া পেয়ে যায়। এ জন্যই ধর্ষিতা অথবা এসিড ঝলসানো নারীর এমন ব্যবহার পেতে হয় যেন সব হয়েছে তাদের দোষে। এ জন্যই সুদ ঘুষের টাকায় হজ্জ করে হালাল করে নেয়ার কথা চিন্তা করে মানুষগুলো।
এগুলোতো বড় বড় উদাহরন। বাংলাদেশে এবার অনেক দিন পরে গিয়ে গ্রামের অপরিচিত মহিলাদের সালাম দিতে গিয়ে টাশকি খেয়েছি। সংজ্ঞাটা একটু বদলে গেছে মনে হল... শুধু পরিচিত মুরুবি্বদের সালাম দেয়া যাবে!
আলহামদুলিল্লাহ, সিডনীতে মুসলিম হওয়ার সুন্দর কিছু অভিজ্ঞতা আছে।
পশ্চিমে বড় হওয়া মুসলিমদের মধ্যে ঐক্য আর সংহতি দেখার মত। একটা মুসলিম দেশে যেখানে মুখের এক ইঞ্চি ঢাকা না ঢাকা নিয়ে কুরুক্ষেত্র বাঁধতে পারে, পশ্চিমে তা হয় না। সবার গ্রহনযোগ্যতা সবার কাছে অনেক বেশি। স্কার্ট-হিজাব, বোরখা, মালয়শিয়ান পোশাক সব চলে, সাথে একটু পশ্চিমা স্পর্শ। শিয়া-সুন্নী-হানাফী-শাফেয়ী এগুলো কোন ব্যপারই না। ইউনিতে সবাই এক সাথে নামাজ পড়ি, ইমাম যেভাবে পড়ায় ঠিক সেভাবে। এই ঐক্যটা যে কি চমৎকার জিনিস, যারা পায় নি, তারা সত্যিই দুর্ভাগা।
এখানে একটু পিছনে ফিরে যাই। বিভিন্ন মাজহাব সৃষ্টি হয়েছিল, মৌলিক ব্যপারগুলো ঠিক রেখে শুধু বিভিন্ন হাদীসের উপর এক এক ধরণের জোড় প্রদানের কারণে। এখানে কোন ঠিক ভুল নেই, কোরআন হাদীসের সঠিক জ্ঞান সহ কেউ, কোরআন হাদীসের মূল ম্যাসেজটা নিয়তের পরিশুদ্ধির সাথে যা করবে, তাতেই সুন্দর প্রতিফল থাকবে।
তুরস্ক, ভারত এরকম এক এক এলাকায় ইসলাম যা্ওয়ার পরে স্থানীয় স্পর্শে অনেকটা লোকালাইজড হয়ে গেছে। মানুষ যেন ভুলেই গেছে পৃথিবীর অন্য প্রান্তে মুসলিমরা আছে, তাদের ধরণ ধারণ অন্য রকম। যোগাযোগের স্বল্পতার কারণে এমনটা হয়েছে।
আলহামদুলিল্লাহ, এখন ইসলামের ইউনিভার্সাল, সার্বজনীন রূপটা ফিরে আসছে, আসবে। এখানে একটা মজার ব্যপার কাজ করে। 9/11 এর আগে পরে, মুসলিমদের যেভাবে স্ক্রুটিনাইজ করা হয়েছে মিডিয়াতে, তাতে দেখা গেছে একজন অসচেতন, ড্যাম কেয়ার মুসলিমও রাস্তাঘাটে গালি খায়। এটাই তাদের নিজেকে জানার ব্যপারে আগ্রহী করেছে। নিজেদের মধ্যে 'ভিন্নতা'টা গৌন হয়ে গিয়েছে। 'মুসলিম' পরিচয়টাই বড় হয়ে উঠেছে।
নতুন প্রজন্ম ইসলামের প্রতি একটা ম্যাচিওয়ার অ্যাপ্রোচ নেয়। ডাইভার্সিটি (বৈচিত্র) আর ডিফারেনস (পার্থক্য), দু'টোই 'ডি' ওয়ার্ড। কিন্তু দু'টোতে যে আকাশ পাতাল তফাৎ তা বুঝতে পারে, রাসুলের জীবনের দিকে আরও ভাল ভাবে তাকায় বলে। ইসলামের মূল বিষয়গুলোর প্রতি বিশ্বস্ত থেকে ইন্টারপ্রিটেশনের পার্থক্য শুধু মুসলিমদের জাতিগত ভাবে বর্ণাঢ্য করে, মলিন করে না, এটুকু বুঝে।
আমার কথা শুনে যেন কেও এই ধারণা করে না বসেন যে আমি অমুসলিমদের প্রতি বিরূপ ধারণা পোষণ করি। কারণ ব্যপারটা মোটেই তা না। এই নতুন প্রজন্ম অমুসলিমদের যতটা কাছে টানতে পারছে তা মুসলিম দেশে বড় হওয়া অনেক নাস্তিকও পারছে না। কারণ এই নতুন প্রজন্ম রাসুল (সা) এর আদর্শে বলীয়ান... পাপকে ঘৃণা কর, পাপীকে নয়।
আমি আমার জীবন, দৃষ্টি ভংগি, শিক্ষা সব কিছুর জন্য অমুসলিমদের কাছে প্রচন্ড ভাবে ঋনী এবং কৃতজ্ঞ তাই এতো জোড় দিয়ে বলতে পারছি। পৃথিবীতে আসার সাথে সাথে প্রথম মানবীয় স্পর্শ পেয়েছি এক অমুসলিম ধাত্রীর, যিনি আমাকে নিতান্ত অসহায় অবস্থায় সাহায্য করেছেন। আমার খুব শ্রদ্ধেয় শিক্ষক, শিক্ষিকারা অমুসলিম, সহপাঠীরা অমুসলিম।
আমি মনে করি আমার পথ সঠিক পথ, যদি তা নাই মনে করতাম, তাহলে এ পথে চলার কোন মানে থাকতো না। এও জানি, এ পথে যারা চলে না, তাদের প্রতি ভালবাসার কারণেই এ পথ সম্পর্কে যতটুকু সম্ভব বলবো... আর এও জানি, এ পথে চলা না চলার পুরো সিদ্ধান্তটা তাদের নিজের। তাদের সিদ্ধান্তকে ব্যক্তিগত ভাবে অশ্রদ্ধা করার অধিকার আল্লাহ আমাকে দেন নি।
যাই হোক, মূল প্রসঙ্গে ফিরে যাই। ইসলামের মূলনীতি কখনই সবাইকে এক ছাঁচে ঢেলে রোবট তৈরি করা নয়। বরং ইসলাম মানুষের ইন্ডিভিজুয়ালিটি বুঝে, প্রত্যেকের নিজেস্ব চাহিদা বুঝে। প্রাথমিক কিছু শর্ত পূরনের পরে সে অনুযায়ী তাকে চলতে দেয়। এটাই ডাইভার্সিটি... বৈচিত্র মানে ভিন্নতা নয়, বরং একতার একটা সুন্দর রূপ।
দু:খজনক, কিন্তু ইসলামের এই সুন্দর রূপটা পশ্চিমে আসার আগে আমার কাছে নেহায়তই থিওরী ছিল।
সামী ইউসূফের "হাসবি রাবি্ব" গানটার মিউজিক ভিডি্ওটা দেখে থাকলে আমি কি বলতে চাচ্ছি তা ভালভাবে উপলব্ধি করতে পারবেন। গানটা গাওয়া হয় চারটা ভিন্ন ভাষায়। ইংরেজি, তুকর্ী, আরবী আর হিন্দী। তুরস্ক, ভারত আর মধ্যপ্রাচ্য তিন জায়গাতেই এক একটা মুসলিম প্রাচীন সভ্যতা ছিল। তিন জায়গাই মুসলিমদের অবদানে ভরপুর, আবার এ তিন জায়গাতেই মুসলিমদের নিজেস্ব সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে স্থানীয় স্পর্শ পেয়ে। প্রধানত এ তিন জায়গা থেকেই মুসলিমরা গিয়ে থাকা শুরু করেছে পশ্চিমা দেশগুলোতে।
চারটি ভিন্ন ভাষার সাথে মিল রেখে ভিডি্ও হয় চারটি ভিন্ন দেশে। গানটার মূল ভাব: যেই দেশেরই হই, যেই সংস্কৃতির হইম এব আল্লাহর বান্দা আমরা। আমরা মুসলিম। আমরা পৃথিবীর নাগরিক।
এই যে সব মুসলিমদের এক সূতোয় গাঁথা, কাজটা শুরু হয়ে গেছে। এখন শিয়া-সুন্নী পঁ্যাচাল, ম্ওদূদীবাদ, নয়াতরিকাবাদ এরকম বিভ্রান্তি-উদ্রেককারী কথাবার্তা বলে মুসলিমদের ঐক্য কেউ ভাঙতে পারবে না। মুসলিমদের এক হ্ওয়া কেউ থামাতে পারবে না, কেউ না, ইনশাআল্লাহ
।
ছবির জন্য নিচের সাইটের কৃতজ্ঞতা স্বীকার করছি:
http://images.amazon.com/images/P/ 0316666033.01.LZZZZZZZ.jpg
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে ডিসেম্বর, ১৯৬৯ সন্ধ্যা ৭:০০

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



