রাসেল আরেফিন
ইউনিভার্সিটি হওয়া উচিত ছাত্র-শিক্ষকদের মুক্ত জ্ঞানচর্চা, স্বাধীন মত প্রকাশ ও মতবৈচিত্র্যের অবাধ বিচরণ ক্ষেত্র। সন্ত্রাসীদের
নিরাপদ আশ্রয়স্থল হয়ে উঠবে ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাস - এটা মেনে নেয়া যায় না। অথচ বর্তমানে ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসেই নির্বিঘ্নে
চলছে একের পর এক সন্ত্রাসী কর্মকান্ড। খুন হচ্ছে ছাত্র, শিক্ষক এমনকি বহিরাগতরাও।
স্বাধীনতার পর থেকে শুধু ঢাকা ইউনিভার্সিটি এলাকায় এ পর্যন্ত মোট ৭১টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। এদের মধ্যে ২৪ জনই ছিল
বহিরাগত। প্রায় ১০০টির কাছাকাছি খুনের ঘটনা ঘটলেও এ পর্যন্ত বিচার হয়েছে মাত্র দুটির। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, প্রতিটি ঘটনা
ঘটার পরই ইউনিভার্সিটির প্রচলিত রীতি অনুযায়ী ক্যাম্পাস উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের মিছিলে মিছিলে কেপে ওঠে
ক্যাম্পাস। শিক্ষকরা কালো ব্যাজ ধারণ করে ক্লাস বর্জন করেন। পত্রিকার পাতায় ফলাও করে ছাপা হয়- ক্যাম্পাসের খবর, সাধারণ
ছাত্রছাত্রীরা পুলিশের মার খেয়ে হাসপাতালে যায়, বুদ্ধিজীবীরা সংবাদপত্রে কলাম লেখেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে অপরাধীদের
গ্রেফতারের আশ্বাস দেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় না। পুলিশ ঘটনার তদন্ত চলছে বলে বিবৃতি দিয়ে বার বারই পার পেয়ে যায়।
ক্যাম্পাসে ছাত্র হত্যাকাণ্ডের ঘটনাগুলো ঘটে মূলত আধিপত্য বিস্তার, হল দখল, অভ্যন্তরীণ কোন্দল, প্রতিপক্ষের সঙ্গে সংঘর্ষ, গ্রুপিং,
ছিনতাই এবং মাদক ব্যবসার টাকা ভাগাভাগি নিয়ে। আর শিক্ষক হত্যাকাণ্ডের ঘটনাগুলোর জন্য দায়ী করা হয়- উগ্র মৌলবাদ,
রাজনৈতিক বিবাদ, মাঝে মধ্যে শিক্ষকদের অনিয়ন্ত্রিত ও অশালীন মন্তব্য, প্রচলিত প্রথার বিরুদ্ধে শিক্ষকদের নিজস্ব মতামত প্রকাশ
ইত্যাদি কারণগুলোকে। স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত শুধু ঢাকা ইউনিভার্সিটিরই চারজন শিক্ষক খুন হয়েছেন।
বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. হুমায়ুন আজাদ প্রথমে সন্ত্রাসীদের দ্বারা আক্রান্ত হন। দীর্ঘ চিকিত্সার পর এক সময় ক্যাম্পাসে ফিরে
এলেও মাত্র কয়েক মাস পরই জার্মানির মিউনিখে মৃত্যু হয় তার। ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে সর্বশেষ শিক্ষক হত্যার ঘটনাটি ঘটে মাত্র
কিছুদিন আগে। ফুলার রোডের সুরক্ষিত আবাসিক এলাকায় ড. আফতাব আহমাদের ফ্লাটে ঢুকে সন্ত্রাসীরা তাকে কমান্ডো স্টাইলে গুলি
করে নির্বিঘ্নে পালিয়ে যায়।
এমনিতেই ঢাকা ইউনিভার্সিটি এলাকা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ এবং সুরক্ষিত। তার ওপর এখানে সব সময় তত্পর থাকে বিভিন্ন গোয়েন্দা
সংস্থার লোকজন। এতো কিছুর পরও শিক্ষকদের বাড়িতে ঢুকে গুলি করে হত্যার ঘটনা শিক্ষকদের যথেষ্ট আতঙ্কিত করে তুলেছে। শুধু
এ দুটি ঘটনাই নয়। এর আগে স্বাধীনতার পরপর ১৯৭২ সালের ৬ জুন খুন হয়েছিলেন দেশের বিশিষ্ট কবি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের
বাংলা বিভাগের অধ্যাপক হুমায়ুন কবির। এরপর দীর্ঘদিন পর ১৯৯৫ সালের ডিসেম্বরে সংসদ ভবন চত্বরে খুন করা হয় অর্থনীতি
বিভাগের প্রফেসর নোবান আহমেদকে।
উল্লেখ্য, রাজশাহী ইউনিভার্সিটিতেও ঘটেছে শিক্ষক হত্যার মতো জঘন্য ঘটনা। ২০০৪ সালের ২৪ ডিসেম্বর খুন করা হয় রাজশাহী
ইউনিভার্সিটির অর্থনীতির শিক্ষক প্রফেসর মোহাম্মদ ইউসুফকে। এরপর চলতি বছরের ৩ ফেব্রুয়ারিতে খুন হন একই ইউনিভার্সিটির
ভূ-তত্ত্ব বিভাগের প্রবীণ শিক্ষক প্রফেসর ড. এস তাহের।
প্রতিটি খুনের ঘটনার পর সব ক্যাম্পাসে ছাত্রছাত্রীরা তীব্র আন্দোলন গড়ে তুললেও এখন পর্যন্ত কোনো ঘটনারই কিনারা করতে
পারেনি সরকার। শুধু তাই নয়, আন্দোলন স্থিমিত হয়ে গেলে ওইসব মামলার কোনো খোজ-খবর না রাখারও দৃষ্টান্ত রয়েছে।
খুনের পাশাপাশি বেশ কিছু শিক্ষককে হুমকি প্রদানের ঘটনাও ঘটেছে। টেলিফোনে হুমকি দেয়া তো এখন গা সওয়া ব্যাপার হয়ে
দাড়িয়েছে। গত দুবছরে প্রায় ১০ জন শিক্ষককে হুমকি দেয়া হয়েছে।
কিন্তুএসব হুমকির ব্যাপারে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এখন পর্যন্ত কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারেনি।
ছাত্র হত্যার ঘটনাগুলোর ব্যাপারেও সরকার উদাসীন। ২০০৪ সালে জহুরুল হক হলে ছাত্রদলের গ্রুপিং-এর জের ধরে খুন হয় ছাত্রদল
নেতা মাহবুবুল হক খোকন। এ হত্যাকাণ্ডের আসামিরা সে সময় পালিয়ে বেড়ালেও ইদানীং ক্যাম্পাসেই তাদের পুলিশের সঙ্গে বসে চা
খাওয়ার দৃশ্য দেখা যাচ্ছে। ২০০৩ সালে স্যার এ এফ রহমান হলের সামনে খুন করা হয় বহিরাগত এবং নগরীর শীর্ষ সন্ত্রাসী ন্যাটা
রুবেলকে। ২৪ মামলার আসামি রুবেলকে ট্যাক্সিক্যাব থেকে হলের সামনে গুলি করে হত্যা করা হয়। ২০০১ সালের ২৭ মার্চ জহুরুল
হক হলের পুকুর পাড়ে সহযোগীদের হাতে খুন হয় ছিনতাইকারী ্তুকুত্তা লিটন্থ। একই বছর ১৮ আগস্ট ছাত্রলীগের মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর
রহমান হল সহ-সভাপতি ফিরোজ আহমেদকেও তার নিজ কক্ষে গুলি করে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় ছাত্রদল এবং ছাত্রলীগ
পরস্পরকে দায়ী করে মামলা করলেও পুলিশ এ পর্যন্ত কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি।
২০০০ সালের ১ জানুয়ারি এলজিআরডি মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব নিকুঞ্জ বিহারি দেবনাথ ক্যাম্পাস এলাকাতে ছিনতাইকারির হাতে খুন
হন। সেই বছরই ২৫ অক্টোবর ছিনতাইয়ের টাকা ভাগাভাগি নিয়ে ক্যাম্পাসে খুন হয় সে সময়ের আলোচিত ছিনতাইকারি ্তুছোট
কাইশ্যা্থ। ১৯৯৮ সালের এপৃল মাসে জিয়া হল দখল নিয়ে ছাত্রদল এবং ছাত্রলীগের মধ্যে গোলাগুলিতে মৃত্যু হয় সাংবাদিকতা বিভাগের
ছাত্র পার্থ প্রতীম আচার্যের। পার্থকে মৃত্যুর পর থেকেই ছাত্রলীগ তাদের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য বলে দাবি করে আসছে। এই ঘটনায়
সে সময় ক্যাম্পাসে ব্যাপক তোলপাড় হলে তত্কালীন ছাত্র নেতা শহীদ উদ্দীন চৌধুরী অ্যানিসহ বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়।
কিছুদিন পর তাদের অবশ্য ছেড়ে দেয়া হয়।
১৯৯৫ সালে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জের ধরে প্রাণ দিতে হয় জয়দীপ দত্ত চৌধুরীকে। একই বছর চারুকলা ইন্সটিটিউটের
অভ্যন্তরে এবং টিএসসি এলাকায় খুন করে ফেলে রাখা হয় দুজন বহিরাগতকে। ১৯৯৪ সালে ছাত্রলীগের শা্থপা গ্রুপ এবং কা্থচু গ্রুপের
সংঘর্ষের সময় পুলিশের টিয়ারশেলের আঘাতে নিহত হয় মাস্টার্সের ছাত্র বুলবুল। ১৯৯৩ সালে ছাত্রদলের অন্তর্কোন্দলে প্রাণ হারায়
ছাত্রদল নেতা জিন্নাহ এবং পাভেল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইতিহাসে সর্বাধিক লাশ পড়ে ১৯৯২ সালে। সে বছর বিভিন্ন ঘটনায় ক্যাম্পাসে প্রাণ হারায় মোট সাতজন। এর মধ্যে
ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মনিরুজ্জামান বাদল হত্যা মামলায় গ্রেফতারকৃত ১৪ জন আসামির প্রত্যেককেই পরবর্তীতে খালাস
দেয়া হয়। এর আগে ১৯৭৪ সালে ঘটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুহসীন হলের বহুল আলোচিত ্তুসেভেন মার্ডার্থ ১৯৭৮ সালে এ মামলার
রায়ে কয়েকজনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেয়া হলেও আইনের ফাক গলিয়ে তারা সবাই পরে বেরিয়ে আসতে সমর্থ হয়।
শুধু এসব পরিকল্পিত এবং রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডই নয়। ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে এর বাইরেও নিয়মিত বিরতিতে মৃত্যু হচ্ছে ছাত্রদের।
প্রতি বছরই পুকুরে ডুবে কিংবা গাছ থেকে পড়ে মৃত্যু হচ্ছে ছাত্র-ছাত্রীদের। আবার ক্যাম্পাসের ভিতর দিয়ে আইন ভেঙে ভারী যানবাহন
চলাচলের কারণেও এ পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে অনেকের। তাছাড়া ক্যাম্পাস সংলগ্ন নগরীর বিভিন্ন রাস্তায় ট্রাফিক আইন না মেনে গাড়ি
চলাচলের ফলে সড়ক দুর্ঘটনায় ইউনিভার্সিটি ছাত্রের মৃত্যুর সংখ্যা দিন দিন বেড়ে চলছে। শাহবাগ এলাকায় হ্যাপির মৃত্যুর পর
প্রশাসন সামান্য কিছু পদক্ষেপ নিলেও এখন আর তা মানা হচ্ছে না।
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে ডিসেম্বর, ১৯৬৯ সন্ধ্যা ৭:০০