somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

অপরচুনিটি রোভার: মানব সমাজেরই এক অবতার!

১৭ ই এপ্রিল, ২০১৯ রাত ৮:১৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



সময়কাল ২০০৩। নাসার বিজ্ঞানিরা ব্যস্ত দুইটি রোবট নিয়ে। মঙ্গলে পানি ও প্রাণীর সন্ধ্যান কিংবা অস্তিত্ব খুঁজে পেতে দুইটি রোবট তৈরি করেন। যাদের নাম, গঊজ-অ অথবা ‘স্পিরিট’ এবং গঊজ-ই অথবা ‘অপরচুনিটি’। তবে আজ আমরা আলোচনা করবো ‘অপরচুনিটি’ নিয়ে। এম.ই.আর-বি, যার বৈজ্ঞানিক নাম ‘মার্স এক্সপ্লোরেশন রোভার’। নাসার বিজ্ঞানীরা ‘অপরচুনিটি’কে আদর করে ‘অপি’ নামে ডাকতো। পাঠকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে ‘অপরচুনিটি’ শুধু মাত্র একটি যন্ত্র বা রোবট। একটি রোবট মানবসমাজের অবতার বলে খেতাব কেন দেওয়া হলো? কিছু সময় মনোযোগ দিয়ে পড়ুন, আপনিও বুঝতে পারবেন মানবসমাজের জন্য ‘অপরচুনিটি’র কি অবদান ছিল।
মার্স এক্সপ্লোরেশন রোভার নাসার এই প্রোগ্রামের কাজ ছিলো মূলত চারটি, মঙ্গলের বুকে প্রাণ খুঁজে বেড়ানো, মঙ্গলের আবহওয়ার সম্পর্কে জানা, মঙ্গলের ভূতত্ত্ব বিশ্লেষণ করা এবং মানুষের মঙ্গল যাত্রা করার পথ সূগম করা।
আগেই বলেছিলাম, মঙ্গলে পানি ও প্রাণীর সন্ধ্যান কিংবা অস্তিত্ব খুঁজে পেতে দুইটি রোবট তৈরি করেন বিজ্ঞানীরা। ‘স্পিরিট’ ও ‘অরচুনিটি’। ২০০৩ সালের ৭ জুলাই মঙ্গলের উদ্দেশে রওনা হয়েছিল ‘অপরচুনিটি’। এর তিন সপ্তাহ আগে ‘স্পিরিট’ কে মঙ্গলের উদ্দেশে পাঠিয়েছিল নাসা। পরের বছর ২৫ জানুয়ারি মঙ্গলের ‘মেরিডিয়ানি প্লেনাম’-এ নামে সে। তার পর থেকে নাসাকে একের পর এক তথ্য পাঠিয়ে গিয়েছে ‘অপরচুনিটি’। সেই সঙ্গে পাঠিয়েছে নৈসর্গিক সব ছবি।
বিজ্ঞানিরা আশা করেছিলেন রোবট রোভার দুটির কার্যদিন হবে প্রায় ৯০ সোল এর মতো। মানে পৃথিবীর ৯০ দিন থেকে সামান্য বেশি। যদিও ‘স্পিরিট’ ও ‘অপরচুনিটি’ দুটোই বেঁচে ছিলো অনেক বেশি সময় ধরে। স্পিরিট মঙ্গলে বেঁচে ছিলো প্রায় ৭ বছর। আর আমাদের গল্পের নায়ক ‘অপরচুনিটি’ রোভার বেঁচে ছিল প্রায় ১৪ বছর। যা নাসার বিজ্ঞানিদের এস্টিমেশনের ৫৫ গুন বেশি।
অপরচুনিটি রোভার এই প্রচেষ্টায় আবিষ্কার করে- প্রাচীন কালে কোনো এক সময়ে মঙ্গলের আবহাওয়া ছিলো আদ্র এবং উষ্ণ। যা বাড়িয়ে দেয় অতীতে মঙ্গলে প্রাণের উপস্থিতি থাকার সম্ভাবনা। তাছাড়াও অপরচুনিটি প্রথমবার পৃথিবীর বাইরের গ্রহে, পাললিক শীলা পাথরের আবিষ্কার করে। তাছাড়াও অপরচুনিটি ছোট হেমাটাইটের পাথর আবিষ্কার করে, যাকে বিজ্ঞানীরা ‘ব্লুবেরি’ নামে ডেকে থাকেন। জীবদ্দশায় অপরচুনিটি সবচে আশা জাগিয়েছিলো, যখন সে মঙ্গলে একধরনের মাটির মিনারেল আবিষ্কার করে, যা তৈরি হয়েছিলো পানি দিয়ে। যার পিএইচ ছিলো নিউট্রাল। যা মঙ্গলে পানি থাকার সম্ভাবনাকে দৃঢ় করে।

আগেই বলেছিলাম রোভারের কাজ ছিলো মঙ্গলে পানি ও প্রাণের অস্থিত্ব বের করা, সে উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই অপরচুনিটি রোভার সাফল্যের সঙ্গে মঙ্গলের বিভিন্ন প্যারানমা ছবি তুলে পাঠায় নাসার বিজ্ঞানিদের কাছে। যারা সেই ছবিগুলো পরীক্ষা করে বের করার চেষ্টা করে মঙ্গলে কি কখনো পানি ছিলো কিনা?

অপরচুনিটি রোভার তাঁর জীবদ্দশায় প্রায় ৪৫.১৬ কিলোমিটার বা ২৮.০৬ মাইল পথ অতিক্রম করে। আপনি হয়তো ভাবছেন, এ আর এমন কি? এটা তো খুব অল্প দূরত্ব। পৃথিবীতে মানুষ একদিনেই ২৮ মাইল থেকে বেশি হাঁটতে পারে। আর রোবট ২৮.০৬ মাইল অতিক্রম করতে ১৪ বছর সময় লেগেছে! পৃথিবীর অবস্থা আর মঙ্গলের অবস্থা অনেক পার্থক্য আছে। যার ফলে ইমেপ্রসিভ ছিলো, অপরচুনিটির যাত্রা। রোভার গুলোকে অন্য একটি গ্রহে চালনা করা আসলেই কষ্টসাধ্য একটি কাজ। কারণ রোভার গুলো চলার পথ নির্ধারণের জন্য ইঞ্জিনিয়ার নির্দেশনা প্রয়োজন। এতে লেগে যায় অনেক সময়। কারণ প্রতিটি মুভমেন্টের আগেই বিজ্ঞানীদের নতুন তথ্য সংগ্রহ করে, তাকে মূল্যায়ন করতে হয়, তারপরই কেবল মাত্র নতুন নির্দেশনা দিতে পারেন একজন বিজ্ঞানী। সাধারণ অপরচুনিটি চলতো সোলার শক্তির উপর, এবং ঝড়ের সময় হাইবারনেশনে চলে যায়। তাছাড়া, অপরচুনিটি রোভার মঙ্গলে চলার সময় মুখোমুখি হয়েছিলো, শত ধুলোর ঝড়ের।
অ্যাপোলো লুনার ৭ এর অতিক্রান্ত দূরত্ব ২২.২ মাইল, সোভিয়েত লুনোখোদ-২ পাড়ি দেয় ২৪ মাইল দূরত্ব। এবং অপরচুনিটি রোভারের ৩ সপ্তাহ আগে মঙ্গলে নামা স্পিরিট পাড়ি দেয় মাত্র ৪.৬ মাইল দূরত্ব। অর্থ্যাৎ, এখন পর্যন্ত অপরচুনিটিই একমাত্র রোবট, যা মঙ্গলে সবচেয়ে বেশি দিন বেঁচে ছিল এবং বেশি দূর পাড়ি দিয়েছিল।
২০০৫ সালে এমন একটি ঝড়ের সম্মুখীন হয়েছিল অপরচুনিটি। এসময় প্রায় সবকটি চাকা ডুবে গিয়েছিলো নরম বালির নিচে। ছয় সপ্তাহ বিভিন্নভাবে চেষ্টা করে সে যাত্রায় বেঁচে যায়। এই নরম বালি থেকে নিজেকে বাঁচাতে রোভারটির চাকাকে ঘুরতে হয়েছিলো প্রায় ৬২৯ ফিট সমপরিমাণে।
এরপর ২০১১ সালেও ভয়ানক ধুলো-ঝড়ের মুখে পড়তে হয়েছিল অপরচুনিটিকে। সেবারও বেঁচে গিয়েছিল। কিন্তু সর্বশেষ ২০১৮’র জুন মাসে এক বিশাল ধুলোঝড় হয়। এই ধুলি ঝড়ে আক্রান্ত হয়ে অপি হাইবারনেশন পর্যায়ে চলে যায়। ২০১৮ সালের আগস্টে নাসার বিজ্ঞানীরা অপিকে ৪৫ দিনের সময় বেঁধে দেন পৃথিবীর সাথে যোগাযোগ করতে। কিন্তু ৪৫ দিনে কোনো সিগন্যাল আসেনি অপি থেকে । অক্টোবরের মাঝামাঝিতেও নাসা আশা করে, রোভারটি হয়তো যোগাযোগ পুনঃস্থাপন করতে সক্ষম হবে। কিন্তু করতে পারেনি।
অপরচুনিটি রোভার নাসার সাথে শেষবার যোগাযোগে বলেছিলো, ‘আমার ব্যাটারি ফুরিয়ে যাচ্ছে, চারপাশ অন্ধকার হয়ে আসছে।’
১৪ বছরের সফর শেষ হওয়ায় মন ভাল নেই নাসার বিজ্ঞানীদের। ‘মার্সিয়ান রিসার্চ অ্যাট অ্যারিজোনা স্টেট ইউনিভার্সিটির ডিরেক্টর ট্যানিয়া হ্যারিসন টুইট করেন, “সন্ধেটা জেট প্রোপালসন ল্যাবে কাটালাম। শেষ কম্যান্ড পাঠানো হল ‘অপরচুনিটি’কে। সবাই চুপ করেছিলাম। সবার চোখে জল। একে অপরকে জড়িয়ে ধরলাম। এতগুলো বছরে কত স্মৃতি। #থ্যাঙ্কইউঅপি#গুডনাইটঅপি।”
‘অপরচুনিটি’কে শেষ মেসেজ পাঠানোর সুযোগ পেয়েছিলেন বিজ্ঞানী কেরি বিন। পরে তিনি টুইট করেন, “নতুন যাত্রার শুভেচ্ছা রইলো অপরচুনিটি। বিশেষজ্ঞ এমিলি লাকডাওলা বলেন, “গ্রহের মাটিতে ঘুরে বেড়ায় রোভার। অনেকটা মানুষের মতোই কাজ করে সে। বলা যেতে পারে, মানব সমাজেরই ‘অবতার’।”
২০১২ সালে মঙ্গলে পৌঁছায় নাসার আর এক যান ‘কিউরিয়োসিটি’। তবু ‘অপরচুনিটি’র স্মৃতিতে বিভোর বিজ্ঞানীরা। মঙ্গলযানের প্রাক্তর ফ্লাইট ডিরেক্টর মাইক সেবার্ট বলেন, “মঙ্গলের রানির জয় হোক!” আমিও বিভোর অপরচুনিটির কাজে। মিস করছি অপরচুনিটিকে। ২০২৪ সালে মঙ্গলে প্রথমবারের মতো মানুষের পা পড়বে। তাও ১০০ জনের। তারা সেখানে মানববসতি তৈরিতে কাজ করবে। তৈরি হবে দ্বিতীয় পৃথিবী। আর এর পেছনে সব চেয়ে বড় ভূমিকা দিতে হয় ‘অপি’কেই।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই এপ্রিল, ২০১৯ রাত ৮:১৫
৪টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

যুক্তরাষ্ট্রে ইসরাইল বিরোধী প্রতিবাদ বিক্ষোভ

লিখেছেন হাসান কালবৈশাখী, ০৩ রা মে, ২০২৪ সকাল ৮:০২

গাজায় হামাস উচ্ছেদ অতি সন্নিকটে হওয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিউইয়র্ক ও লসএঞ্জেলসে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পরেছিল। আস্তে আস্তে নিউ ইয়র্ক ও অন্যান্ন ইউনিভার্সিটিতে বিক্ষোভকারীরা রীতিমত তাঁবু টানিয়ে সেখানে অবস্থান নিয়েছিল।


... ...বাকিটুকু পড়ুন

৫০১–এর মুক্তিতে অনেকেই আলহামদুলিল্লাহ বলছে…

লিখেছেন বিচার মানি তালগাছ আমার, ০৩ রা মে, ২০২৪ বিকাল ৩:০০



১. মামুনুল হক কোন সময় ৫০১-এ ধরা পড়েছিলেন? যে সময় অনেক মাদ্রাসা ছাত্র রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছিল। দেশ তখন উত্তাল। ঐ সময় তার মত পরিচিত একজন লোকের কীভাবে মাথায় আসলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

মেহেদীর পরিবার সংক্রান্ত আপডেট

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ৮:৪৯


মার্চ মাস থেকেই বিষয়টি নিয়ে ভাবছিলাম। ক'দিন আগেও খুলনায় যাওয়ার ইচ্ছের কথা জানিয়েও আমার বিগত লিখায় কিছু তথ্য চেয়েছিলাম। অনেক ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও মেহেদীর পরিবারকে দেখতে আমার খুলনা যাওয়া হয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

'চুরি তো চুরি, আবার সিনাজুরি'

লিখেছেন এমজেডএফ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৮


নীলসাধুকে চকলেট বিতরণের দায়িত্ব দিয়ে প্রবাসী ব্লগার সোহানীর যে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল তা বিলম্বে হলেও আমরা জেনেছি। যাদেরকে চকলেট দেওয়ার কথা ছিল তাদের একজনকেও তিনি চকলেট দেননি। এমতাবস্থায় প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বরাবর ব্লগ কর্তৃপক্ষ

লিখেছেন নীলসাধু, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২২

আমি ব্লগে নিয়মিত নই।
মাঝে মাঝে আসি। নিজের লেখা পোষ্ট করি আবার চলে যাই।
মাঝেমাঝে সহ ব্লগারদের পোষ্টে মন্তব্য করি
তাদের লেখা পড়ি।
এই ব্লগের কয়েকজন ব্লগার নিজ নিক ও ফেইক... ...বাকিটুকু পড়ুন

×