সাদাত শাহরিয়ার
ছোটবেলায় পড়েছিলাম সাত দিনে এক সপ্তাহ। আর সপ্তাহের সাতটি দিন হচ্ছেÑশনি, রবি, সোম, মঙ্গল, বুধ, বৃহস্পতি ও শুক্র। এ বারগুলো আমাদের জীবনে এই ক্রমানুসারে আসে। অর্থাৎ শনির পর রবিবার, রবির পর সোমবার। সোমের পর মঙ্গল। এভাবে সাতটি দিনে সাতটি বার। কখনোই এ অনুক্রমের ব্যতিক্রম হয় না। কিন্তু কেন? শনির পর সোমবার হলে কী দোষ হত?
সপ্তাহের দিনগুলোর নাম সৌরজগতের গ্রহ আর উপগ্রহদের দিয়েই চিহ্নিত (যদিও রবি বা সূর্য একটি নক্ষত্র)। তাই বলে সৌরমণ্ডলে এদের অবস্থানের সাথে বারগুলোর অনুক্রমের কিন্তু কোন সম্পর্ক নেই। যেমন ধরা যাক, বুধের কথা। এটি সূর্যের নিকটতম গ্রহ। দ্বিতীয় নিকটতম গ্রহ হচ্ছে শুক্র। অথচ সপ্তাহের দিনে বুধবারের পর শুক্রবার আসে না, আসে বৃহস্পতিবার। এর কারণ কি?
বারগুলোর এ অনুক্রমটি পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও প্রচলিত। তবে যে সব ভাষায় লাতিনের প্রভাব আছে সেগুলোতে কিছু পরিবর্তন রয়েছে, গ্রহদের নামের জায়গায় সেই গ্রহদের সাথে জড়িত রোমান দেবদেবীর নাম ঢুকে পড়েছে। আবার ইংরেজি বা জার্মান ভাষায় এসেছে অন্য সভ্যতার দেবদেবীর নাম। যেমন, রোমানদের কাছে বৃহস্পতি যেমন আকাশের দেবতা, তেমনই ভাইকিংদের বজ্রের দেবতা ‘থর’। তাই বৃহস্পতিবার ইংরেজিতে হয়ে গেছে ‘ঞযঁৎংফধু’ বা ‘ঞযড়ৎ’ং ফধু’।
এবার আসা যাক সপ্তাহের বারগুলোর অনুক্রম বিশ্লেষণে। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে এই বারের সাথে গ্রহদের সম্বন্ধ ব্যাবিলনে খুঁজে পাওয়া যায়। তখন ব্যাবিলনবাসীরা আকাশের সাতটি জ্যোতিষ্কÑসূর্য, চন্দ্র বা সোম, বুধ, শুক্র, মঙ্গল, বৃহস্পতি এবং শনিকে ভাবত একেকজন দেবদেবী। তারা মনে করত এ জ্যোতিষ্কগুলো মানবজীবনে বিস্তর প্রভাব বিস্তার করে। তারা এই জ্যোতিষ্কগুলোকে সাজিয়েছিল আকাশে এদের গতি অনুসারে, পৃথিবী থেকে যে রকমটি মনে হয় (চন্দ্র ছাড়া আসলে কোন বস্তু যদিও পৃথিবীর চারদিকে ঘুরছে না)। যেমনÑপৃথিবীর আকাশে একই জায়গায় ফিরে আসতে শনির লাগে সবচেয়ে বেশি সময়, ২৯ বছর। এরপর আসে বৃহস্পতি (১২ বছর), মঙ্গল (৬৮৭ দিন), সূর্য (৩৬৫ দিন), শুক্র (২২৫ দিন), বুধ (৮৮ দিন), আর চাঁদ (২৭ দিন)। এই ক্রমটি থেকেই আমরা বারের ক্রম পেতে পারি। এজন্যে কোন একটি দিনে শুরু করে তার পরের দুটি গ্রহ ছেড়ে দিতে হবে। যেমনÑযদি শনিবার দিয়ে শুরু করি, তা হলে এরপরের বৃহস্পতি ও মঙ্গলকে ছেড়ে দিলে পাব রবিবার। তারপর রবিকে বিবেচনা করে পরবর্তী শুক্র ও বুধ ছেড়ে দিয়ে পাব চাঁদ অর্থাৎ সোমবার।
সাপ্তাহিক বারের এ নিয়মের উৎস খুঁজতে গিয়ে জানা গেছে, রোমান ইতিহাস লেখক প্লুটার্কের ১০০ খ্রিস্টাব্দে লেখা একটি বইয়ের সূচিপত্রের পাতায় তার একটি প্রবন্ধের কথা জানা যায়, যার বিষয় ছিল, ‘বারগুলো গ্রহদের ক্রমানুযায়ী সাজানো হয় কেন?’ সেই বইটি অবশ্য কখনও খুঁজে পাওয়া যায়নি। পরবর্তীতে আরেকজন ইতিহাস রচয়িতা, দিও ক্যাসিওসের লেখায় তখনকার দিনের জ্যোতিষীদের একটি প্রচলিত প্রথার কথা জানা যায়। এই প্রথা অনুসারে, যা মনে করা হয় আলেকজান্দ্রিয়াতে শুরু হয়েছিল, দিনের প্রতিটি ঘণ্টাকে এই সাতটি জ্যোতিষ্কদের নামে চিহ্নিত করা। আর দিনের প্রথম ঘণ্টার সঙ্গে জড়িত গ্রহকে ভাবা হত সেইদিনের সবচেয়ে বেশি প্রভাবশালী গ্রহ এবং সেই দিনটিকে গ্রহের নাম দেয়া হত। জ্যোতিষীদের এই বিশ্বাসই আমাদের ভাষায় বারগুলোকে এখনকার মত সাজিয়েছে।
উল্লেখ্য, দিনে ২৪ ঘণ্টার সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন সাতটি গ্রহের সাতজন দেবতা। প্রথম দিনের প্রথম ঘণ্টার ভার যদি শনির হাতে দেয়া হয় (যেহেতু ব্যাবিলনীয় তালিকায় শনি সবচেয়ে উপরে) তাহলে এর পরের ঘণ্টাগুলোর ‘অধিকর্তা’ হবে একে একে বৃহস্পতি, মঙ্গল, রবি, শুক্র, বুধ ও চাঁদ। কিন্তু ২৪কে ৭ দিয়ে ভাগ করলে অবশিষ্ট থাকে তিন। তাই ২২, ২৩, ২৪ নম্বর ঘণ্টার নাম হবে আবার শনি, বৃহস্পতি আর মঙ্গলের নাম। আর তা হলে ২৫তম ঘণ্টা, যেটা পরের দিনের প্রথম ঘণ্টা হবে, সেটা হবে রবির নামে চিহ্নিত। তাই শনিবারের পরের দিনের নাম হবে রবিবার। ঠিক একই নিয়মে দেখা যাবে ২৯তম ঘণ্টার (তৃতীয় দিনের প্রথম ঘণ্টা) ঘরে থাকবে চন্দ্র, আর তৃতীয় দিনের নাম হবে সোমবার।
প্রাচীন ভারতে সপ্তাহ, ঘণ্টা ইত্যাদির ব্যবহারে গ্রিক আর ব্যাবিলনীয় সভ্যতার প্রভাব পড়েছে বলে ইতিহাস রচয়িতরা মনে করেন। আলেকজান্ডারের এশিয়া বিজয়ের পর ইউরোপ, মধ্য এশিয়ার সঙ্গে ভারতের আরও যোগাযোগ বাড়ে। তাই বর্তমানের বেশিরভাগ ভাষায় একই ধরনের দিনের ক্রম সাজানো আছে। আশা করা যায়, এ ক্রম চিরকালই অবিকৃত থাকবে।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই নভেম্বর, ২০০৭ সন্ধ্যা ৭:৪৮

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




