দশ বছর পরপর কবিতা কি পাল্টায়? কবিতা কি পরিকল্পিতভাবে নতুন হয়? দশ বছরেই একটা ধারা থেকে আরেকটা ধারায় বিবর্তন ঘটে যায় কবিতার? নাকি এ সময়ের মধ্যে ঘটে যাওয়া নানা কিছুর বা আসন্ন ভবিষ্যত্ বার্তার ধাক্কায় কবিতার ঝোঁক পাল্টায়? কবিতা বিবর্তিত হয়, না কবিতার মধ্য দিয়ে কবির বিবর্তন ঘটে? কবিতাকে দশকের মাপে চিহ্নিত করার প্রসঙ্গ থেকেই প্রশ্নগুলো উঠছে।
উত্তর কারো কাছে মীমাংসিত, কারো কাছে দ্বান্দ্বিক। আবার অনেকের কাছে প্রশ্নগুলো একেবারেই ‘ফালতু’। তাদের যুক্তি, কবিতা সাহিত্যের সেরা ফর্ম। কবিতার নিরুপম সৌন্দর্যের অন্যতম উত্স তার স্বাধীনতা, বাধা-বন্ধনহীন গতি। এ স্বাধীনতা, গতির কারণে একটা নতুন দশকের কবিতার শব্দ, শরীর, ফর্মেটে কিছু পরিবর্তন আসতেই পারে। তবে কবিকে কাল, দশকে মাপে যায় না।
একবিংশ শতাব্দী শুরুর সময় থেকে যারা কবিতা লিখছেন, তারা শূন্য দশকের কবি। পাঠককে সেটা তারা জানিয়েও দিয়েছেন। তাদের কবিতার শাব্দিক নাম ‘শূন্যের কবিতা’। বিগত শতাব্দীর সব দশক আর এ শতাব্দীর নতুন দশকের কবিতার মধ্যে বিবর্তনটা কোথায় ঘটছে?
বিবর্তনটা গুণমানের কিনা? এ প্রশ্নের উত্তরের জন্য দীর্ঘ সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। বিবর্তনটা কি কেবলই যুগধর্মের? যুগের দাবি যেসব অবদমিত চিত্কার, সেগুলো কি শূন্যের কবিতায় ধ্বনিত হয়? শূন্যের কবিরাও কাব্য ভাষার অধিকারী, তারা শব্দ ভাঙতে, গড়তে জানেন। বিবর্তনের প্রশ্নটা দক্ষতা নিয়ে নয়, কবিতার তাত্পর্য, পাঠক সমাজে প্রভাব, নিজের গন্তব্য নিয়ে।
দক্ষতা বিচার হয় কাব্যতত্ত্ব থেকে। চিন্তাবিদ ফরহাদ মজহারের বক্তব্য ধার করে বলা যায়— ‘কাব্যতত্ত্ব তো কবিতাকে কবিতা হিসেবে বুঝতে সাহায্য করে না। কবিতার গঠন বর্ণনা বুঝতে সাহায্য করে।’ অনেকের অভিযোগ। শূন্যের কবিতা যৌনতা-সর্বস্ব, কঠিন শব্দে ভরা, প্রতীকী উপমায় আক্রান্ত। পাঠকেরা সহজে তা বোঝেন না। অভিযোগ : কবির বিরুদ্ধেও আছে। তারা অতিমাত্রায় উত্তরাধুনিক। কবিতাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন মহাশূন্যের দিকে। তারা কাঁড়ি কাঁড়ি কবিতা লিখলেও প্রবন্ধ, গদ্য লিখছেন না। বই পড়বার বেলায় পরিশ্রমী নন। প্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে মুদ্রিত বইয়ের পাঠকসংখ্যা যেখানে কমে যাচ্ছে, বইয়ের ভবিষ্যত্ নিয়ে দেখা দিয়েছে শঙ্কা, সেখানে শূন্যের কবিরা নতুন দশকের নামে কবিতাকে করে তুলছেন দুর্বোধ্য। তাতে কবিতাপ্রেমীদের কবিতার প্রতি অনুরাগ, আগ্রহে ভাটা পড়ছে।
কবিতার দশকওয়ারি বিভাজন ধরলে মেনে নিতে হবে, ভাবনাচিন্তার জগতেও বিভাজন আছে। সময়ই বিভাজনটা তৈরি করে। শূন্যের ভাবনাচিন্তা কি দাঁতভাঙানো শব্দে ঠাসা কবিতা লেখার? এ চিন্তা কি প্রবন্ধের বাইরে?
যে কোনো দশকের কবিতা সম্পর্কে একটা চিরকালীন সত্য আছে। সেটা হচ্ছে সমাজ, এমনকি সাহিত্যসমাজ নতুনকে সহজে মেনে নেয়নি। কবিতাও সমাজ মানে না। কবিতা সব সময়ই সমাজের অনুশাসন ভাঙার এক উষ্ণ শিস। সমাজ চির প্রচলিত প্রথা ধরে চলতে অভ্যস্ত। কবির সৃজনশীলতা, সমাজের ঐতিহ্য-চিরকালই পরস্পরবিরোধী। ইংরেজ কবি টিএস এলিয়ট ‘ট্র্যাডিশন অ্যান্ড দি ইন্ডিভিজুয়াল ট্যালেন্ট’ শিরোনামের প্রবন্ধে লিখে গেছেন ‘ঐতিহ্য চায় মানিয়ে চলা, সৃজনশীলতা চায় পরিবর্তন।’ পুরনো প্রথা ভাঙতে গেলেই সমাজপতি, অগ্রজদের পক্ষ থেকে রব উঠে চারপাশ থেকে ‘নবীন মূর্খরা এসব করছে কী!’ প্রশ্ন আসে, শূন্যের কবিরা সৃজনশীলতা দিয়ে কবিতায় কি পরিবর্তন ঘটাচ্ছেন? সমাজ কোথায় তার বিরুদ্ধ অবস্থান নিয়েছে? নানা দশকে নানা রকমের বিচারে কবিতার কতখানি বিবর্তন হলো, কীভাবে হয়েছে, সেসব অর্ধেক কিচ্ছা, অর্ধেক বানোয়াট কথাবার্তা দিয়ে আরেক ধরনের ‘সাহিত্য’ লেখা হয়। সে আরেক ভাওতাবাজি, ভণ্ডামির গল্প! এটাই সত্য, কবিতার বিবর্তনের বিচার এত অল্প সময়ে হয় না, হওয়ার নয়।
উত্তরসূরিদের অনুসরণের ধারাকে ভাঙার চেষ্টা করছেন শূন্যের কবিরা। তারা গত শতকের কবিদের চৈতন্যসার দ্বারা প্রভাবিত নয়। দেখা, জানার বিষয়গুলো ভিন্ন পয়েন্ট অব ভিউ থেকে নির্মাণের চেষ্টা করছেন। আগের দশকের ‘গডফাদার কবিদের’ (রাষ্ট্রীয় সব সাহিত্য পুরস্কার ছিনিয়ে নেবার ক্ষমতা যাদের নখদর্পণে থাকে) পা তারা চাটেন না। ফলে গডফাদার কবিরা সমাজপতিদের নিয়ে কবিতার ঐতিহ্য উদ্ধারে অভিযানে নেমেছেন। শূন্যের কবিদের চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করছেন। এটাই প্রমাণ করে শূন্যের কবিরা প্রথা ভাঙছেন। এদিকগুলো কারো চোখে না পড়লে আঙুল দিয়ে দেখাবার দরকার নেই। কেননা, জন্মান্ধ না হলেও একটা দশকের সঙ্গে আরেকটা দশক, একটা প্রজন্মের সঙ্গে আরেকটা প্রজন্মের কবিতাগত পার্থক্য দেখার আলো (জ্ঞান) তাদের নেই।
‘শূন্য দশকে যারা লিখছেন, অধিকাংশেরই জন্ম ১৯৮০ সাল বা এর কিছু আগে, পরে। সালের হিসেবে তাদের বয়স ত্রিশের কম বা বেশি। অথচ তাদের কবিতায় জীবনবোধ ফুটে উঠছে আশ্চর্যজনকভাবে। কবিতায় জীবনদর্শনে রয়েছে প্রগাঢ় অভিজ্ঞতার ছাপ, প্রকাশ ঘটছে রূঢ় বাস্তবতার। কবিতার শব্দ, শব্দের সংকেত, সীমানা, প্রয়োগ কৌশল অনেকেরই অসাধারণ। পাঠকের অভিযোগ, হৈচৈ, শূন্যতা, যৌনতায় ভরা প্রতীকী শব্দের এসব কবিতা বোঝা কঠিন। পাঠকের সঙ্গে কবিতাগুলোর যোগাযোগ গড়ে উঠছে না।
সদ্য শেষ হওয়া একুশে বইমেলায় দেখা গেছে, যত কবিতার বই এসেছে, তার বেশির ভাগই শূন্যের কবিদের। কিন্তু পাঠকপ্রিয়তা, বিক্রির বেলায় আল মাহমুদ, সৈয়দ শামসুল হক, নির্মলেন্দু গুণ, আসাদ চৌধুরী, আবদুল মান্নান সৈয়দ ও অন্য অগ্রজ কবির বই। শূন্যের কবিদের বই পাঠক সেভাবে টানেনি। এটাও সত্য, ওই অগ্রজ কবিরা যুগের পর যুগ ধরে নিমগ্ন সাধকের নিষ্ঠায় কবিতা লিখে আসছেন। পাঠকের কাছে তাদের অবস্থান এক দিনে এক দশকে তৈরি হয়নি। সমকালীনতা আর চিরকালীনতার মেলবন্ধনের প্রয়াসী কবি হিসেবে এক দিনেই তারা পাঠকের মনে শ্রদ্ধার আসনটি গ্রহণ করে ফেলেননি। শূন্যের কবিদের পাঠকগোষ্ঠী গড়ে উঠতে তাই সময় লাগবে, এখানে হাহাকারের কিছু নেই।
তাত্ত্বিকেরা যাই বলুক, কবিতাকে শেষ পর্যন্ত পাঠকের কাছে পৌঁছুতেই হবে। পাঠকই কবিতার গন্তব্য। সেজন্য পাঠকের অভিযোগ নিয়ে আলোচনা, পর্যালোচনা দরকার। কবিতার অলঙ্কার, ভাব, উপমা, উৎপ্রেক্ষা, শব্দের সীমানা কবির নিজস্ব বিষয়, তিনিই নির্মাণ স্তর ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণের খবর রাখবেন, এ যুক্তিতে শূন্যের কবিতাকে পাঠকবিমুখ করে রাখার মানে নেই। তাই বলে পাঠকের দিকে তাকিয়ে কবি লিখবেন, তাও নয়।
কবি কী লিখবেন, সেটা সুনির্দিষ্ট নয় বলেই লেখাটি কবিতা। কবিতা প্রতীকধর্মী হতেই পারে। সাধারণ পাঠকেরা একটা বিষয় যেভাবে দেখেন, কবিরা সেভাবে দেখেন না। একটি পাথরের টুকরো কেবল পাথরের টুকরো নয়, আরো অনেক কিছু হতে পারে। কাগজ চাপা দেয়ার বস্তু, ছোঁড়ার ঢিল, অণুপরমাণুর সমষ্টি হতে পারে। কবির শব্দ ব্যবহারের বেলায়ও তাই। প্রতীকী নানা মাত্রায় সাজানো সম্ভব কবিতায়। কবিতার প্রতীকী অর্থ পাঠক ধরবেন সৃজনীক্ষমতা দিয়ে। এ ক্ষমতার বিকাশ পাঠকের মাঝে ঘটে চর্চা করলে; চিন্তা, মনোযোগ, চেতনাকে স্বাধীনভাবে বিচরণ করতে দিলে।
এক দশকের কবিতার অর্থ পাঠকের কাছে প্রচার করার দায়ভার আগের দশকের উপর চাপিয়ে দেয়াটা যুক্তিহীন অভদ্রতা। তবুও চর্চা করা, বিচরণের সুযোগ, ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে পারেন নানা কারণেই অগ্রজ কবি, সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, বুদ্ধিজীবীরা। অনেকে সেটা করছেনও। তবে তাদের বেশির ভাগই ব্যস্ত রাজনৈতিক দলাদলিতে। তরুণদের সৃজনীক্ষমতা বিকাশে কাজ করার সময় তাদের নেই। সে জন্যও সৃজনশীল পাঠকের সংখ্যা বাড়ছে না। শূন্যের কবিদের বিরুদ্ধে এ ক্ষেত্রেও তাই অভিযোগের শক্ত যুক্তি দাঁড় করানো যায় না। প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে বই প্রকাশ করাটা সহজ হয়ে পড়েছে। যাচ্ছেতাই লিখেও অনেকেই কবিতার বই বের করে ফেলছেন। পাঠক তাতে বিভ্রান্ত হচ্ছেন শূন্যের কবিতা নিয়ে। ‘জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের মতো বই সংখ্যা নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতিও সেজন্য জরুরি’ (সৌজন্যে, মঈনুল আহসান সাবের)। পদ্ধতিটা আবিষ্কার, প্রণয়নের জন্য পাঠক মত তৈরির ক্ষমতা রাখেন অগ্রজরাই।
শূন্যের কবিদের বহুমাত্রিকতায় উপস্থিতি নেই। তারা যত কবিতা লিখছেন, তার সিকিভাগও প্রবন্ধ, উপন্যাস, মঞ্চনাটক, শিশুতোষ, ছড়া লিখছেন না। সৈয়দ শামসুল হক কবিতায় যেমন শক্তিশালী, তেমনি গল্প, উপন্যাস, মঞ্চনাটকেও। আল-মাহমুদ কবিতা, উপন্যাসে, বড় গল্পে সমান প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। আবদুল মান্নান সৈয়দ, ফরহাদ মজহার কবিতা, গল্প, প্রবন্ধে বহুমাত্রিক।
শূন্যের কবিরা বেশি আগ্রহী কবিতা লেখায়। সাহিত্যের অন্য শাখায় তাদের প্রজ্ঞাদীপ্ত বিচরণ দেখার জন্য পাঠককে হয়তো আরো অপেক্ষা করতে হবে। তবে তারা সাহসী। তাদের কবিতা বেড়ে উঠছে শহর, মফস্বল থেকে প্রকাশিত অসংখ্য ছোট কাগজের পাতায়। তারা স্বাধীন, স্বতঃস্ফূর্ত। পয়সাওয়ালা, পুঁজিপতিদের বড় কাগজে লেখা ছাপাবার জন্য ঘুরঘুর, তেলবাজি করেন না। তাদের কবিতা প্রাকৃতশিল্প নয়। মননশীল, সৃজনশীল নির্মাণেরই ফসল। নিজের গন্তব্য এক সময় কবিতাগুলোই খুঁজে নেবে। ইংরেজ কবি স্টিফেন স্পেন্ডার বলে গেছেন, ‘মহান কবিতা তার পক্ষেই লেখা সম্ভব, যিনি নিজের ক্ষমতাকেও ছাড়িয়ে যাবার চেষ্টা করেন।’ শূন্যের কবিরা তাই করছেন।
বি.দ্র. আমার এ লেখা একই শিরোনামে ২০১২ সালের ৭ মার্চে দৈনিক আমার দেশ'র সাহিত্য পাতায় ছাপা হয়। লেখাটির লিংক- amardeshonline.com/pages/weekly_news/2010/03/07/1253
হা.শা.
দৈনিক যায়যায়দিন
ভালোবাসা সড়ক,
তেজগাঁও, ঢাকা।
প্রসঙ্গ : শূন্যের কবি, কবিতার বিরুদ্ধে অভিযোগ
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
শ্রমিক সংঘ অটুট থাকুক
আপনারা যখন কাব্য চর্চায় ব্যস্ত
অধিক নিরস একটি বিষয় শান্তি ও যুদ্ধ নিয়ে
আমি তখন নিরেট অলস ব্যক্তি মেধাহীনতা নিয়ে
মে দিবসের কবিতা লিখি।
“শ্রমিকের জয় হোক, শ্রমিক ঐক্য অটুট থাকুক
দুনিয়ার মজদুর, এক হও,... ...বাকিটুকু পড়ুন
কিভাবে বুঝবেন ভুল নারীর পিছনে জীবন নষ্ট করছেন? - ফ্রি এটেনশন ও বেটা অরবিটাল এর আসল রহস্য
ফ্রি এটেনশন না দেয়া এবং বেটা অরবিটার
(ভার্সিটির দ্বিতীয়-চতুর্থ বর্ষের ছেলেরা যেসব প্রবলেম নিয়ে টেক্সট দেয়, তার মধ্যে এই সমস্যা খুব বেশী থাকে। গত বছর থেকে এখন পর্যন্ত কমসে কম... ...বাকিটুকু পড়ুন
প্রতিদিন একটি করে গল্প তৈরি হয়-৩৭
ছবি-মেয়ে ও পাশের জন আমার ভাই এর ছোট ছেলে। আমার মেয়ে যেখাবে যাবে যা করবে ভাইপোরও তাই করতে হবে।
এখন সবখানে শুধু গাছ নিয়ে আলোচনা। ট্রেনিং আসছি... ...বাকিটুকু পড়ুন
একাত্তরের এই দিনে
শহীদুল ইসলাম প্রামানিক
আজ মে মাসের এক তারিখ অর্থাৎ মে দিবস। ১৯৭১ সালের মে মাসের এই দিনটির কথা মনে পড়লে এখনো গা শিউরে উঠে। এই দিনে আমার গ্রামের... ...বাকিটুকু পড়ুন
হুজুররা প্রেমিক হলে বাংলাদেশ বদলে যাবে
তখন প্রথম বর্ষের ছাত্র। আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে আমাদের আরেক বন্ধুর জন্মদিনের উপহার কিনতে গেছি মৌচাক মার্কেটের পিছনে, আনারকলি মার্কেটের সামনের ক্রাফটের দোকানগুলোতে। একটা নারীর ভাস্কর্য দেখে আমার... ...বাকিটুকু পড়ুন