● যোসেফ স্টালিনের হাতঘড়ি খোয়া গেছে! সোভিয়েত ইউনিয়নের তিনি তখন রক্ষাকর্তা! খবরটা নি:সন্দেহে সাংঘাতিক! আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও তৎপর হয়ে ওঠেন। তারা মাত্র পাঁচ মিনিটের মধ্যে দশ-বারোজনকে গ্রেপ্তার করেন! ওই দশ-বারোজনই 'স্বীকার' করেন, ঘড়ি চুরির কথা! ঘড়ি একটি, অথচ দশ-বারোজন আইন শৃঙ্খলার লোকের কাছে আলাদা আলাদা স্বীকার করেন, তিনিই নাকি চুরি করেন! পরে অবশ্য জানা যায়, স্টালিনের ঘড়িটি আসলে চুরিই হয়নি, নিজের কক্ষেই আছে। ঘটনাটা সত্য নয়, স্টালিনের শাসনামল নিয়ে প্রচলিত হাস্যরসের গল্প।
স্টালিন আমলের আইনশৃঙ্খলার সদস্য আর এদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কতিপয় সদস্যের (সবাই নন) মধ্যে প্রায়ই পার্থক্য খোঁজে পান না বিশেষজ্ঞরা। এরকম সদস্যের কাছে 'রিমান্ড সেলে দেয়া স্বীকারোক্তির জবানবন্দি'র উপর ভিত্তি করে 'শেয়ারবাজার আদালত' পরিচালনা, 'তথ্য প্রযুক্তি আইন' বাস্তবায়ন করা প্রায় ক্ষেত্রে নাগরিকের মৌলিক অধিকার পরিপন্থী। অথচ তাই হচ্ছে। শেয়ার বাজার নিয়ে ফেসবুকে গুজব ছড়ানোর 'দায়ে' গত ৩ আগস্ট দুই বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয় একজনকে। এর আগে ফেসবুকে অপপ্রচারের 'দায়ে' আরো কয়েকজনের সাজা হয় তথ্য প্রযুক্তি আইনে।
দণ্ড পাওয়া ব্যক্তিরা প্রকৃত অর্থে দোষী হয়ে থাকলে রায়ের বিষয়ে সদ্য জন্ম নেয়া কোনো শিশুরও অভিযোগ থাকার কথা নয়। তবে যে প্রক্রিয়ায় কয়েকজনের সাজা হয়েছে (সবার নয়, কয়েকজনকে সাজা দেয়ার মানে তাদেরকে আইনের আওতায় আনা বা আইনের কার্যকারিতা প্রতিষ্ঠা), সেই প্রক্রিয়া নিয়ে নানা প্রশ্ন আছে। প্রশ্ন আসে, শেয়ার বাজারের হাজার কোটি টাকা লুটপাটের কথা বললেই কি 'অপপ্রচার' হয়ে যাবে? কারো রাজনৈতিক সমালোচনা করলেই তা রাষ্ট্রের কাছে 'অপরাধ' বলে গণ্য হবে? অভিযোগ ওঠেছে, শাসকশ্রেণির বিরুদ্ধে সামাজিক মাধ্যমগুলোতে 'অনাকাঙ্খিত সমালোচনা'র পথ বন্ধ করতেই আদালত গঠিত হয়েছে, আইনশৃঙ্খলার লোকেরা মাঠে নেমেছেন।
হ্যাঁ, ফেসবুকের অপব্যবহার হচ্ছে, উগ্রপন্থী, রাজনৈতিক গোষ্ঠী স্বার্থ হাসিলের জন্য ফেসবুকসহ অনলাইনে সামাজিক যোগাযোগের অন্য মাধ্যমগুলোকে ব্যবহার করছে। ধর্মান্ধরা ফেসবুক ও অনলাইনমাধ্যমকে ব্যবহার করছে ধর্মান্ধতা ছড়ানোর কাজে। কাজটা সবাই করছি না। অনেকে মত প্রকাশ করছি, চিন্তাগুলো বন্ধুদের কাছে তুলে ধরছি, ভাবনাগুলোর কথা বলছি। চিন্তা, মত প্রকাশ ও ভাবনার স্বাধীনতা আমাদের নিজস্ব, সংবিধান স্বীকৃত!
প্রায় সময় অনেকে ফেসবুক, ব্লগ, টুইটারে ব্যক্তিগত বিদ্বেষ তুলে ধরছি, বন্ধুকে আঘাত করছি। এগুলো অসামাজিক বটে, তবে রাষ্ট্রবিরোধী কাজ নয়। কারো বন্ধুর সঙ্গে তার খারাপ সম্পর্কের জন্য রাষ্ট্র তাকে শাস্তি দিতে পারে না। ভাইয়ের সঙ্গে ভাইয়ের অসামাজিক আচরণ, বেয়াদবির জন্য অভিযুক্ত ভাইকে রাষ্ট্র আইনের মুখোমুখি করতে পারে না। কষ্ট, যন্ত্রণা পেলে সাধারণ মানুষ প্রায় সময়ই তার সৃষ্টিকর্তার বিরুদ্ধেও অভিযোগ করে। আপনজনদের কাছ থেকে পাওয়া কষ্টগুলোর কথা মানুষ যুগ যুগ ধরেই সমাজের অন্যজন, পাশের জনদের কাছে বলে আসছে। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে যারা বলছেন, তারা তাই অন্যায় কিছু করছেন না নিশ্চয়ই!
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কাঠামোতে নাগরিকদের নানা মত প্রকাশ করার জন্য সব দরজা, জানালা খোলা থাকে। এজন্যই গণতন্ত্র এতো প্রত্যাশিত। আর সব দরজা, জানালা বন্ধ হয়ে গেলে মানুষের দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এরকম পরিস্থিতির মুখোমুখি হলে মুক্ত বাতাসে ফিরে আসার জন্য মানুষ দরজা, জানালা ভেঙে ফেলে। কথাটা যে কোনো রাষ্ট্রের শাসকশ্রেণির মনে রাখা দরকার। তাছাড়া অনলাইনে 'সরকার বিরোধী মত' দমন করে ডিজিটাল রাষ্ট্র হিসেবে দেশটাকে অনেক দূর এগিয়ে নেয়া সম্ভব হবে না। নানা মত প্রকাশের পথ খোলা রাখতে হবে। তবে যারা প্রকৃত দোষী, সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে অপপ্রচার, কুৎসা, উগ্রবাদ ছড়াচ্ছেন, তাদের বিচারের দাবি অবশ্যই জানাচ্ছি।
হা.শা.
দৈনিক যায়যায়দিন,
ঢাকা।●
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই আগস্ট, ২০১৫ বিকাল ৪:৫৩