somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নিলয়ের হাতে বিজয়ের চিহ্ন

১৪ ই আগস্ট, ২০১৫ দুপুর ১:২৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

●গত কয়েকদিন আমি যতবার খবরের কাগজের পৃষ্ঠা খুলেছি ততবার নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায় নিলয়ের হাসিমাখা মুখটির ছবি দেখে বুকের ভেতর এক ধরনের বেদনা অনুভব করেছি। তার পরিপূর্ণ একজন মানুষের পরিচয় ছিল। এখন তার একটিমাত্র পরিচয়, সেটি হচ্ছে ব্লগার। শুধু ব্লগার নয়, নৃশংসভাবে খুন হওয়া একজন ব্লগার। এই দেশে ব্লগার পরিচয়টি এখন একটি অভিশপ্ত পরিচয়। আমরা মোটামুটিভাবে ধরে নিয়েছি- যারা ব্লগার, আগে হোক পরে হোক ধর্মান্ধ মানুষের চাপাতির আঘাতে তাকে মারা যেতে হবে, রাষ্ট্রযন্ত্র তখন অন্যদিকে তাকিয়ে থাকবে, তাদের হত্যাকাণ্ড নিয়ে মুখ খুলবে না, কারণ এটি অতি ‘সংবেদনশীল’ একটি বিষয়।

ধর্মান্ধ মানুষেরা কথা দিয়েছিল, তারা প্রতি মাসে একজন করে হত্যা করবে। তারা তাদের কথা রেখে যাচ্ছে, মাঝে মাঝে এক মাসের জায়গায় হয়তো তিন মাস হয়েছে; কিন্তু নিয়মিতভাবে ব্লগার হত্যায় এতটুকু বিরতি পড়েনি। তারা আরও সাহসী হয়েছে, আরও বেপরোয়া হয়েছে। আগে বাসার বাইরে ঘাপটি মেরে থাকত, এখন তারা বাসা খুঁজে বের করে সেই বাসায় হাজির হয়। পাঁচতলা বাসায় পৃথিবীর নিষ্ঠুরতম হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে ঠাণ্ডা মাথায় সেখান থেকে বের হয়ে বাতাসে মিলিয়ে যায়।

পুলিশ আমাদের কথা দিয়েছিল, তারা হত্যাকারীদের ধরবে। সত্যি সত্যি রাজীব হত্যাকারীদের ধরে ফেলেছিল (আমরা অবাক হয়ে আবিষ্কার করেছিলাম, হত্যাকারীরা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের সচ্ছল পরিবারের সন্তান), তারপর কীভাবে জানি এ দেশের মানুষকে বোঝানো হল, ব্লগারমাত্রই ‘নাস্তিক,’ তখন থেকে হঠাৎ করে সবকিছু পাল্টে গেল, আর কোনো হত্যাকারী পুলিশের হাতে ধরা পড়ল না। শুধু পথচারীরা একবার নিজের প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে দুই জন হত্যাকারীকে ধরে ফেলেছিল। কিন্তু তারপর কী হল আমরা কিছু জানি না। ধর্মান্ধ জঙ্গি মানুষেরা নিয়মিতভাবে খুন করে যাবে কথা দিয়ে তাদের কথা রেখে যাচ্ছে; কিন্তু পুলিশ হত্যাকারীদের ধরে ফেলবে কথা দিয়েও কথা রাখতে পারছে না কিংবা কে জানে হত্যাকারীদের ধরে ফেলার বিষয়টিকে আর তত গুরুত্বপূর্ণ মনে করছে না।
নিলয়ের হত্যাকাণ্ডের পর থেকে আমি এক ধরনের অপরাধবোধে ভুগছি। দেশের অনেক গুরুত্বপূর্ণ মানুষের সঙ্গে সঙ্গে আমাকেও হত্যার হুমকি দেয়ার পর সরকার আমাকে চব্বিশ ঘণ্টা নিরাপত্তা দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এখন আমার সঙ্গে সার্বক্ষণিকভাবে কয়েকজন সশস্ত্র পুলিশ থাকে। আমি আমাকে নিরাপত্তা দেয়ার জন্য কারও কাছে অনুরোধ করিনি, সরকার নিজেই এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

নিলয় কিন্তু নিজের জীবনের নিরাপত্তার জন্য পুলিশের কাছে ছুটে গিয়েছিল, পুলিশ তাকে নিরাপত্তা দিতে রাজি হয়নি। শুধু যে নিরাপত্তা দিতে রাজি হয়নি তাই নয়, তাকে দেশ ছেড়ে চলে যেতে বলেছে। এ ঘটনাটির কথা এখন সারা পৃথিবীর মানুষ জানে। যে পুলিশ অফিসার নিলয়কে দেশ ছেড়ে চলে যেতে বলেছেন তিনি কি জানেন তার এ কথাটি দিয়ে তিনি আমার এই দেশটিকে সারা পৃথিবীর সামনে একটি ক্ষমতাহীন, দুর্বল, অসহায়, ভীত, কাপুরুষের দেশ হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন? কিংবা তার থেকেও ভয়ংকর কিছু, তিনি নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায়কে বুঝিয়ে দিয়েছেন, এই দেশ ‘গুরুত্বপূর্ণ’ মানুষকে নিজ থেকে রক্ষা করবে; কিন্তু সে গুরুত্বপূর্ণ নয়, সে গুরুত্বহীন তুচ্ছ একজন ‘ব্লগার’, তার জন্য এ দেশের বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই!
খবরের কাগজে দেখেছি পুলিশের পক্ষ থেকে এ বিষয়টিকে অস্বীকার করা হয়েছে। আমি অবশ্য এতে অবাক হইনি, এ দেশে কেউ কখনও দায়িত্ব নেয় না! পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের অকাট্য প্রমাণ দেয়ার পরও শিক্ষা মন্ত্রণালয় কখনও সেটি স্বীকার করেনি! একটা সমস্যা সমাধান করার প্রথম ধাপ হচ্ছে সমস্যাটা স্বীকার করে নেয়া, যদি এটি কখনও স্বীকার করা না হয় সেই সমস্যার সমাধান কখনও হবে না।

২.
এবারে ভিন্ন বিষয় নিয়ে একটু কথা বলি। আমার পরিচিত একজনের কাছে এ ঘটনাটা শুনেছি। বাংলাদেশ-সাউথ আফ্রিকার খেলা চলছে, সারা দেশের মানুষ রুদ্ধ নিঃশ্বাসে সেখানে সৌম্য সরকারের সেই অবিশ্বাস্য ব্যাটিং দেখছে। আমার পরিচিত মানুষটি সৌম্য সরকারের একটা ছক্কা কিংবা বাউন্ডারি দেখে আনন্দে হাততালি দিতেই গৃহকর্তা খেঁকিয়ে উঠলেন, ‘খালি সৌম্য সরকার আর লিটন দাস? হিন্দু প্লেয়ার ছাড়া আর কারও খেলা পছন্দ হয় না?’
ঘটনাটি শোনার পর প্রথমবার আমার খেয়াল হল আমাদের বাংলাদেশের ক্রিকেট টিমের এ বিস্ময়কর ব্যাটসম্যান ব্যক্তিগত জীবনে হিন্দু ধর্মাবলম্বী। এর আগে কখনোই আমার চোখে পড়েনি যে আমাদের ক্রিকেট টিমের কোনো কোনো প্লেয়ার মুসলমান এবং কোনো কোনো প্লেয়ার হিন্দু। আমার সবচেয়ে বড় আনন্দ ছিল যে, ভারতবর্ষের এত বিখ্যাত ক্রিকেট টিমে একজন বাঙালি প্লেয়ার নেই, আর আমাদের দেশের ক্রিকেট টিমের সবাই বাঙালি! আমার পরিচিত মানুষের ঘটনাটি শুনে লজ্জায় আমার মাথা কাটা যাওয়ার অবস্থা যে, আমাদের দেশে এরকম মানুষ আছে যার কাছে একজন অসাধারণ ক্রিকেট প্লেয়ারের খেলার দক্ষতাটির কোনো গুরুত্ব নেই, কারণ তার ধর্মটি ভিন্ন। তার চেয়ে বড় কথা, এ মানুষটি তার এই কুৎসিত সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িক রূপটি দশজনের সামনে প্রকাশ করতে লজ্জাবোধ করে না। এ দেশে এরকম মানুষ কতজন আছে? তাদের সংখ্যা কি বাড়ছে? তাদের সাহসও কি বাড়ছে?
এ ঘটনাটি শোনার পর আমি আমার ভিন্ন ধর্মাবলম্বী সহকর্মীদের সঙ্গে কথা বলেছি এবং তাদের সবাই আমাকে বলেছে, তাদের জীবনে তারা সবাই কখনও না কখনও এমন সাম্প্রদায়িক অসম্মানের শিকার হয়েছে। শুধু তাই নয়, তারা বলেছে, বিষয়টা শুরু হয়েছে আশির দশক থেকে এবং যত সময় যাচ্ছে সেটি বাড়ছে। একসময় আমরা সবাই বাংলাদেশের মানুষ ছিলাম, এখন কীভাবে জানি আমাদের কেউ কেউ মুসলমান এবং বাকিরা ‘বিধর্মী’! এটি আমরা কেমন করে হতে দিলাম?

তার থেকেও ভয়ানক ব্যাপার আছে। যখনই একজন ব্লগারকে হত্যা করা হয়েছে, তখন আমাদের খুব কাছের মানুষরা, যাদের সঙ্গে আমরা ওঠাবসা করি তারা মাথা নেড়ে বলেছে, ‘না, না, কাজটা ঠিক হয়নি। কিন্তু-’। তারপরই তারা বুঝিয়ে দিয়েছে, যেটা ঘটেছে সম্ভবত তার একটা যৌক্তিক কারণ আছে। এক অর্থে হত্যাকাণ্ডটি তারা মেনে নিয়েছে।

একসময় শুধু মুসলমান-হিন্দু ছিল। এরপর হঠাৎ করে ‘মুরতাদ’ নামে একটা শব্দ খুব শোনা যেতে থাকল। আজকাল নাস্তিক শব্দটি খুব ব্যবহার করা হচ্ছে। একজন মানুষ যদি নিজে নিজেকে নাস্তিক দাবি না করে, বাইরে থেকে অন্যেরা তাকে কোনোভাবেই নাস্তিক বলতে পারার কথা নয়। কিন্তু এখন একজন মানুষকে প্রথমে টার্গেট করা হয়, তারপর তাকে ‘নাস্তিক’ বলে প্রচারণা শুরু করে দেয়া হয়। একজন মানুষকে ‘নাস্তিক’ হিসেবে মোটামুটিভাবে দাঁড় করিয়ে দিতে পারলে আসলে তাকে হত্যা করার একটা গণলাইসেন্স দিয়ে দেয়া হয়। শেষ পর্যন্ত যখন তাকে সত্যি সত্যি হত্যা করে ফেলা হবে তখন মানুষজন মাথা নেড়ে বলবে, ‘না, না, কাজটা ঠিক হল না। কিন্তু-’। এই একটা ‘কিন্তু’ শব্দ উচ্চারণ করে নাস্তিককে হত্যা করা যে তার জীবনের স্বাভাবিক পরিণতি সেটি তারা খুব সহজভাবে মেনে নেবে।

যাদের ওপর ‘নাস্তিক’ অপবাদ দেয়া হয়, তারা সাবই কি নাস্তিক? তার কি কোনো প্রমাণ আছে? একজন মানুষ যদি একটু যুক্তিবাদী হয়, একটু বিজ্ঞানমনস্ক হয়, একটু মুক্তচিন্তা করে, তাহলেই কি তার পিঠে নাস্তিক ছাপ দেয়া হয়? না, এ দেশে একজন মানুষের পিঠে ‘নাস্তিক’ ছাপ দেয়া হয় যদি সে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষ হয়। আরও স্পষ্ট করে বলা যায়, যদি তারা যুদ্ধাপরাধীর বিচারের দাবিতে সোচ্চার হয়। সবাই কি লক্ষ করেছে ব্লগার হিসেবে যাদের হত্যা করা হচ্ছে, তারা সবাই কোনো না কোনোভাবে যুদ্ধাপরাধীর বিচারের দাবি করে লেখালেখি করেছে কিংবা গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনে অংশ নিয়েছে? এই হত্যাকাণ্ড আসলে একাত্তরের বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের একটি নতুন রূপ!

বিষয়টি আমার থেকে ভালো করে কেউ জানে না, কারণ আমি নিজের চোখে আমাকে নিয়ে এ প্রক্রিয়াটি করতে দেখেছি। আমি এখন পর্যন্ত প্রায় ১৭০টি বই লিখেছি, প্রায় প্রতি সপ্তাহে কোথাও না কোথাও আমি কিছু লিখছি, অসংখ্যবার টেলিভিশনে বক্তব্য দিতে হয়েছে, সভা-সমিতিতে বক্তৃতা দিয়েছি, বাচ্চাদের স্কুলে কথা বলেছি, কেউ দেখাতে পারবে না যে আমি আমাদের নিজের ধর্ম কিংবা অন্য কোনো ধর্মকে নিয়ে কখনও বিন্দুমাত্র অসম্মানজনক একটি কথা বলেছি! কেন বলব? আমার বাবা-মা পৃথিবীর সবচেয়ে ধর্মপ্রাণ এবং সবচেয়ে সেকুলার মানুষ ছিলেন। তাদের কাছ থেকে কখনোই কোনো ধর্মকে অবজ্ঞা করা শিখিনি। কিন্তু তারপরও খুবই গুছিয়ে এবং পরিকল্পনা করে আমার নামের সঙ্গে ‘নাস্তিক’ শব্দটি জুড়ে দেয়ার কাজ চলছে। আমার ছাত্র ও সহকর্মীদের প্রধান একটি কাজ আমার নামে তৈরি করা ভুয়া ফেসবুক কিংবা অন্য অ্যাকাউন্টগুলো বন্ধ করার ব্যবস্থা করা। সর্বশেষ যে অ্যাকাউন্টটি বন্ধ করা হয়েছে সেটি ছিল ‘নাস্তিক জাফর ইকবাল’! বিষয়টি কী পর্যায়ে গিয়েছে তার একটা উদাহরণ দিই। একটি চোখের হাসপাতালে আমার হঠাৎ করে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ অলরাউন্ডার ক্রিকেটার সাকিবের সঙ্গে দেখা। বাচ্চাকাচ্চাদের জন্য লেখালেখি করি বলে বইমেলায় বাচ্চাকাচ্চারা রীতিমতো হুড়োহুড়ি করে আমার অটোগ্রাফ নেয়। এর আগেরবার একটা পুরস্কার দেয়ার অনুষ্ঠানে সাকিবের সঙ্গে যখন আমার দেখা হয়েছিল, আমি বাচ্চাদের মতো হুড়োহুড়ি করে তার অটোগ্রাফ নিয়েছি, তার সঙ্গে ছবি তুলেছি। ফটোগ্রাফারকে বলেছি, সে যেন অবশ্যই সেই ছবি আমাকে পাঠায়! ফটোগ্রাফার আমাকে কখনও সেই ছবি পাঠায়নি, আমি সাকিবকে সেটা জানানো মাত্র সে আমাকে বলল, ‘স্যার, আমি এখনই আপনার সঙ্গে ছবি তুলে সেটা আপনাকে ই-মেইল করে দিচ্ছি!’ সত্যি সত্যি পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ একজন ক্রিকেট প্লেয়ার নিজের হাতে আমাদের ছবিটি আমাকে ই-মেইল করে দিল, সেই আনন্দে ও অহংকারে এখনও আমার মাটিতে পা পড়ে না। কয়দিন পর আমি খবর পেলাম সাকিব আমাদের সেই ছবিটি তার ফেসবুকে আপলোড করেছে। সেখানে অনেক ধরনের মন্তব্য পড়েছে, তার মাঝে একটা মন্তব্য এরকম- ‘সাকিব ভাই, আপনাকে তো আমি ভালো মানুষ বলেই জানতাম; কিন্তু আপনিও শেষ পর্যন্ত একজন নাস্তিকের সঙ্গে ছবি তুললেন!’ শুনে আমি হাসব না কাঁদব বুঝতে পারি না।

তবে যে ঘটনাটা শুনে নিশ্চিতভাবে আমি জানি যে এটা মোটেও হাসির ঘটনা নয় সেটা এসেছে একটা বাচ্চা মেয়ের কাছ থেকে। সে আমাকে চিঠি লিখেছে, আমি তার চিঠির উত্তর দিয়েছি। মেয়েটি সেই চিঠি পেয়ে খুব খুশি, ক্লাসে নিয়ে গেছে তার বন্ধুদের দেখানোর জন্য। একজন শিক্ষক হঠাৎ করে সেটা জেনে মেয়েটির ওপর ভয়ানক খেপে উঠলেন, তাকে গালিগালাজ করে বললেন, ‘তোর এত বড় সাহস? তুই একজন নাস্তিকের হাতে লেখা চিঠি ক্লাসে নিয়ে এসেছিস?’ বাচ্চা মেয়েটি দুর্বলভাবে তার মতো করে আমার পক্ষে একটু কথা বলার চেষ্টা করতেই সেই শিক্ষক তাকে ক্লাস থেকেই বের করে দিলেন!
আমার জন্য এটি মোটেও নতুন কোনো ব্যাপার নয়। আমার চামড়া অনেক মোটা, তাই এগুলো গায়ে মাখি না। কিন্তু এ দেশের যে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা আমার জন্য একটুখানি ভালোবাসা প্রকাশ করতে গিয়ে নিগৃহীত হয় তাদের জন্য খুব মায়া হয়। এটি কি আমার দেশ?

আমি ‘নাস্তিক’ সেই কথাটি আমি অসংখ্যবার শুনেছি; কিন্তু আমি কেন ‘নাস্তিক’ সেই কথাটি আমি কখনও কোথাও দেখিনি। শেষ পর্যন্ত আমার সেটি দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। আমি আমস্টারডামে বসে একদিন কম্পিউটারে বাংলাদেশের খবর দেখছি। হঠাৎ খবরের হেডলাইন দেখে চমকে উঠলাম। ঢাকার প্রেস ক্লাবের সামনে আমার বিরুদ্ধে মানববন্ধন। মানববন্ধন করছে আওয়ামী ওলামা লীগ। তাদের বক্তব্য অত্যন্ত পরিষ্কার- ‘প্রধানমন্ত্রীর ছেলে জয় নাস্তিকদের বিরুদ্ধে, জাফর ইকবাল জয়ের বিরুদ্ধে। কাজেই জাফর ইকবাল নাস্তিক।’ যুক্তির সারল্য আমাকে মুগ্ধ করেছিল- যারা জানেন না তাদের জন্য বলছি, প্রধানমন্ত্রীর ছেলে রয়টার্সের সঙ্গে একটা সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ব্লগারদের হত্যাকাণ্ড নিয়ে প্রধানমন্ত্রী প্রকাশ্যে কোনো মন্তব্য করতে পারবেন না। আমাদের ছাত্র অনন্তকে হত্যা করার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা প্রতিবাদ সভায় আমি এ বক্তব্যটির প্রতিবাদ করেছিলাম।

যা হোক, আমি যতদূর জানি আওয়ামী ওলামা লীগ আওয়ামী লীগের অনুসারী বা তাদের একটা অঙ্গসংগঠন। তাদের বক্তব্য নিশ্চয়ই আওয়ামী লীগেরই বক্তব্য। কাজেই যখন দেখতে পাই তারাও জামায়াত-শিবিরের পথ ধরে আমাকে ‘নাস্তিক’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার কাজে লেগে গেছে তখন আমি একটু চমকে উঠি। এ ব্যাপারে সবচেয়ে লাগসই মন্তব্য করেছে বিদেশে পিএইচডি করছে এরকম আমার একজন সাবেক ছাত্র এবং বর্তমান সহকর্মী। তার ভাষায় আমি বাংলাদেশের একমাত্র মানুষ যে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, হেফাজতে ইসলাম থেকে শুরু করে কমিউনিস্ট পার্টি, ওয়ার্কার্স পার্টি, জাতীয় পার্টি, এমনকি আওয়ামী লীগ পর্যন্ত সবাইকে নিজের বিরুদ্ধে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছি! এমনটি আর কেউ পারেনি।

বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ নামে একটা অসাধারণ বই রয়েছে। যারা এ বইটা পড়েছে তারা সবাই জানে বঙ্গবন্ধু কীভাবে আওয়ামী লীগ নামের দলটির নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি সরিয়ে সেটিকে একটি সেকুলার রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগে পাল্টে দিয়েছিলেন। তাই এখন যখন দেখি সেই দলটির কেউ কেউ রাজনীতিতে ধর্মকে ব্যবহার করার চেষ্টা করছেন তখন আমি একটু হতাশা অনুভব করি। তবে আমি একটি বিষয় সব সময়ই স্পষ্ট করে বলতে চাই। পঞ্চাশের দশকে বঙ্গবন্ধু যে সাহস দেখিয়েছিলেন, তার কন্যা শেখ হাসিনা এ সময়ে এই দেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার প্রক্রিয়া শুরু করে একই রকম কিংবা তার থেকেও বেশি সাহস দেখিয়েছেন। আজ থেকে দশ বছর আগেও আমরা কেউ কল্পনা করিনি যে, এ দেশের মাটিতে সত্যি সত্যি একদিন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবে। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে নেতৃত্ব দেয়ার গৌরব যেরকম কেউ বঙ্গবন্ধু, তাজউদ্দীন এবং তাদের দল আওয়ামী লীগের কাছ থেকে কেড়ে নিতে পারবে না, ঠিক সেরকম এ সময়ে এই দেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে দেশকে গ্লানিমুক্ত করার গৌরবটুকুও কেউ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার সরকারের কাছ থেকে কেড়ে নিতে পারবে না। আওয়ামী লীগ এবং তার সরকারের অসংখ্য সীমাবদ্ধতা নিয়ে আমরা যত সমালোচনাই করি না কেন, যুদ্ধাপরাধীর বিচার করার জন্য তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানোর ভাষা আমার জানা নেই।

৩.
আমি যখন এই লেখাটা লিখছি, ঠিক তখন আমার একজন সহকর্মী আমাকে নিলয়ের একটা ছবি পাঠিয়েছে। নিলয়, তার স্ত্রী এবং গণজাগরণ মঞ্চের আরও এক-দুইজন কর্মীর সঙ্গে আমি এবং আমার স্ত্রী দাঁড়িয়ে আছি। ছবিটি বিজয় দিবসে তোলা, তাই আমরা সবাই দুই আঙুলে ভি সাইন তৈরি করে বিজয় দিবসকে স্বাগত জানাচ্ছি। নিলয়ের মুখে তার সেই মধুর হাসি। আমি দীর্ঘ সময় ছবিটির দিকে তাকিয়েছিলাম, একজন পরিপূর্ণ মানুষ হঠাৎ কেমন করে শুধু একটা ছবি হয়ে যায়, আমি তার হিসাব মেলাতে পারি না।

আমরা সম্ভবত এখন একটা খুব দুঃসময়ের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি। দেশকে ভালোবাসার অপরাধে ধর্মের দোহাই দিয়ে একজন একজন করে তরুণকে হত্যা করা হচ্ছে, সেটি যে কোনো হিসেবে খুব ভয়ংকর একটা বিষয়। তার থেকেও ভয়ংকর হচ্ছে, আশ্চর্য একটা নির্লিপ্ততা দিয়ে এ পুরো ব্যাপারটিকে মেনে নেয়া। চারপাশের এই অশুভ নির্লিপ্ততা থেকে দেশের মানুষকে বের করে আনার সময় হয়েছে। তা না হলে এ দেশটিই অর্থহীন হয়ে যাবে।
সবার নিশ্চয়ই মনে আছে, যুদ্ধাপরাধীর বিচারে সঠিক রায় হয়নি বলে কয়েকজনের ক্ষুব্ধ প্রতিবাদ থেকে শাহবাগে লাখ লাখ তরুণের একটা গণজাগরণ হয়েছিল, যেটি দেখতে দেখতে শুধু সারা দেশে নয়, সারা পৃথিবীর সব বাঙালির মাঝে ছড়িয়ে পড়েছিল। এরপর ঘটনাচক্রে যা-ই ঘটে থাকুক না কেন, সেই গণজাগরণের পর থেকে বাংলাদেশের ইতিহাসটুকু যে চিরদিনের জন্য পরিবর্তিত হয়ে গেছে, কেউ সেই সত্যিটুকু অস্বীকার করতে পারবে না। আমরা এখন সবাই জানি এ দেশের লক্ষ কোটি তরুণ আসলে বাংলাদেশকে এবং মুক্তিযুদ্ধকে বুকের মাঝে ধারণ করে। তারা শিক্ষিত, তারা অসাম্প্রদায়িক, তারা আধুনিক, তারা দেশপ্রেমিক এবং তারা সাহসী। সবচেয়ে বড় কথা, যখন প্রয়োজন হয় তারা পথে নামতে ভয় পায় না। আমরা তাদের একবার পথে নামতে দেখেছি; তাই আমরা নিশ্চিতভাবে জানি, প্রয়োজন হলে তারা আবার পথে নামবে।

আমি আমাদের দেশের সেই তরুণদের কাছে আবার ফিরে যেতে চাই, তাদের অনুরোধ করে বলতে চাই, তোমরা আমাদের স্বপ্নের বাংলাদেশকে ফিরিয়ে দাও। মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের যে দেশ দিয়েছিল, সেই দেশ নিলয়ের হত্যাকারীদের নয়। সেই দেশ আমাদের। আমরা যদি হত্যাকারীদের হাত থেকে দেশকে মুক্ত করে না আনি তাহলে মুক্তিযোদ্ধাদের রক্তের ঋণ শোধ হবে না। বিজয় দিবসে নিলয় হাতে ভি-সাইন তৈরি করে হাতটি উঁচু করে ধরে রেখেছিল। নিলয় নেই, শুধু তার হাতের বিজয় চিহ্নটি আছে। সেই বিজয়ের চিহ্নটি দিয়ে যে কোনো মূল্যে বাংলাদেশের স্বপ্নটি আমাদের ধরে রাখতে হবে।
প্রিয় নিলয়, তুমি তোমার হাতে বিজয়ের চিহ্নটি ধরে রেখে যে বাংলাদেশের বিজয়ের স্বপ্ন দেখেছ, এ দেশের তরুণদের নিয়ে আমরা নিশ্চয়ই সেই বাংলাদেশের সেই বিজয় ছিনিয়ে আনব। আনবই আনব।

... লেখাটি প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ, নন্দিত কথাসাহিত্যিক শ্রদ্ধেয় মুহাম্মদ জাফর ইকবাল স্যারের। আজকের দৈনিক যুগান্তরে প্রকাশিত।

সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই আগস্ট, ২০১৫ দুপুর ১:২৭
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শ্রমিক সংঘ অটুট থাকুক

লিখেছেন হীসান হক, ০১ লা মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪৮

আপনারা যখন কাব্য চর্চায় ব্যস্ত
অধিক নিরস একটি বিষয় শান্তি ও যুদ্ধ নিয়ে
আমি তখন নিরেট অলস ব্যক্তি মেধাহীনতা নিয়ে
মে দিবসের কবিতা লিখি।

“শ্রমিকের জয় হোক, শ্রমিক ঐক্য অটুট থাকুক
দুনিয়ার মজদুর, এক হও,... ...বাকিটুকু পড়ুন

কিভাবে বুঝবেন ভুল নারীর পিছনে জীবন নষ্ট করছেন? - ফ্রি এটেনশন ও বেটা অরবিটাল এর আসল রহস্য

লিখেছেন সাজ্জাদ হোসেন বাংলাদেশ, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৪

ফ্রি এটেনশন না দেয়া এবং বেটা অরবিটার


(ভার্সিটির দ্বিতীয়-চতুর্থ বর্ষের ছেলেরা যেসব প্রবলেম নিয়ে টেক্সট দেয়, তার মধ্যে এই সমস্যা খুব বেশী থাকে। গত বছর থেকে এখন পর্যন্ত কমসে কম... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রতিদিন একটি করে গল্প তৈরি হয়-৩৭

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৫১




ছবি-মেয়ে ও পাশের জন আমার ভাই এর ছোট ছেলে। আমার মেয়ে যেখাবে যাবে যা করবে ভাইপোরও তাই করতে হবে।


এখন সবখানে শুধু গাছ নিয়ে আলোচনা। ট্রেনিং আসছি... ...বাকিটুকু পড়ুন

একাত্তরের এই দিনে

লিখেছেন প্রামানিক, ০১ লা মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৬


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

আজ মে মাসের এক তারিখ অর্থাৎ মে দিবস। ১৯৭১ সালের মে মাসের এই দিনটির কথা মনে পড়লে এখনো গা শিউরে উঠে। এই দিনে আমার গ্রামের... ...বাকিটুকু পড়ুন

হুজুররা প্রেমিক হলে বাংলাদেশ বদলে যাবে

লিখেছেন মিশু মিলন, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ৯:২০



তখন প্রথম বর্ষের ছাত্র। আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে আমাদের আরেক বন্ধুর জন্মদিনের উপহার কিনতে গেছি মৌচাক মার্কেটের পিছনে, আনারকলি মার্কেটের সামনের ক্রাফটের দোকানগুলোতে। একটা নারীর ভাস্কর্য দেখে আমার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×