●সমকামিতার প্রতীকে কাবাঘরের ছবি বিকৃত করে নিজের ফেসবুক ওয়াল থেকে তা শেয়ার করেছেন এক ব্লগার! আজ সকালে বেসরকারি চ্যানেল একাত্তর টিভিতে প্রচারিত অনুষ্ঠানে তথ্যটা জানান র্যাবের মহাপরিচালক, শ্রদ্ধেয় বেনজীর আহমেদ। তিনি ওই ব্লগারের নাম পরিচয়সহ তাঁর বর্তমান অবস্থানের কথাও জানান দর্শকদেরকে। মুক্তমনা ব্লগারদের একের পর এক হত্যার ঘটনা যেখানে চলছে, ব্লগাররা যখন শোয়ার ঘরেও নিরাপদ নন, সেখানে র্যাবের মতো সংস্থার প্রধানের আলোচ্য ব্লগারের অবস্থান, তাঁর নাম এভাবে প্রকাশ্যে প্রকাশ করাটা কতোটা যুক্তিসঙ্গত, এ প্রশ্ন অনেকেই সামনে আনবেন।
ধর্মবিশারদরা মনে করেন, কাবার গিলাফ বদলানোর ছবিকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধের দাবিতে সৌদির ইমামদের মানববন্ধন বলে চালানো যেমন অন্যায়, তেমনি কাবার বিকৃত ছবি প্রকাশ, প্রচারও সমর্থন করা যায় না। এটাকে মুক্তচিন্তা প্রকাশের আওতায় আনতেও তাঁরা নারাজ। ওই ব্লগার সজ্ঞানে এরকম ছবি দেয়ারই বা কারণ কি? এসব ছবি তো এখন কথিত ধর্মওয়ালাদের পক্ষে কথা বলার জন্য মৌলবাদীদের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর 'যুক্তি' হিসেবেও ব্যবহৃত হচ্ছে। যদিও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যর্থতায় একের পর এক ব্লগার হত্যাকাণ্ড ঘটতে থাকায় তা ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র বাংলাদেশের মৌলিক চরিত্রে আঘাত করছে।
ধর্ম সম্পর্কে প্রচলিত ভুল বিশ্বাসের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে সত্যটুকু তুলে ধরা আর এর বিকৃতি ঘটিয়ে বিশ্বাসীদের মনে আঘাত দেয়া এক বিষয় নয়। যেমন, বিজ্ঞানের যুগেও ধর্ম সম্পর্কে সমাজে প্রচলিত থাকা মূর্খতাযুক্ত ধারণাগুলোর বিরুদ্ধে কথা বলাটা নাস্তিকতা নয়। তাই ওই ব্লগারের আলোচ্য ছবিটির দিকে প্রগতিশীলদের সমর্থন নেই। তবে একাত্তর টিভির আজকের ওই অনুষ্ঠানের অন্য অতিথি আইনমন্ত্রী, শ্রদ্ধেয় আনিসুল হক দাবি করেন- 'ব্লগারদের নামে ভুয়া আইডি থেকে জামায়াত, শিবির, ধর্মান্ধরা ধর্ম সম্পর্কে অবমাননাকর ছবি দিচ্ছে, মন্তব্য প্রকাশ করছে। এটা গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ'।
তরুণ বয়সে ক্রিস্টোফার কলম্বাস আমেরিকা আবিষ্কার করতে গিয়ে নানা রাষ্ট্রের নারীদের সঙ্গে যৌনতায় লিপ্ত হন। এভাবে যৌনাচারের ফলে এক পর্যায়ে তিনি কঠিণ রোগে আক্রান্ত হন। একই সময় আরেকজন কলম্বাসের মতো একই রোগে আক্রান্ত হন। তাঁর নাম ছিল সিফিলিস। তিনি ধর্ম বিশ্বাস করতেন না। ব্যস, ধর্ম বিষয়ে সুবিধাবাদীরা রোগটিরই নামকরণ করে ফেলেন সিফিলিসের নামে! রোগটির নাম হয়- 'সিফিলিস'। ধর্ম বিশ্বাসী হওয়ায় কলম্বাস বেঁচে যান 'অপবাদ' থেকে। ধর্মে অবিশ্বাসী হলে কলম্বাসের নামেই হতো আজকের সিলিফিস রোগটির নাম হতো কী না, সেটাই বা কে বলতে পারেন! ইতিহাসের পাতার এ ঘটনা থেকে আমরা পরিষ্কার, ধর্মের নাম ভাঙ্গিয়ে নানা কিছু করার একটা গোষ্ঠী বিভিন্ন রাষ্ট্রেই আছে!
বোধ-বুদ্ধি হওয়ার পর মা যাকে দেখিয়ে বলেন, তিনি তোমার বাবা, সন্তান তাকেই মেনে নেয়। এখানে সন্তান কোনো স্বাক্ষী আছে কী না, তা জানার কথা বলে না। এমনকি পাশ্চাত্যের কোনো রাষ্ট্রের সন্তানও মায়ের কথায় অবিশ্বাস করে জন্মদাতার বিষয়ে নিশ্চিত হতে আজ পর্যন্ত ডিএনএ পরীক্ষা করিয়েছেন বলে কোনো ঘটনা আমাদের জানা নেই। সন্তান যেমন মাকে কোনো প্রশ্ন ছাড়াই জন্মদাতাকে মেনে নেন, তেমনি ধর্মের অনেক বিষয়ও বিশ্বাসীরা যুক্তি ছাড়াই মেনে নেন। তবে ধর্মের সব বিষয়ই যুক্তির বাইরে নয়। কেননা, বিভিন্ন ধর্ম বিভিন্ন রাষ্ট্রের ধর্ম ব্যবসায়ীদের কবলে পড়ে বিকৃত হয়েছে, হচ্ছে।
প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ'র 'লালসালু' ধর্মের বিপক্ষে নয়, ধর্ম ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে। প্রখ্যাত ভাষাবিদ ড. হুমায়ুন আজাদ স্যারের 'পাক সার জমিন সাদ বাদ'র গল্পটা দাঁড়ানো ক্ষমতায় গিয়ে জামায়াত, শিবিরের সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিষয়ে। জামায়াত, শিবির মানে ইসলাম ধর্ম হতে পারে না। তাই তাঁর উপন্যাসটি ধর্মের বিপক্ষে নয়। একাত্তরে যুদ্বাপরাধীরা 'যুদ্ধের সময় হিন্দু মেয়েদের ধর্ষণ জায়েজ' বলে যে ফতোয়া দেয়, তা নিশ্চয়ই ধর্মের কোথাও উল্লেখ নেই। বিষয়টি নিয়ে কথা বললে ধর্মদ্রোহীতা হয় না।
প্রখ্যাত কবি, শ্রদ্ধেয় আসাদ চৌধুরীর 'বারবারা বিডলারকে' কবিতার কয়েকটা লাইন এরকম- 'সাধু অ্যাবের মর্মর মূর্তিকে গণতন্ত্র আর মানবতার জন্য/মালির ঘামে ভেজা ফুলের তোড়া দিও না/নিহত লোকটি লজ্জায় ঘৃণায় আবার আত্মহত্যা করবে।' তাঁর কবিতার লাইনগুলো এখানে উল্লেখের কারণ হচ্ছে- ব্লগারদের বিরুদ্ধে একটি শ্রেণি থেকে তথাকথিত নাস্তিকতার যে অভিযোগ দেয়া হচ্ছে, তাতে নিহত ব্লগারদের আত্মা লজ্জা, ঘৃণায় 'আত্মহত্যা' করারই কথা। ব্লগার মানেই 'নাস্তিক' নন। মন্দির, মসজিদ, গির্জা, প্যাগোডায় প্রার্থনা শেষ করে ব্লগে বসেন, এমন বেশ কয়েক ব্লগারকে ব্যক্তিগতভাবে চিনি, জানি।
ধর্ম হচ্ছে, স্রষ্টার সঙ্গে সৃষ্টির সম্পর্কের সেতু। কোন সৃষ্টি তাঁর স্রষ্টার সঙ্গে সম্পর্ক রাখলেন, কী রাখলেন না, এটা দেখভালের জন্য স্রষ্টা কারো ঘাড়ে 'দায়িত্ব' চাপিয়ে দেননি। তাই 'নাস্তিকদের' হত্যার বিষয়টি নিঃসন্দেহে মধ্যযুগীয় নৃশংসতা, বর্বরতা। এসব হত্যাকাণ্ডের মধ্যে ধর্ম প্রতিষ্ঠার কোনো উদ্দেশ্য নেই। বর্বরতা থামাতে রাষ্ট্রকে 'কার্যকর তৎপর' হয়ে মত প্রকাশের সব জানালা খোলা থাকার নিশ্চয়তা নিশ্চিত করতে হবে সব নাগরিকের। কেউ অবিশ্বাসী হতে পারেন! তাই বলে ওই অবিশ্বাসীর এমন কিছু করা উচিত নয়, যা প্রকৃত বিশ্বাসীদের মনে আঘাত করে।
আরেকটি বিষয়, ব্লগার নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায় হত্যায় জড়িত সন্দেহে গ্রেপ্তার হওয়া সাদ আল নাহিয়ান শ্রম প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হকের ভাতিজা। ব্লগার আসিফ মহিউদ্দীনের ওপর হামলার ঘটনায় নাহিয়ানকে এর আগে গ্রেপ্তার করা হয়। তিনি শ্রম প্রতিমন্ত্রীর ভাতিজা হওয়ায় যাঁরা নীলাদ্রি হত্যাকাণ্ডের বিচারের জোরালো কণ্ঠ থামিয়ে দিয়েছেন, তাঁরা এতোদিন পরিপূর্ণ নৈতিক অবস্থান থেকে এ হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবি জানাননি।
হা.শা.
দৈনিক যায়যায়দিন,
ভালোবাসা সড়ক,
তেজগাঁও, ঢাকা।●
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই আগস্ট, ২০১৫ বিকাল ৫:২৭