●দহগ্রাম-আঙ্গরপোতার জীবনধারা নিয়ে নাটক লেখায় উৎসাহ আমার কম জানতে পেরে অনুরোধকারী পাঠক গ্রামীণ জীবন, বিশেষত কৃষক সমাজের ওপর অন্তত একটি কলাম লিখতে বলেন আমাকে। প্রথমত, আমরা যারা শহরে থাকি, কৃষক সমাজের ওপর তাদের ধারণা সুপারফিসিয়াল, ভাসাভাসা। এমন শিশু-কিশোরের সংখ্যা অনেক, যারা এখনও ধান দেখেনি। অথচ এই ধানই হচ্ছে চালের আদিরূপ, যেমন কৃষকের মুরগি হল চাইনিজের চিকেন ফ্রাইয়ের আদি রূপ। দেয়ালে টাঙ্গানো বিউটি-পিসটির উৎপত্তিস্থল হল গাঁয়ের বাঁশঝাড়, অনেক আমলার ভ্রুণ জন্ম নিয়েছিল গ্রাম্য পাঠশালায়। মে-ফেয়ারে চুল কেটে বেরিয়ে আসা অনেক রোজী আদিতে ছিল গোলাপি। ধান শুধু চালের আদি রূপই নয়, ধান হল কৃষকের স্বপ্ন, তার লুঙ্গি ও বউয়ের শাড়ি প্রস্তুতের কাঁচামাল, মেয়ের যৌতুকের টাকা কিংবা হোমিওপ্যাথি চিকিৎসার ভিজিট।
দ্বিতীয়ত, ব্যক্তিগতভাবে আমি কৃষক সম্প্রদায়ের বহুভঙ্গিম জীবনের কতটুকুই বা জানি। এটা ঠিক, দীর্ঘ ১০ বছর আমি গ্রাম কিংবা আধাগ্রাম-আধাশহরে বাস করেছি। কিন্তু গ্রামীণ জীবনের যে বিশাল ক্যানভাস এবং সেই ক্যানভাসের অন্তর্গত লক্ষ-কোটি মানুষের বেঁচে থাকার মরণপণ সংগ্রামের যে অসংখ্য খণ্ডচিত্র, সেগুলো বুঝে ওঠার জন্য যে তীক্ষè অন্তর্দৃষ্টি এবং তীব্র শ্রবণ ও ঘ্রাণশক্তি থাকা দরকার, তা আমার নেই। তৃতীয়ত, কিছু বিষয় নিশ্চয়ই আছে, যা দশ বছর কেন, দশ হাজার বছরেও বুঝে ওঠা সম্ভব নয়। সেটা কেমন, একটা উাহরণ দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করি আগে।
পেলিক্যান নিশ্চয়ই অতি পুরাতন এক পাখি প্রজাতি। অথচ এই পাখির শাবক শুধু নয়, ভ্রুণও যে মাকে ডাকে, এ বিষয়টি গত শতাব্দীর শেষতক কেউ খেয়াল করেনি অথবা বলা যায় কান থাকার পরও মনুষ্য সমাজের কেউ ভ্রুণের সেই মা-ডাক শুনতে পায়নি। মাত্র বছর ত্রিশেক আগে কানাডার এক পাখি-বিশারদ ঘটনাটি লক্ষ করেছেন এবং তার উদ্ভাবন পক্ষীবিজ্ঞানে এক নতুন সংযোজনের মর্যাদা পেয়েছে। বিষয়টি ঘটে এভাবে- পেলিক্যানের ডিম ফুটে যখন বাচ্চা বেরোতে চায়, তখন ডিমের একটা জায়গা হঠাৎ ফুটো হয়ে যায়। সেই ফুটোর ভেতর দিয়ে বেরিয়ে আসে ক্ষুদে শাবকের দুটি চোখ। তারপর একনাগাড়ে চলতে থাকে তীব্র আর্তনাদ। সেই আর্তনাদে সাড়া দিয়ে মা পেলিক্যান সঙ্গে সঙ্গে ডিমটি বুকের নিচে আগলে পা দুটির মাঝখানে চেপে ধরে। সূর্যের তাপ অথবা ঠাণ্ডা আবহাওয়া থেকে ডিমটিকে রক্ষা করতে গিয়ে তাকে ওইভাবে থাকতে হয় দুই থেকে তিনদিন। কিন্তু সমস্যা দাঁড়ায় কুলায় যদি থাকে দুটি ডিম। দ্বিতীয় ডিমটিকে অতিরিক্ত গরম বা শীতের কবল থেকে রক্ষা করার ব্যাপারে তার নজর থাকে কম। তখন ওই ডিমের মধ্যে ভ্রুণের হয়তো বাড়ন্ত অবস্থা। শীত বা গরমে তার অতিষ্ঠ অবস্থা হলে সে ডিমের মধ্যে পুরোপুরি বদ্ধ অবস্থাতেও শুরু করে আর্তনাদ। এই আর্তনাদ শুনে মা তখন তার দিকেও তাকায়।
লাখ লাখ কিংবা কোটি কোটি বছর ধরে পেলিক্যানের ডিম ফুটে বাচ্চা বেরোচ্ছে। আগের মানুষগুলোর কথা বাদ দিলাম, পক্ষীসমাজ নিয়ে যারা গবেষণা করে আসছেন, তারাও বিষয়টি লক্ষ করতে ব্যর্থ হয়েছেন শত শত বছর ধরে। অতঃপর পেলিক্যানের তুলনায় অনেক নবীন প্রজন্ম- বাংলার কৃষকের সব আর্তনাদ কি মাত্র কয়েক বছরেই শোনা বা বুঝে ওঠা সম্ভব? হতে পারে, শতছিদ্র হালকা ত্যানার মতো শাড়িতে অর্ধাবৃত কৃষকের বউয়ের পেটের সন্তানটিও শীতের কষ্টে অতিষ্ঠ হয়ে আর্তনাদ করে ওঠে, কই আমি তো তা শুনিনি!
তবে আমি দেখেছি, ঘোর গাঁয়ের ভূমিহীন কৃষকের বউয়ের কাছে সংসার মানে একজন স্বামী ও এক পাল সন্তান, চার-পাঁচ সের ধান উঠানে শুকোতে দেয়া, দুতিনটি মুরগিকে সন্ধ্যায় ঘরে তোলা আর শতছিন্ন কাপড়ে সুঁচের জোড়াতালি দেয়া। সে মনে করে পৃথিবীর সব সংসারেই বুঝি হাঁস-মুরগি থাকে, কাপড় ছিঁড়ে গেলে সেলাই করা হয় আর ধনী মানে ধানের পুঞ্জটা একটু বড় হওয়া। আমি একবার লিখেছিলাম, কৃষকেরও ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থাকে কখনও কখনও, তবে সেটা ঘরের খুঁটির বাঁশ কেটে তাতে ভাংতি পয়সা জমানো।
আমাদের কৃষক সমাজের বহুমাত্রিক যে বঞ্চনা, সেই বঞ্চনা যদি বিদ্রোহে রূপ নিত, এই সমাজে শৃংখলা বলে কিছু থাকত না, আইনের শত হাতজোড় প্রার্থনায়ও ঠেকানো যেত না রক্তারক্তি। কী অদ্ভুত নিয়ম। আমি লাঙ্গল না ধরলে তোমার জমি বিরান পড়ে থাকত, গর্ব করে বলতে পারতে না যে এবার খাদ্য ঘাটতি হবে না, প্রয়োজনের অতিরিক্ত মজুদ আছে; আর আমাকেই বলছ কি-না গ্রাম্য চাষা! এই পৃথিবীর সবচেয়ে নির্মম প্রহসনটি বুঝি- শ্রমের চেয়ে মেধার মূল্য বেশি। সেই আদিম সমাজ থেকেই শুরু হয়েছে একটি প্রক্রিয়া- একদল মেধাসম্পন্ন মানুষ তাদের মাথা দিয়ে হাজার-লক্ষ-কোটি বোকা মানুষের শ্রমশক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করে সুখে থাকবে। মাঝখানে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র নির্মাণের মধ্য দিয়ে একটা মৌখিক চেষ্টা হয়েছিল শ্রমকে মেধার জাতে তুলে আনার। বাস্তবে তা সম্ভব হয়নি। শ্রম শ্রমই থেকে গেছে, আর মেধা গড়ে তুলেছিল ক্রেমলিন, পলিটব্যুরো, সেক্রেটারি জেনারেল ইত্যাদি। রুশ কৃষক টলস্টয়ের উপন্যাসের নায়ক হতে পেরেছে, লেনিন-স্ট্যালিন হতে পারেনি।
যাক রুশ কৃষক আমাদের প্রসঙ্গ নয়, আমরা বলছি বাংলার কৃষকের কথা। চীনের কৃষক সমাজ নিয়ে গুড আর্থ লিখে পার্ল এস বাক নোবেল পেয়েছিলেন। উপন্যাসটি যারা পড়েছেন, তারা নিশ্চয়ই চৈনিক কৃষকের সঙ্গে বাংলার কৃষককে মিলিয়ে দেখেছেন। আমি এখন বরং আরেক মহৎ ঔপন্যাসিক ও গল্পকার সমারসেট মম এ দেশের কৃষক সম্প্রদায়কে কী চোখে দেখেছিলেন, সেটাই শেয়ার করি। ১৯৩৮ সালে মম এসেছিলেন ভারতে। ভ্রমণশেষে ফিরে গিয়ে ভারতীয় কৃষক সম্প্রদায় সম্বন্ধে যা লিখেছিলেন তার একটি মনোগ্রাহী অংশ যথাসম্ভব ভালো অনুবাদে তুলে ধরছি। বলা বাহুল্য, অবিভক্ত ভারতের কৃষক মানে এখনকার বাংলাদেশেরও কৃষক।
যখন আমি ভ্রমণশেষে ভারত ছেড়ে আসছিলাম, বন্ধুবান্ধব আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল সে দেশের কোন্ দর্শনীয় বস্তুটি আমার মনে সবচেয়ে গভীর ছাপ ফেলেছে। বলি- তাজমহল, বেনারসের ঘাট, মথুরার মন্দির অথবা ত্রাভাংকোরের পর্বতমালা এগুলোর কোনোটিই আমাকে অবিভূত করতে পারেনি। ভয়াবহভাবে কৃশ, রোদে পোড়া যে মাটি সে চষে, সেই মেটে রঙের এক টুকরো কাপড়ে নগ্নতা ঢাকা, ভোরের শীতে কাঁপতে থাকা, দুপুরের সূর্যতাপে ঘর্মাক্ত, ফেটে চৌচির হওয়া ক্ষেতে সন্ধ্যা পর্যন্ত লাঙ্গল বাওয়া কৃষক, বিরামহীন শ্রমে নিয়োজিত ক্ষুধার্ত কৃষক, ভারতের উত্তর-দক্ষিণ-পূর্ব-পশ্চিম দিগন্তের বিলীন প্রান্তরে কর্মরত কৃষক, এ দেশে হাজার হাজার বছর আগে যখন আর্যরা প্রথম এসেছিল, তখন থেকে বংশপরম্পরায় এক মুঠো ভাতের কাঙাল মেহনতী কৃষক, যার একমাত্র কামনা তার শরীর ও আত্মাকে কোনোরকমে একত্র রাখা, সেই কৃষকের ছবিই আমাকে সবচেয়ে বেশি অবিভূত করেছে।
সমারসেট মম, এ রাইটার্স নোটবুক, ১৯৪৯
২.
রাজধানীর পাঠকদের প্রশ্ন করি, আপনারা কি ঈদের পর থেকে এ পর্যন্ত সকালের নাস্তাটা ঠিকমতো করতে পারছেন? এই সময়টায় প্রায় প্রতি সকালে নাস্তার টেবিলে অথবা টেবিলে বসার আগে পত্রিকার পাতায় মানব নিধনের যে হতবাক হওয়ার মতো খবরগুলো পড়তে হচ্ছে, তাতে গলা দিয়ে নাস্তার আইটেমগুলো নামার কথা নয়। ব্লগার নিলয় হত্যার খবর পড়ার পর মুক্তচিন্তার মানুষরা হয়তো টেবিল ছেড়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বলছেন- এই নশ্বর দেহ আর কতোদিন! জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটিয়েছিল বিএনপি, আর এখন আওয়ামী লীগ সাচ্চা মুসলমান সেজে জঙ্গিদের মতোই ভাবছে- ব্লগ মানেই নাস্তিকতা, ব্লগার মানেই নাস্তিক। উপায়ান্তরহীন আমরা এখন আর কারোরই দোষ ধরবো না, পারলে শক্তি সঞ্চয় করে চ্যালেঞ্জ করবো এই রাষ্ট্রটাকেই।
পৃথিবীর সব দেশেই সাধারণভাবে মানুষের দুটি ভাগ থাকে- শাসক ও শাসিত। এই দেশ বোধকরি অতিশয় প্রগতিশীল, যে কারণে দেশটি টু-ডাইমেনশনাল নয়, হয়ে গেছে থ্রি-ডাইমেনশনাল। শাসিতের অপরাধ নিয়ন্ত্রণে রাখাই শাসকের কাজ; কিন্তু শাসিত ভাগের একটি অংশকে পরিচর্যা দিয়ে, আশকারা দিয়ে এমনভাবে গড়ে তোলা হয়েছে যে, তারা শাসক ও শাসিতের মধ্যখানে এক বিপজ্জনক আলাদা শ্রেণী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। খুব ধীরে, সমাজের বৃহত্তর অংশের বুঝে ওঠার আগেই গুণ্ডা, বদমাশ, খুনি, জঙ্গি, ডাকাত, ছিনতাইকারী, রেপিস্ট, স্যাডিস্ট সবাই ডগমগ করে বেড়ে উঠে তৈরি করেছে এই শ্রেণীটি। শ্রেণীটি এখন সমাজ ও রাষ্ট্রের এক অতি প্রতিষ্ঠিত অংশ। মুশকিলটা হল, শাসক শ্রেণীর ভাবটা হলো- আহা ওরা তো এমন করবেই, করেই থাকে! বাঘ তো মানুষই খাবে, আলো চাল খাবে নাকি? আর ধরাধরির প্রশ্ন আসে কেন? মানুষের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করে ডিক্টেটর, ফ্যাসিস্ট।
কতবার বলব, অপরাধীদের দমন করতে গিয়ে কঠোর হলে গণতন্ত্রের কোনো ক্ষতি হয় না। অবশ্য এখন আর কঠোর হলেও লাভ কিছু হবে বলে মনে হয় না। মানুষের ষড়রিপু বিদ্রোহ করতে শিখে গেছে, এই বিদ্রোহ দমন করা বিডিআর বিদ্রোহ দমন করার চেয়েও কঠিন। শিশু হত্যার ঘটনাগুলো এক ধরনের স্যাডিজম। স্যাডিস্টের আনন্দ পায় যারা, তাদের ফেরাবে কে? মানুষ দুঃখ থেকে সরে আসতে চায়, সুখের আনন্দ থেকে তাকে সরিয়ে আনাটা খুবই কঠিন।
পুনশ্চ : লেখাটিতে সমারসেট মমের যে কথাগুলো উদ্ধৃত করেছি, তার অনুবাদ করেছিল ৮৫ সালে ক্যান্সারে মারা যাওয়া বন্ধু জহির। ১৯৭৯-৮০ সময়ে বিপক্ষ নামে একটি লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদনা করতাম আমি। সেখানে ছাপা হওয়া তার একটি লেখায় ছিল কথাগুলো। কে যেন বলেছিলেন, অনুবাদ হচ্ছে স্ত্রী জাতির মতো- সুন্দরী হলে বিশ্বস্ত হয় না, বিশ্বস্ত হলে সুন্দরী হয় না। সম্পাদকের দায় ঘাড়ে নিয়ে অরিজিনালের সঙ্গে মিলিয়ে দেখেছিলাম অনুবাদটি বিশ্বস্ত ছিল। অতি সামান্য ঘষামাজা করে একে যথাসম্ভব সুন্দরও করার চেষ্টা করেছি।
জহিরের সঙ্গে অনেক মিশেছি; কিন্তু তার সম্পর্কে কিছুই বলব না। সবটুকু যখন নয়, তখন কোনোটুকুও নয়।
উপরের লেখাটি সাংবাদিক মাহবুব কামাল ভাইয়ের।
হা.শা.
যায়যায়দিন,
ঢাকা।
ফেসবুক- http://www.facebook.com/hasan.shantonu.7 ●
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই আগস্ট, ২০১৫ রাত ৯:৫২