somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্প : ফড়িং

০৮ ই আগস্ট, ২০১৩ বিকাল ৪:৫৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



এবারের ঈদ বাণিজ্য বেশ ভালো হয়েছে। বাসা থেকে শপিং করবার জন্য টাকা দেয়,আমি খেয়ে ফেলি। তাই এই সাত সকালে মায়ের চেঁচামেচি শুনে পুরানো পাঞ্জাবী পরেই নামাজ পড়তে রওনা দিলাম।ঈদ মানে খুশী,ঈদ মানে আনন্দ। তাই গতরাতে আনন্দের ঠ্যালায় দুই পেগ বেশী খেয়ে ফেলেছি।ঝাড়া এক ঘন্টার গোসলও তাই ঝিমুনী কমাতে পারছে না।মসজিদের সামনে বিরাট জটলা,আঁতরের গন্ধে উৎসব মৌ মৌ করছে। ও হ্যাঁ জটলাটা যতটা নামাজ পড়ুয়াদের তারচে ভিক্ষুকের কোন অংশে কম না।যে কোন উৎসব ভিক্ষা করবার জন্য দারুণ উপলক্ষ। এ সময় মানুষের মন পুডিং এর মতো নরম থাকে। টিপ দিলে ভেঙ্গে যায়।মসজিদ মুখেই সুজনের সাথে দেখা
-কিরে ব্যাটা পুরান পাঞ্জাবী মনে হয়?
-হ্যাঁ গত বছরেরটা,তোরটা কত দিয়া কিনলি?
-আড়াই হাজার মামা,দেরী করছি বলে পছন্দমত পাইনি।
সুজনের মুখ দিয়ে পাঞ্জাবীর মতই ঘ্রাণ বেরুচ্ছে। আঁতরের না আত্নপ্রসাদের।ব্যাপারটা লক্ষনীয় আত্নপ্রসাদের হাসি কেবল নিজে থেকে সম্মানে নিচের দিকের লোকদের সাথেই হাসা যায়। আপাতত আমার পাঞ্জাবী পুরান। রিমনের নতুন পাঞ্জাবী,দামও পাঁচশ বেশী। সেখানে সুজন প্রায় কৈফিয়ত দেবার মত করে বলছে “দোস্ত বলিস না,শেষে গেছি এর থেকে ভালো পাঞ্জাবী পাই নাই।তোরটা কিন্তু ভালো হইছে”। ঈদের নামাজ যতটা না নামাজ,বেশীরভাগ বাঙালীর জন্য ততটাই গল্প করবার জায়গা। বহুদিন পর সবাইর দেখা হয়,খোঁজ খবর করে। কম বয়সী কি বেশী বয়সী সবাই একটা আলাপের মুডে থাকে। ইমাম সাহেব মাঝে মাঝেই রেগে গিয়ে হুঙ্কার ছাড়েন। কিন্তু খুব বেশী এগুতে পারেন না কারণ তিনি আসলে চাকরী করেন।তবে আসলেই ঈদ হলো বাচ্চাদের। বড়দের মত সেজেগুজে ঈদের নামাজ পড়তে এসেছে। যাদের সামান্য বুদ্ধি হয়েছে তারা গিয়েই হামলে পড়বে বড়দের পকেটে।এটা এক ধরণের মজা। দিন শেষে তিন চারজন বাচ্চা হিসাবে বসবে কে কত টাকা পেয়েছে।যে কম পেয়েছে তার মন খারাপ হবে,বাবার কাছে বায়না ধরবে বাড়তি টাকার জন্য।

নামাজ শেষে কোলাকুলি করার একটা বিরাট যুদ্ধের ব্যাপার।কোলাকুলি শেষে বন্ধু আমার বাসায় আসিস মুখস্ত কথাটা বলতে হয় সবাইকে। প্রায় ভাবি কোন এক ঈদে শ’খানেক লোক নিয়ে নির্দিষ্ট কেউ একজনের বাসায় গিয়ে বলবো “ঈদ মোবারক চলে এলাম,খাওয়া”। সেটা করা হয় না। এদিন খাবারের অভাব হয় না।বাড়ীর মেয়েরা এক মাস আগ থেকে রেসিপি বই কিনে রাখে,মায়েদের সনাতন রান্নার পাশাপাশি নতুন রাধুনীরা নানা রকম এক্সপেরিমেন্ট চালায়।কোলাকুলি শেষে যে যার মত চলে গেলে আমি সিগারেট নিয়ে একটু আলাদা হয়ে গেলাম।স্বাধীনতা বলে একটা কথা আছে,সেটা এখন আমি উপভোগ করছি। ঝাড়া একটা মাস পর বুক ফুলিয়ে সিগারেট খাবার মধ্যে একটা গুরুগম্ভীর ব্যাপার আছে।টং দোকানে মানুষ নাই,ঈদের দিন মানুষ চা খায় না।কোরমা পোলাও,বিরানী আরও অনেক কিছুই খায়। চায়ের অর্ডার দিয়ে সিগারেট টানছি।সামনেই একটা বারো তেরো বছরের ছেলে বসা হাতে একটা পলিথিন।বুঝা যাচ্ছে বাতাস দিয়ে ফুলিয়ে রাখা হয়েছে।একা একা চা খেতে বোর লাগছিলো। একটু কথা বলার উদ্দেশ্যেই ছেলেটাকে বললাম “ঈদ মোবারক বাবু”। পাত্তাই দিলো না,এমনকি শুনেছে এমন ভাবও করলো না। অপমানজনক হতে পারতো ব্যাপারটা। কিন্তু ঈদের দিন অপমান গায়ে মাখতে হয় না।পলিথিনে একটা ফড়িং! আবার বললাম “ঈদ মোবারক”। আমার দিকে না তাকিয়েই ছেলেটা বলল “মুবারুক”
-তোমার নাম কি?
-নাই
-আচ্ছা। নাম না থাকা ভালো। নাম থাকার নানা ঝামেলা।
ওদিক থেকে কোন উত্তর এলো না।আবার প্রশ্ন করলাম “পলিথিনে কি?
-হাতি,সুন্দরবন থেকে ধইরা আনছি,চিড়িয়াখানা দিমু।
-দারুণ ব্যাপার,টিকিট কত করে রাখবা?
এবার ছেলেটা ফিরে তাকালো,তার দৃষ্টিতে আগুণ। সে মহা বিরক্ত। “চা খাবে এক কাপ?একলা চা খেতে কষ্ট।ওই মামা চিড়িয়াখানার মালিককে একটা চা দাও। আপনি কাছে আসেন”
ছেলেটা কাছে এসে আমার সামনের টুলেই বসলো।হাতের পলিথিন শক্ত করে ধরে আছে। পলিথেনের মুখ বাঁধা হয়নি। সেজন্য বাড়তি নিরাপত্তা। ফড়িং উড়ে যেতে পারে যেকোন মুহুর্তে।“তা তোমার নামটা বলো এবার”
-টিটু
-সুন্দর নাম,আমার নাম রোমেল।
-আপনের নাম দিয়া কি করুম?
-নাহ কিছু করতে হবে না।তা ঈদের নামাজ না পড়ে এখানে কি করছো?
-আমি নামাজ পড়তে পারি না।আব্বা শিখায় নাই।আমার আব্বাও নামাজ পড়তে পারে না।

হা হা হা করে হাসি দিলাম। ছেলেটা একেবারেই শিশু,ও জানেনা নামাজ না জানলেও ঈদের নামাজ পড়ে হাজার হাজার মানুষ। আর বাচ্চাদের জন্য সব মাফ।গায়ের পুরান জামা পরা টিটুকে দেখে আপন আপন মনে হচ্ছে। তবে বেচারা নিশ্চয় টাকার অভাবে কিনতে পারে নি। মনে মনে শপথ করে ফেললাম। আগামি ঈদে টিটুকে লাল পাঞ্জাবী উপহার দিবো। গরীবের বাচ্চারা লাল রং পছন্দ করে।কথা খুঁজে পাচ্ছি না।আমার চা প্রায় শেষ। আরেক কাপ অর্ডার দিয়ে নতুন করে কথা শুরু করতে হবে।গরীবদের সাথে কথা বলতে একটা অসুবিধা আছে। কোথায় কোন কথায় আবার ঝামেলা বেঁধে যায়। এমনিতেই তারা ছেড়া কাপড় ছাড়া কাউকে দেখলেই বড়লোক মনে করে। যেহেতু আমার পাঞ্জাবী ইস্ত্রী করা আপাতত আমি তার কাছে বিরাট বড়লোক। তার উপর তাকে সেধে সেধে চা খাওয়াচ্ছি। টিটু হয়ত ভাবছে কোন পাপ কর্ম করে এসে তাকে চা খাইয়ে প্রায়শ্চিত্য করছি।
চা পেয়ে টিটু পিরিচে ঢেলে ফেলল,ফুড়ুত করে এক টানে মুখে নিয়ে আবার ঢালতে মনযোগী হতেই আমি জিজ্ঞেস করলাম “বাবা কি করে?
-ঘরে বইসা থাকে!
-বাহ! খুব ভালো কাজ। আমিও একই কাজ করি।
-মা কি করে?
-বুয়ার কাম করে।
-ঈদে নতুন জামা কিনতে পারো নি তাই না?
-আমার নতুন জামা কেনা লাগে না,আমি পাই।
খুব আত্নবিশ্বাসী এবং আত্নপ্রসাদের হাসিসহ। কেবল মাত্র ডোন্ট কেয়ার টোকাইরাই পারে নিজের অবস্থান থেকে উপরের মানুষদের সাথে আত্নপ্রসাদের হাসি হাসতে। “ভালো কথা তুমি ঈদের দিন পলিথিনে ফড়িং ঢুকাইছো কেন?
-অন্যদিন হলেতো কাগজ ঢুকাইতাম।

এই ছেলের সাথে তর্ক করা অযথা। কাজের কথায় আসা যাক “তা নতুন জামা পেয়ে পুরান জামা পরে আছো কেন? কাহিনী কি?
টিটু একটু ভাবলো। চুপচাপ পিরিচের চা শেষ করে ঠিকই, তবে দৃষ্টি নিচ থেকে ফেরায় না। আমার বলার আর বেশী কিছু নেই। তাই চুপচাপ থাকাই শ্রেয়।মিনিটখানে পর নিজেই থেকেই বলল “বাপে সব বেইচা দিছে”! আমার মন খারাপ না হোক,মন খারাপের ভাব করা উচিত। টিটু সামান্য কাঁদছে বোধহয়।গিফটের জামা কাপড় বিক্রি করে দেয়া বিরাট কষ্টের ব্যাপার। জানা দরকার তার বাবা এটা কেন করতো। কিন্তু প্রশ্ন করতেই ভয় লাগছে। অবস্থা সুবিধার না। চোখের টলটলে থেমে থাকা পানি যেকোন সময় বাঁধ ছুটে বেরিয়ে আসতে পারে।আমি বরং আরেকটা সিগারেট ধরিয়ে অপেক্ষা করি। লক্ষন দেখে মনে হচ্ছে নিজে থেকেই বলবে। বারো তেরো বছরের বাচ্চারা বললে নিজে থেকে বলে,না বললে মেরে ফেললেও বলে না।গোৎ গোৎ করে নাক টানলো দুবার। কান্না না সর্দি বুঝে উঠতে পারিনি।কিছু বলবে বলবে ভাব,কিন্তু ঠিক বলতে পারছে না। তাকে সাহায্য করা দরকার।টিটুর পিঠে হাত দিলাম।
-টিটু তুমি আমাকে বলো কি বলতে চাও
টিটু কেঁদে দিলো। নাক টানা কান্না।বুঝা যাচ্ছে বেশ কিছুদিন পর কাঁদছে।আমি অপেক্ষা করছি কান্না থামার জন্য,কান্না থামলেই শুনতে পারবো। আপাতত তার কান্না থামানোর কোন প্রক্রিয়া আমার হাতে নেই।আমি সিগারেটে টান দিতে থাকলাম।
টিটু কান্না থামালো,প্রায় ফুঁফিয়ে বলল “এইবার ঈদে আমি তিনটা জামা পাইছিলাম,মায়ে পাইছিলো দুইটা শাড়ী,সব বাপে বেইচা দিছে”
-কেন বিক্রি করছে?
-আমার বাপ ল্যাংড়া,রিশকা চালাইতো,একসিডেন্ট কইরা ঘরে বইসা আছে। তার অষুধ লাগে। মায়ের ট্যাকায় কিচ্ছু হয় না।
-তাই বলে জামা কাপড় বিক্রি করে দিবে?
-বাপ বুঝে না,ঘরে খাইতে না পাইলেতো কেউ দেখবো না,কিন্তু ঈদের দিন পুরান কাপড় পরলে সবাই দেখবে।

বলা হয়নি আমি খুব লজ্জা পেয়েছি টিটু,বুঝতে না দিয়ে ফোন কানে চেপে উঠে মোটামুটি পার পেয়ে গেছি মনে হয়।টিটু আমার চলে যাওয়া দেখে ফড়িং ছেড়ে দিয়েছে। আমি অবশ্য তা দেখিনি!তবে হ্যাঁ টিটুর বাপ কিন্তু মৌলিক অধিকারের ধারা মেনেই চলেছে। প্রথমে সেমাই চিনি,তারপর নতুন জামা!
৩৪টি মন্তব্য ৩৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

অন্যায় অত্যাচার ও অনিয়মের দেশ, শেখ হাসিনার বাংলাদেশ

লিখেছেন রাজীব নুর, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৪:৪০



'অন্যায় অত্যাচার ও অনিয়মের দেশ, শেখ হাসিনার বাংলাদেশ'।
হাহাকার ভরা কথাটা আমার নয়, একজন পথচারীর। পথচারীর দুই হাত ভরতি বাজার। কিন্ত সে ফুটপাত দিয়ে হাটতে পারছে না। মানুষের... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্য অরিজিনস অফ পলিটিক্যাল জোকস

লিখেছেন শেরজা তপন, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১১:১৯


রাজনৈতিক আলোচনা - এমন কিছু যা অনেকেই আন্তরিকভাবে ঘৃণা করেন বা এবং কিছু মানুষ এই ব্যাপারে একেবারেই উদাসীন। ধর্ম, যৌন, পড়াশুনা, যুদ্ধ, রোগ বালাই, বাজার দর থেকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×