somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আজ ইয়াসমিন হত্যা দিবস

২৪ শে আগস্ট, ২০১৪ বিকাল ৪:৪৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

১৯৯৫ সালের ২৪ শে আগস্ট, সকালের স্নিগ্ধ আলোকে ম্লান করে দিয়ে সেদিন এক নিরপরাধ কিশোরীর জীবনে নেমে এসেছিল নিকষ কালো রাতের মতো অন্ধকার!!


১৯৯৫ সালের ২৩ আগস্ট ঢাকা থেকে বাড়িতে ফিরছিলেন তিনি। ভুল গাড়িতে উঠে পড়ার পর দিনাজপুরের দশমাইল মোড়ে ভোরের আলো ফোঁটার আগেই ইয়াসমিনকে নামিয়ে দিয়ে চলে যায় বাসটি। যাওয়ার সময় চায়ের দোকানদারকে কন্ডাক্টর বলে যান, পরে যেন ইয়াসমিনকে গাড়িতে তুলে দেন।
এর কিছুক্ষণ পর পুলিশের একটি পিকআপ ভ্যান বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে নিয়ে যায় ইয়াসমিনকে। কিন্তু, সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়ার নামে পুলিশ সদস্যরাই পালাক্রমে ধর্ষণ এবং পরে হত্যা করে কিশোরী ইয়াসমিনকে।
দিনাজপুর শহরের রামনগর এলাকার গরিব ঘরের মা শরীফা বেগমের মেয়ে ইয়াসমিন। গরিব পরিবারে জন্ম নেওয়ায় চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত পড়তে পেরেছিলেন তিনি। টাকা জমিয়ে আব‍ার লেখাপড়া করার স্বপ্ন বুকে নিয়েই পাড়ি জমান ঢাকায়। ঢাকায় এসে একটি বাড়িতে গৃহকর্মীর কাজ নেন তিনি।
ইয়াসমিন আট-নয় মাস কাজ করার পর নিজের বাড়িতে যেতে যান। কিন্তু যার বাসায় তিনি কাজ করতেন, তিনি দূর্গা পূজায় যেতে বলেন। কিন্তু মায়ের জন্য মন ছুটে যায় ইয়াসমিনের।
আর সে কারণেই হয়ত ২৩ আগস্ট ওই পরিবারের ছেলেকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে কাউকে কিছু না জানিয়ে একাই দিনাজপুরের উদ্দেশে রওয়ানা হয়ে যায় ইয়াসমিন।
ভুল করে ঠাকুরগাঁওগামী নৈশকোচ হাছনা এন্টারপ্রাইজে উঠে পড়েন। বাসটি ২৪ আগস্ট ভোররাত তিনটা থেকে সাড়ে তিনটার মধ্যে দিনাজপুর শহরে যাওয়ার জন্য দিনাজপুর-ঠাকুরগাঁ-রংপুরের সংযোগ মোড় দশমাইল এলাকায় এসে পৌঁছায়।
এখানে চায়ের স্টল, খাবারের দোকান প্রায়ই খোলা থাকে। কোচের সুপারভাইজার খোরসেদ আলম ও হেলপার সিদ্দিকুর রহমান ইয়াসমিনকে জোবেদ আলীর চায়ের দোকানে নামিয়ে দেয়। তারা দোকান মালিককে অনুরোধ করেন যেন ইয়াসমিনকে দিনাজপুরগামী কোনো গাড়িতে উঠিয়ে দেন।
জানা যায়, সে সময় জয়ন্ত নামে একজন যাত্রীও বাস থেকে নামেন। বাস থেকে নেমে জয়ন্ত ও ইয়াসমিন জোবেদ আলীর চায়ের দোকানের পাশেই একটি দোকানে নাস্তা খান।
আবদুর রহিম নামে এক পান দোকানদার ইয়াসমিন কীভাবে দিনাজপুরের রামনগরে যাবে জানতে চাইলে জয়ন্ত তাকে পৌঁছে দেবে বলে জানান। এ সময় উপস্থিত কয়েকজন আপত্তি জানিয়ে ইয়াসমিনকে তারাই দিনাজপুরগামী গাড়িতে তুলে দিতে চান।
এ সময় বীরগঞ্জ থেকে পুলিশের একটি পিকআপ ভ্যানের (নং-ম-০২-০০০৭) চালক অমৃতলাল বিষয়টি জানতে চান। পিকআপ ভ্যানে আরো দুইজন উপপরিদর্শক (এসআই) মইনুল এবং আব্দুস সাত্তার বসে ছিলেন। অমৃতলাল এ সময় ইয়াসমিনকে তাদের সঙ্গে যাওয়ার প্রস্তাব দেন।
তবে ইয়াসমিন সকাল না হওয়ায় যেতে সাহন পান না। এরপর অমৃতলাল ধমক দিয়ে তাকে পৌঁছে দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে নিয়ে যান।
এরপ পিকআপ ভ্যানটি আনুমানিক তিনশ গজ দূরে সাধনা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কাছে দাঁড় করিয়ে পুলিশ টর্চ দিয়ে কিছু একটা বা কাউকে খুঁজতে থাকে।
এ সময় ওই স্কুলের দিক থেকে ধান বোঝাই দুটি রিকশাচালককে পুলিশ জানতে চায়, তাদের পিকআপ ভ্যান থেকে যে মেয়েটি লাফ দিয়েছে, তাকে তারা দেখেছে কিনা? ঠিক ওই মুহূর্তে ঢাকা থেকে দিনাজপুরগামী একটি নৈশ কোচের হেডলাইটের আলোয় পুলিশ এবং রিকশা চালকরা ইয়াসমিনকে রাস্তার ওপর পড়ে থাকতে দেখতে পান। এরপর পুলিশ আবার ইয়াসমিনকে পিকআপ ভ্যানে তুলে নেয়।
পরবর্তীতে ওই এলাকার লোকজন রাস্তায় রক্তের দাগ, পাশে ইয়াসমিনের জুতা, রুমাল, হাতপাখা ও ভাঙা চুড়িও পড়ে থাকতে দেখেন। এর ঘণ্টা তিনেক পরে গোবিন্দপুর সড়কে ব্র্যাক অফিসের সামনে ইয়াসমিনের মৃতদেহ পাওয়া যায়।
এরপর উত্তর গোবিন্দপুর এলাকায় পড়ে থাকা ইয়াসমিনের লাশের সুরতহাল রিপোর্ট তৈরির উদ্দেশ্যে কোতোয়ালি থানার উপপরিদর্শক (এসআই) স্বপন কুমার প্রকাশ্যে লাশ বিবস্ত্র করে ফেললে উৎসুক জনতার মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হয় এবং ঘটনার পরদিনই দিনাজপুরে এ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে এবং হত্যা ও ধর্ষণের বিচারের দাবিতে বিক্ষোভ শুরু হয়।
এলাকাবাসীর অভিযোগ, দিনাজপুর কোতোয়ালি পুলিশ বিষয়টি সামাল দেওয়ার জন্য ‘একজন অজ্ঞাতপরিচয় যুবতীর লাশ উদ্ধার’ মর্মে ঘটনাটি সাজিয়ে থানায় একটি ইউডি মামলা করে। লাশের তড়িঘড়ি ময়নাতদন্ত শেষে আঞ্জুমানে মফিদুলের মাধ্যমে বালুবাড়ি শেখ জাহাঙ্গীর গোরস্থানে দাফন করা হয়। লাশের কোনো ধরনের গোসল ও জানাজা পড়ানো হয়নি।
২৫ আগস্টের বিক্ষোভে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষ অংশ নেন। মিছিলে অংশ নিয়ে পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান আরো সাতজন। এ সময় বিভিন্ন মহল থেকে ইয়াসমিনের পরিবারকে হুমকিও দেওয়া হয় অনেকবার।
পরে আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯৭ সালে ধর্ষক ও খুনিদের ফাঁসির রায় দেয় আদালত। ২০০৪ সালে রায় কার্যকর করা হয় এবং সম্মিলিত নারী সমাজের পক্ষ থেকে ‘২৪ আগস্ট নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
ওদিকে শাসকগোষ্ঠী নেমে পড়ে নির্লজ্জ ও নির্মম মিথ্যাচারে। এলাকার মানুষ বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠলে প্রশাসন ইয়াসমিনকে ভাসমান পতিতা বলে ধামাচাপা দেবার চেষ্টা করেছিল। ২৬ আগষ্ট রাতে বিক্ষুব্ধ জনতা কোতয়ালী থানা ঘেরাও করে বিক্ষোভ করা কালে পুলিশ লাঠিচার্জ করে। বিক্ষুব্ধ জনতা কোতয়ালী থানার সীমানা প্রাচীর ভেঙ্গে ফেলে। ২৭ আগষ্ট বিক্ষুব্ধ জনতা প্রশাসনিক কর্মকর্তার বদলি সহ দোষী পুলিশ সদস্যদের শাস্তির দাবীতে বিশাল মিছিল বের করলে পুলিশ সেই মিছিলে নির্বিচারে গুলি চালায়। এ সময় ৭ জন নিহত ও আহত হয় ৩ শতাধিক, জারি হয় ১৪৪ ধারা, মোতায়ন করা হয় বিডিআর। সামু, কাদের ও সিরাজের লাশ পাওয়া যায় কিন্তু বাকি ৪টি লাশ পুলিশ গুম করে ফেলে। জনগণের রোষ আরো বেড়ে যায় এতে, তারা শহরের ৪টি পুলিশ ফাঁড়ি জ্বালিয়ে দেয়। বিক্ষোভের দাবানল জ্বলে ওঠে দিনাজপুরের ১৩ থানাসহ সারা দেশব্যাপী। দিনাজপুর থেকে তৎকালীন জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারকে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়।

চাঞ্চল্যকর ইয়াসমিন ধর্ষণ ও হত্যা মামলার দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের ফাঁসির রায় কার্যকর করা হয় আট বছর পর, ২০০৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে।

প্রতিবছর ২৪ আগষ্ট নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে স্থানীয়, জাতীয় ও আর্ন্তজাতিক পর্যায়ে। সেদিনের মতো প্রতিবাদ যদি প্রতিটি ধর্ষণের বিরুদ্ধে হয়, তাহলে এদেশ থেকে ধর্ষণ একদিন হারিয়ে যাবে। সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে অবিচল থাকার প্রেরণা জোগায় ২৪ আগস্ট। ভীরুর মতো অন্যায় মেনে চুপ করে বসে থাকার চেয়ে ন্যায়ের পথে আসা মৃত্যুকে বরণ করে নেয়া অনেক গর্বের বিষয়। আসুন, আমরা সকল প্রকার অন্যায়-নির্যাতনের বিরুদ্ধে এক হয়ে লড়ি

লেখাটির মূল-অংশ ফাহিমা কানিজ লাভা হতে আর কিছুটা বিভিন্ন জায়গা ও নিজে থেকে সংযোযিত করা হয়েছে।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে আগস্ট, ২০১৪ বিকাল ৫:২৭
৭টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

হুজুররা প্রেমিক হলে বাংলাদেশ বদলে যাবে

লিখেছেন মিশু মিলন, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ৯:২০



তখন প্রথম বর্ষের ছাত্র। আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে আমাদের আরেক বন্ধুর জন্মদিনের উপহার কিনতে গেছি মৌচাক মার্কেটের পিছনে, আনারকলি মার্কেটের সামনের ক্রাফটের দোকানগুলোতে। একটা নারীর ভাস্কর্য দেখে আমার... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইসলামের বিধান হতে হলে কোন কথা হাদিসে থাকতেই হবে এটা জরুরী না

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ১০:৫৫



সূরাঃ ৫ মায়িদাহ, ৩ নং আয়াতের অনুবাদ-
৩। তোমাদের জন্য হারাম করা হয়েছে মৃত, রক্ত, শূকরমাংস, আল্লাহ ব্যতীত অপরের নামে যবেহকৃত পশু, আর শ্বাসরোধে মৃত জন্তু, প্রহারে মৃত... ...বাকিটুকু পড়ুন

লবণ্যময়ী হাসি দিয়ে ভাইরাল হওয়া পিয়া জান্নাতুল কে নিয়ে কিছু কথা

লিখেছেন সম্রাট সাদ্দাম, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১:৫৪

ব্যারিস্টার সুমনের পেছনে দাঁড়িয়ে কয়েকদিন আগে মুচকি হাসি দিয়ে রাতারাতি ভাইরাল হয়েছিল শোবিজ অঙ্গনে আলোচিত মুখ পিয়া জান্নাতুল। যিনি একাধারে একজন আইনজীবি, অভিনেত্রী, মডেল ও একজন মা।



মুচকি হাসি ভাইরাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবন চলবেই ... কারো জন্য থেমে থাকবে না

লিখেছেন অপু তানভীর, ০২ রা মে, ২০২৪ সকাল ১০:০৪



নাইমদের বাসার ঠিক সামনেই ছিল দোকানটা । দোকানের মাথার উপরে একটা সাইনবোর্ডে লেখা থাকতও ওয়ান টু নাইন্টি নাইন সপ ! তবে মূলত সেটা ছিল একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। প্রায়ই... ...বাকিটুকু পড়ুন

দেশ এগিয়ে যাচ্ছে; ভাবতে ভালই লাগে

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০২ রা মে, ২০২৪ দুপুর ১:০৩


বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ছিল নেতিবাচক। একই বছরে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ছিল প্রায় ১ শতাংশ। ১৯৭৩ সালে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রবৃদ্ধি ছিল ৭... ...বাকিটুকু পড়ুন

×