somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ডায়েরির পাতা থেকে

০১ লা নভেম্বর, ২০১৪ রাত ১:১৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

২২শে জানুয়ারি ২০১৩ ।

রাতে একটা বিয়ের দাওয়াত ছিল । আমি আর ভাইয়া যাই। আমাদের সাথে ভাইয়ার কিছু বন্ধু ছিল । বেশ মজাই করলাম । বড় ভাইয়রা আগে থেকেই আমার সাথে বন্ধুসুলভ আচরন করতেন । আমার কখনো তাদের সাথে কথা বোরিং লাগে নায় ।

যাই হোক রাত ১১টার দিকে বাসায় এসে আব্বার সাথে কথা হইলো । আব্বার পোস্টিং রাংগামটিতে দেখে সেদিন আমাদের সাথে বিয়ের দাওয়াতে যেতে পারেন নায় ।

আমার স্পষ্ট মনে আছে এই কথা সেই কথা বলে ফোনটা রাখার সময় আব্বা বললো, ''শিহাব, জীবনে এই প্রথম তোমরা আমাকে ছাড়া কোন বিয়ে বাড়িতে গেলা । এজন্য মন খারাপ করো না । জীবন্টা অনেক বড় আর জীবন কখনোই থেমে থাকে না ।হয় শেষ হয়ে যায় না হয় চলতে থাকে ।''

যাই হোক আব্বার সাথে কথা বলার পর ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাস দিই । আমার খুবই ক্লোজ তিনজন ফ্রেন্ডকে পিঞ্চ করে স্ট্যাটাসটা দিই । কলেজ উঠার অনেক দিন পর আমার সেই স্ট্যাটাসে কাছের দূরের নতুন পুরনো সব ফ্রেন্ড একসাথে অনেক মজা করলাম । একজন আরেকজনকে পচাইলাম । অ্যান্ড আই ওয়াজ রিয়েলি রিয়েলি হ্যাপি ।আমি খুশি মনে ঘুমাইতে গেলাম।

এরপর দিন ভোর চারটার দিকে আম্মার ডাকে ঘুম ভাঙ্গে আমার ।আমি এক কানে ফজরের আজান শুনি আর আরেক কানে শুনতে পাই যে আব্বা স্ট্রোক করছে । রাত দুইটার দিকে রাঙ্গামাটি থেকে আব্বুর পিয়নরা আব্বুকে চিটাংয়ে নিয়ে আসে।

হার্ট স্ট্রোক করার পর আব্বু যে চারদিন হস্পিটালে ছিল তার প্রথম তিন দিন ডায়রি লিখসিলাম । চতুর্থ দিন লিখা হয় নায় । তৃতীয় দিনের পাতা থেকে নেওয়া............


''রাতের দেড়টা ।

পুরো হাসপাতাল ঘুমায় গেছে । আমার অবশ্য না ঘুমানোর প্ল্যান আছে আপাতত ।আগের দুরাতের মতোই পেশেন্টের আত্মীয়-স্বজনরা সিসিইউয়ের সামনের মাঝারি সাইজের করিডোরে নিজেদের মতো করে বিছানা করে নিয়েছে ।আমি তাদের পাহাড়াদারের মতো জেগে আছি ।

কিছুক্ষন আগে এক বয়স্ক মানুষ ঘুমের ঘোরেই ফ্যান বাড়ায় দিতে বললো । কাকে বললো কে জানে ! আমি দেখলাম ফ্যানের রেগুলেটর আরো বাড়ানো যায় ।

''চাচা ফ্যান বাড়ায় দিবো?'' বলেই ফ্যানের স্পীড বাড়ায় দিলাম । বয়স্ক মানুষটার দিকে তাকাই । দেখি আমার দিকে তাকায় আছে । মুখ ভর্তি দাড়ি। নিয়ম করে দাড়িতে মেহেদি দেন বলেই মনে হচ্ছে ।

-যেই গরম পড়সে । মানুষ ঘুমায় কেমনে?

-জি চাচা । ফ্যানের স্পীড বাড়ায় দিসি । আপনে ঘুমান ।

-তুমি ঘুমাবা না ?

-না চাচা আপনে ঘুমান ।

-অ । তোমার তো আবার বাপ । জাইগাই থাক ।বাপ-মা অসুস্থ থাকলে দীন দুনিয়া কিচ্ছু ভাল লাগে না ।কেমন খালি খালি লাগে ।

-আমি সারা রাত জাইগাই থাকবো চাচা।

-বুঝলা বাজান,বাপ-মা খুব কঠিন জিনিস । যার নাই হেই বুঝে খালি !

-চাচা আপনি ঘুমান । আমি একটু হাইটা আসি ।

-আচ্ছা বাজান,জাইগা থাকলে আমি ফজরের ওয়াক্তে ডাইকা দিও ।ওয়াক্তের মধ্যে ফজরের নামাজ না পইড়া দিন শুরু করলে আমার আবার দিনই ভালো যায় না ।

-ঠিক আছে চাচা । আমি ডাইকা দিব ।


এই তিনদিন হাসপাতালে থেকেই বুঝছি এখানে সবাই সবার অপরিচিত । কিন্তু সবার মানসিক অবস্থা সেইম ।


অল্প কয়েক ঘন্টার মধ্যেই একজন আরেকজনের সাথে দু;খের কথা শেয়ার করে ।আর্থিক অবস্থার কথা শেয়ার করে । একজনের প্রয়োজনে আরেকজন চিন্তা করে । একজনকে ধরে আরেকজন কান্না করে ।

আসলে বড় ধরনের অসুস্থতা সবার মাঝে অদ্ভুত এক বিশ্বাস সৃষ্টি করে ।

-আম্মু,আমি পি করবো !

-চুপ ! চুপ করে বসে থাকো !

-না আমি পি করবো !

-ভিতরে তোমার দাদি আসে । চিল্লা চিল্লি করলে আইসা মাইর লাগাবে কিন্তু !

-না আমি পি করবো !

-আপা,আমারে দেন । বাবুরে পি করায় আনি ।

-ভাই,দেইখো,বেশি লাফালাফি করে কিন্তু । এর সাথে তুমিও দৌড়ে পারবা না !

-সমস্যা নাই আপা ।বাবুর সাথে আমিও লাফালাফি করবো !


এই মহিলাকে আমি চিনতাম না । তিনিও আমাকে চিনতেন না । অথচ কতো নির্ভয়ে তার ছেলেকে আমার কাছে দিয়ে দিলেন । আসলে কখনো এক সাথে একাধিক ভয় কাজ করে না । হাসপাতালে সবাই আত্মীয়ের অসুখের ভয় নিয়ে আসে । এসময় অন্য কোনো ভয় কাজ করে না ।

রাত আড়াইটা বাজে আর আমি এখন একটা আড়াই বছরের পোলাকে পি করাইতে নিয়ে যাচ্ছি !


রাত চারটা ।

কাজহীনভাবে বসে আসি । বই পড়লাম কিছুক্ষন । বিরক্ত লাগতেসিল । একজনের সাথে ম্যাসেজিং করতেসিলাম।তার মোবাইলেরও চার্জ শেষ । আমি নিজেরই চার্জ শেষের পথে । চার্জ শেষ হওয়ায় এখন ঘুম পাচ্ছে প্রচুর !


কিছুক্ষন আগে সাত তালায় একটা ১৪-১৫ বছরের মেয়ে মারা যায় । তিনটার মতো বাজে মনে হয় তখন ।

তার বাবা-চাচারা খুব জোড়ে চিৎকার করে কান্না করতেছিল । চিল্লানো শুনে সাত তালায় গেলাম ।আমার সাথে আরো দুইটা বড় ভাইয়াও যায় ।

চাইল্ড ও মাদার কেয়ারে রাখা হইসিল মেয়েটাকে। ঢুকতে পারি নাই ।শুনলাম ব্রেইন ক্যান্সার বা ব্রেইন টিউমার হইসিল ।গ্রামের মেয়ে । ওঝা দিয়ে চিকিৎসা করার পরে হাসপাতালে আনা হয় । শেষ সময়ে আনে । ডাক্তারদের নাকি কিছু করার ছিল না ।

মেয়েটার বাবা-মায়ের জন্য দুঃখ হয় । বেশিক্ষন থাকি না সেখানে ।নেমে আসি পাঁচ তালায়।

সিসিইউয়ের সামনের বেঞ্চে বসে বসে ভাবি এই মেয়েটা তো প্রায় আমার বয়সেরই ।

এই মেয়ে হয়তো কিছু দিন আগেও মায়ের হাতে না খেলে খেতে পারতো না ।

এই মেয়ে হয়তো কিছু দিন আগেও ফ্রক পরতো, চুলে দুই বেনী করতো,পুকুরে সাতার কাটতে যেয়ে খাবি খেত,ভাবির সই হয়ে সারা দিন ভাবির পিছন পিছন ঘুরতো,পুতুলের বিয়ে নিয়ে ঝগড়া করতো সইয়ের সাথে।

এই মেয়েকে হয়তো কিছুদিন আগেও ফ্রক ছেড়ে কামিজ পড়ানোর জন্য তার বাবা-মা চিন্তিত ছিল,দিনে দুপুরে পুকুরে নেমে গোসল করতে মানা করা হয়েছিল,যার তার সাথে মেলামেশা করতে মানা করেছিল,আগের মতো গাছে উঠতে মানা করেছিল ।

এই মেয়ের দস্যিপনা নিয়ে হয়তো বাবা-মা সারাদিন চিন্তিত থাকতো ।বাড়ন্ত মেয়ের এভাবে লাফালাফি করা যে ঠিক না ! আর সেই মেয়ে আজ বাবা-মার সকল চিন্তা দূর করে দিয়ে ঐ পারে চলে গেল ।

এই বয়সের মেয়ের কতো নিয়ম-কানুনের ভেতর দিয়ে চলতে হয় । অথচ আজ এই বয়সের মেয়েটাই সকল নিয়ম কানুন ভন্ডুল করে দিয়ে চলে গেল ।


সকাল ছয়টা ।

ঘুম পাচ্ছে খুব । ঘুমানো দরকার ।''
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

লালনের বাংলাদেশ থেকে শফি হুজুরের বাংলাদেশ : কোথায় যাচ্ছি আমরা?

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:১৪



মেটাল গান আমার নিত্যসঙ্গী। সস্তা, ভ্যাপিড পপ মিউজিক কখনোই আমার কাপ অফ টি না। ক্রিয়েটর, ক্যানিবল কর্পস, ব্লাডবাথ, ডাইং ফিটাস, ভাইটাল রিমেইনস, ইনফ্যান্ট এনাইহিলেটর এর গানে তারা মৃত্যু, রাজনীতি,... ...বাকিটুকু পড়ুন

অভিনেতা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:১৫



বলতে, আমি নাকি পাক্কা অভিনেতা ,
অভিনয়ে সেরা,খুব ভালো করবো অভিনয় করলে।
আমিও বলতাম, যেদিন হবো সেদিন তুমি দেখবে তো ?
এক গাল হেসে দিয়ে বলতে, সে সময় হলে দেখা যাবে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমেরিকার গ্র্যান্ড কেনিয়ন পৃথিবীর বুকে এক বিস্ময়

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৪১


প্রচলিত কিংবদন্তি অনুসারে হাতে গাছের ডাল আর পরনে সাধা পোশাক পরিহিত এক মহিলার ভাটাকতে হুয়ে আতমা গ্র্যান্ড কেনিয়নের নীচে ঘুরে বেড়ায়। লোকমুখে প্রচলিত এই কেনিয়নের গভীরেই মহিলাটি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি! চুরি! সুপারি চুরি। স্মৃতি থেকে(১০)

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৩৪


সে অনেকদিন আগের কথা, আমি তখন প্রাইমারি স্কুলে পড়ি। স্কুলে যাওয়ার সময় আব্বা ৩ টাকা দিতো। আসলে দিতো ৫ টাকা, আমরা ভাই বোন দুইজনে মিলে স্কুলে যেতাম। আপা আব্বার... ...বাকিটুকু পড়ুন

তাবলীগ এর ভয়ে ফরজ নামাজ পড়ে দৌড় দিয়েছেন কখনো?

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:২৬


আমাদের দেশের অনেক মসজিদে তাবলীগ এর ভাইরা দ্বীন ইসলামের দাওয়াত দিয়ে থাকেন। তাবলীগ এর সাদামাটাভাবে জীবনযাপন খারাপ কিছু মনে হয়না। জামাত শেষ হলে তাদের একজন দাঁড়িয়ে বলেন - °নামাজের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×