বিশ্ব শান্তি কি কখনো আমরা দেখেছি? এমন কোন অবস্থা কি আসলেই অর্জন করা সম্ভব, যখন বলা যায় যে পৃথিবীতে শান্তি অর্জিত হয়েছে। ধরা যাক আপনার আলমারীতে একশ বিষধর সাপ আছে। আপনি আলমারীর চাবী হাতে বসে আছেন। আপনি কি শান্তিতে আছেন? আপনার বাসায় যারা আছে, তারা কি শান্তিতে ঘুমাতে পারছে? তাহলে পৃথিবীর অল্প কয়েকটি দেশ যারা হাজার হাজার পারমানবিক ওয়ারহেড ও জীবানু অস্ত্র নিয়ে বসে আছে, তারা কি বিশ্বকে শান্তিতে রেখেছে? এই লেখাটিতে আমাকে বলা হয়েছে তাদের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্রটি নিয়ে কিছু বলতে। যার নাম ইউ এস এ। পৃথিবীর দুটো বিশ্বযুদ্ধ এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ভ পরবর্তি সকল যুদ্ধে দেশটির কোনো না কোনো ভূমিকা ছিল। যদিও বলা হয়ে থাকে যে তাদের সকল কাজই বিশ্বকে শান্তিময় রাখার জন্য করা হয়ে থাকে। তাদের প্রেসিডেন্টরা বিশ্বশান্তি শব্দটি বলতে বলতে দাঁত ক্ষয় করে ফেলেছেন। কাজে কর্মে অবশ্য এর প্রমাণ পাওয়া যায় না।
এই দেশটি জীবানু অস্ত্র নিয়ে নিজেরা গবেষণা করে কিন্তু অন্যদের করতে বাঁধা দেয়। এরা পরিবেশ সংক্রান্ত কিয়োটো প্রটোকলে সই করে না কিন্তু অন্য দেশকে গ্রীন হাউজ গ্যাস কমাতে বলে। এরা দেশে দেশে গণতন্ত্র কায়েমের জন্য মুখে ফেনা তুলে ফেলে কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যেে তেল সমৃদ্ধ দেশগুলিতে অলস, অথর্ব, স্বেচ্ছাচারী রাজতন্ত্রকে সমর্থন দেয় ও সাহায্য করে। এরা কিউবার উপর অবরোধ দিয়ে রাখে বছরের পর বছর অথচ ইসরায়েলকে কিছু বলে না। উত্তর কোরিয়া, ইরান বা পাকিস্তানের পরমানু গবেষণা নিয়ে এদের মাথাব্যাথার সীমা নেই, কিন্তু ইসরায়েল বা ভারতকে এরা তেমন কিছু বলে না।
বিশ্ব শান্তি যে শুধু অস্ত্রের কারনে বিপন্ন সেটি নয়। বিশ্ব শান্তি পরিবেশ, অর্থনীতি কিংবা রাজনীতির জন্যও বিপন্ন হতে পারে। দেশে দেশে জাতীয়তাবাদের বিকাশও কিন্তু বিশ্ব শান্তির শত্র“। আমরা পৃথিবীকে ভালবাসি না, ভালবাসি শুধু নিজের জাতি আর নিজের দেশকে। ফলে ভারত ফারাক্কা বাঁধ দিয়ে আমাদের মরুভুমি বানায়, নিজের কোলকাতা বন্দরকে নাব্য রাখতে আর সেচ এর পানি জোগাতে। চীন তিব্বত দখল করে নেয়। মায়ানমার থেকে রোহিংগারা বিতাড়িত হয়। কাশ্মীর আর বেলুচিস্তানে স্বাধীনতাকামীদের সন্ত্রাসী বলে আখ্যা দেয়া হয়। আফগানিস্তানে জিহাদ এর ফিলসফি বিক্রি করে সি.আই.এ রাশিয়ানদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে ধর্মকে। আবার সেই জিহাদীরা মুজাহেদীন থেকে সন্ত্রাসী হয়ে যায় যখন জেহাদ এর তরবারী ঘুরে যায় আমেরিকানদের দিকেই। উগ্র জাতীয়তাবাদী হুটু আর টুটসীরা একে অন্যকে হত্যা করে, রবার্ট মুগাবে জাতীয়তাবাদের নামে জিম্বাবুয়ে থেকে শ্বেতাংগ ও ভারতীয়দের তাড়িয়ে দেন, উগান্ডার ইদি আমিনের মতো পরিষ্কার করেন দেশকে। বিশ্ব শান্তি অর্জন তখনই সম্ভব হতো যদি আমরা জাতী ধর্ম বর্ণের উপরে উঠে মানুষকে ভালবাসতে পারতাম। দেশের সীমানা ছাড়িয়ে ভালবাসতে পারতাম পৃথিবীকে।
ঐতিহাসিকভাবে পশ্চিম যেমন সভ্যতাকে সমৃদ্ধ করেছে তেমনি সভ্যতাকে ধ্বংসও করেছে। স্প্যানিশ কনকুইজাডোরদের হাতে ধ্বংশ হয়ে গেছে মায়া আর ইনকা সভ্যতা। বাগদাদ আর কার্থেজ ধ্বংস হয়েছে। ক্রসেড করেছে তারা বারবার। ধর্মের নামে বারবার আক্রমন করেছে, মধ্যযুগে উইচ হান্টিং এর নামে পুড়িয়েছে হাজারো বই, মেরেছে জিওর্দানো ব্র“নো, জোয়ান অব আর্ক এর মতো মানুষদের। আলেক্সান্ডার কে বলেছে গ্রেট আর চেংগীস খানকে বলেছে নৃশংস। যেনো আলেক্সান্ডার ফুলগাছ দিয়ে যুদ্ধ করতেন আর চেংগীস খান তরবারী দিয়ে। কোন অংশেই দুজনের কেউ কারো চেয়ে কম নৃশংস ছিলেন না। অথচ মেসেডেনিয়ার আলেক্স্রান্ডার বীর আর চেংগীস শয়তান, এভাবেই পশ্চিমারা বলে থাকে। সিজার তাই তাদের কাছে অসাধারন আর ক্লিওপেট্রা পুরুষলোভী রমনীমাত্র। ক্লাইভ বাংলা দখল করেছেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর জন্য। যেমন আমেরিকাতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী ভার্জিনিয়া দখল করেছিল তামাক চাষের জন্য। ইতিহাস নিজেও তাই সবসময় নিরপেক্ষ নয়। যে কারনে ফিডেল ক্যাস্ট্রোকে মেরে ফেলার জন্য চেষ্টা করে সি আই এ, তার প্রতি তার জনগনের সমর্থন থাকার পরও, চিলির আলেন্দেকে, আফ্রিকাতে প্যট্রিস লুমুম্বাকে হত্যা করায়। অথচ নির্লজ্জভাবে জনসমর্থনহীন মার্কোস, ইরানের শাহ বা ইন্দোনেশিয়ার সুহার্তোকে সমর্থন দিয়ে যায়। এরা সাদ্দামের বাহিনীকে ইরানের বিরুদ্ধে অস্ত্র দেয় আবার কনট্রা গেরিলাদের সাহায্য করার জন্য ইরানের কাছে অস্ত্র বিক্রি করে সেই টাকা নিকারাগুয়াতে পাঠায়। মোনিকার সাথে দুষটুমী করার জন্য ক্লিন্টনের প্রেসিডেন্সি যায় যায়, অথচ রিগান এর কিছুই হয় না। শুধু অলিভার নর্থ এর সাজা হয়।
ইউ এস এ বিশ্ব পরিবেশের বারোটা বাজানোতে সবচেয়ে এগিয়ে আছে। তারা অন্যতম প্রধান গ্রীনহাউজ গ্যাস নির্গমনকারী দেশ। তারা এটি কমাতেও নিমরাজী। এরা দুটো পারমানবিক বোমা মানুষের উপর ব্যবহার করেছে। এরা সবচেয়ে বেশী পারমানবিক পরীক্ষা চালিয়েছে। এরা স্টার ওয়ারস কর্মসূচির মাধ্যমে মহাশূণ্যেও যুদ্ধকে নিয়ে গেছে। এদের রাসায়নিক অস্ত্রের কারনে ভিয়েতনাম এর লক্ষ লক্ষ হেক্টর জমিতে এখনো কোন ফসল হয় না এবং এখনো বিকলাংগ শিশু জন্ম নিচ্ছে। এরা কোরিয়াতে সৈন্য পাঠিয়েছে এবং যুদ্ধ করেছে। তারপর ভিয়েতনামে। তারপর আফগানিস্তানে তৈরী করেছে বিশ্ব সন্ত্রাসবাদ। এরা ইরাক আক্রমনের নামে কুয়েত ও সৌদি আরব এবং কাতারে ৯১ সালে ঢুকেছে এবং এখনো ঘাঁটি বানিয়ে বসে আছে। এরপর এরা লাদেন মারার নামে আফগানিস্তানে ন্যাটো বাহিনী প্রবেশ করিয়েছে এবং ইরাকে লাখ লাখ শিশু ও নারীকে হত্যা করেছে দীর্ঘমেয়াদী অবরোধের মধ্য দিয়ে। তারপর ইরাকে প্রবেশ করেছে এবং বাগদাদের যাদুঘরটাকে ধ্বংস আর লুটপাট করেছে। পুরো মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাস আর ঐতিহ্যের জায়গাটিকে শেষ করে দিয়েছে। এরা বিমিনি দ্বীপকে প্রানী ও জনমানবশূণ্য বানিয়ে ফেলেছে নিউক্লিয়ার টেস্টিং করে। এরা দিয়েগো গার্সিয়া থেকে জোর করে অধিবাসীদের বের করে দিয়ে সেখানে নিজেদের সামরিক ঘাঁটি বানিয়েছে। এরা হাইতি থেকে অ্যারিস্টিড সরকারকে উৎখাত করেছে বৃহৎ কর্পোরেশনগুলোর স্বার্থ রক্ষা করার জন্য। পরে আবার তাকে সেখানে নিয়ে গেছে তাদের সাথে আপোষের পর। এরা তাদের মিত্র পানামার নরিয়েগাকে ড্রাগস ব্যবসা করতে দিয়েছে কিউবা, নিকারাগুয়া সহ বিভিন্ন দেশে অপতৎপরতার টাকা জোগানের জন্য আবার তাকে ধরে এনে বিচার করেছে যখন নরিয়েগা ডাবল এজেন্ট এর কাজ করছেন বলে জেনেছে।
এরা গ্রানাডাতে সামরিক অভিযান চালিয়ে সরকার উৎখাত করেছে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় এরা পাকিস্তানকে সমর্থন করেছে। এরা পূর্ব তিমুরে ইন্দোনেশীয় বাহিনীর গণহত্যাকে সমর্থন করেছে। বসনিয়াতে এথনিক ক্লেনজিং এর সময় এরা চুপ করে থেকেছে। এরা দারফুরের বেলাতেও নিষ্ক্রিয় এক ধরনের ভুমিকায় আছে। এরা সিয়েরা লিওন সহ আফ্রিকার নানা দেশ থেকে প্রাকুতিক সম্পদ লুটপাটকারীদের নিজের দেশে ব্যবসা করতে দিয়েছে। গুয়ানতানামোতে জেলখানা বানিয়েছে। ওকিনাওয়া দখল করে রেখেছে।
এসব সবাই জানে। একটি বিষয় বুঝতে হবে যে, প্রকৃত অর্থেই দারিদ্র দুর না করে এবং বিশ্বপরিবেশ রক্ষা না করে বিশ্ব শান্তি অর্জন করা সম্ভব নয়। ইউ এস এ বা অন্য কেউ এখানে কোন প্রতিপক্ষ নয়। ইউ এস এ তাদের নিজেদের স্বার্থ দেখছে। যার শক্তি বেশী সে স্বেচ্ছাচারী হবে এটা স্বাভাবিক। বড় বড় কর্পোরেশনগুলি তাদের বিনিয়োগ বাঁচাতে চাইবে, আরো বেশী মুনাফা চাইবে, সেটাই স্বাভাবিক। আমরা তাহলে কি করবো? আমাদের নিজস্ব পূঁজির বিকাশ এই মুহুর্তে বেশী জরুরী। ১৫ কোটি মানুষের দেশে সবচেয়ে বড় সম্পদ মানুষ। তাই আমাদের এখন মানুষ তৈরী করা দরকার। পশ্চিমে এখন সম্পদ আছে মানুষ নাই। আমাদের মানুষ আছে, সম্পদ নাই। মানব সম্পদ উন্নয়নে বিনিয়োগ করা এখন সবচেয়ে বেশী দরকার । এই জনগোষ্ঠীকে উৎপাদন প্রক্রিয়ায় নিয়ে আসতে পারলেই আমরা সম্পদ সৃষ্টি করতে পারবো অনেক বেশী। যেটা চীন হাতে কলমে করে দেখিয়েছে। কাজের সুযোগ দিতে পারলে সনত্রাস, মৌলবাদ অনেক কমে যাবে। ইউ এস এ বা অন্য কোন বৃহৎশক্তি তখনই আমাদের সংগে অসম আচরন করতে পারে যখন আমরা অসচেতন থাকি। ভারতের সাথে বা চীনের সাথে এমন পারে না কারন তারা দর কষাকষি করতে জানে। আমাদের পক্ষে দরকষাকষির জন্য সবল, জ্ঞানী ও যুক্তিশীল ব্যক্তিদের নিয়েজিত করতে হবে।
অসাম্য থাকলে শান্তি থাকে না। সবাই সমান হতে পারলে শান্তি অর্জন এমনিতেই সম্ভব। তাই বিশ্বশান্তি অর্জনের জন্য উন্নয়নের কোন বিকল্প নাই। আমাদের জন্য কেউ কিছু করে দেবে না, এটাই বাস্তবতা। এখন আর খাদ্য সাহায্য আসে না। খাদ্য কিনতে বিশ্বব্যাংক ঋণ দেয়। তাই ভিয়েতনাম বা থাইল্যান্ড এর মতো হেকটরপ্রতি উৎপাদন বাড়াতে হবে যদি ভবিষ্যতে চাল খেতে হয়। এখন আর আগের মতো বিদেশে ফ্রী পড়া যায় না। তাই দেশে উচ্চ শিক্ষার সুযোগ বাড়াতে হবে। এখন আর ভারসাম্যহীন সামরিক ব্যয় বাড়ানো যায় না। তাই সুষম বাজেট ও দূরদর্শী উন্নয়ন পরিকল্পনা করতে হবে।
অবস্থার পরিবর্তনে ইউ এস এ এখন আমাদের সবচেয়ে মিত্রদেশ গুলির একটি। এই মিত্রতাকে কাজে লাগিয়ে কতটুকু নিজস্বার্থ অর্জন করা সম্ভব সেটা নির্ভর করছে নেতৃত্বের উপর। দ: কোরিয়া, সিংগাপুর, তাইওয়ান, হংকং, মালয়েশিয়া, ভারত এসব দেশের উদাহরন আমাদের সামনেই আছে। এই শতাব্দির যুদ্ধ হবে অর্থনৈতিক শক্তির বিস্তার ও বাজার দখলের। এখানে নতুন পূঁজি তৈরী হবে মেধাবী মানুষের আইডিয়া ও ইনোভেশন অর্থাৎ নতুন ধারনা ও আবিষ্কারের মাধ্যমে। তাই গুগল কিংবা ইউ টিউব এর মতো সাইবার প্রপার্টি আরো বি¯তৃত হবে। পেটেন্ট রাইটস এর যুদ্ধ হবে । যেখানে যে দেশের যতো বেশী পেটেন্ট, সে দেশ ততো বেশী আয় করবে। সে যুদ্ধে আমরা অনেক এগিয়ে থাকবো যদি পনেরো কোটি মানুষকে শিক্ষার সুযোগ দেয়া যায়। কারন টাকা দিয়ে সব তৈরী করা যায় কিন্তু মানুষের মগজ বানানো যায় না। পনেরো কোটি মানুষ মানে পনোরো কোটি মগজ। পনেরো কোটি নতুন আবিষ্কারের কাঁচামাল, পনেরো কোটি আইনস্টাইন অথবা বিল গেটস তৈরীর সম্ভাবনা।
এই শতাব্দীতে বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মকে সঠিকভাবে গড়ে তুলতে পারলে অতি সহজেই দারিদ্র দুর করা যাবে। দেশের সম্পদ বাড়ানো যাবে। আর আমরা যতো বেশী সবল হবো ততোই শোষন কমবে, অবিচার কমবে। বৃহৎ শক্তির চোখ রাংগানি কমবে। বিশ্ব শান্তি অর্জন ততোই সহজ হয়ে উঠবে।
ইউটোপিয়া মনে হচ্ছে? মনে হতে পারে বৈকি!
সবাইকে আরেকবার মনে করিয়ে দেই, স্বপ্ন দিয়েই ভবিষ্যত তৈরী হয়। স্বপ্নহীন মানুষ পৃথিবীকে কিছু দিতে পারে না, নিজেও কিছু পায় না। আসুন সবাই বিশ্বশান্তির স্বপ্ন দেখি আর তাকে বাস্তবে পরিনত করি।
****লেখাটি একটি ডিবেটিং ক্লাবের স্মরনিকার জন্য লিখিত।