somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায় সম্পর্কে প্রাথমিক পর্যালোচনা

২৫ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ ভোর ৪:১৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


পাকিস্তানের শাসক শ্রেণীর উপনিবেশিক শোষণ-নিপীড়নের বিরুদ্ধে পূর্ববাংলার জাতি ও জনগণ যখন জাতীয় মুক্তির সংগ্রাম গড়ে তোলে তখন সে সংগ্রামকে সামরিকভাবে দমনের লক্ষ্যে অন্যায় আগ্রাসী যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়। ১৯৭১ সালে এ যুদ্ধে পাকিস্তানের ফ্যাসিস্ট সামরিক বাহিনী এ জাতি ও জনগণের উপর ইতিহাসের এক নির্মম গণহত্যা পরিচালনা করে। যুদ্ধে ৩০ লক্ষ মানুষ শহীদ হয়, ২ লক্ষাধিক নারী ধর্ষনের শিকার হয়, লুটতরাজসহ জ্বালিয়ে দেয়া হয় হাজার হাজার গ্রাম ও হাটবাজার। ১৯৭১ সালে এ যুদ্ধে ও গণহত্যায় পাকিস্তানের ফ্যাসিস্ট সামরিক বাহিনীকে সহায়তা করে তাদের এ দেশীয় দোসর রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনী। এ দোসর বাহিনী গঠনে যোগ দেয় জামাত ইসলামী, মুসলিম লীগ ও পিডিপি। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ভারতীয় বাহিনীর নেতৃত্বে যৌথ বাহিনীর কাছে পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর আত্ম-সমর্পন এবং পাকিস্তান হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটলে এদেশের জনগণ আশা করেছিল এ নির্মম যুদ্ধাপরাধের ন্যায্য বিচার পাবে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, জাতিগত ও সাম্প্রদায়িক নিশ্চিহ্নতার লক্ষ্যে বেসামরিক জনগণকে ব্যাপক হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন, অগ্নিসংযোগ ও লুণ্ঠনসহ যে জেনোসাইড ঘটেছিল তার বিচার আজ পর্যন্ত হয়নি। এ জাতি দুনিয়ার বুকে যতদিন টিকে থাকবে, ততদিন এ গণহত্যাকারী পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীসহ রাজাকার-আলবদর-আলশামস্দের; তাদের চিহ্নিত পালের গোদাদের ঘৃণা করবে এবং বিচার না হওয়া পর্যন্ত সকল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবী করবে।
১৯৭২ সালেই জনগণ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবী তুলেছিল। ১৯৯২ সালে গোলাম আযমের নাগরিকত্ব প্রদানের পর জনগণ যুদ্ধাপরধাীদের বিচারের দাবীতে ফুঁসে ওঠে এবং গণআদালতে গোলাম আযমের ফাঁসির রায় দেয়। সর্বশেষ কাদের মোল্লার প্রহসনের বিচার ও রায় জনগণকে বিক্ষুব্ধ করে তুলেছে। ৪২ বছরের প্রবঞ্চনার জবাবে দেশপ্রেমিক ও সংবেদনশীল তরুণ ও মধ্যবিত্ত আজ মাঠে নেমেছে, তাদের সাথে একাত্মতা পোষণ করেছে এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ। এটা সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করতে চাই, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও জঘন্য অপরাধীদের ফাঁসির দাবী এক ন্যায়সঙ্গত দাবী। বিচার নিয়ে প্রহসনের বিরুদ্ধে এ জাগরণ-অন্যায়ের বিরুদ্ধে এক ন্যায়সঙ্গত বিদ্রোহ
গত ৪২ বছরের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বিএনপি নেতৃত্বাধীন শাসক শ্রেণী যুদ্ধপরাধীদের নগ্নভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করেছে। অপরদিকে আওয়ামীলীগ নেতৃত্বাধীন শাসকশ্রেণী গোপন আঁতাতের মাধ্যমে এদের রক্ষা ও পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে গেলেও- তার দায় অস্বীকার করছে। আরবীতে প্রত্যক্ষ শত্রুকে বলা হয় ‘কাফের’ এবং আর দলে ঘাপটি মেরে থেকে পিঠে ছুরি চালায় এমন শত্রুদের বলা হয় ‘মুনাফেক’। যুদ্ধাপরাধীদের প্রশ্নে বিএনপি নেতৃত্বধীন শাসকশ্রেণীকে যদি ‘কাফের’ বলি তবে আওয়ামীলীগ নেতৃত্বাধীন শাসক শ্রেণীকে বলতে হবে ‘মুনাফেক’।

মাও সেতুঙ চীনের কয়েক শ বছরের বিপ্লবের ইতিহাস পর্যালোচনা করে বলেছিলেন, ‘কারা আমাদের শত্রু? কারা আমাদের মিত্র? এটাই হলো বিপ্লবের জন্য সর্বপ্রধান গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। অতীতে চীনের সমস্ত বিপ্লব কেন যে অত অল্প সাফল্য অর্জন করেছিল তার মূল কারণ হচ্ছে, প্রকৃত শত্রুদের বিরুদ্ধে প্রকৃত বন্ধুদের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হতে না পারা।’ আজকের যে ন্যায়সঙ্গত বিদ্রোহ, তাকে সঠিক পথে পরিচালিত ও সফল করতে হলে আমাদের ঠিক করতে হবে কারা এ আন্দোলনের প্রকৃত বন্ধু এবং কারা প্রকৃত শত্রু।
কিন্তু আমরা লক্ষ্য করছি, জনগণের এ স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভকে বরাবরের মত আওয়ামীলীগের নেতৃত্বে বিশ্বাসঘাতক শাসক শ্রেণী তাদের নিজস্ব ছকে পরিচালনা করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে এবং এ পর্যন্ত সফলও হয়েছে। আমরা আশঙ্কা করি, এ আওয়ামী বিশ্বাসঘাতকদের কব্জা ও ছক থেকে মুক্ত করে এ আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে না পারলে আবারো আন্দোলন কাঙ্খিত সাফল্য অর্জন করতে পারবে না। কেবল তাই নয়, আন্দোলন পরিণত হবে শাসক শ্রেণীর স্বার্থ সিদ্ধির হাতিয়ারে। তাই আসুন, আমাদের আবেগকে বিচার-বুদ্ধি প্রয়োগে শানিত করি। প্রকৃত শত্রু ও মিত্র চিহ্নিত করে জনগণের বিক্ষোভ ও আন্দোলনকে সঠিক দিশায় পরিচালনার জন্য ঐক্যবদ্ধ হই।
সঠিক দিশায় আন্দোলনকে অগ্রসর করার স্বার্থেই আজ আমাদের প্রশ্ন তুলতে হবে, কেন কাদের মোল্লার বিচার প্রহসনে পরিণত হল, কেন একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীরা এ ৪২ বছরেও শাস্তির মুখোমুখি না হয়ে পুনর্বাাসিত ও প্রতিষ্ঠিত হল, এ জন্য কারা দায়ী? আমাদের প্রশ্ন তুলতে হবে এ আন্দোলনের বর্তমান ছক নিয়েও: শাসক শ্রেণীর ছক থেকে মুক্ত করে আনার জন্য কি কি দাবী ও স্লোগান আজ তুলতে হবে, কি কর্মসূচি ও সাংগঠনিক রূপ আজ প্রয়োজন, কোন পথে পরিচালিত হবে এ আন্দোলন? কেবল বিচারের রায়ের ন্যায্যতা নিয়েই নয়, বরং প্রশ্ন তুলতে হবে এ রাষ্ট্রকে নিয়ে। যে জাতি ও জনগণ ’৭১ সালে শ্রমিক-কৃষক-জনগণের একটি স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক শাসন ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এত আত্মত্যাগ করল, তার প্রেক্ষিতে ৭১ পরবর্তীকালে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্র ও শাসন ব্যবস্থার ন্যায্যতা নিয়েই আজ আমাদের প্রশ্ন তুলতে হবে।
একাত্তরের নরঘাতক কসাই কাদের মোল্লার ফাঁসি না হওয়ার পেছনে দায়ী কে?
আন্তর্জাতিক মানবাতা বিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনালে কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে আনীত হত্যা, ব্যাপক হত্য ও ধর্ষণসহ ৬টি অভিযোগের ৫টি প্রমাণ করা হয়েছে। এ সব অপরাধে তার সংযুক্তির প্রমাণও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু এ সংযুক্তির মাত্রা এমনভাবে প্রমাণ করা হয়েছে যে, বিচারকরা তাকে মৃত্যদন্ড- থেকে রেহাই দেয়ার আইনগত সুযোগ পেয়েছে। প্রথমত সরকারের প্রসিকিউসন মামলার এজহারে সরাসরি হত্যাকান্ডের জন্য কোন অভিযোগই করেনি; যা সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড নিশ্চিত করতে পারত। দ্বিতীয়ত জেনোসাইড বা গণহত্যাকে উপস্থাপন করা হয়েছে ‘ব্যাপক হত্যা’ বা মাস কিলিং হিসাবে। এতে অপরাধের মাত্রা লঘু হয়ে পড়েছে। তৃতীয়ত কাদের মোল্লাকে প্রমাণিত অপরাধগুলো উর্ধ্বতন কর্মকতা হিসাবে দায়ী করা হয় নি। ফলে অপরাধের গভীরতা প্রমাণের দিকটি দুর্বল হয়ে পড়েছে। ফলে বিচারকরা অপরাধের সাথে কাদের মোল্লার ‘সংযুক্তির মাত্রা ও গভীরতা’ বিচারে তাকে সর্বসম্মতিক্রমে সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন প্রদান করেছে, মৃত্যদ- নয়। এ থেকে আমরা সিদ্ধান্তে আসতে পারি যে, বিচারকরা আইনের আওতায় অথবা তার ফাঁক গলেই এ রায় দিয়েছে। আইন লঙ্ঘন করে তা করেনি।
আইনের এ ফাঁক সৃষ্টির জন্য দায়ী তাহলে কে? প্রসিকিউসন? প্রসিকিউসনের যোগ্যতা, দক্ষতা ও আন্তরিকতার অভাবই কি এ ব্যর্থতার কারণ? আপাতদৃষ্টিতে তাই মনে হতে পারে। কিন্তু যে অদক্ষতা প্রসিকিউসন দেখিয়েছে-তা অনিচ্ছকৃত, না ইচ্ছাকৃত ;সে প্রশ্নের উত্তর আমাদের পেতে হবে। প্রসিকিউটর নিয়োগ দেয় সরকার ও তার তত্ত্ববধান করে আইন মন্ত্রণালয়। কেন অনেক দক্ষ আইনজীবী থাকা সত্ত্বেও সরকার এ প্রসিকিউসন নিয়োগ করেছে? সরকার কি দক্ষ প্রসিকিউশন চেয়েছে না আজ্ঞাবাহী প্রসিকিউশন-এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া জরুরী ।
সার্বিকভাবে বর্তমান রাষ্ট্রের বিচার ব্যবস্থা কতটা সরকারী ইচ্ছামুক্তভাবে চলতে সক্ষম- তার আলোকে এ প্রসিকিউসনের তৎপরতা ও মামলার রায়টিকে বিবেচনা না করলে- তা আমাদের বিভ্রান্তির দিকেই চালিত করবে। একজন প্রধান বিচারকের পদত্যাগ, স্কাইপি কেলেঙ্কারি ইত্যাদি ঘটনায় ট্রাইবুনালের কার্যক্রমে সরকারের হস্তক্ষেপের প্রমাণ রয়েছে। গত ৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ কালের কণ্ঠে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানা যায়, কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে কেরাণী গঞ্জের ‘ঘাটারচর গণহত্যা’ মামলার ২ সাক্ষীকে মামলা চলাকালে অপহরণ করে ২৮ দিন অন্তরীণ করে রাখা হয়। তারা গণমাধ্যমে মুখ খুলতে নারাজ। তবে তারা বলেছে, সাক্ষী সত্য বলবে বলেই তাকে অপহরণ করা হয় এবং অপহরণের পর পুলিশ অভিযোগ গ্রহণ করেনি। তাহলে সরকারের ইচ্ছাতেই কি বিচারের রায় এ পথে চালিত হয়েছে? এ প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে আরও কিছু বিষয়কে বিবেচনায় নিতে হবে।

মানবতা বিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনাল যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তি দিতে অক্ষম
নির্বাচনী অঙ্গীকার, আওয়ামীলীগের একাংশ ও জনমতের চাপের কারণে ক্ষমতায় এসে এবার যুদ্ধাপরাধীদের অন্ততঃ একটি প্রতীকী বিচার কাজ হলেও শুরু করা ছাড়া আওয়ামীলীগের গত্যন্তর ছিল না। একই সাথে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হিসেবে বিএনপি জোটকে কোনঠাসা করা এবং পরবর্তী নির্বাচনে এ বিচার কাজকে ব্যবহারের স্বার্থেও আওয়ামীলীগ এ বিচারের উদ্যোগ নেয়। শুরুতে তারা যুদ্ধাপরাধের বিচারের কথা বলে। কিন্তু ট্রাইব্যুনাল গঠনের আগে আইন মন্ত্রী যুক্তরাষ্ট্র সফর করেন। সেখান থেকে এসে তিনি বলতে শুরু করেন, যুদ্ধাপরাধ নয় বিচার হবে মানবতা বিরোধী অপরাধের। আর ট্রাইব্যুনালের নাম হবে মানবতা বিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। জামাত ইসলামী মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিশ্বস্ত মিত্র। মার্কিন-ভারতের মদদে ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসা আওয়ামীলীগের পক্ষে তার প্রভু মার্কিনের আদেশ উপেক্ষা করা অসম্ভব। সুতরাং যে মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদ ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের গণহত্যাকারী শাসক শ্রেণী ও সামরিক বাহিনীকে মদদ দিয়েছিল তাদেরই নির্দেশে যুদ্ধাপরাধের বিচার পরিণত হল তথাকথিত মানবতা বিরোধী অপরাধের বিচারে।
১৮৯৮ সালে প্রণীত ফৌজদারি কার্যবিধিতে গণহত্যা, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ, শান্তির বিরুদ্ধে অপরাধ,যুদ্ধাপরাধের বিচারের কোন সুযোগ নেই।
১৯৭২-৭৪ সালের মধ্যে ভারত-পাকিস্তান সিমলা চুক্তির অধীনে জাতীয় বিশ্বাসঘাতক দিল্লি চুক্তির আওতায় ৯৩ হাজার পাকিস্তানী সৈন্য, জেনারেল নিয়াজীসহ ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধী এবং সমসংখ্যক আটক ব্যক্তিকে সসম্মানে পাকিস্তানে ফেরত পাঠানো হয়েছিল। একাত্তরের ঘাতক-দালালরা ছিল অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তি। তৎকালীন আওয়ামীলীগের পৃষ্ঠপোষকতায় বহু চিহ্নিত দালাল অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে পুনর্বাসিত হয়। গুরুত্বপূর্ণ পদে তাদের আসীন করা হয়। সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার মাধ্যমে হাজার হাজার বন্দী দালালদের মুক্তি দেওয়া হয়। ১৯৭৩ সালের দালাল আইনের অধীনে গুরুতর অপরাধে অপরাধীদের বিচারের কথা থাকলেও চিকন আলী নামে এক ছিঁচকে চোরের ফাঁসিসহ গুটি কয়েকের শাস্তি হলেও বাঘা বাঘা অপরাধীদের বিচার করা হয়নি।
আওয়ামীলীগ যুদ্ধাপরাধীদের পুনর্বাসনের যে কাজ শুরু করেছিল ১৯৭৫ সাল থেকে সামরিক শাসক জেনারেল জিয়া ক্ষমতায় এসে তাকে পরিপূর্ণতা দান করে। মুক্তিযুদ্ধের ঘোষক দাবীদার জিয়াউর রহমান ১৯৭৩ সালের দালাল আইন বাতিল করে বিচারাধীন দালালদের বিচারের পথ বন্ধ করে দেয়। বহু দালালদের সঙ্গে নিয়ে বিএনপি গঠন করে। রাজাকার শাহ আজীজকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করে। বহু দলীয় গণতন্ত্র প্রবর্তনের আড়ালে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির অনুমতিসহ জামাতকে রাজনৈতিক অধিকার ফিরিয়ে দেয় এবং বিএনপি-র রাজনৈতিক সহযোগী হিসাবে প্রতিষ্ঠা করে। গোলাম আযমকে নাগরিকত্ব প্রদান করে। ১৯৭৯ সালে নির্বাচনে গণতান্ত্রিক লীগ নামে জামাত ৬ টি আসন লাভ করে।
জেনারেল এরশাদ রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম করার মধ্যদিয়ে সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে শক্তিশালী করে। ১৯৮৩ ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠার অনুমতি দেয়। তৎকালীন স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে ১৯৮৬ সালে আওয়ামীলীগ ও জামাত এরশাদের সাথে আঁতাত করে। তারা সামরিক স্বৈরাচারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নেয়। এ নির্বাচনে জামাত ১০ টি আসন লাভ করে। এ সময়কালে জামাত বিএনপি ও আওয়ামীলীগের সাথে যুগপত আন্দোলন করে রাজনৈতিকভাবে পুনর্বাসিত হতে থাকে।
১৯৯১ সালের নির্বাচনে জামাত ২টি সংরক্ষিতসহ ২০টি আসন লাভ করে। বিএনপি জামাতের সহযোগীতায় সরকার গঠন করে। হাইকোর্ট গোলাম আযমের নাগরিকত্ব বহাল রাখার সিদ্ধান্ত দিলে গোলাম আযম জামাতের আমীর নির্বাচিত হয়। অপরদিকে আওয়ামীলীগের প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী বিচারপতি বদরুল হায়দার চৌধুরী গোলাম আযমের সাথে দেখা করে তাদের সমর্থন চান।
১৯৯২ সালে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গণআদালতে গোলাম আযমের বিচারের জন্য আন্দোলন সংঘটিত করার উদ্যোগ গ্রহণ করলে বিপুল গণজোয়ার সৃষ্টি হয়। চার লক্ষাধিক জনতার এক সমবেশে গণআদালতে গোলাম আযমের ফাঁসির রায় ঘোষণা করা হয়। কিন্তু আওয়ামীলীগ এ আন্দোলনকে কুক্ষিগত করে এবং পরে জামাতের সাথে রাজনৈতিক আঁতাতের কারণে এ আন্দোলনের টুঁটি চেপে ধরে। ঐ সময় তারা জামাতের সাথে আঁতাত করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য আন্দোলনে যুগপত আন্দোলনে শরীক হয়। ১৯৯৪ সালে আন্দোলনকে শক্তিশালী করার জন্য জামাতের সাংসদরা পদত্যাগ করে।
জনঘৃণার কারণে ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে জামাত মাত্র ৩টি আসন লাভ করে। কিন্তু ঐ সময় আওয়ামীপন্থী বুদ্ধিজীবীরা ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটিকে নিষ্ক্রিয় করে রাখে। জামাত নির্বিঘেœ তার অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কার্যক্রমের বিকাশ সাধন করে।
২০০১ সালে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চার দলীয় জোট আকারে নির্বাচন করে জামাত ১৮টি আসন লাভ করে। সরকারে তারা দুটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীপদ পায়।
২০০৭ সালে মইনুদ্দিন-ফখরুদ্দিন সরকার আওয়মীলীগ ও বিএনপি-রনেতা-কর্মীদের দুর্নীতির কারণে শায়েস্তা করলেও জামাতকে রহস্যজনকভাবে নিষ্কিৃতি দেয়।
৯৬, ২০০১ এবং ২০০৫ সালে নির্বাচন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ইস্যুকে আওয়ামীলীগ নির্বাচনী রাজনীতির জন্য অপব্যবহার করার পর ২০০৮ সালের নির্বাচনেও একে নির্বাচনী অঙ্গীকার হিসাবে হাজির করে। বিরোধী জোটে ভাঙ্গণ, দুর্বল করা, নির্বাচনী রাজনীতিতে সুবিধা করার নানা সমীকরণ এবং জনদাবীর কারণে আওয়ামীলীগ চিহ্নিত কিছু যুদ্ধাপরাধীর বিচারকে মানবতা বিরোধী বিচারে পরিণত করে প্রতীকী বিচার শুরু করে। গত ৪ বছরে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ইস্যুকে তারা যে কোন ন্যায়সঙ্গত জনদাবী ও আন্দোলনকে ‘বিচার বানচালের ষড়যন্ত্র’ আখ্যা দিয়ে ফ্যাসিবাদী দমনের হাতিয়ারে পরিণত করে। কিন্তু নির্বাচনের বছর শুরু হওয়ার কিছুদিন আগে থেকেই তলে তলে সরকার-জামাত আঁতাতের খবর প্রকাশ হতে থাকে। এ আলোচনা আমরা পূর্বেই তুলে ধরেছি।
এভাবে গত ৪২ বছরে আওয়ামীলীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি এবং তাদের জোটগুলোর নেতৃত্বে যারাই ক্ষমতায় থেকেছে বা ক্ষমতায় যাওয়ার চেষ্টা করেছে তারাই একাত্তরের দালাল ও যুদ্ধাপরাধীদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে পুনর্বাসন করেছে। তারা অনেক যুদ্ধাপরাধীদের নিজেদের দলে ও অর্থনৈতিক কারবারেও যুক্ত ও প্রতিষ্ঠিত করেছে।
শুধু তাই নয়, ৭০-র দশক থেকে এদেশের দালাল শাসক শ্রেণীর অর্থনৈতিক বিকাশের ক্ষেত্রে পেট্রো ডলার বিরাট ভূমিকা রেখে চলেছে। প্রবাসী আয় ও সহযোগীতা হিসাবে এ কর্মসংস্থান ও বৈদেশিক মূদ্রার জন্য শাসক শ্রেণী আরব দেশগুলোর উপর ক্রমশ নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। ফলে দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ইসরাইল ভারত অক্ষের বিপরীতে আরব-পাকিস্তান অক্ষ শক্তিশালী হয়। কেবল আরব-পাকিস্তানই নয়, ঐতিহাসিকভাবে তাদের বৈশ্বিক মোড়ল মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদের কাছেও এ দেশের শাসক শ্রেণী একাত্তরের আগে থেকেই দাসখত দিয়ে রেখেছিল। এ পাকিস্তান-আরব-মার্কিন অক্ষের অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার কারণেও এখানে জামাতসহ বিভিন্ন দলে যুক্ত যুদ্ধাপরাধী ও তাদের অনুসারিরা শক্তিশালী রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়। এমন কি ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ কাশ্মীরে তার দখল-নিয়ন্ত্রণসহ ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে তার বিজয়কে সংহত করার স্বার্থে পাকিস্তানী ৯০ হাজার সৈন্যসহ ১৯৫জন যুদ্ধাপরাধীকে ছেড়ে দেয়ার বিষয়ে দরকষাকষির সুযোগ নিয়ে তথাকথিত সিমলা শন্তি চুক্তির মাধ্যমে ছেড়ে দিতে পরোয়া করেনি। একাত্তরের পর ভারতের আজ্ঞাবাহী যে পুতুল সরকার গঠিত হয়েছিলÑতারা জাতির সাথে বিশ্বাঘাতকতা করে ভারতের আজ্ঞানুসারেই কাজ করেছিল। সুতরাং যুদ্ধাপরাধীদেরর রক্ষা ও পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে এদেশের শাসক শ্রেণী এবং তাদের বৈদেশিক প্রভু পাকিস্তান সৌদি আরবসহ ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ এবং মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদও দায়ী। সুতরাং মার্কিনসহ সা¤্রাজ্যবাদ, ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ, সৌদি ইত্যাদি বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক শক্তির তাঁবেদার শাসক শ্রেণীর অন্যতম আওামীলীগের পক্ষে তার প্রভুর আজ্ঞা উপেক্ষা করা এবং প্রভুর আশীর্বাদপুষ্ট যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা কতটা সম্ভব?
প্রকৃতপক্ষে আওয়ামীলীগ যুদ্ধাপরাধীর ইস্যুটি হাজিরই করত না, যদি না তার বাস্তব রাজনৈতিক স্বার্থ না থাকত। শাসকশ্রেণীর ক্ষমতার রাজনীতিতে জামাতের অবস্থান আওয়ামীলীগের বিরোধী বলয়ে। এ কারণে নির্বাচনী রাজনীতিতে বিরোধী পক্ষকে ঘায়েল করার জন্যই যুদ্ধাপরাধীদের ইস্যুটিকে পর্যাপ্ত ব্যবহার করা আওয়ামীলীগের পক্ষে এক বাস্তব প্রয়োজন ছাড়া কিছু নয়। আওয়ামীলীগ ইস্যুটিকে ততদুর পর্যন্ত তুলে ধরে যতদুর পর্যন্ত তার রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল হয়। একারণেই আওয়ামীলীগ ও তার বুদ্ধিজীবীরা যুদ্ধাপরাধী বলতে কেবল একাত্তরের দালালদের বোঝায়, পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীদের নয়। কারণ পাকিস্তানী ফ্যাসিস্ট সেনা বাহিনীর বিচারের দাবীর সাথে আশু বাস্তব রাজনৈতিক ফায়দার কোন যোগাযোগ নেই। বরং তাদের নিজেদের চেহারা উন্মোচিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এমনি কি তারা দালালদের মধ্যে কেবল জামাতী দালালদেরই হাজির করে কারণ তারা এখন অর্থনৈতিক রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী হয়ে প্রতিপক্ষ শিবিরকে শক্তিশালী করছে। মুক্তিযুদ্ধের একচেটিয়া কৃতিত্ব দাবী করে যুদ্ধাপরাদের বিচারের ইস্যুকে কাজে লাগানোর সুযোগ রয়েছে বলেই এখনও আওয়ামীলীগ ও তাদের বুদ্ধিজীবীরা এ প্রশ্নকে গুরুত্ব দেয়। কিন্তু পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী যারা গণহত্যাকা-ের প্রধান শক্তি তাদের বিচারের দাবী এসব সংগঠন তুলতে নারাজ।
জামাত ইসলামী শাসক শ্রেণীর সেই চরম প্রতিক্রিয়াশীল অংশের প্রতিনিধিত্ব করে যারা মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদের দালাল সৌদি প্রতিক্রিয়াশীল শাসকদের মদদে ধর্মকে পুঁজি করে রাজনীতি করে চলেছে এবং সবসময় শ্রমিক-কৃষক জাতি ও জনগণের বিরুদ্ধে জিহাদ করছে। এরা ১৯৭১ সালে পূর্ববাংলার সমগ্র জাতি ও জনগণের মুক্তির আকাক্সক্ষার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল। কেবল এতেই তারা ক্ষান্ত হয়নি বরং পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক ফ্যাসিস্টদের দোসর হিসাবে এ জাতি ও জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল এবং ইতিহাসের এক নির্মম গণহত্যায় অংশগ্রহণ করেছিল।
অনেক আগেই আওয়ামীলীগ ও জামাতের মধ্যে গোপন সমঝোতার অভিযোগ উঠেছে। একাধিক জাতীয় পত্রিকা এ নিয়ে খবর প্রকাশিত হয়েছে। দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন-এর ২৩ মে ২০১২ সংখ্যায় আওয়ামীলীগ ও জামাতের মধ্যে সমঝোতার বিষয়ে একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। রিপোর্টে সূত্র প্রকাশ না করে বলা হয়, জামাতের এক ব্যবসায়ী নেতার নেতৃত্বে আওয়ামীলীগের একাংশের সাথে জোর লবি চলছে। জামাত তার শীর্ষ পাঁচ নেতা নিজামী, মুজাহিদ, কামরুজ্জামান, সাঈদী ও কাদের মোল্লার ফাঁসীর পরিবর্তে কারাদ-, জামাতকে নিষিদ্ধ না করে অন্তত ভিন্ন নামে কাজ করার অনুমোদন এবং তাদের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বাজেয়াপ্ত না করাসহ কয়েকটি বিষয়ে দেনদরবার করছে। অপরদিকে আওয়ামীলীগ বিনিময়ে ১৮ দলীয় জোট থেকে সরে এসে আগামী নির্বাচনে এককভাবে অংশগ্রহণ, আর্থিক প্রতিষ্ঠানে দুতিয়ালদের ৫০ ভাগ শেয়ার প্রদান, শিবিরের কর্মকান্ড নিয়ন্ত্রণসহ বিভিন্ন দাবী করছে। এ সমঝোতার লক্ষণ হিসাবে রিপোর্টে বলা হয়, সমঝোতার অংশ হিসাবেই ১৮ দলীয় জোটের শীর্ষ ৪৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা করা হলেও শিবিরের সেক্রেটারি জেনারেলকে এ মামলা থেকে সরকার অব্যহতি দিয়েছে। গাড়ি পোড়ানো মামলায় বিএনপি জোটের ৩৩ নেতা আটক হলেও জামাত-শিবিরের ৩ নেতা ধরা ছোঁয়ার বাইরে রয়েছে।
সম্প্রতি জামাত পুলিশের উপর হামলা করলেও রহস্যময় কারণে পুলিশ পড়ে পড়ে মার খাচ্ছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী ম খা আলমগীর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার পরিবর্তে ছাত্রলীগ-যুবলীগকে পাল্টা সন্ত্রাস সৃষ্টির আহ্বান জানিয়েছেন। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে উভয়পক্ষ অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করে ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে নেমেছে।
আওয়ামীলীগ কর্তৃক যুদ্ধাপরাধীর বিচারকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার ও জামাতের সাথে সমঝোতার ইতিহাস, জামাতের সাথে গোপন আঁতাতের সংবাদ, মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদ কর্তৃক জামাতকে প্রকাশ্য সমর্থন, বিএনপি-র ভারতমূখীতা, সৌদি সমর্থিত জামাতকে পরিত্যাগের বিষয়ে ভারতকে প্রতিশ্র“তি প্রদান এবং জামাত হতে আলগা মনোভাব, আগামী নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা, আওয়ামীলীগের পরাজয়ের আশঙ্কা, আগাম নির্বাচন ও জরুরী অবস্থা ঘোষণার গুঞ্জন, আশুলিয়ায় গার্মেন্টসে আগুনের ঘটনার পর বিভিন্ন গার্মেন্ট কারখানায় আগুন দেয়ার সাজানো নাটক, জামাতের হামলা, সংঘাত, প্রাণহানী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কর্তৃক পাল্টা হামলার ডাকের প্রেক্ষাপটে যে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে তাতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও শাস্তি নিশ্চিত হবে কি না-তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। আমরা সম্ভাব্য চক্রান্তের বিষয়ে জনগণকে সজাগ থাকার আহ্বান জানাই। সেই সাথে অবিলম্বে চলমান যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও শাস্তি সম্পন্ন করাসহ পাকিস্তানি সামরিক ফ্যাসিস্টদের বিচারের আওতায় আনার জন্য জোর দাবী জানাচ্ছি।
সম্প্রতি জামাতকে পুলিশ পাহাড়ায় সভা-সমাবেশ করতে দেয়ার পর কাদের মোল্লার এ লঘু রায়; সরকার ও জামাতের আঁতাতের গুঞ্জন ও আশঙ্কাকে যেন স্বপ্রমাণিত করল।
কাদের মোল্লার রায়ের পর সংসদে মহাজোটের শরীক রাশেদ খান মেনন, মাইনুদ্দিন খান বাদল এ রায়ের প্রতিবাদে বক্তব্য রাখতে গিয়ে আপোস-সমঝোতার স্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়েছে। মাইনুদ্দিন খান বাদল বলেছেন, “কিছু কিছু ইস্যু আছে যা নিয়ে কোন নেগোসিয়শন চলে না। আমি আমার বোনের ইজ্জতের প্রশ্নে নেগোসিয়েশন করতে পারি না।” কিন্তু সংসদের উপনেতা আওয়ামীলীগ নেত্রী সাজেদা চৌধুরী সংসদে এ আলোচনা বন্ধ রাখার জন্য স্পীকারকে বলার পর, তা বন্ধ করে দেয়া হয়।
এসব ঘটনা এ কথা বিশ্বাস করার জন্য যথেষ্ট যে, আওয়ামীলীগ ও জামাতের মধ্যে গোপন আঁতাত হয়ে থাকতে পারে এবং এ রায় সেই সমঝোতারই ফসল। সরকারের শেষ বছরে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে যে রাজনৈতিক পরিস্থিতি তার প্রেক্ষাপটে বিচার করলে এ ধরণের সমঝোতার সারবস্তু উন্মোচিত হতে পারে।
১/১১-এর সামরিক বাহিনী নিয়ন্ত্রিত সরকার মার্কিনসহ সা¤্রাজ্যবাদ এবং ভারতীয় সম্পসারণবাদী শক্তির স্বার্থে একটি সামগ্রিক রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামরিক সংস্কার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ক্ষমতা গ্রহণ করেছিল। রাজনৈতিক সংস্কারের অংশ হিসাবে তারা মাইনাস টু ফর্মুলা বাস্তবায়নেরও চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। শেষ পর্যন্ত মইনুদ্দিন-ফখরুদ্দিন সরকারের দায়মুক্তি ও তাদের সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়ন অব্যহত রাখার প্রতিশ্রুতির বিনিময়েই হাসিনা নেতৃত্বে মহাজোট সরকার গঠন করে। গত চার বছরের শাসনামলে এ সরকার দেশবিক্রি, অদক্ষতা, দুর্নীতি ও দুঃশাসনসহ গণবিরোধী কর্মকা-ের কারণে জনগণের কাছে চরম ধিকৃত হয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে সা¤্রাজ্যবাদের মদদে ‘মাইনাস’ হওয়ার আতঙ্কে ভুগছে হাসিনা নেতৃতা¡ধীন আওয়ামীলীগ। এ আশঙ্কা থেকে তারা সা¤্রাজ্যবাদের বেতনভূক সুশীল সমাজ ও তার প্রতিনিধি ড. ইউনুসের সাথেও দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধানও বাতিল করেছে। এভাবে মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদ পরিচালিত রাজনৈতিক সংস্কারের তৎপরতায় বাধা সৃষ্টি করতে গিয়ে সরকার মার্কিনের রোষানলে পড়েছে। তাই হাসিনার আওয়ামী লীগ ভারতের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে ক্ষমতা আকড়ে থাকার আশায় রয়েছে। কিন্তু ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী আওয়ামী লীগের পুনরায় ক্ষমতায় ফিরে আসা দুঃসাধ্য হতে পারে জেনে ভারতের শাসক শ্রেণী আওয়ামী লীগকে রক্ষার নানা উদ্যোগের পাশাপাশি খালেদা নেতৃত্বাধীন বিএনপি’র সাথেও সম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা করছে। বিএনপির সভানেত্রী খালেদা জিয়াও ক্ষমতায় গেলে ভারতের কাছে দেশবিক্রির আগাম প্রতিশ্রুতি দিয়ে এসেছে।
এ অবস্থায় আওয়ামীলীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকারে ফিরে যেতে কোনভাবেই চায় না। তারা হাসিনার নেতৃত্বে উভয় পক্ষের অংশগ্রহণে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের প্রস্তাব দিচ্ছে। তবে বর্তমান প্রেসিডেন্ট বা স্পীকারের নেতৃত্বে উভয় পক্ষ থেকে সমসংখ্যক মন্ত্রী নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের বিষয়ে তারা একমত হতে পারে। কিন্তু পরিস্থিতি প্রতিকূল হলে সরকার বিএনপিকে বাইরে রেখে জাতীয় পার্টিকে প্রধান বিরোধী দল করে নির্বাচনে যাওয়ার বিকল্প পথ খোলা রেখেছে। বিএনপি-র সাথে সমঝোতা হোক বা না হোক, উভয় ক্ষেত্রেই জামাতকে ১৮ দলীয় জোট থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারলে ভোটের রাজনীতিতে আওয়ামীলীগ বড় ধরণের সুবিধা পাবে। বিএনপি ও আওয়ামীলীগের মোট ভোটের পার্থক্য খুব সামান্য। মাত্র ১ থেকে ২ শতাংশ। জামাতের রয়েছে ১ শতাংশ ভোট। জামাতকে যদি একক নির্বাচনে নেয়া যায়, তবে বিএনপি জোটের এক শতাংশ ভোট কমবে, যা নির্বাচনে বড় ধরণের সুবিধা করে দেবে আওয়ামীলীগের। যদি বিএনপিকে বাইরে রেখে নির্বাচন করা যায় সেক্ষেত্রে নির্বাচনে জামাতকে অংশগ্রহণ করাতে পারলে বিরোধী দলগুরলোর অংশগ্রহণে নির্বাচন হয়েছে-এটা প্রমাণ করা যাবে। এছাড়া জামাতের সাথে গোপন আঁতাত হলে আওয়ামীলীগ ও বিএনপি জোটের মধ্যে নির্বাচন নিয়ে যে আন্দোলন ও দরকষাকষি চলছে তাতেও শক্তি পাবে আওয়ামীলীগ আর দুর্বল হবে বিএনপি। সুতরাং নির্বাচনী রাজনীতিতে আওয়ামীলীগের জন্য জামাতের সাথে আঁতাত করার আকাক্সক্ষা না থাকলেও রীতিমত প্রয়োজন রয়েছে।
কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেন ‘ধমনিরপেক্ষ’, ‘স্বাধীনতার নেতৃত্বদানকারী’ আওয়ামীলীগ কি এমন হীন রাজনৈতিক সুবিধা গ্রহণ করতে পারে? আওয়ামীলীগ ও জামাতের রাজনীতির বৈরীতার যে মাত্রা তাতে তাদের মধ্যে সমঝোতা হওয়া কি আদৌ সম্ভব?
প্রথমত আওয়ামীলীগ ও জামাতের মধ্যকার সমঝোতার ইতিহাস নতুন নয়। ১৯৭৩ সালে সাধারণ ক্ষমা, ১৯৮৬ সালে জামাতসহ এরশাদের সাথে নির্বাচনে যাওয়া, ১৯৯১ সালে গোলাম আযমের সমর্থন প্রার্থনা, ১৯৯৪-৯৬ সালে নির্মূল কমিটির আন্দোলনে ছুরিকাঘাত ও যুগপত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আন্দোলন এবং ১৯৯৬-২০০১ সালের মধ্যে বিচারের প্রতিশ্রুতি এড়িয়ে চলাÑ এসবই লীগ-জামাত সমঝোতার ইতিহাস। লীগ-জামাত স্থায়ী জোট গঠন করার ক্ষেত্রে আওয়ামীলীগের কিছু রাজনৈতিক অসুবিধা আছে। কিন্তু আওয়ামীলীগের পক্ষে এ ধরণের বিশ্বাসঘাতকতা করা এবং জামাতের সাথে সাময়িক রাজনৈতিক সমঝোতা কেবল সম্ভাবনা নয়, একটা বাস্তব ব্যাপার।
দ্বিতীয়ত আওয়ামীলীগ অতীতে বারবার নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার জন্য যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তির ইস্যুকে ব্যবহার করেছে। ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় গিয়ে তারা বিচারের কোন উদ্যোগই নেয়নি। এমনকি গার্মেন্ট শ্রমিক, নৌযান শ্রমিকদের আন্দোলনসহ জনগণের আন্দোলন সংগ্রামকে প্রতিহত করার জন্য আওয়ামীলীগ এ ইস্যুকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করেছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আওয়ামীলীগের কোন খাঁটি দাবী নয় বরং রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের হাতিয়ার মাত্র-এটা বহুবার প্রমাণিত হয়েছে। সুতরাং রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য সমঝোতা করা আওয়ামীলীগের পক্ষে খুবই সম্ভব।
তৃতীয়ত আওয়ামীলীগ কোন অসম্প্রদায়িক দলও নয়। তারা মুসলিম লীগ থেকেই জন্ম নিয়েছে। হিন্দুদের সম্পত্তির এক বড় অংশই এ আওয়ামীলীগের লোকজন দখল করেছে। আর ১৯৯৬ সালে হাসিনা মাথায় হিজাব পরে ‘নৌকার মালিক তুই আল্লাহ’ স্লোগান দিয়ে ভোট চেয়েছে। ২০০৬ সালে শরীয়া আইনের স্বীকৃতি দিয়ে ইসলামিক শক্তিগুলোর সাথে জোট করার উদ্যোগ নিয়েছে। এবার ক্ষমতায় এসে সংবিধানে রাষ্ট্র ধর্ম ইসলামসহ অন্যান্য ধর্মের মানুষকে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত করে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী করেছে। তারা নিজেেেদর দলেও একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের স্থান দিয়েছে। সুতরাং আওয়ামীলীগ সাম্প্রদায়িক শক্তির সাথে হাত মেলাতে পারে না, একারণে জামাত থেকে দুরে থাকবে-এমন যারা ভাবছেন, তারা বোকার স্বর্গে বসবাস করছেন।
চতুর্থত ১৯৭২ সালে ভারত-পকিস্তানের সিমলা চুক্তির অধীনে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কাজ আওয়ামীলীগ স্থগিত করে। ১৯৭৩ সালের দিল্লি চুক্তির মাধ্যমে ৯০হাজার পাকিস্তানের ফ্যাসিস্ট সামরিক বাহিনীর সদস্যকে সসম্মানে দেশে ফেরত পাঠায় এ আওয়ামীলীগ। সেইসাথে জেনারেল নিয়াজীসহ পকিস্তানী সামরিক বাহিনী ১৯৫ জন এবং সমসংখ্যক বেসামরিক যুদ্ধাপরাধীকে বিনা বিচারে পাকিস্তানে ফেরত পাঠায়। শুধু তাই নয়, একাত্তরের নরঘাতক রাজাকার, আলবদর, আলশামসের সাথে যুক্ত ৪০ হাজার যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষমা ঘোষণা করে তৎকালীন শেখমুজিব সরকার। বলা হয়ে থাকে, শেখমুজিব খুন, ধর্ষণ, হত্যার সাথে জড়িতদের ক্ষমা করেন নি। তাদের বিরুদ্ধে মামলা ও বিচার চলছিল। কথা সত্য। তবে এও সত্য সরকারের প্রায় তিন বছরে চিকন আলী নামে এক ছিঁচকে চোরের ফাঁসিসহ কয়েকজনের সাজা হলেও গোলাম আযমসহ বাঘা বাঘা নরঘাতকদের শাস্তি এ সরকার সেদিন সম্পন্ন করেনি। খোদ পাকিস্তানী নরঘাতক ও যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচিয়ে দিয়ে তাদের দোসরদের মানবতাবিরোধী অপরাধের হাঁক-ডাক করে মুক্তিযুদ্ধে সপক্ষ শক্তি হিসাবে আওয়ামীলীগ নিজের চেহারা দক্ষতার সাথেই আড়াল করতে পেরেছে। এখনও পারছে।
আওয়ামীলীগ যুদ্ধাপরাধীদের পুনর্বাসনের যে কাজ শুরু করেছিল সামরিক শাসক জেনারেল জিয়া ক্ষমতায় এসে তাকে পরিপূর্ণতা দান করে। মুক্তিযুদ্ধের ঘোষক দাবীদার জিয়াউর রহমান ১৯৭৩ সালের দালাল আইন বাতিল করে বিচারাধীন দালালদের বিচারের পথ বন্ধ করে দেয়। গোলাম আযমকে নাগরিকত্ব প্রদান করে, রাজাকার শাহ আজীজকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করে এবং সর্বোপরি জামাতকে রাজনৈতিক অধিকার ফিরিয়ে দেয়। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম দাবীদার পাকিস্তান ও সৌদিপন্থী এ দল মুক্তিযুদ্ধকালে ভারতের কাছে দেশবিক্রি করা জন্য আওয়ামীলীগের সমালোচনা করলেও কখনোই পাকিস্তানী সামরিক ফ্যাসিস্ট যুদ্ধাপরাধীদের পাকিস্তানে ফেরত পাঠানোর সমালোচনা করেনা। এ দলটি রাজনৈতিক জোট করে, সংসদে ও মন্ত্রীত্ব দিয়ে জামাতকে রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী করেছে।
কেন গত ৪২ বছরে পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীরাসহ জাতীয় বিশ্বাসঘাতক রাজাকার, আলবদর, আলশামসদের বিচার ও সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত হল না? এ প্রশ্নের সাথে আমাদের সমগ্র জাতি ও জনগণের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র এবং সার্বিক মুক্তির প্রশ্নটি সম্পর্কিত।
আওয়ামীলীগ ছিল পূর্ববাংলার জমিদার-জোতদার এবং বড় বুর্জোয়াদের দল। তারা নিজেদের বিকাশের স্বার্থেই পাকিস্তানের পাঞ্জাবী শাসকশ্রেণীর কাছ থেকে পাকিস্তানের কাঠামোর মধ্যেই নিজেদের ক্ষমতার অংশীদারিত্ব দাবী করছিল। কিন্তু পূর্ববাংলার শ্রমিক-কৃষক জনগণের জন্য প্রয়োজন ছিল সা¤্রাজ্যবাদসহ পশ্চিম পাকিস্তানী উপনিবেশিক শোষণের অবসান এবং জমিদার-জোতদার-বড় বুজোয়াদের হাতে নয়, শ্রমিক-কৃষক-জনগণের হাতে ক্ষমতা। কিন্তু জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের শেষ পর্যায়ে আওয়ামীলীগ পাকিস্তানের উপনিবেশিক শোষণের বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ ছাত্র-শ্রমিক-কৃষক-জনগণের একাংশকেও তার পেছনে সংগঠিত করতে সক্ষম হয়। জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম বেগবান হলে পাকিস্তানী ফ্যাসিস্টরা ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ গণহত্যার মাধ্যমে যুদ্ধাভিযান শুরু করে। এসময় মুসলিমলীগ, জামাত ও আওয়ামীলীগের আপোসকামী প্রথম সারির নেতারাসহ বড় ধণীক ও আমলাদের একাংশ যুদ্ধে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকে। অপরদিকে আওয়ামীলীগের মধ্যম পর্যায়ের নেতা ও ছাত্ররা ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করে। পূর্ববাংলার জনগণ আওয়ামীলীগের জন্য অপেক্ষা না করেই প্রতিরোধ যুদ্ধে নেমে পড়ে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ভারতের হস্তক্ষেপে পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী পরাজয় বরণ করলে জনগণের জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম অসমাপ্ত থেকে যায়। রুশ-ভারতের তাঁবেদার হিসাবে জমিদার-জোতদার ও বড় বুর্জোয়াদের দল আওযামীলীগ ক্ষমতা দখল করে। ফলে লাখো শহীদের আত্মত্যাগ সত্ত্বেও শ্রমিক-কৃষক-জনগণের বিজয় ও ক্ষমতা সম্ভব হয়নি; সম্ভব হয়নি শ্রমিক-কৃষক-জনগণের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা।
পাকিস্তান আন্দোলনে জামাত, মুসলিমলীগ এবং পরবর্তীতে আওয়ামীগের নেতৃত্বাধীন জমিদার-জোতদার, বড় বুর্জোয়ারা ছিল মোটামুটি ঐক্যবদ্ধ। পাকিস্তান আমলে পূর্ববাংলার শোষক শ্রেণী জামাত, মুসলিমলীগ এবং আওয়ামীলীগে বিভক্ত হয়ে পরস্পর প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠলেও তাদের মধ্যে শ্রমিক-কৃষক-জনসাধারণকে শোষণ ও শাসনের বিষয়ে শ্রেণীগত স্বার্থের ঐক্য অটুট ছিল এবং তা আজও আছে। ১৯৭১-এর আগে ও পরে আওয়ামীলীগের নেতৃত্বে জোতদার-মহাজন, বড় বুর্জোয়াদের মধ্যে আরেক দফা ভাঙ্গণ সৃষ্টি হয়। তারই ধারাবহিকতায় আওয়ামীলীগের এবং জামাত ও মুসলিমলীগের একাংশের সমন্বয়ে সামরিক-বেসামরিক আমলাসহ বড় বুর্জোয়া, জোতদার-মহাজনদের নতুন দল বিএনপি-র আবির্ভাব ঘটে। আওয়ামীলীগের এ অংশই মুজিব হত্যার সাথে জড়িত ছিল। এমনকি এ দলের প্রতিষ্ঠাতা মেজর জিয়া ছিল বাকশালেরই সদস্য। অর্থাৎ মুসলিমলীগ, জামাত, আওয়ামীলীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি এসব দল মূলত একই শাসক-শোষক শ্রেণীর দল। তাদের মধ্যে শাসন ক্ষমতা নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বীতা থাকলেও জনগণকে শোষণ-শাসনের প্রশ্নে শ্রেণীগত ঐক্য রয়েছে। আর এ ঐক্যই হল মৌলিক ও প্রধান, বিরোধটা অমৌলিক ও গৌন। কাক যেমন কাকের মাংস খায় না, তেমনি পরস্পর বিরোধ থাকলেও, অপরকে ঘায়েল করার চেষ্টা থাকলেও এরা চরম দ- দিতে চায় না।
একারণেই একাত্তরের পর ভারত-পাকিস্তান সিমলা চুক্তির অধীনে আওয়ামীলীগ ভারতের আজ্ঞাবহন করে পাকিস্তানী ৯০ হাজার সৈন্যসহ গণহত্যাকারী যুদ্ধাপরাধীদের সসম্মানে স্বদেশে ফেরত পাঠায়, অপরাধীদের ক্ষমা করে, তাদের বিচার করে না। এ কারণেই ১৯৭৫ সালের পর বিএনপি-র নেতৃত্বে শাসক শ্রেণীর অপর অংশটি সংগঠিত হওয়ার কালে তারা জামাতের নেতৃত্বে শাসক শ্রেণীর চরম প্রতিক্রিয়াশীল অংশটির সাথে হাত মেলায়। মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদের দালাল জেনারেল জিয়া এ জাতীয় বিশ্বাসঘাতক-গণহত্যাকারীদের রাজনৈতিকভাবে পুনর্বাসিত করে, বিনিময়ে পাকিস্তান-সৌদি অক্ষের মদদ নিশ্চিত করে। এ মৌলিক শ্রেণী ও উপদলীয় ঐক্যের কারণেই বিএনপি বারবার জামাতের সাথে জোট গঠন, মন্ত্রীত্ব প্রদানসহ সার্বিক বিকাশে সহায়তা প্রদান করেছে।
এরশাদ সংবিধানে রাষ্ট্র ধর্ম ইসলামসহ নানাভাবে এ প্রতিক্রিয়াশীল ধর্মব্যবসায়ীদের হাতকে শক্তিশালী করেছে।
প্রতিক্রিয়াশীল জামাতে ইসলামী শাসক শ্রেণীর প্রধান দুই দলের সাথে সুবিধাজনক ঐক্য করে নিজের বিকাশ সাধন করেছে। শ্রমিক-কৃষক-জনগণের প্রতি বৈরী মনোভাবের কারণে জামাতের নেতৃত্বে প্রতিক্রিয়াশীলরা জনগণের মধ্যে ভিত্তি গাড়তে ব্যর্থ হলেও রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার পাশাপাশি মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদের খাস দালাল সৌদি-পাকিস্তানি আর্থিক ও গোয়েন্দা সহায়তায় একটা মজবুত অর্থনৈতিক ভিত্তি গড়ে তুলেছে।
১৯৯৬ সালে রাজনৈতিক সমঝোতার কারণে আওয়ামীলীগ যুদ্ধাপরাধের বিচার করেনি। কিন্তু বর্তমান আওয়ামীলীগের সাথে চার দলীয় জোটের শরীক জামাতের সমঝোতা না থাকার ফলে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য বিচারের পথে অগ্রসর হয়েছে। সে ফায়দা তারা তুলতে সক্ষমও হয়েছে।
সুতরাং মার্কিনসহ সা¤্রাজ্যবাদ, ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ, সৌদি, পাকিস্তান এবং তাদের দালাল শাসক শ্রেণীর অভ্যন্তরীন এ মৌলিক ঐক্যের কারণেই দীর্ঘ ৪২ বছরেও আমরা পাকিস্তানের সামরিক ফ্যাসিস্ট যুদ্ধাপরাধী-গণহত্যাকারী এবং তাদের দোসরদের বিচার নিশ্চিত করতে পারিনি। একারণেই বর্তমান আওয়ামীলীগের অধীনে তাদের শাসক শ্রেণীর উপদলীয় রাজনৈতিক সংঘাত ও জনদাবীর কারণে গুটি কয়েক দোসরদের প্রতীকী বিচার শুরু হলেও পাকিস্তানি সামরিক ফ্যাসিস্টসহ তাদের সহযোগী গণহত্যাকারী ও যুদ্ধাপরাধীদের প্রকৃত বিচার ও শাস্তির কাজ অনিষ্পন্নই থেকে যাচ্ছে। শুধু তাই নয়, এভাবে অটুট থাকছে ধর্ম ব্যবসায়ী এ চরম প্রতিক্রিয়াশীল শাসকগোষ্ঠীর রাজনৈতিক ক্ষমতা, ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার।
১৯৪৭ সালের পূর্বে এদেশের জনগণ বৃটিশ উপনিবেশ থেকে স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করেছিল। এ লড়াইয়ে পূর্ববাংলার জনগণ মুসলিমলীগের নেতৃত্বে বৃটিশের দালাল জমিদার-বড় বুর্জোয়াদের বন্ধু ভেবেছিল। ফলে বৃটিশের প্রত্যক্ষ উপনিবেশের অবসান হলেও বৃটিশসহ সা¤্রাজ্যবাদী শোষণের অবসান ঘটেনি। আর এ ‘বন্ধুরা’ পূর্ববাংলাকে উপনিবেশে পরিণত করে এবং ১৯৭১ সালে ‘গণহত্যা’ উপহার দেয়। ১৯৭১ সালে পূর্ববাংলার জনগণ জোতদার-মাহাজন ও বড় বুর্জোয়াদের দল আওয়ামীলীগ ও রুশ-ভারতকে বন্ধু ভেবেছিল। কিন্তু এ ‘বন্ধুরা’ এদেশকে ভারত, রুশ ও পরে মার্কিনসহ সা¤্রাজ্যবাদের পরোক্ষ উপনিবেশে পরিণত করে। সিরাজ সিকদারসহ জাতীয় মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী হাজার হাজার তরুণ ও বিপ্লবীদের হত্যা করে। বাকশালের পর ফ্যাসিস্ট সামরিক শাসন কায়েম করে। ১৯৯০ সালে আবারো এরশাদের সামরিক স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে গণ আন্দোলনে জনগণ বুর্জোয়া-সামন্তদের শাসক শ্রেণীর দল আওয়ামীলীগ ও বিএনপিকে বন্ধু মনে করেছিল। তাদের নেতৃত্বে একদফার আন্দোলন করেছিল। সে আন্দোলনে এরশাদের পতন হলেও গত দুই দশক ধরে বছর এ ‘বন্ধুরা’ ক্ষমতায় গিয়ে সংসদীয় স্বৈরাচার ও ফ্যাসিবাদী দুঃশাসন কায়েম করেছে। একইসাথে মার্কিনসহ সা¤্রাজ্যবাদ ও ভারতীয় সম্প্রসারণবাদের শোষণ-নিপীড়নও অব্যহত রয়েছে। আমরা বৃটিশকে, পাকিস্তানীকে, এরশাদকে উৎখাতের জন্য লড়াই করেছি কিন্তু শ্রমিক-কৃষক-জনগণের দিক থেকে ক্ষমতা দখল ও প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে অগ্রসর হইনি। এ কারণে বৃটিশ, পাকিস্তানি ও এরশাদকে হটিয়ে যেসব গণশত্রুরা ক্ষমতা দখলের জন্য মুখিয়ে ছিল তারা জনগণের ক্ষোভকে কাজে লাগিয়েছে। তারা ক্ষমতায় গিয়ে শ্রমিক-কৃষক জনগণের উপর শোষণ-নিপীড়নমূলক শাসন অব্যহত রেখেছে। এভাবে বন্ধুবেশী গণশত্রুরাই লড়াইয়ের ফল ভোগ করেছে, জনগণে বিপুল আত্মত্যাগ বৃথা গেছে। ইতিহাস প্রমাণ করছে যে, শাসক শ্রেণীর একাংশ যখনই জনগণের আন্দোলনের নেতৃত্ব কব্জা করেছে, তারা তাদের স্বার্থের সাথে সঙ্গতিপূর্ণভাবে আন্দোলনের লক্ষ্যকে সীমিত আকারে নির্ধারণ করে দিয়েছে। তারা শাসক শ্রেণীর প্রতিদ্বন্দ্বী অংশকে আন্দোলনের টার্গেটে পরিণত করেছে আর নিজেদের স্বতঃস্ফূর্ত জনগণের নায়কে পরিণত করেছে। জনগণকে পরিণত করেছে নিজ স্বার্থের সেবকে। এভাবে আন্দোলনের লক্ষ্যকে সীমিত রাখা, শাসক শ্রেণীর একাংশকে টার্গেটে পরিণত করে অপরাংশের স্বার্থের অধীনে জনগণকে পরিচালনা করা হল, জনগণের স্বার্থের চূড়ান্ত বিরোধী, এটা শাসকশ্রেণীর রাজনৈতিক কৌশলেরই অংশ, জনগণের নয়। গত আড়াইশ বছরের আন্দোলনের ইতিহাসে আমরা শাসকশ্যেণীর এ রাজনৈতিক কৌশলের বৃত্ত ভাঙ্গতে পারিনি। আর একারণেই এদেশকে আমরা মার্কিনসহ সা¤্রাজ্যবাদ ও ভারতীয় সম্প্রসারণবাদেরশোষণ-নিপীড়ন এবং তাদের দালাল শাসকশ্রেণীর ফ্যাসিস্ট দুঃশাসনথেকে মুক্ত শ্রমিক-কৃষক-জনগণের স্বাধীন ও সার্বভৌম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারিনি। এ কারণেই গত ৪২ বছরেও তাঁবেদার ও ফ্যাসিস্ট এ শাসক শ্রেণীর অন্যতম অংশীদার এবং পাকিস্তান ফেরত ৭১-এর যুদ্ধাপরাধী গণহত্যাকারীদের ন্যায়সঙ্গত বিচার আজও করা সম্ভব হয় নি।
তাই আমরা সমগ্র জাতি ও জনগণের প্রতি আহ্বান জানাই, আসুন, শাসক শ্রেণীর বিচার-বিচার খেলা ও চক্রান্ত থেকে নিজেদের মুক্ত করি, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবীতে সংগ্রামকে মার্কিনসহ সা¤্রাজ্যবাদ, ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ এবং তাদের দালাল শাসক শ্রেণীর রাষ্ট্র উচ্ছেদ করে শ্রমিক-কৃষক-জনগণের স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সরকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে পরিণত করি। আমাদের প্রাণের দাবী বাস্তবায়নের বাস্তব শর্ত সৃষ্টি করি।

প্রাথমিক আলোচনা ....... চলবে ,,,,,,,,,


৩টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

লালনের বাংলাদেশ থেকে শফি হুজুরের বাংলাদেশ : কোথায় যাচ্ছি আমরা?

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:১৪



মেটাল গান আমার নিত্যসঙ্গী। সস্তা, ভ্যাপিড পপ মিউজিক কখনোই আমার কাপ অফ টি না। ক্রিয়েটর, ক্যানিবল কর্পস, ব্লাডবাথ, ডাইং ফিটাস, ভাইটাল রিমেইনস, ইনফ্যান্ট এনাইহিলেটর এর গানে তারা মৃত্যু, রাজনীতি,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমেরিকার গ্র্যান্ড কেনিয়ন পৃথিবীর বুকে এক বিস্ময়

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৪১


প্রচলিত কিংবদন্তি অনুসারে হাতে গাছের ডাল আর পরনে সাধা পোশাক পরিহিত এক মহিলার ভাটাকতে হুয়ে আতমা গ্র্যান্ড কেনিয়নের নীচে ঘুরে বেড়ায়। লোকমুখে প্রচলিত এই কেনিয়নের গভীরেই মহিলাটি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি! চুরি! সুপারি চুরি। স্মৃতি থেকে(১০)

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৩৪


সে অনেকদিন আগের কথা, আমি তখন প্রাইমারি স্কুলে পড়ি। স্কুলে যাওয়ার সময় আব্বা ৩ টাকা দিতো। আসলে দিতো ৫ টাকা, আমরা ভাই বোন দুইজনে মিলে স্কুলে যেতাম। আপা আব্বার... ...বাকিটুকু পড়ুন

যেকোন বাংগালীর ইন্টারভিউর সময়, 'লাই-ডিটেক্টটর' যোগ করে ইন্টারভিউ নেয়ার দরকার।

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৫ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:০৭



আপনার এনলাকার এমপি, প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী কামাল সাহেব, যেকোন সেক্রেটারী, যেকোন মেয়র, বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান, বিএনপি'র রিজভী, আওয়ামী লীগের ওয়ায়দুল কাদের, আপনার থানার ওসি, সীমান্তের একজন বিজিবি সদস্য, ঢাকার... ...বাকিটুকু পড়ুন

তাবলীগ এর ভয়ে ফরজ নামাজ পড়ে দৌড় দিয়েছেন কখনো?

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:২৬


আমাদের দেশের অনেক মসজিদে তাবলীগ এর ভাইরা দ্বীন ইসলামের দাওয়াত দিয়ে থাকেন। তাবলীগ এর সাদামাটাভাবে জীবনযাপন খারাপ কিছু মনে হয়না। জামাত শেষ হলে তাদের একজন দাঁড়িয়ে বলেন - °নামাজের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×