ঘুম থেকে উঠেই আমার মেয়ে সোফি জিজ্ঞেস করলো 'বাবা, ভোট দিতে যাবেনা?' আমি সরাসরি অনিচ্ছাবশত বললাম ' যাবোনা মা'। মেয়ে জিজ্ঞেস করলো 'কেন?'। আমার কাছে এই কেনটা'র কোন উত্তর নাই, আমি বিব্রত!
ভোর পাঁচটায় ঘুম থেকে উঠলাম। পেছনের বারান্দায় গিয়ে দেখলাম আজ ভোরের বাতাস একটু বেশী জোরেই বইছে। টবের গাছগুলো দেখে মায়া হলো।বালতি আর মগ নিয়ে এসে পানি দিলাম। তখনো ভোরের আলো ফুটবো ফুটবো করছে। রবি ঠাকুরের 'তখনো কুহেলী তলে সখা তরুণী উষার ভালে' টাইপ সকাল।
ভারী জামা কাপড় জড়িয়ে সাইকেল নিয়ে চুপি চুপি বের হলাম বাসা থেকে। প্যাডেল ঘুরিয়ে এলাকাটা চক্কর দিতে দিতেই কয়েকটি নির্বাচনী কেন্দ্রর সামনে থেকে ঘুরে এলাম। পথেই আমার বাবার কবর পড়লো। একটু থেমে কবর জিয়ারত করলাম।
ভোট কেন্দ্রগুলাতে পুলিশের উপস্থিতি লক্ষ করলাম। এক জায়গায় নির্বাচনী জিনিস ভরা গাড়ী ও দেখলাম।একেবারে কবরস্থানের মাঝের রাস্তাটায়। দুইপাশে অগনিত কবর। আমি মনে মনে হাসলাম। ব্যালট পেপারগুলাকে ও আমার এই নিস্তব্দ কবরের মতোই মনে হলো। আর যারা ভোট দিতে যাবেন তাদের মনে হলো মৃত মানুষ! ভোট নিয়ে আমার আফসোস হলো। আমাদের ভোট চুরি হয়ে গেছে, ভাবতেই মন খারাপ হলো। আমার মেয়েটাকে এই সহজ সরল কথাটা কিভাবে বুঝিয়ে বলি? কিভাবে বলি, 'মা, আমি ভোট দিলেও যা, না দিলেও তা'। কে জিতবে আগেই ঠিক করা।
এই যে নতুন একটা প্রজন্ম আসবে আগামীতে, এরাই নানান ব্যাপারে প্রশ্ন তুলবে। ইতিহাস সাক্ষী থাকবে কারা কিভাবে রাতের আঁধারে আমাদের অধিকার আর মতামত চুরি করে নিয়ে গেছে। উন্নয়নের নামে প্রাণ - প্রকৃতি, পরিবেশের অপূরণীয় ক্ষতি করছে। লক্ষ হাজার কোটি টাকার লুটপাট করছে কারা, এসব সবাই জানে। কিন্তু অবাক করার ব্যাপার এই জনপদ, এই বাংলা এখন এক অদ্ভুদ মৃত জনপদ। এখানে কেউ টু শব্দটিও করেনা। আমার প্রশ্ন করা মেয়ের যে জেনারেশন ওরা জাগবে কিনা জানিনা। সে সম্ভাবনাও প্রায় নেই। শিক্ষার নামে সারাদেশে যে বলদ বানানোর কারখানা হচ্ছে, সেই আশাটুকুন ও ক্ষীণ।
সাইকেলের প্যাডেল ঘুরিয়ে এই ভোরে যাদের আজ রাস্তায় দেখলাম এরা কেউ ভালো মানুষ না। এদের চেহারায় আর অভিব্যাক্তিতে খাই খাই একটা ভাব। আজ ভোরে রাস্তায় এই মুখ গুলান দেখেই বুঝি এ দেশের নেতৃত্ব কাদের হাতে, আমাদের ভবিষ্যৎ কাদের হাতে। এদের কাউকে তো আমরা নেতা বানাতে চাইনি। কি প্রক্রিয়ায় এরা আমাদের নেতৃত্বে চলে আসছে, কেউ জানতে ও চায়না।
আবারো মন খারাপ হয়। আমার মতো এদেশের বেশীরভাগ লোকেরই মন খারাপ হয়। কিন্তু আমরা ভয়ানক নিশ্চুপ থাকি। এই মাটির নিচে ঘুমিয়ে থাকা ত্রিশ লক্ষ শহীদেরা অভিশাপ দিচ্ছে নিশ্চিত। ভোটের নামে যে বাটপারি করা হচ্ছে আমাদের সাথে এর দায় একদিন কড়ায় গন্ডায় আদায় করা হবে।
অনেক হতাশার মাঝেও আমি স্বপ্ন দেখতে চাই।
ফিরতি পথে নাস্তা নিয়ে বাসায় আসি। গুনগুন করে গান গাই "নবাব নবাবী করে, নেতা নেতাগিরী...."। বাসায় এসে দুরন্ত টিভি ছেড়ে নাস্তা করতে বসি। টিভিতে বাজতে থাকে " আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি"। খাবার গিলতে গিলতে নিজেই প্রশ্ন করি নিজেকে, আমি কি আসলেই দেশকে এখন ভালোবাসি? আর যদি নাই বা বাসি, এই না বাসার ভাবটা, দায়টা কারা, কেন, কিভাবে আমার মাথায় ঢুকিয়ে দিলো?
বন্ধু হানিফের ফেসবুক টাইম লাইন থেকে সংগৃহীত
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে জানুয়ারি, ২০২১ দুপুর ১:৩০