somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বাঙালির শেকড় ।। পর্ব- ২

৩০ শে নভেম্বর, ২০১৯ রাত ৮:৩১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



১ পর্বের লিংক- Click This Link

ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে খননলব্ধ প্রত্নতাত্মিক নিদর্শন ও মনুষ্য কংকালাদি আবিস্কার ও গবেষণার ফলে বাঙালি জাতিসত্তার একটি নৃতাত্ত্বিক পরিচয় রূপায়িত করা সম্ভব হচ্ছে। গবেষকদের মতে আদি অস্ট্রিকরাই (অস্ট্রাল) এই অঞ্চলের আদিতম বাসিন্দা। এরা মূলত ভূমধ্যসাগরীয় জনগোষ্ঠী সম্ভবত জলপথে এরা বঙ্গে প্রবেশ করে। অন্য মতে এরা স্থলপথে দক্ষিণ উপকূল দিয়ে অগ্রসর হয়ে বঙ্গ, উড়িষ্যা ও ছোটনাগপুরে বসতি স্থাপন করে। এদের একটি দল পূর্ব ভারত থেকে দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হয়ে সুদূর অস্ট্রেলিয়াতে বসতি স্থাপন করে। তাই এদের নাম হয় অস্ট্রিক। এদের ভারতীয় শাখা কোল বা মুন্ডা নামেও পরিচিতি লাভ করে। ঐতিহাসিক ও ভাষাতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গিতে অস্ট্রিকরা ছিল প্রাগ-দ্রাবিড়-প্রাগ-আর্য জাতি। পরে ভূমধ্যসাগরীয় আরেকটি দল উপকূলীয় স্থলপথে বা জলপথে দক্ষিণ ভারতে প্রবেশ করে এবং বসবাস করতে শুরু করে। তারা দ্রাবিড় নামে পরিচিত। অস্ট্রিক ও দ্রাবিড়দের মধ্যে সময়ে সময়ে সংঘর্ষ ও সহাবস্থান বজায় ছিল। কালের পরিক্রমায় তাদের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক সৃষ্টি হলে নতুন প্রজন্মের মধ্যে তাদের অবয়ব ঘুছে যায় এবং মন-মানস থেকে মুছে যায় তাদের গোত্রীয় স্বাতন্ত্র্য। এর পরে আসে আলপাইনীয় আর্যভাষী জনগোষ্ঠী। তাদের শির ছিল হ্রস্ব। এরা জলপথে পূর্ব ভারতেই প্রবেশ করে। সে কারণে বিহারের উত্তরে তাদের কোন নিদর্শন পাওয়া যায় না। এই সময়ে বা আরও কিছুকাল আগে হিমালয় ও লুসাই পর্বতের মালভূমি থেকে নেমে আসে বিভিন্ন গোত্রের মোঙ্গল জনগোষ্ঠী। কালক্রমে বৈবাহিক সূত্রে তাদের রক্তও মিশ্রিত হয়েছে এ অঞ্চলে বসবাসরত অস্ট্রিক-দ্রাবিড়-আলপীয় আর্যগোষ্ঠীর রক্তের সঙ্গে। পরে আর যে সব বিজেতা-ব্যবসায়ী-যাযাবর-ধর্মপ্রচারক এদেশে এসেছে তাদের রক্তও স্থানীয় মানুষের মধ্যে রয়েছে বটে, তবে তা সামান্য। অবশ্য নিগ্রো রক্তের মিশ্রণের কিছু লক্ষণও কিছু মানুষের মধ্যে দুর্লভ। তারা পুন্ড্র, রাঢ়, বঙ্গ, সুহ্ম প্রভৃতি গোষ্ঠী নামে অভিহিত হয়। এভাবেই আজকের বাঙালি-আসামী-উড়িয়া জাতিসত্তার উদ্ভব ও বিকাশ ঘটে।

চোখ-নাক-মুখ-চুল-চোয়াল-মাথার গড়ন আর দেহের বর্ণ, রক্ত ও আকার ধরেই নৃতাত্ত্বিক জাতিসত্তার শ্রেণী ও পর্যায় নির্ধারণ করা হয়। নৃতত্ত্বের পরিভাষায় বাঙালিদের অস্ট্রিক বলা হয় কারণ তাদের সঙ্গে মিল রয়েছে অস্ট্রেলিয়ার আদিম অধিবাসীদের। আদি অস্ট্রিকদের দেহ খ্রবাকার, মাথা লম্বা ও মাঝারি, নাক চওড়া ও চ্যাপ্টা, দেহবর্ণ কালো, মাথার চুল ঢেউ খেলানো কোঁকড়া। সাঁওতাল, মুন্ডা, কল, ভীল, কোরওয়া, কোরবু, জুয়াং প্রভৃতি অস্ট্রিক এবং বাঙালির নিকট জাতি। অস্ট্রিকরা ছিল মূলত ভূমধ্যসাগরীয় বর্গের নরগোষ্ঠী।
দ্রাবিড়রা হল ভূমধ্যসাগরের অপর বর্গের নরগোষ্ঠী। এরা ‘ভেড্ডিড’ নামেও পরিচিত। সম্ভবত এরা উপকূলীয় স্থলপথে দাক্ষিণাত্যে প্রবেশ করে। এদের মাথা লম্বা, নাক ছোট, দেহ মধ্যমাকার। এদের গাত্রবর্ণ শ্যামল।

আলপাইনীয় আর্যভাষী নরগোষ্ঠী ও বৈদিক আর্যভাষী ইরান-ভারতের নরগোষ্ঠী একই ভাষী, তবে নৃতত্বের সংজ্ঞায় পৃথক গোত্র। আলপাইনীয় বা আলপীয় ও ইন্দো-ইরানী-ইউরোপীয় আর্যভাষীরা বসাবস করত রাশিয়ার উরাল মালভূমি ও দক্ষিণের সমতল ভূমি থেকে দানিয়ুব নদীর উপত্যকা জুড়ে। তাই তাদের মধ্যে স্থানিক ভাষার সাদৃশ্য রয়েছে। গবেষকদের মতে তাই আর্য নামটি ভাষা জ্ঞাপক, জাতিবাচক নয়। আল্পস পার্বত্য অঞ্চলে যে দল ছড়িয়ে পড়ে তারা আল্পীয় এবং যারা পশ্চিম ইউরোপে, মধ্য এশিয়ায়, ইরানে ও ভারতে প্রবেশ করে তারা সম্ভবত অভিন্ন বর্গের নরগোষ্ঠী। এই নরগোষ্ঠী ‘নর্ডিক’ নামে পরিচিত। ‘নর্ডিক’রা ছিল যাযাবর এবং তাদের পেশা ছিল পশুপালন। আল্পীয়রা ছিল কৃষিজীবী। শারীরিক গঠনের দিক দিয়ে তারা হ্রস্বশির, মধ্যমাকার, মাথার খুলি ছোট ও চওড়া, খুলির পিছনের অংশ গোল, নাক লম্বা, মুখ গোল এবং গৌর দেহবর্ণের অধিকারী। আল্পীয় আর্যরা পরে এশিয়া মাইনর হয়ে ভারতের পশ্চিম উপকূল ধরে বেলুচিস্থান, সিন্ধু, গুজরাট ও মারাঠা অঞ্চলে এবং পূর্ব উপকূল ধরে বঙ্গ ও উড়িষ্যায় বাস করে।

বর্তমানে চাকমা, মারমা, লেপচা, ভুটিয়া, মিজো, ত্রিপুরা, মুরং, খাসিয়া, মেচ, গারো, হাজং প্রভৃতি গোত্রের লোকেরা মোঙ্গলীয় বর্গের। পৃথিবীতে মোঙ্গলীয় বর্গের লোকেরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। মধ্য এশিয়া, জাপান ও রাশিয়া অবধি অঞ্চলে এদের বসবাস। রঙ মিশ্রণের ফলে নৃতত্ত্বের একক মাপে তাদের আর চিহ্নিত করা যায় না। সাধারণত মোঙ্গলীয় নরগোষ্ঠীর গাত্রবর্ণ পীত, ঈষৎ ঘন পিঙ্গল। এদের মাথা গোল, মাথার খুলির পিছনের অংশ স্ফীত, চুল কালো ও ঋজু, ভ্রূ অনুচ্চ, মুখাকৃতি ছোট বা স্বল্পপরিসর, চিবুকের হাড় উঁচু, নাক মাঝারি ও চেপ্টা, মুখে ও দেহের লোম স্বল্প, চোখের খোল বাঁকা এবং শারীরিক গঠন মধ্যমাকার।

নর্ডিক আর্যরা (বৈদিক আর্য) গৌরবর্ণ। তাদের নাক দীর্ঘ ও সরু, শির বা দীর্ঘ কপাল এবং দেহ দীর্ঘ ও বলিষ্ঠ। নর্ডিক আর্যরা প্রচীনকালে গ্রীসে, ইরানে ও ভারতে এবং বর্তমানে ইউরোপে জ্ঞান-বিজ্ঞানে-দর্শনে-সাহিত্যে ও কৃৎকৌশলে উন্নতি লাভ করায় পৃথিবীর তাবৎ জাতির ঈর্ষার পাত্র। একারণে এশিয়া ও ইউরোপের অনার্য বর্গের লোকদের “আর্য” পরিচয়ের গৌরব লাভের লোভও প্রবল।
আসলে আদিতে আর্যরা ছিল বর্বর ও যাযাবর। মিসরীয়, আশশিরীয়, সুমেরীয়, ব্যবিলনীয়, সিন্ধুদেশীয় কিংবা চৈনিক সভ্যতার কালে আর্যদের উন্নতির কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না। উরাল ও দানিয়ুব অঞ্চলে বসবাস কালে অন্য বর্বরদের মতো তারা ছিল নরমাংস ভোজী। পরে অশ্ব, ষাড়, গাভী, মহিষ, মেষ এবং তারও পরে তারা অজভোজী হয়। নরমেধ, অশ্বমেধ, বলীবর্দমেধ, মেষমেধ, অজমেধ অবধি নিয়ম ও নীতি পরিবর্তিত হতে সমাজ বিবর্তনের ধারায় সময় লেগেছে কয়েক হাজার বছর। তার প্রমাণ বৈদিক সাহিত্যে রয়েছে। রিচিকপুত্র পুনঃশেপের, কর্ণের, শিবিরাজা প্রভৃতি গল্পে অতিথি ভোজনার্থে পুত্র বা নরবলি দানের কাহিনী রয়েছে। শুক্ল যর্জুবেদে ভূতসিদ্ধির জন্য ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়রা যজ্ঞ করত বলে বর্ণিত আছে। অম্বরিয়, হরিশ্চন্দ্র ও যযাতি এ যজ্ঞ করেছিলেন। এসব নরমেধ যজ্ঞ প্রজনন ও সন্তান-সম্পদকামী সমাজের আদিম যাদুবিশ্বাস যুগের স্বারক।

নর্ডিক আর্যরা পশুজীবী ছিল বলে তারা ছিল নগর সভ্যতার শত্রু। লুণ্ঠনের কারণে তারা নগর সভ্যতা বিনাশে ছিল উৎসাহী। কালক্রমে তারা কৃষিজীবী ও স্থিতিশীল জীবন-যাপনে অভ্যস্থ হয়ে পড়লে তারাও হয়ে উঠে নগর সভ্যতার ধারক। স্থায়ীনিবাস ও কৃষিজীবী হওয়ার পূর্বে আর্যরা কোথাও উন্নত সভ্যতা সৃষ্টির স্রস্টা ছিল না। আহমদ শরীফ ‘সমাজ সংস্কৃতির স্বরূপ’ গ্রন্থে লিখেছেন-

“আসলে আমরা যাকে বৈদিক আর্য বা ব্রাহ্মণ্য সভ্যতা বলি, তার চৌদ্দ আনাই আর্যপূর্ব দেশী জনগোষ্ঠীর অবদান। শিব, বিষ্ণু ও ব্রহ্মা, নারী, বৃক্ষ, পশু ও পাখিদেবতা, মূর্তিপূজা, মন্দিরোপাসনা, ধ্যান, ভক্তিবাদ, অবতারবাদ (ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের নবীবাদ স্মর্তব্য), জন্মান্তরবাদ, প্রেতলোক, ঔপনিষদিক তত্ত্ব বা দর্শন, সাংখ্য, যোগ, তন্ত্র এবং স্থাপত্য, ভাস্কর্য সবটাই দেশী। যাযাবর আর্যের স্থাপত্য-ভাস্কর্য জানা থাকার কথা নয়। ইরানের নর্ডিক আর্যরাও ইলামী, আশশিরিয়, সুমেরীয় ও ব্যবিলনীয় প্রভাব স্বীকার করে হয়েছে সভ্যতা সংস্কৃতিতে উন্নত। ”৩

প্রাচীন বঙ্গে নিষাদ গোত্রের লোকেরা ছিল অস্ট্রিক-দ্রাবিড় আর কিরাত গোত্রের লোকেরা ছিল মোঙ্গল। বঙ্গের দেশজ মুসলমানরা ও তথাকথিত নিম্নবর্গের লোকগুলো ছিল অস্ট্রিক-দ্রাবিড়। উচ্চবর্ণের হিন্দুদের মধ্যে আল্পীয় রক্তের প্রাধান্য ছিল। নর্ডিক আর্য রক্তের মানুষ বঙ্গে বিরল। তবে বৈদিক আর্যদের শাস্ত্র, সমাজ ও সংস্কৃতি দুই হাজার বছর ধরে বাঙালির মন ও মননে, জীবন ও জীবিকায় প্রবল প্রভাব ফেলেছে।

চলবে------
১ পর্বের লিঙ্ক--- Click This Link0
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা ডিসেম্বর, ২০১৯ সকাল ৮:৫২
২টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সৎ মানুষ দেশে নেই,ব্লগে আছে তো?

লিখেছেন শূন্য সারমর্ম, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:৪৮








আশেপাশে সৎ মানুষ কেমন দেখা যায়? উনারা তো নাকি একা থাকে, সময় সুযোগে সৃষ্টিকর্তা নিজের কাছে তুলে নেয় যা আমাদের ডেফিনিশনে তাড়াতাড়ি চলে যাওয়া বলে। আপনি জীবনে যতগুলো বসন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

গরমান্ত দুপুরের আলাপ

লিখেছেন কালো যাদুকর, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৫৯




মাঝে মাঝে মনে হয় ব্লগে কেন আসি? সোজা উত্তর- আড্ডা দেয়ার জন্য। এই যে ২০/২৫ জন ব্লগারদের নাম দেখা যাচ্ছে, অথচ একজন আরেক জনের সাথে সরাসরি কথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজীব নূর কোথায়?

লিখেছেন অধীতি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:২৪

আমি ব্লগে আসার পর প্রথম যাদের মন্তব্য পাই এবং যাদেরকে ব্লগে নিয়মিত দেখি তাদের মধ্যে রাজীব নূর অন্যতম। ব্যস্ততার মধ্যে ব্লগে কম আসা হয় তাই খোঁজ-খবর জানিনা। হঠাৎ দু'একদিন ধরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৮



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=তুমি সুলতান সুলেমান-আমি হুররাম=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৩৬



©কাজী ফাতেমা ছবি

মন প্রাসাদের রাজা তুমি, রাণী তোমার আমি
সোনার প্রাসাদ নাই বা গড়লে, প্রেমের প্রাসাদ দামী।

হও সুলেমান তুমি আমার , হুররাম আমি হবো
মন হেরেমে সংগোপনে, তুমি আমি রবো।

ছোট্ট প্রাসাদ দেবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×