কেউ যখন সমুদ্রতীরে দাঁড়ানো ফেনিল তরঙ্গের পটভূমিতে তার উচ্ছ্বাসিত মুহূর্তগুলো ক্যামেরাবন্দী করে তখন আমি অপলক সেই পটভূমির দিকেই চেয়ে থাকি। পৃথিবীর সিংহভাগ জনসাধারণের কাছে সমুদ্র যেন অদৃশ্য আবরনে মোড়ানো একটা রহস্যই রয়ে গেল। সমুদ্রের বিশালতা চিরকাল তাদের অগোচরেই পড়ে রয়। যদিও আরো অনেকের মতো সমুদ্র আমাদের এতো সহজে আবেগ প্রবণ করতে পারে না। আবার কারো হয়তো কোনদিনও না। যেন সমুদ্রই আমাদের সবকিছু। আবার যেন সে কিছুই নয়। নগন্য কিছু মানুষই জানে-
সমুদ্র মানে আনন্দ বেদনা। কখনো বা এক দুঃস্বপ্নের তাড়না!
তোমরা যখন সাগরতীরে বেড়াতে যাও কেউ কেউ যেন অতি অল্পতেই আবেগে উদ্বেলিত হয়ে পড়ো। তোমরা সবকিছু দেখতে থাকো এক ক্ষণিকের আগন্তুকের চাহনি নিয়ে। বালুকাবেলায় পায়ের পাতা ভিজিয়ে। তোমরা সমুদ্র দেখ সানগ্লাসের ফাঁক গলে। ক্যামেরার ক্লীকে। ছাউনি ঘেরা কোনো পরিপাটি রেস্তোরায় বসে ধোঁয়া উঠা চটপটিতে জ্বিভ লাগিয়ে। তোমরা সমুদ্র দেখ যুগলবন্দী হয়ে। পায়ে পায়ে হেঁটে হেঁটে। দুইজোড়া চোখে আকাশ কুসুম সব কল্পনা নিয়ে। সমুদ্র কি কেবলই ঢেউ যা তীর ভেঙে আছড়ে পড়ে পাথরের 'পরে?
সমুদ্র তোমাদের অতি সহজেই আবেগী করে যার নিজেরই হয়তো কোনো আবেগ নেই। তোমরা ভালবেসে সাগর তীরে নাম লিখে রাখো। আর ঢেউ এসে প্রতিবার তা নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে যায়। তোমরা যতটা প্রেম নিয়ে ঐ নীলের পটভূমিতে চেয়ে থাকো ততটুকু নিঃস্বার্থ প্রেম হয়তো ঐ বিশাল জলরাশিতেও নেই। তোমরা কেবল তার কোমলতাই দেখতে পাও। তার হিংস্রতা হয়তো কখনই তোমাদের গোচর হবে না।
সমুদ্র সে তো বহুরূপী।
তুমি তার কতটুকুই বা দেখেছ। সমুদ্র প্রেমময়ী। সমুদ্র ছলনাময়ী। তার সর্বগ্রাসী প্রেম তোমার জীবনে কেবল দুঃস্বপ্ন হয়েই থেকে যেতে পারে। তার ছলনায় পোড় খাওয়া নাবিকও যেন দিশেহারা হয়ে পড়ে। প্রেয়সীর কাজল কালো ছলছল চোখের বোধগম্যতা পলকেই হারিয়ে ফেলে।
সমুদ্র কখনো কেড়ে নেয়। কখনো প্রয়োজন শেষে ফিরিয়ে দেয়। তাই আমি সমুদ্রকে দেখি এক প্রেমান্ধ প্রেয়সীর রূপে। যে প্রাণ উজাড় করে ভালবাসতে পারে। আবার ভালবেসে সব কেড়ে নিতেও পারে। আমি জানি এ সমুদ্রের মায়াজাল ঠিক কতটা মোহময়। কতটা বিস্তৃত।
সমুদ্র আমার কাছে এক প্রেমময়ী প্রেয়সীর মতো। অভিমানী নারীর মতো। কখনো হাসায়। কখনো কাঁদায়। কখনো বিভ্রান্ত করে দেয়।
আমি সমুদ্রকে ভালবাসি। আমি সমুদ্রকেই ঘৃণা করি। অভিমান করতে করতে আবার তারই মাঝে ফিরে আসি। আমি সমুদ্রে হাসি। আমি সমুদ্রে ভাসি।
তাকে ঘিরেই যত সব স্বপ্নের জাল বুনি।
আমার মাঝে মাঝেই ইচ্ছে করে কোনো সমুদ্রপ্রেমী মানুষের সাথে সমুদ্র দেখতে যেতে।
আমি তার সাথে সাথে তার মতো করেই সমুদ্র দেখতে থাকবো।
ভুলে যাবো আমি নিজেই কোনো সমুদ্রচারী। তার কাছ থেকে তার মতো করেই সমুদ্রের কথা শুনবো। প্যান্ট উপরের দিকে ভাঁজ করে খালি পায়ে হাঁটবো অনেকক্ষণ। সহস্র মানুষের ঢলে, অচেনা জনস্রোতের ভীড় ঠেলে সেই প্রাণোচ্ছ্বাসে মিশে যাবো সহজেই।
হবো তাদেরই একজন। সাঁঝের বেলায় ঘনক আকৃতির বিশাল এক পাথরের ওপর দাঁড়িয়ে আমরা সূর্যাস্ত দেখবো। অপলক চেয়ে থাকবো লাল আবিরে রাঙা ঐ দিগন্ত রেখার পানে।
আমি হয়তো একদিন কোনো এক সমুদ্রপ্রেমীকেই খুঁজে বেড়াবো যে আমাকে সমুদ্র দেখা শেখাবে ঠিক তার মতোই অনাবিল উচ্ছ্বাস নিয়ে।
একদিন আমিও হয়তো সমুদ্র দেখতে এই বালুকাবেলায় ফিরে আসবো। যখন জাহাজে ফেরার কোনো তাড়া থাকবে না। সাগরতীরে আমার জন্য কেউ আর প্রতীক্ষায় রইবে না। থাকবে না ঘরে ফেরার পিছুটান। নগ্ন পায়ে আমি কেবলই হেঁটে যাবো.....
এক প্রান্ত হতে আরেক প্রান্তে..... সিক্ত বালির ওপর উপুড় হয়ে শুয়ে থাকবো অনেকটা সময়। নোনা জলের সেই চিরচেনা ঘ্রাণ নেবো খুউব খুউব কাছ থেকে..... ছোট ছোট কাঁকড়াদের পিলপিল করে ছুটে চলা পথের মাঝে হয়তো জীবনের কোনো হারানো ছন্দকেই খুঁজে বেড়াবো নতুন করে.....
আমি হয়তো আবারো সমুদ্র দেখবো.....
আমি সমুদ্র দেখবো এক স্বপ্নচারী হয়ে;
ঠিক তোমাদেরই মতো করে. . . . . . . . . . . . .
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে ডিসেম্বর, ২০১৬ দুপুর ১:৪৬