somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ভালোবাসার রঙ লাল

২৬ শে মে, ২০১৪ রাত ১:১৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

“আবার এসেছে আষাঢ় , আকাশ ছেয়ে
আসে বৃষ্টির সুবাস বাতাস বেয়ে ।।
এই পুরাতন হৃদয় আমার আজি পুলকে দুলিয়া উঠিছে আবার বাজি
নূতন মেঘের ঘনিমার পানে চেয়ে ।।”


সিডি প্লেয়ারে গানটা ছেড়ে বিপাশা ছোট, ক্লান্তি জর্জরিত একটুকরো শ্বাস ফ্যালে এবং বারান্দার দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে। দৃষ্টি তার রাতের নিকশ কালো আকাশে নিবদ্ধ।

খানিকটা দূর থেকে দেখলে মনে হবে ঘনঘোর আষাঢ় মাসের রাত্রিটা বিষণ্ণ একটি সকালের প্রত্যাশায় মুখ ভার করে ঝুলে আছে বারান্দায়। আরও খানিকটা দূর থেকে দেখলে মনে হবে, মন খারাপ করা এ রাত, দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে থাকা মেয়েটি, হু হু বাতাসে উড়তে থাকা তার খোলা চুল - এ সবকিছু কোন নিপুন চিত্রকরের তুলিতে আঁকা এক তৈলচিত্র।

বিপাশার বেশ করে মনে হয়, এখন বৃষ্টি নামা উচিৎ। এখন বৃষ্টি নামবে।

মিয়া তানসেন নাকি মিয়া কি মল্লারের ঝংকারে বৃষ্টি নামাতেন! অদ্ভুত না? আচ্ছা, নেচে নেচে যদি কেউ দেহ ভঙ্গিমায় অর্চনা অর্পণ করে আকাশের দেবতাকে,তবে কি বৃষ্টি নেমে আসবে এ তৃষিত পৃথিবীতে?

বর্ষা বন্দনার রবীন্দ্রসঙ্গীত, সিডি প্লেয়ারে যেটা বেজে চলেছিল ক্রমাগত, তার মাদকতা ছড়িয়ে পড়ে বিপাশার শরীরে, ধীর গতিতে। আকাশের পানে হাত বাড়িয়ে পিপাসার্ত নয়ন মেলে চেয়ে থাকে সে কিছুক্ষণ। তারপর সে ময়ূরীর মত দশদিক আলো করে তার পেখম মেলে। মনোহরণ করা ছন্দে- ভঙ্গীতে সে ঘুরে ঘুরে সে নেচে বেড়ায় তার বিশাল বারান্দা জুড়ে।

নৃত্যরত অবস্থায়ই তার দৃষ্টি পড়ে বারান্দার পাশে, বেডরুমে অঘোরে ঘুমিয়ে থাকা জয়ন্তের ওপর।

জয়ন্ত বিপাশার স্বামী।

বৃষ্টি কি বিপাশার প্রেমিক?

বিপাশাও কি তবে দ্বিচারী?
ক্লান্ত অবসন্ন দেহে পুনরায় বারান্দার মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে বিপাশা। নৃত্যের শ্রমে তার কপাল , গণ্ডদেশ, গ্রীবা, বক্ষ, নাভিমূল হয়ে কোমরের ঝুলবারান্দায় শ্বেতবিন্দুর মত যে ঘাম ফোঁটায় ফোঁটায় এসে জমেছে, তার স্বাদ আস্বাদনে, চোখের আলোয় চেটেপুটে খাবার জন্যে আজ কেউ সজাগ নেই। না জয়ন্ত , না পোড়া বৃষ্টি।

আষাঢ় মাসের গহীন আঁধার ঘেরা এই রাতে বৃষ্টি নামবে কি নামবে না তা নিয়ে আর বেশীক্ষণ মাথা ঘামানোর সুযোগ হল না। শিরশিরে শীতল সরীসৃপের মত প্রশ্নটা বিপাশার মস্তিষ্কে প্রবেশ করে-

ভালবাসার রঙ কি লাল?

“অবশ্যই, অবশ্যই লাল” - ফিসফিসিয়ে বলে ওঠে সে। শব্দগুলো বাতাসের তোড়ে বেশিদূর যেতে পারে না। ঘুরপাক খেতে থাকে বিপাশাকে ঘিরে, গাছের পাতা ঝরে পড়ার পর বাতাসের তোড়ে যেভাবে গাছকে ঘিরেই ঘুরপাক খায়- তেমনি।

বিপাশা পেইন্টার। প্রফেশনাল না ,শখের। জয়ন্তের প্ররোচনায় এ পর্যন্ত দু’বার তার প্রদর্শনী হয়েছে। জয়ন্ত নিজে একটা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে ইংরেজি পড়ায়। বিয়ের পর থেকে নিয়ে আজ দশ বছর ধরে তারা স্বামী-স্ত্রীতে মিলে আছে বিপাশার বাবার এই বাড়িতে। পুরনো ঢাকার গোসাইবাড়ি লেনে অবস্থিত এই প্রায় প্রাচীন বাড়িতে বাবার মৃত্যুর বছরে একবার সংস্কার করা হয়েছে। তাও আজ প্রায় পাঁচ বছর হল। বেশ খোলামেলা দোতালা বাড়িটির সামনে ছোট্ট একটা উঠোনে কিছু গাছ লাগানো হয়েছে। আগে কিছু ভেষজ গাছ থাকলেও তারা এখন আর বেঁচে নেই, এখন আছে কেবল ফুলগাছ। বাবার শখ ছিল ভেষজ গাছ লাগানোর। বিপাশার সে শখ নেই। বাবার মৃত্যুর সাথে সাথে বাবার শখেরও অপমৃত্যু ঘটে। বিপাশার ভালোবাসার স্পর্শে ও যত্নে এখনও বেশ ভালোভাবেই বেঁচে আছে বাগানের জুঁই, হাসনাহেনা আর টগর গাছ। নিয়মিত ছাঁটাই আর নিখুঁত পরিচর্যার অভাবে মারা গেছে গোলাপ গাছের চারাদুটো।

আদ্র বাতাসের সাথে যখন হাসনাহেনার একটা বুনো ঘ্রাণ এসে কড়া নাড়ে বিপাশার নাকের ডগায় , তার বড় ভাল লাগে। এ সুঘ্রাণের ওপর তার একার অধিকার – ব্যাপারটা তাকে অন্যরকম আনন্দ দেয়।

ড্রইংরুমের ভারী দেয়ালঘড়ি থেকে তিনবার ঘণ্টা বাজে – “ঢং ঢং ঢং”। বিপাশা তার স্টুডিওতে যাওয়ার উদ্যোগ নেয়। একটা অর্ধ সমাপ্ত ছবি নিয়ে কাজ করছে সে গত একমাস। ঘুম যখন আসছে না, কাজ খানিকটা আগিয়ে নিতে পারলে মন্দ হয় না। বেডরুমে এসে থমকে দাঁড়িয়ে যায় সে।

পূর্ণদৃষ্টিতে তাকায় বিপাশা, জয়ন্তের দিকে। ঘুমিয়ে থাকলে একদম দেবশিশুর মত মায়াকাড়া চেহারা ছেলেটার, অথচ একবার ঘুম ভেঙ্গে একবার উঠে দাঁড়ালেই বলিষ্ঠ সুপুরুষ! লোকটা সারাদিনের দুশ্চিন্তাগ্রস্থ চেহারার সেই ছাপ এখন আর তার মাঝে নেই, কপালের বলিরেখাগুলোও একদম উধাও।
অনেক শান্ত, অনেক অনেক শান্ত লাগছে ওকে।

তাদের দশম বিবাহবার্ষিকীর রাত আজ। ডায়নিং টেবিলে এখনও কাটা কেক পড়ে আছে। পড়ে আছে হোটেল ওয়েস্টিন থেকে প্যাক করে আনা স্পেশাল ডিনার। সব খেয়ে শেষ করতে পারে নি তারা। এত খাবার তাদের মত মিতাহারী দুজন মানুষের পক্ষে খেয়ে শেষ করা কখনোই সম্ভব না। তবুও.........

বিপাশা তাদের ওয়ার্ডরোবের ওপর থেকে নানা ঔষধের পুরনো বোতলের সাথে লেক্সাপো এবং র্যা মেরনের দুটো খালি বোতল সরিয়ে নেবার পর তাদের বিয়ের দিন তোলা বাঁধাই করা ছবিটা খুঁজে পায়। বিস্ময়ভরা চোখে তাকিয়ে দেখে, কি সুন্দর একটা মুহূর্ত আটকে আছে ফ্রেমের মধ্যে! তার প্রচণ্ড মায়া হয় , সে ছুটে গিয়ে জয়ন্তের কপালে একটা চুমু খায়। তারপর হেঁটে হেঁটে চলে আসে তার স্টুডিওতে।

বেশ খোলামেলা একটা রুমে বড় বড় জানালা। টিউবলাইটের ঝলমলে আলোয় একটা মাত্র ক্যানভাস দেখা যায়। রুমের মাঝ বরাবর রাখা ক্যানভাসটি বেশ বড়সড়। তাতে টাঙ্গানো ছবিটা দেখে সে হতাশ হয়। বিমূর্ত চিত্রের ওপর সে বেশ কয়েক বছর ধরেই পড়াশোনা করছে। এর ওপর কাজ শুরু করেছে মাত্রই। ক্যানভাসে টাঙ্গানো তার এ অর্ধ সমাপ্ত ছবি, বিপাশার তুলিতে সে ধারার প্রথম ছবি হতে চলেছে। সে চাচ্ছিল মধ্যরাতের হতাশা ব্যাপারটা ইজেলের রঙে তুলে আনতে, কিন্তু ছবিটায় প্রাণহীনতা চোখে কাঁটার মত খচখচ করছিল।

বিপাশা ইজেল হাতে জানালার পাশে এসে আবার আকাশের দিকে তাকায়। বৃষ্টি এলো বলে। বৃষ্টির অপেক্ষায় থাকা আকাশের রঙ যদি কালো হয়, ভালোবাসার রঙ কি তবে লাল হবার কথা না? তবে জয়ন্ত এটা মানতে চায় না কেন?

বিপাশার এই এক বাতিক- সব অনুভূতিকে একএকটা রঙে প্রকাশ করা।

বিপাশার অন্তরে সবগুলো অনুভূতির জন্যে একেকটা রঙ নির্দিষ্ট করা আছে। তবে এই বিভাজন বিপাশার একান্তই ব্যাক্তিগত। কোন একটা বস্তু দেখার পর তার মনে যে অনুভূতি কাজ করে , সেই অনুভূতি অনুযায়ী সে তার রঙ ঠিক করে। সে মোতাবেক মনখারাপ করা যেকোনো কিছুর রঙ তার কাছে সবুজ, আনন্দের রঙ সাদা, অহমের রঙ গোলাপি এবং,

ভালোবাসার রঙ অবশ্যই অবশ্যই লাল।

জয়ন্ত অন্যান্য কালার কম্বিনেশানগুলো মেনে নিয়েছে। কিন্তু ভালোবাসার রঙ যে লাল, এটা সে মানতে চায় না কোনক্রমেই। জয়ন্তের মতে ভালোবাসার রঙ পার্পল, অর্থাৎ বেগুনী। কিন্তু কেন? – এ প্রশ্নের কোন জবাব দেয় নি সে, কখনোই। প্রশ্নের পর প্রশ্নে খালি মুচকি মুচকি হেসেছে, কিন্তু বোমা মেরেও পেট হতে সে কোন উত্তর বের করতে পারে নি।

“যাকগে” – ভাবে বিপাশা, বয়েই গেল তাতে তার। ইংরেজির প্রোফেসর হলেই রঙের ব্যাপারে বিদ্যা ফলাতে আসবে , এতই জ্ঞানী নাকি সে!

ঝড়ো হাওয়ায় কেঁপে কেঁপে দুলে দুলে একটা হলদে প্রজাপতি জানালার প্রাগৈতিহাসিক গরাদ অতিক্রম করে বিপাশার চারপাশে ওড়াউড়ি করতে থাকে। কি সুন্দর, কি সুন্দর! হাত বাড়াতেই প্রজাপতিটা ওর হাতের উল্টো পীঠে এসে বসে। একজন ভাল আর্টিস্ট হবার পূর্বশর্ত হচ্ছে আপনাকে খুব মনযোগী পর্যবেক্ষক হতে হবে। বিপাশা জানে তা। বিপাশা খুব মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করে ওর ডানার কারুকাজ। বাইরে সম্পূর্ণ হলুদ ডানার ভেতরের দিকটা কমলা, গাঢ় হলুদ আর কালো রঙের, তার ওপরে আছে কিছু কালো কালো ফোঁটা । বিপাশা প্রজাপতির ডানার নকশা এত কাছ থেকে কখনোই দেখে নি। মুগ্ধতা নিয়ে সে দেখে, প্রজাপতিটি একবার ডানা মেলছে, আবার বন্ধ করছে; মেলছে, আবার বন্ধ করছে, এভাবে বেশ কয়েকবার।

বিপাশা তার মুগ্ধতার দৃষ্টি একবারের জন্যেও না সরিয়ে নিখুঁত ক্ষিপ্রতায় প্রজাপতিটিকে হাতের মুঠোয় খপ করে পুরে ফেলে ধীরে ধীরে চাপ বাড়াতে থাকে। প্রজাপতির শরীরের কম্পন ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে আসে। বিপাশা শরীরে শিহরন নিয়ে মুহূর্তটুকু উপভোগ করে।

“প্রাণবন্ত এবং প্রাণহীন বস্তুর সৌন্দর্যের পার্থক্য কি খুব বেশী?”- প্রজাপতির ডানাদুটো টেনে ছেঁড়ার ফাঁকে নিজেকেই নিজে শুধোয় সে। তারপর, ডানাদুটোকে খুব যত্নে , আলতো করে হাতের মুঠোয় ধরে রেখে সে ক্যানভাসের সামনে দাঁড়ায়। অর্ধসমাপ্ত প্রাণহীন ছবিটিতে প্রাণসঞ্চার করার উদ্দেশ্যে সে প্রজাপতির ডানাদুটো শক্ত করে আঙ্গুলের ফাঁকে মুচড়ে ধরে এবং শক্তি দিয়ে ঘষতে থাকে ক্যানভাসের ফাঁকা জায়গাগুলোয়। তবে ঠিক হলুদ নয়, কমলা, কালো , হলুদের মিশ্রণে এক বিদঘুটে রঙের সৃষ্টি হয়। বিপাশার মন খারাপ হয়ে যায়। তার ক্লান্ত লাগে এবং ধুরে ফিরে তার মাথায় আবার প্রশ্নটা এসে হানা দেয়- ভালোবাসার রঙ কী লাল?

যদিও ঘুম আসছে না এতটুকুও , তবু বিপাশার মনে হয় এখন তার বিছানায় যাওয়া উচিত। সে তার ক্যানভাসের পাশে রাখা ছোট টেবিল থেকে ঘুমের ঔষধের ছোট কৌটো খুঁজে নিয়ে তা থেকে দুটো ট্যাবলেট বের করে। গ্লাসে রাখা পানি দিয়ে ঢকঢক করে গিলে ফেলে। রুমের একপাশে রাখা বুকসেলফ থেকে টেনে বইটা টেনে বের করে- “Selected poems- Robert Browning” – Penguin classics. পাতাটা ভাঁজ করা ছিল। একবারেই কবিতাটা বের হয়ে আসে এবং রাতের নীরবতাকে খানখান করে দিয়ে বিপাশা উচ্চস্বরে আবৃত্তি করে ওঠে-

“That all it scorned at once is fled,
And I, its love, am gained instead!
Porphyria's love: she guessed not how
Her darling one wish would be heard.
And thus we sit together now,
And all night long we have not stirred,
And yet God has not said a word”

বেডরুমে এসে জয়ন্তের পাশে ধুপ করে শুয়ে পড়ে বিপাশা। জয়ন্তের দিকে ফিরে আবারো জয়ন্তের মায়াভরা মুখখানি দেখে এবং তার মনে প্রশ্ন জাগে – কেন জয়ন্ত কখনোই এটা মানতে চায় না যে ভালোবাসার রঙ লাল?

বিপাশা উত্তরটা জানে। তার ঠোঁটের কোনে ক্ষণিকের জন্যে খেলে যায় ক্রূঢ় হাসি। জয়ন্ত ভেবেছিল সে বিষয়টা লুকিয়ে রাখতে পারবে বিপাশার কাছ থেকে, কিন্তু পারে নি। - “ বিচ, দ্যাট গার্ল ওয়াজ!”, চিবিয়ে চিবিয়ে উচ্চারণ করে সে।

নিশ্চয়ই জয়ন্তের সাথে অ্যাফেয়ার চলছিল মাগীটার। ওর প্ররোচনায়ই নিশ্চয়ই জয়ন্তের মানসিকতা বদলে গেছে। তাই নিশ্চয়ই ও কথায় কথায় তার বিরধিতা করতো । মানতে চাইতো না যে ভালোবাসার রঙ লাল।

স্বামীর মোবাইল গোপনে চেক করা ব্যাপারটা শোভন নয়, কিন্তু বিপাশার কিছু করারও ছিল না। জয়ন্তের মোবাইলে সে গোপনে মেয়েটার ম্যাসেজ দেখেছে। বন্যা নাম ওর। জয়ন্তের ছাত্রী। “ ছাত্রী না কলগার্ল একটা! মাগী কোথাকার” – রাগে ফেটে পড়তে পড়তে বিপাশা সামলে নেয় নিজেকে। ঠিক আছে, জয়ন্ত ওর কোন ম্যাসেজের রিপ্লে নাহয় দেয় নি, কিন্তু ফোনে নিশ্চয়ই কথা বলত ওর সাথে। নাহলে এ মেয়ে এতখানি বাড় বাড়ে কিভাবে?

গত বছরের বিপাশার মিস ক্যারেজের পর থেকে জয়ন্তের হয়েছে আবার নতুন বাতিক। সে বলত, বিপাশার নাকি কিছু মানসিক সমস্যা দেখা দিয়েছে। এটাও নিশ্চয়ই ঐ মেয়ের শিখিয়ে দেয়া বুলি, দুজনের সম্মিলিত ষড়যন্ত্র! বিপাশা এটা মানে যে দীর্ঘ ৯ বছর অপেক্ষার পর বাচ্চার জন্যে অপেক্ষা করে জন্মের মুহূর্তে মিসক্যারেজ হওয়ায় সে খুব আপসেট হয়ে পড়েছিল। কিন্তু তাই বলে পাগল? একদমই না! সব ষড়যন্ত্র!

যাই হোক, আজ রাতটা অন্তত এ সব বাজে চিন্তা মনে স্থান দিতে চায় না বিপাশা। আজ তাদের বিবাহবার্ষিকীর রাত, এ রাতে জয়ন্তের যে উপহার পাবার তা তো সে ইতমধ্যে পেয়ে গেছেই!

বিপাশা গভীর ভালবাসা নিয়ে তার পাশে শুয়ে থাকা মানুষটির দিকে তাকায়। তার মনে পড়ে যায় কক্সবাজারের বালুবেলায় কাটানো তাদের মধুচন্দ্রিমার রাতগুলো। তারা বেছে নিয়েছিল শুক্লপক্ষের সময়কাল। প্রায় প্রতিরাতেই তারা দুজন প্রকৃতির সন্তানের মত গিয়ে শুয়ে থাকতো সমুদ্রের পাড়ে রেখে দেয়া আরাম কেদারাগুলোয়। সৃষ্টির ইতিহাসের দীর্ঘতম সে রাতগুলোয় আকাশে রাজত্ব করত পূর্ণিমার চাঁদ, আর তাদের সঙ্গী হত সমুদ্রের গর্জন এবং ভেজা বাতাস।

আজ প্রায় দশবছর পরে জয়ন্তের পাশে শুয়ে মনে হল, সেই রাত যেন আজ আবার ফিরে এসেছে। জানালা দিয়ে প্রবেশ করা ল্যাম্পপোস্টের আলো ফেরত এসেছে শুক্ল পক্ষের চাঁদ হয়ে, ঘরময় ছটফটিয়ে বেড়ান ভেজা বাতাস যেন সমুদ্রের ভেজা বাতাস এবং, পাশে সেই বহুদিনের চেনা জয়ন্ত।

“ভালোবাসার রঙ পার্পল নয় ডিয়ার”- বিপাশা বলে ওঠে। ভালোবাসার রঙ লাল এবং সে আজ শত ভাগ নিশ্চিত এ ব্যাপারে। বিছানা, ঘরের মেঝেময় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা লালরঙের অবুঝ আলপনা তার বিশ্বাসকে অকাট্য করেছে।

বিপাশা আবার তাকায় জয়ন্তের দিকে এবং ভাবে - কি পবিত্র দেখাচ্ছে তার শিশুসুলভ মুখখানা! জয়ন্তকে আবেগের সাথে জড়িয়ে ধরতে গিয়ে বিপাশার শাড়ির ফাঁকে - নগ্ন পেটে ধাতব বস্তুটির স্পর্শ অনুভব করে, যার আমুল জয়ন্তের বুকে বেঁধা। সারা শরীরে শিহরণ নিয়ে বিপাশা উঠে বসে!

খুব বেশী ছটফট করে নি জয়ন্ত। রাতে ঘুমানোর সময়ই ওর কফিতে গোটা পাঁচেক ঘুমের ঔষধ মিশিয়ে দেয়ায় যে বেঘোর ঘুম ঘুমুচ্ছিল, ও হয়তো টেরও পায় নি। মাংস কাটার বড় ছুরিটা ঘণ্টা খানেক ধরেই বসে আছে ওর হৃদপিণ্ড বরাবর। ফিনকি দিয়ে ছুটে আসা রক্তের ছড়াছড়ি দেখা যাচ্ছিল পাশের দেয়ালে, দেয়াল চুয়ে গড়ানো মেঝেতে। বিছানায় কিছুটা চাদর- ম্যাট্রেস শুষে নিয়েছে, কিছুটা জমাট বেঁধে থকথকে হয়ে আছে।

বিপাশা হৃদপিণ্ডের চারদিকে তৈরি হওয়া গভীর ক্ষতটিকে মনোযোগ দিয়ে দেখে। তার ইচ্ছে ছিল হৃদপিণ্ডটা টেনে বের করে আনা ,কারণ তার খুব জানতে ইচ্ছা করছিল যে সব কিছু উজাড় করে ভালোবাসার পরেও কিভাবে একজন মানুষ অন্য আরেকটি মেয়ের প্রেমে পড়তে পারে, এবং সে মানুষটির হৃদপিণ্ডের গঠনই বা ক্যামন। সুযোগ পেলে সে হয়তো আরেকটা মানুষের হৃদপিণ্ডের সাথে তুলনা করে দেখত। কাল সকালে বুয়া কাজ করতে আসলে, ওর হৃদপিণ্ডটা কেটে বের করে পরীক্ষাটা চালানো যেত , কিন্তু বিপাশার শক্তিতে কুলায় নি। চেষ্টা করেও সে জয়ন্তের হৃদপিণ্ডটা খুবলে বের করে আনতে পারে নি।

কিন্তু বিপাশা প্রমাণ করতে পেরেছে যে ভালোবাসার রঙ লাল! জয়ন্তের শরীর জুড়ে, বিপাশারও প্রায় সারা শরীরে, এবং ঘরের মেঝে সহ বাকি সব জায়গা , যেখানে জয়ন্তের উষ্ণ রক্তের স্রোত ফোয়ারার মত গিয়ে ধাক্কা মেরেছে- তার লালিমাই তো বিপাশার বিজয়ের চিহ্ন!

বিপাশা বোধ করে, জয়ন্তের রক্তের এ প্রবাহ অবশ্যই বৃথা যায় নি বরং তাদের ভালবাসাকে অমরত্বের স্তরে পৌঁছে দিয়েছে। তাদের দশ বছরের ভালোবাসার সম্পর্ক, যা ছিল চূড়ান্ত ভাবে অসম্মানিত হবার থেকে চুলমাত্র দূরত্বে, জয়ন্তের প্রবহমান লাল রক্ত তার বিশুদ্ধতা রক্ষা করেছে।

সকাল হওয়ার আগেই জয়ন্তের দেহ সে বাড়ির সামনে বা পেছনে কোন এক জায়গায় পুঁতে ফেলবে, কিন্তু তার আগে , বিপাশার খুব ইচ্ছা হয়, শেষবারের মত তাদের ভালোবাসার ছোট ছোট নিদর্শনগুলো আরেকবার, শেষবারের মত পুনরাবৃত্তি করার।

বুকে বেঁধা ছুরি হ্যাঁচকা টানে বের করে ছুঁড়ে ফেলতেই বাড়ির সাদা বেড়ালটা ফ্যাঁশ করে ওঠে। সে অবলা চারপেয়েটা তখন অতি নিমগ্নভাবে ঘন, লাল এবং প্রায় জমে যাওয়া লাল তরল পদার্থটা চেটে বোঝার চেষ্টা করছিল যে এর ঠিক কতটুকু তার পেটে সইবে।

বিপাশা প্রথমে জয়ন্তকে মৃদু আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে। তারপর আলতো করে তার ঠোঁট স্পর্শ করে জয়ন্তের শীতল ঠোঁট। সে শীতলতা অসহ্য মনে হয় বিপাশার। এটাই এ পার্থিব জীবনে (যদিও জয়ন্তের জন্যে আর পার্থিব নয়) তাদের শেষ চুম্বন।

জয়ন্ত চোখ বন্ধ করে আছে কেন? বিপাশা টেনে তার চোখের পাপড়িগুলো মেলে ধরতেই জয়ন্তের দৃষ্টি ঘরের ছাদে আবদ্ধ হয়। মিছে আক্রোশে বিপাশা চুমুর তীব্রতা আরও বাড়ায়। থেমে গিয়ে আগে নিজের অবিন্যস্ত চুলের গোছাকে চুড়ো করে বাঁধে এবং বুনো-আদিম প্রাণশক্তি নিয়ে পুনরায় ঝাঁপিয়ে পড়ে জয়ন্তের মৃতদেহের ওপর।

বিপাশা হঠাৎ টের পায়, তার পেটের নীচ থেকে একটা আগুনের হলকা শরীরের প্রতিটি কোষকে পোড়াতে পোড়াতে মস্তিষ্কে এসে উত্তাপ ছড়াচ্ছে। তার শরীর নারীত্বের পূর্ণতা দাবী করছে এক মৃত মানুষের কাছে, শেষবারের মত। একবার, আর একবার , শেষবারের মত জয়ন্তের সাথে মিলেমিশে একাকার হবার তীব্র প্রয়োজন বোধ করে বিপাশা।

অমানবিক শক্তি এসে ভর করে তার দেহে। এক হ্যাঁচকা টানে জয়ন্তের সুতিশার্টের পলকা বোতামগুলো পটপট আওয়াজ তুলে ছিটকে ছড়িয়ে পড়ে। পাতলুন গিয়ে পড়ে দরজার পাশে। নিজে অনাবৃত হতে আরও কম সময় নেয় বিপাশা।

বিপাশা যখন সর্বোতভাবে প্রস্তুত, ঠিক তখন সে আবিষ্কার (বা পুনরাবিষ্কার) করে, জয়ন্ত আর সাড়া দেবে না। তারপক্ষে আর সাড়া দেয়া সম্ভব না। যে ভাষায় বিপাশা জয়ন্তের সাথে কথা বলতে চায়, জয়ন্ত সে ভাষায় প্রতিউত্তর দিতে চূড়ান্তভাবে অক্ষম।

দূর আকাশে মেঘের গম্ভীর গর্জন ভেসে আসে, শোনা যায় মেঘের শরীর হতে ফোঁটায় ফোঁটায় বৃষ্টির ছুটে আসার শব্দ। বৃষ্টির ছাঁট তীব্র থেকে তীব্রতর হয়। বৃষ্টি পড়ার মধুর সে আওয়াজ বিপাশার বুকে শেলের মত এসে বেঁধে এবং তার মস্তিষ্কে বিস্ফোরণ ঘটে। বৃষ্টি আর মাটির সঙ্গম তাকে মনে করিয়ে দেয় নারীত্বের সমস্ত পূর্ণতা অঙ্গে ধারন করেও কতটা অপূর্ণ সে।

জীবনে প্রথমবারের বিপাশার মনে হয়, ভালবাসার রঙ লাল না হলেও তার কোন সমস্যা নেই। সে ধাক্কার পর ধাক্কা দিতে থাকে জয়ন্তের বুকে এবং অনুনয় করে বলে যে ভালোবাসার রঙ লাল নয়, সে সেটা মেনে নিয়েছে, এখন জয়ন্ত জেগে উঠুক।

কিন্তু কে শোনে কার কথা!

বারান্দা পর্যন্ত গড়িয়ে আসা রক্তের স্রোত আর বৃষ্টির ছাঁট – এ দুয়ে মিলে মেঝেতে যখন সৃষ্টি করছে অপূর্ব আলপনা , বৃষ্টি ও মাটির প্রতি ঈর্ষায় কাতর এক নগ্ন নারী তখন ব্যাস্ত একুল-অকুল দু’কুল ভাঙ্গা কান্নায়!
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই মার্চ, ২০২১ রাত ১১:১৮
১০টি মন্তব্য ৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

টের পেলে

লিখেছেন সাইফুলসাইফসাই, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:৫৭

টের পেলে
সাইফুল ইসলাম সাঈফ

টের পেলে গুটিয়ে যায় লজ্জাবতী/ পরিপূর্ণ যৌবনে যুবতীর নিখুঁত অনুভূতি। আমার চাওয়া, ইচ্ছে, স্বপ্ন! আমার পছন্দ বুঝদার, সুন্দর হৃদয়ের রূপ! সৌন্দর্য সুন্দর যা চিরন্তন সত্য। কিন্তু সেটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইসলামের চার খলিফার ধারাবাহিকতা কে নির্ধারণ করেছেন?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:৩৭




সূরাঃ ৩ আলে-ইমরান, ২৬ নং আয়াতের অনুবাদ-
২৬। বল হে সার্বভৈৗম শক্তির (রাজত্বের) মালিক আল্লাহ! তুমি যাকে ইচ্ছা ক্ষমতা (রাজত্ব) প্রদান কর এবং যার থেকে ইচ্ছা ক্ষমতা (রাজত্ব)... ...বাকিটুকু পড়ুন

কিভাবে বুঝবেন ভুল নারীর পিছনে জীবন নষ্ট করছেন? - ফ্রি এটেনশন ও বেটা অরবিটাল এর আসল রহস্য

লিখেছেন সাজ্জাদ হোসেন বাংলাদেশ, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৪

ফ্রি এটেনশন না দেয়া এবং বেটা অরবিটার


(ভার্সিটির দ্বিতীয়-চতুর্থ বর্ষের ছেলেরা যেসব প্রবলেম নিয়ে টেক্সট দেয়, তার মধ্যে এই সমস্যা খুব বেশী থাকে। গত বছর থেকে এখন পর্যন্ত কমসে কম... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রতিদিন একটি করে গল্প তৈরি হয়-৩৭

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৫১




ছবি-মেয়ে ও পাশের জন আমার ভাই এর ছোট ছেলে। আমার মেয়ে যেখাবে যাবে যা করবে ভাইপোরও তাই করতে হবে।


এখন সবখানে শুধু গাছ নিয়ে আলোচনা। ট্রেনিং আসছি... ...বাকিটুকু পড়ুন

একাত্তরের এই দিনে

লিখেছেন প্রামানিক, ০১ লা মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৬


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

আজ মে মাসের এক তারিখ অর্থাৎ মে দিবস। ১৯৭১ সালের মে মাসের এই দিনটির কথা মনে পড়লে এখনো গা শিউরে উঠে। এই দিনে আমার গ্রামের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×