somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সাম্প্রদায়িকতার ছকে রবীন্দ্রভাবনাঃ বিচ্ছিন্নতা বনাম আত্তীকরণের রাজনীতি

০৯ ই মে, ২০২০ ভোর ৪:২৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



"When desire blinds the mind with delusion and dust
O thou Holy One, thou wakeful
Come with Thy light and Thy Thunder."


(Gitanjali , verse 39, Rabindranath Tagore)


১।

রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে পঁচিশে বৈশাখের রাতে যখন লিখতে বসেছি, বাইরে তখন প্রচণ্ড কালবৈশাখীর ঝড়, আমার রুম জুড়ে ঠাণ্ডা বাতাস আর ইটালিয়ান পিয়ানিস্ট - কম্পোজার লুদোভিকো ইনাউদি'র পিয়ানোর মূর্ছনা। মাথার মধ্যে অশান্ত চিন্তার প্রবাহ, পেছনে ফিরে নিজেকে খুঁজে দেখার প্রয়াস, রবীন্দ্রনাথের সাথে আমার শৈশব থেকে সম্পর্কের উচাটন। একদম ছোটবেলায়, বয়স যখন আমার চার, যখন পাঁচ টাকা রিকশাভাড়ায় ঢাকার প্রায় অর্ধেকটা ঘুরে ফেলা যেত , সেই সময়টায় বাবার হাত ধরে কিশলয় কচিকাঁচার আসরে গান শিখতে যাওয়া, এবং জীবনে প্রথম হারমোনিয়াম তোলা সে গান - "আমরা সবাই রাজা"। যে দেশে সবাই রাজা, সেই সব রাজাদের রাজত্বে যে ঠিক কি গোলযোগ পাকিয়ে উঠতে পারে - তা বুঝবার বয়স আমার আদৌ তখনও হয়নি। গাইতে ভালোই লাগতো। মাথায় অদৃশ্য মুকুট , হাতে রাজার অদৃশ্য তরবারি, আর ঘরময় ছুটে বেড়ানো এবং গানে গানে নিজের রাজত্ব দাবী করে ফেরা। স্কুলে ভর্তি যখন হলাম, তারপর আবারো দেখা হল রবীন্দ্রনাথের সাথে, কোন আড়ম্বর ছাড়া, পাঠ্যপুস্তকে - কাজী নজরুল ইসলাম, বন্দে আলী মিয়া, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, বা শামসুর রাহমান - আল মাহামুদ সাথে মিলিয়ে। পার্থক্য শুধু এতটুকু জানতাম যে - রবীন্দ্রনাথের নামের আগে বিশ্বকবি বা কবিগুরু সম্ভাষণ যোগ করলে মাষ্টারমশাই নাম্বার বেশী দেন। আর পরীক্ষার হলে তাঁর নামের বানান ভুলে গেলে সংক্ষেপে রবিঠাকুর লিখে চালিয়ে দেয়া যায়, তাতে কেউ খুব বেশী আপত্তি করে না।

কলেজ লাইফের গণ্ডি পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পা রাখবার পর, যখন বয়স বিদ্রোহ করবার, সবকিছুকে অগ্রাহ্য করবার, দীর্ঘদিন বর্ষণের পর জমিতে জন্মানো কচিঘাসের মত নিজের সদ্য গজিয়ে ওঠা বিচারবুদ্ধি নিয়ে যখন এক পৃথিবীকে মোকাবেলা করা, অস্বীকার করার বয়স, রবীন্দ্রনাথের প্রতি সে সময়কালে আমার দৃষ্টি ছিল প্রত্যাখ্যানের দৃষ্টি। আরে ভাই, জীবনানন্দ দাস , সুনীল পেরিয়ে এখন জয়গোস্বামী পড়ছি! মলচত্বরে বাসের অপেক্ষায় ঠিক আমার পাশেই মোহময়ী সহপাঠী, আর আমার মনজুড়ে পাতার পোশাক। তখন রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে ভাবার কি সময় আছে? যেখানে তার জীবিতাবয়স্থায়ই কল্লোল সাহিত্যগোষ্ঠী তাঁর কবিতাকে পুরাতন ও অনাধুনিক বলে সমাধিস্তবক রচনা করে সেরেছেন। শেষের কবিতা ততদিনে পড়া হয়েছে, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ যে ওতে অর্বাচীন কল্লোলগোষ্ঠীর কলকাকলিকে আলতো করে কান মলে দিয়েছেন তা বুঝে ওঠা হয় নি। এও বোঝা হয় নি যে - কাউকে প্রত্যাখ্যান করতে হলে তাকে পড়ে প্রত্যাখ্যান করা লাগে, কল্লোলগোষ্ঠী সে দুঃসাহস দেখিয়েছিলেন, কারণ তাঁরা রবীন্দ্রনাথ পড়েছিলেন সকল রবীন্দ্রভক্তের চেয়েও কষে। সে যাক, প্রশ্ন করা ছিল তখন অনেক সহজ আমার জন্যে। তাই প্রশ্ন করে বসেছিলাম - আজ থেকে ষাট - সত্তর বছর আগে গত হয়ে যাওয়া কবির কবিতা কেন পড়বো আর? তাকে নিয়ে আলোচনাই বা হবে কেন এই বিংশ শতাব্দীতে টিএসসির সড়ক দ্বীপের চায়ের দোকানে বসে?

মুখে বলতাম অমন কিছু - কিন্তু ভেতরে ভেতরে বোধ করতাম, মন কোনজায়গায় যেন সায় দিচ্ছে না। তখন আমি, আর আমার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের আমার একমাত্র উল্লেখযোগ্য বন্ধু, আইন বিভাগের ছাত্র চিশতী অনিমেশ টুকটাক নিজেরা গান লিখে সুর দেয়ার চেষ্টা করছি। মনে পড়ে, ধুম্রশলাকার ধোঁয়ায় চারপাশ আচ্ছন্ন করে দিয়ে অনিমেশের স্বগতোক্তি - "হালার রবীন্দ্রনাথ, সব খাইয়া দিলো। মানব মনের এমন একটা স্তর নাই যাতে ও সাতার কাটে নাই, এমন একটা অনুভূতি নাই যা ও অনুভব করে নাই , এমন একটা বিষয় নাই বা যা নিয়া ওর একটা কবিতা , বা অন্তত একটা গান নাই।" কবিগুরু সেই উঠতি বয়েসি বিদ্রোহী দুই তরুণ কবি - গীতিকারের মুখে উচ্চারিত অমার্জনীয় শব্দগুছ হয়তো মার্জনার চোখেই দেখতেন, যদি বেঁচে থাকতেন, নইলে আর বিশ্বকবি কিসের। কিন্তু সত্য কথা হচ্ছে, আমি আমার বন্ধু চিশতী অনিমেশের বোধনের সাথে অসহায়ের মত আত্মসমরপন না করে উপায় ছিল না। কারণ বাসায় ততদিনে বাবার কল্যাণে রবীন্দ্রনাথের সঞ্চয়িতা নামক ইয়া মোটা কবিতার কালেকশন যথাযথ অবস্থায় বিদ্যমান, এবং রবীন্দ্রনাথের কবিতা যে টেক্সট বইয়ের মত একাধারে বইয়ের শুরুর পাতা থেকে শেষ পাতা পর্যন্ত পড়তে হয় না, বরং একটা দুটো করে, যখন যে পাতা সামনে পড়ে - সে অনুপাতে পড়ে আত্মস্থ করতে হয় - কথা সাহিত্যিক হাসান আজিজুল হকের এই পরামর্শ সম্বলিত সাক্ষাৎকার তখনও আমার পড়া হয় নি। কাজেই সঞ্চয়িতার আগাপাছতলা নিংড়ে পড়তে গিয়ে গলদঘর্ম হওয়ার সে দিনগুলিতে বন্ধু অনিমেশের প্রস্তাবে নীরব সম্মতি জানানোটাই ছিল আমার পক্ষে একমাত্র সত্যভাষণ। ততদিনে বুঝে গিয়েছিলাম, না বুঝলে বলা যায় যে রবীন্দ্রনাথ নজরুলকে সময় মতো সেঁকো বিষ না খাওয়ালে আজ নোবেলটা রবীন্দ্রনাথের বদলে নজরুলের গলায়ই ঝুলত, তবে ঠিকমত বুঝে শুনে রবীন্দ্রনাথকে অপছন্দ করা অনেক কঠিন।

তারও বহুকাল পরে, এই গত বছরের ঘটনা। প্রতিমাসেই বেতন অ্যাকাউন্টে এসে জমা হলে শাহবাগের পাঠক সমাবেশে গিয়ে দেশী বিদেশী ম্যাগাজিন কিনি। এক কপি কালি ও কলম, এককপি একবিংশ, এককপি দেশ, অনুস্টুপের নতুন ইস্যু এলে সেটা। রবীন্দ্র জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে দেশ পত্রিকার পাতায় কবি জয় গোস্বামীর রবিঠাকুরের কবিতা নিয়ে লেখা এক প্রবন্ধে পড়লাম বাসে বসে - তিনি তাঁর পছন্দের এক তরুণী কবিকে প্রশ্ন করেছিলেন যে - রবিঠাকুরের কবিতা তিনি পড়েছেন কিনা। উত্তরে ঐ তরুণী বলেছিলেন ছাড়া ছাড়া ভাবে পড়া হয়েছে, ধারাবাহিকভাবে নয়। জয় গোস্বামী উক্ত তরুণীর উত্তরের ওপর ভিত্তি করে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছান যে বাংলা কবিতা এখন এতই সমৃদ্ধ হয়েছে যে, রবীন্দ্রনাথকে ডিঙ্গিয়েও এখন কবি হিসেবে নিজের একটা পরিচিতি তৈরি করে নেয়া যায়। এই ইন্টার্ভিউ যদি তাঁর একদশক আগে আমার হাতে এসে পড়তো, তবে হয়তো রবীন্দ্রনাথকে ধারাবাহিকভাবে পড়ে ক্রমশ নিজের কবিতার বোধ এবং চিন্তার গভীরতা নিয়ে শিশুবয়সেই অস্তিত্ববাদী সংকটে ভোগা প্রয়োজন হত না। তাই বলে কি রবীন্দ্রনাথের কবিতা বা লেখা বুদ্ধি যখন পূর্ণতার দিকে হাঁটি হাঁটি পা পা করে এগুচ্ছে - তখন অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাবে?

২।

সম্পর্কের গলিঘুঁজিগুলো বড়ই গোলকধাঁধাঁর। বাংলাদেশের আবহাওয়া সংবাদের মত এই রৌদ্র, এই বৃষ্টি। অবাক হয়ে দেখলাম - বহু পূর্বে প্রয়াত বাংলা সাহিত্যের এই মহাগুরুর সাথেও আমার সম্পর্ক সেইরকমেই এগুচ্ছে।

ভাবতে মজা লাগে, রবীন্দ্রনাথের সাথে আমার এককালে শত্রুতার সম্পর্ক ছিল। তাঁর কারণ আমার বাবা।

স্বাধীনতাউত্তর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের স্বর্ণযুগের ছাত্র তিনি। ডিপার্টমেন্ট দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন তখন আহমদ শরীফ স্যার, হুমায়ূন আজাদ স্যার , আবু হেনা মোস্তফা কামাল স্যার সহ আরও অনেকেই। রুদ্র মুহাম্মদ শহিদুল্লাহ তখন একটা পাঞ্জাবী আর কাঁধে ঝোলা ব্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে ডিপার্টমেন্টের করিডোরে। টিএসসিতে গেলে তখন আহমদ ছফাকে পাওয়া যায়, কার্জন হলে গেলে হুমায়ূন আহমেদকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অমন সুসময় কি আর এসেছে কখনো? সেই স্বর্ণযুগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে অনার্স এবং মাস্টার্সের একটি সার্টিফিকেট আদায় করে এবং অনেক প্রবাদপ্রতিম শিক্ষকদের আশীর্বাদ ধন্য হয়ে তিনি বাংলাদেশ টেলিভিশনের জন্যে নাটক লেখা শুরু করলেন, আর পেশা হিসেবে নিলেন সাংবাদিকতা। সচিত্র সন্ধানি হয়ে শাহাদাত চৌধুরীর সাথে বিচিত্রা, তাঁরপর সাপ্তাহিক ২০০০ হয়ে সবশেষ ডেইলি স্টার - আনন্দধারা।

আমার শৈশবে - বুঝতে যখন শিখেছি , তখন থেকেই দেখি বাবার মধ্যে ক্রমাগত লেখার ঝোঁক কমছে আর বাসায় ফিরে বেশীর ভাগ সময় বই নিয়ে বসে আছেন, পড়ার ঝোঁক বাড়তে থাকার কারণে। বলা বাহুল্য, উল্টে পাল্টে দেখি - প্রায় সব বই রবীন্দ্রনাথের, বা রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে লেখা। চাইলে খুব আয়েসের সাথে একটা জীবন রবীন্দ্র সাহিত্যজগতে অবগাহন করে পার করে দেয়া যায় - এ বোধ তখনও তৈরি হয় নি, এদিকে আমার তখন যে বয়স, সে বয়সে বাবারাই ছেলেদের রোলমডেল, সুপারম্যান। সৃজনশীল লেখালিখির জগত থেকে ক্রমশ নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে সারাদিন রবীন্দ্রনাথের মাঝে ডুবে থাকার ফলে আমার বাবার সৃষ্টিশীলতার হন্তারক হিসেবে কাউকে চিহ্নিত করার প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। নির্দ্বিধায় রবীন্দ্রনাথের দিকে দাগিয়ে তিলাম তোপ। একটু একটু গাইতে শেখা, একটু একটু পড়তে শেখা, একটু একটু লিখতে শেখাকে পুঁজি করে সৃজনশীলতার অপার রহস্যময় জগতের দরজায় তখনও কড়া নাড়ছি, খুলতে দেরি হচ্ছে বিধায় ধরেই নিলাম ওপারে রবীন্দ্রনাথ শেকল তুলে বসে আছেন সমস্তটি পথ জুড়ে। বাসায় তখন হুমায়ূন আহমেদের প্রেমের উপন্যাস নিয়ে গেলে মা অশ্লীলতার ভয়ে লুকিয়ে ফেলে, কিন্তু সুনীল - শীর্ষেন্দুর ভাষাকে কোডিফাই করা তার জন্যে একটু কঠিন হয়ে দাঁড়ায় বিধায় তাদের নিয়ে, এবং খানিকটা বিরতিতে মানিক, বিভূতি - তারাশংকর, এবং গানের জগতে অর্ণব, অনুপম রয় ... নিজের অর্বাচীনতার ফর্দ বড় করে লোকহাস্যের পাত্রে পরিণত করারই বা কি প্রয়োজন।

এই ফাঁকে টুক করে রবিঠাকুরকে পুঁজি করে একটি ব্যক্তিগত লাভ হাসিলের গল্প দু'লাইনে শেয়ার করি। প্রেমিকার তিন চারটে অ্যাসাইনমেন্ট এক সপ্তাহে পড়ে যাওয়ায় , আর বাংলা সাহিত্য নিয়ে তাঁর জ্ঞান খুবই ভাসাভাসা লেভেলে থাকায়, সে রবীন্দ্রনাথ সংক্রান্ত তাঁর একটি অ্যাসাইনমেন্ট আমাকে লিখতে দেয়। তখনও তো জানতাম না যে একদিন পাকে চক্রে শিক্ষকের পেশায় এসে এই ধরনের বুদ্ধিবৃত্তিক চৌর্যবৃত্তির স্বীকার আমারও হরহামেশাই হতে হবে। যাক, তাঁর শিক্ষক অ্যাসাইনমেন্টটির এতই ভূয়সী প্রশংসা করে যে, যখন আমার সাথে তার পরে দেখা হল সে স্থানকাল ভুলে এমনই উষ্ণ আলিঙ্গনে আমাকে আবদ্ধ করে, তা ভুলতে আমার বিয়ে করা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছিল। সে বিয়ে অবশ্য তাঁর সাথে হয় নি। সে আরেক গল্প।

৩।

প্রসঙ্গ পঁচিশে বৈশাখ, প্রসঙ্গ রবীন্দ্রনাথ, এবং দুর্ভাগ্যজনকভাবেই, প্রসঙ্গ সাম্প্রদায়িকতা। দীর্ঘশ্বাস চেপে রেখে, ধীর কদমে সেদিকেই এগুনো যাক।

গঠনকালের দিনগুলোতে, যখনো তিনি "রবীন্দ্রনাথ" রবীন্দ্রনাথ হয়ে ওঠেন নি, রবিঠাকুরের মূল মর্মবেদনা ছিল - লোকে তাকে ঠিকমত পড়তে পারে না। তাকে বেশী বোঝা হয় (অতিপ্রশংসার ক্ষেত্রে), কম বোঝা হয় (হিংসুকের নিন্দার ক্ষেত্রে) , কিন্তু বোঝাপড়া করা হয় না সাহিত্যমহলে, বা পত্রপত্রিকায়। রবীন্দ্রনাথের চিঠির সংকলন ছিন্নপত্রাবলীতে রবীন্দ্রনাথের ৩০ বছর বয়সের আশেপাশের সময়কালের মানস পরিব্যপ্ত হয়ে ছড়িয়ে আছে, তা থেকে ভাবটুকু নিলাম। ১৯১৩'র পর, কবি রবীন্দ্রনাথকে বুঝে ওঠাটা জরুরী হয়ে ওঠে সবার জন্যে। অবিভক্ত ভারতের তিনি কবিগুরু, শুনশান নীরবতার ওয়েস্টার্ন ফ্রন্টে তিনি প্রাচ্যের শান্তির বারতাবাহী সন্ন্যাসী কবি। সমগ্র ইউরোপ চষে বেড়িয়েছেন তিনি নোবেল লরিয়েট কবির সম্মাননায়। তবুও হতাশ হয়ে আমাদের দেখতে হয় - মৃত্যুশয্যায় পতিত হবার পূর্ব পর্যন্ত ঈর্ষাকাতর বাঙ্গালীর শত্রুতার বানে, ঈর্ষার বানে বারবার, বারবার জর্জরিত হতে, রক্তাক্ত হতে। অজস্র অপবাদ তাঁর বিরুদ্ধে দেশে বিদেশে ছড়ানো হয়েছে। নোবেল পুরস্কার লাভ করার পর তাঁর নিন্দাকাতর একশ্রেণীর বঙ্গবাসী যখন তাকে সংবর্ধনা জানাতে আগ্রহ প্রকাশ করে, তিনি তাদের আগের অবজ্ঞা, অবহেলা, তাকে এড়িয়ে চলার, ছোট করবার প্রয়াসে সদা তৎপর ঐ শ্রেণীর নোবেল পুরষ্কারোত্তর সংবর্ধনা নিতে অস্বীকৃতি জানান। বাবার মুখে শোনা এ ঘটনা, এই মুহূর্তে বইয়ের রেফারেন্স তো দিতে পারছিনা, কিন্তু আমার মনে হয় না এ ঘটনা ঐতিহাসিকভাবে অসত্য। আবার নোবেল বিজয়ের পর ইতালিতে মুসোলিনির প্রোপ্যাগান্ডা ট্যুরের মুসলিনির প্রশংসা করবার পর ফরাসি দেশে এসে রমো রল্যা যখন মুসলিনির ব্যাপারে তার চোখ খুলে দেন, এবং রবীন্দ্রনাথ ভুল স্বীকার করে মুসলিনির প্রতি তার আগের প্রশংসাস্তুতি ত্যাগ করেন - ইতালি থেকে যে ভাষায় তাকে বারবনিতা বুদ্ধিজীবী হিসেবে প্রমাণ করবার জন্যে উঠে পড়ে লাগে, শান্তিনিকেতনে ফিরে এসে ঘড়া ঘড়া জল ঢেলে গোসল করবার পরেও তার মনের সে অশুচি দূর হয় নি।

কাজেই অনেক অভিযোগ, অনেক ঈর্ষা, অনেক প্রতিহিংসাপরায়ণ আচরণ রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যচর্চা, চিন্তা - দর্শন থেকে নিয়ে ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথ, এমনকি তাঁর পরিবারকে নিয়েও করা হয়েছে। কিন্তু সাম্প্রদায়িকতার বিষে জর্জর ভারতীয় উপমহাদেশে আজ ২০২০ সালে এসে যখন বাংলাদেশে রবীন্দ্রনাথকে প্রধানত একজন সাম্প্রদায়িক ব্যক্তির ছকে ফেলে বিচার করবার - প্রচার করবার একটা প্রয়াস চোখে পড়ে, তখন সে পক্ষের দাবীর সাথে বোঝাপড়ার জন্যে নিজের নিজের ব্যক্তিগত রাবীন্দ্রিক আবেগউচ্ছ্বাসকে সচেতনভাবে একটু দূরে দাঁড় করিয়ে রেখে রবীন্দ্রনাথের পুনঃপাঠ প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে। প্রবন্ধের বাকি অংশে আমি ব্যক্তিজীবনে, লিখিত সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথকে হিন্দুমুসলিম সাম্প্রদায়িকতার খাঁচায় আটকানো যায় কিনা, তা পর্যালোচনা করবো। পরবর্তী ধাপে রবীন্দ্রনাথের ধর্মবিশ্বাস কিরকমের ছিল, তা নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোকপাতের শেষে বাকি সব আলোচনার প্রেক্ষিতে লব্ধ আমার নিজের নববোধের মোড়ক উন্মোচন, এবং পাঠকদের জন্যে চিন্তার একটি স্পেস ছেড়ে দেয়ার প্রচেষ্টার মাধ্যমে প্রবন্ধের সমাপ্তি টানা হবে।

৪।

রবীন্দ্রনাথ ব্যক্তিগত জীবনাচরনে হিন্দু - মুসলিম বিভেদ করতেন কিনা, এ বড় লম্বা আলোচনা। এ বিষয়ে একদম চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর মত আলোচনা করবার মত ক্ষেত্র একটি প্রবন্ধ নয়, এবং সত্য বলতে - সে আলোচনা করবার যোগ্য লোকটিও আমি নই। কিন্তু আমার বিচ্ছিন্নভাবে পড়া রবীন্দ্রনাথের , এবং রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে যে সমস্ত লেখা - তাতে রবীন্দ্রনাথের জীবনাচারে সাম্প্রদায়িকতার , বৈষম্যে চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায় কিনা, এব্যাপারে একটি ফুটনোট দেয়া সম্ভব। সে চেষ্টাই করা যাক।

হিন্দু - মুসলমানের মাঝে বৈষম্যমূলক আচরণ করবার সবচে ভালো সুযোগ রবিঠাকুরের পক্ষে ছিল, যখন তিনি তাঁর বাবা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাত থেকে জমিদারী দেখভাল (ইন্সপেকশান) করার দায়ভার পান ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দে, ২৯ বছর বয়সে। বিশ্বভারতী প্রেস থেকে প্রকাশিত অমিতাভ চৌধুরীর লেখা "জমিদার রবীন্দ্রনাথ" বইটিতে ১৮৯০ এ জমিদারীর দেখভাল করার শুরু থেকে নিয়ে ১৮৯৬ সালে পুরো জমিদারীর দায়িত্ব পিতার কাছ থেকে বুঝে পাওয়া, এবং পরবর্তীতে ১৯২২ সালে শিলাইদহে তাঁর জমিদার হিসেবে শেষবারের মত গমন পর্যন্ত সময়কালে অবস্থায় জমিদার রবীন্দ্রনাথের বিবিধ ঘটনা, সিদ্ধান্ত - ইত্যাদি সবিস্তারে আলোচিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর বাবার সূত্রে পেয়েছিলেন জমিদারী, আমি আমার বাবার সূত্রে পেয়েছি রবীন্দ্রনাথের জমিদারীর উপরে লেখা এই বই। সেই বই থেকেই জানা যায় জমিদার রবীন্দ্রনাথের এক স্বচ্ছ নিটোল রূপ।

১৮৯১ খ্রিস্টাব্দে রবীন্দ্রনাথ যখন জমিদারীর ইন্সপেকশনে বা ছায়া জমিদার হয়ে প্রথম পুণ্যাহ অনুষ্ঠানে অংশ নিতে যান - সেখানেই জাতপাতের ভেদ দূরকারী, এবং দীর্ঘদিন যাবত প্রাচীন অনড় শৈলের মত প্রথার বুকে হুকুমের আঘাত করেন। ঘটনাটি অমিতাভ চৌধুরীর বইয়ে এভাবে বিবৃত -

"প্রিন্স দ্বারকানাথের আমল থেকে সম্ভ্রম ও জাতিবর্ণ - অনুযায়ী পুন্যাহ অনুষ্ঠান থাকে বিভিন্ন আসনের বন্দোবস্ত। হিন্দুরা চাদরে ঢাকা সতরঞ্জি উপর একধারে, তারমধ্যে ব্রাহ্মণের স্থান আলাদা এবং চাদর ছাড়া সতরঞ্জির উপর মুসলমান প্রজারা অন্য ধারে। সদর ও অন্যান্য কাছারির কর্মচারীরাও নিজ নিজ পদমর্যাদামতো বসেন পৃথক পৃথক আসনে। আর বাবুমশায়ের জন্যে ভেলভেটমোড়া সিংহাসন।
বরণের পর রবীন্দ্রনাথের সিংহাসনে বসার কথা। কিন্তু তিনি বসলেন না। সদর নায়েবকে রবীন্দ্রনাথ জিজ্ঞেস করলেনঃ ' নায়েব মশাই, পুণ্যাহ উৎসবে এমন পৃথক পৃথক বসার ব্যবস্থা কেন?' এই অস্বাভাবিক প্রশ্নে বিস্মিত নায়েব বলেনঃ 'বরাবর এই নিয়ম চলে আসছে।' রবীন্দ্রনাথ জবাব দেনঃ 'না, শুভ অনুষ্ঠানে এ জিনিস চলবে না। সব আসন তুলে দিয়ে হিন্দু - মুসলমান, ব্রাহ্মণ চণ্ডাল সবাইকে একইভাবে একই ধরনের আসনে বসতে হবে।' নায়েব মশাই প্রথার দাস। তিনি বলেন, এই আনুষ্ঠানিক দরবারের প্রাচীন রীতি বদলাবার অধিকার কারো নেই। রবীন্দ্রনাথ আরও রুস্ঠ হয়ে তৎক্ষণাৎ জবাব দিলেনঃ 'আমি বলছি তুলে দিতে হবে। এ রাজ দরবার নয় মিলনস্থল। ... প্রাচীন প্রথা আমি বুঝি না, সবার এক আসন করতে হবে। জমিদার হিসেবে এই আমার প্রথম হুকুম।


জমিদারি সম্ভ্রম আর প্রাচীন প্রথায় আস্থাবান সদর নায়েব ও অন্যান্য হিন্দু আমলারা একসঙ্গে হঠাৎ একযোগে ঘোষণা করে বসলেন, প্রথার পরিবর্তন ঘটালে তাঁরা একযোগে পদত্যাগ করবেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ অবিচল। তিনি উপস্থিত বিরাট প্রজামণ্ডলীকে উদ্দেশ্যে করে বললেন - 'এই মিলন উৎসবে পরস্পর ভেদাভেদ সৃষ্টি করে মধুর সম্পর্ক নষ্ট করে দেয়া চলবে না। প্রিয় প্রজারা, তোমরা সব পৃথক আসন, পৃথক ব্যবস্থা - সব সরিয়ে দিয়ে একসঙ্গে বসো। আমিও বসব। আমি তোমাদেরই লোক।

অপমানিত নায়েব গোমস্তার দল সবিস্ময়ে দূরে দাঁড়িয়ে দেখলেন, রবীন্দ্রনাথের আহ্বানে হিন্দু মুসলমান প্রজারা প্রকাণ্ড হলঘরে সব চাদর, সব চেয়ার নিজেরাই সরিয়ে দিয়ে ঢালা - ফরাসের উপর বসে পড়ল। মাঝখানে বসলেন রবীন্দ্রনাথ। সে এক অপরূপ দিব্যমূর্তি। প্রজারা মুগ্ধ হয়ে দেখল তাদের নতুন বাবুমশাইকে।

মিলন উৎসবে কারো মনে ব্যাথা দেয়া অনুচিত। প্রজাদেরই তাই রবীন্দ্রনাথ বললেনঃ ' যাও, সদর নায়েব আর আমলাদের ডেকে আন, সবাই একসঙ্গে বসে পুণ্যাহ উৎসব করি। রবীন্দ্রনাথ আমলাদের অনুরোধ করলেন পদত্যাগ পত্র প্রত্যাহার করতে। উৎসব শুরু হোল। দলে দলে আরও লোক কাছারিবাড়িতে এসে ভেঙ্গে পড়লো। এবং সেদিন থেকে ঠাকুর এস্টেটের পুণ্যাহ সভায় শ্রেণীভেদের ব্যবস্থা উঠে গেলো।
... সেই দিনই তিনি ঘোষণা করলেন, 'সাহাদের থেকে শেখদের বাঁচাতে হবে। এটাই আমার সর্বপ্রধান কাজ।' " (অমিতাভ চৌধুরী, পৃষ্ঠা ৩৯ - ৮১)

অমিতাভ চৌধুরীর সাক্ষ্য যথেষ্ট মনে না হলে বাংলা সাহিত্যের বীরবল - প্রমথ চৌধুরীকে টেনে আনা যায়। প্রমথ ছিলেন রবীন্দ্রনাথের অগ্রজ সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কন্যা ইন্দিরা দেবীর স্বামী, রবীন্দ্রনাথের অতি ঘনিষ্ঠ সহচর , এবং বাংলা সাহিত্যের জগতে পৃথকভাবে উল্লেখ করবার মত এক গুণী লেখক। তিনি তাঁর "রায়তের কথা" প্রবন্ধে উল্লেখ করেন -

"রবীন্দ্রনাথ জমিদার হিসেবে মহাজনদের কবল থেকে প্রজাকে রক্ষা করবার জন্যে আজীবন কী করে এসেছেন তা আমি সম্পূর্ণ জানি - কেননা তাঁর জমিদারী সেরেস্তায় আমিও কিছুদিন আমলাগিরি করেছি। আর আমাদের একটা বড় কর্তব্য ছিল সাহাদের হাত থেকে শেখদের বাঁচানো। কিন্তু সেইসঙ্গে এও আমি বেশ জানি যে, বাংলার জমিদারমাত্রই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নন।" ( ১৩৩৩ বঙ্গাব্দ)

দুটি সাক্ষ্যের ওপর ভিত্তি করে রবীন্দ্রনাথ জমিদার হিসেবে প্রজাদের মাঝে সাম্প্রদায়িক বৈষম্য করেন নি বলে সিদ্ধান্ত নিতে যদি কষ্ট হয়, তবে সে সময়ে লেখা তার চিঠি সমূহের সংকলন ছিন্ন পত্রাবলীর সাহায্য নেয়া যেতে পারে। তাতে কখনোই সাম্প্রদায়িকতার সূত্র ধরে কারো সঙ্গে তার মনোমালিন্য হবার ছাপ পাওয়া যায় না। এক সাদা চামড়ার ইংরেজের সাথে এক সভায় বসে কিছু অপমানজনক আমবক্তৃতার থেকে পাওয়া মনকষ্টের ফলে তার তিনরাত ধরে ঘুম হয় না - এমন রবীন্দ্রনাথের হদিস তার মনের কথার ঝাঁপিতে মেলে, কিন্তু সাম্প্রদায়িকতার কোন দূরবর্তি ছায়া তাতে দেখা যায় না। কাজেই জমিদার হিসেবে রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রজাদের মধ্যে হিন্দু - মুসলিমে , অন্তত আচরণগত তফাৎ করেন নি, এটা ঐতিহাসিক সত্য হিসেবে ধরে নেয়া যায়।

রবীন্দ্রনাথ আলাপচারিতার সঙ্গী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে খুবই খুঁতখুঁতে ছিলেন, তাঁর আত্ম জৈবনিক লেখাগুলোয় প্রায়ই অভিযোগ করতেন কিভাবে কোলকাতার বাঙ্গালী সম্প্রদায়ের তরুণ যুবকেরা অহেতুক আলাপ - তর্ক বিতর্কে প্রবৃত্ত হয়ে তাঁর সময় নষ্টের চেষ্টা করে। উল্লেখ্য , উক্ত অভিযোগ আনা বেশীরভাগ তরুণই হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত। বাংলার যে মুসলমানদের তিনি জীবনের অধিকাংশ সময়ে তাঁর চারপাশে পেয়েছেন, তাঁরা ছিল চাষাভুসো শ্রেণীর। রবীন্দ্রনাথের ছিন্ন পত্রাবলীতে এই ধরণের মুসলিম চাষা শ্রেণীর লোকদের সহজ সরলতার তারিফে রত অবস্থায় রবীন্দ্রনাথকে প্রায়ই পাওয়া যায়। আবার প্রতিভাধর কোন যবনসন্তানকে পেলে তিনি সাম্প্রদায়িকের মত দূরে ঠেলে দেন নি। সৈয়দ মুজবতা আলী তাই শান্তি নিকেতন থেকে তাঁর সান্নিধ্যলাভ করে বেরোতে পেরেছিলেন।

জমিদার রবীন্দ্রনাথ অনেকসময়ই সহজ সরল প্রজাদের ভক্তি গ্রহণ করতেন আদি প্রথা অনুযায়ী। যেমন ছিন্ন পত্রাবলীর ২১৯ নং চিঠির উল্লেখ করা যাক। রবীন্দ্রনাথ ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দের পুণ্যাহ অনুষ্ঠান নিয়ে লেখেন -

"কাল আমাদের এখানকার পুণ্যাহ শেষ হয়ে গেল। বিস্তর প্রজা এসেছিল। আমি বসে বসে লিখছিলুম, এমন সময় প্রজারা দলে দলে রাজদরশন করতে এলো - ঘর বারান্দা সমস্ত পূর্ণ হয়ে গেল। ... শিশুর মত সরল এবং মনের ভাব - প্রকাশে অক্ষম সব দাঁড়ি - ওয়ালা পুরুষমানুষ একে একে এসে আমার পায়ের ধুলো নিয়ে চুমো খেতে লাগলো - কখনো কখনো এরা কেউ কেউ একেবারে পায়ে চুমো খায়। একদিন কালীগ্রামে মাঠে চৌকি নিয়ে বসে আছি, সেখানে হঠাৎ এক মেয়ে এসে আমার দুপায়ে মাথা রেখে চুমো খেলে - বলা আবশ্যক সে অল্পবয়স্কা নয়। পুরুষ প্রজারাও অনেকে পদচুম্বন করে। আমি যদি আমার প্রজাদের একমাত্র জমিদার হতুন তাহলে আমি এদের বড়ো সুখে রাখতুম এবং এদের ভালবাসায় আমিও সুখী থাকতুম।" ( ছিন্ন পত্রাবলী, চিঠি নং ২১৯, পৃষ্ঠা ২১৮-১৯)

শিশুর মত সরল, ভক্তি গদগদ , মনের ভাব প্রকাশে অক্ষম দাঁড়িওয়ালা পুরুষ এবং বয়োজ্যেষ্ঠ নারীরা তাঁর পায়ে চুমু খাচ্ছে, পায়ের ধুলো মাথায় নিচ্ছে - এগুলোর সরল বর্ণনা দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ তাঁর উক্ত চিঠির এ অংশে।

প্রশ্ন হচ্ছে - কোন অপরাধবোধে না ভুগে এভাবে একজন মানুষ হয়ে আর একজন মানুষের নিজের পায়ে মুখ ঘষা বা চুমুখাওয়ার বর্ণনা দেয়ার জন্যে আমরা আজ ২০২০ সালে বসে তাকে দোষারোপ করতে পারি?

আমাকে জিজ্ঞেস করলে আমি বলবো, পারি না। রবীন্দ্রনাথের এই কাজকে বিচার করতে হবে সেই সময়, অর্থাৎ ১৮৯৫ সালের প্রেক্ষিতে। সে সময় প্রজাদের কাছ থেকে এই সম্মান জমিদারের প্রাপ্যই ছিল। রবীন্দ্রনাথ অসচেতনতার মাঝে এই ভক্তিপ্রসাদটুকু লাভ করার পর আত্মশ্লাঘায় ভোগেন নি , বরং প্রজাদের সরলতার তারিফ করেছেন, এবং তাদের সাথে একীভূত হয়ে যাবার আকাঙ্খা ব্যক্ত করেছেন।এভাবে , সমস্তকিছুকে যদি তার সময়ের, তার কালের ছকে ফেলে বুঝবার চেষ্টা করা হয়, তাহলে পৃথিবীর অধিকাংশ বিবাদের মীমাংসা আপনাতেই হয়ে যায়। কিন্তু যারা তা বুঝেই বিবাদে জড়িয়ে পড়ে, তাদের বোঝানো অসম্ভব।

সত্যকথা তো এই যে - রবীন্দ্রনাথ যদি হিন্দু মুসলিমের বিভেদ জিইয়ে রেখে জমিদারী করতেন, তবে সেটাই হত তার জন্য সবচে সুবিধাজনক সিদ্ধান্ত। তাঁর হিন্দু, সাহা আমলা ও নায়েবশ্রেণী তাঁর ওপর খুশী থাকতো। কিন্তু ব্যক্তিজীবনে রবীন্দ্রনাথ সাম্প্রদায়িকতার পক্ষপাতি ছিলেন না বলেই জমিদারী এস্টেটের ওপর এই আত্মঘাতি সিদ্ধান্ত নেয়ার সাহসী পদক্ষেপ তিনি নিয়েছিলেন, তাও এমন এক সময়ে - যখন অন্য কোন জমিদার সাম্প্রদায়িক পরিচয়ের রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসার কথা চিন্তাও করতে পারতো না।

৫।

ব্যক্তিগত জীবনাচারে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে সাম্প্রদায়িকতা মুক্ত একজন মানুষ হিসেবে চিহ্নিত করবার পর তাঁর লেখনী, তাঁর সৃজনশীল কর্ম ও তাঁর মননশীল - দার্শনিক চিন্তায় সাম্প্রদায়িকতার সুলুকসন্ধানে নিবৃত হবার চেষ্টা করা যাক।

এই প্রসঙ্গে প্রাথমিকভাবে উল্লেখ করা যায় যে - যদিও রবীন্দ্রনাথ আজীবন বঙ্কিমচন্দ্রের সাহিত্যপ্রতিভার অনুরক্ত ছিলেন, কিন্তু বঙ্কিম যেভাবে হিন্দুভারত প্রতিষ্ঠার আকাঙ্খা সবার আগে উচ্চারণ করবার সাহস দেখান, বা হিন্দুত্ববাদের ধ্বজাধারী প্রচারকে পরিণত হন - রবীন্দ্রনাথকে সেই বিচ্ছেদি বিভেদ সৃষ্টিকারী সৃজনশীল ব্যক্তিহিসেবে আবিষ্কার করতে আমাদের বেগ পেতে হয়। তাঁর সাহিত্যকর্মে "যবন" শব্দের উল্লেখ নেই, বা মুসলমানদের হেয় ভাবে উপস্থাপনের নিদর্শন নেই এটা বলা ভুল হবে, কিন্তু এই তথ্য সমূহের অবতারণ হয়েছে প্রাসঙ্গিকভাবেই। তার সাহিত্য কর্মের যে ঐতিহাসিক যবন চরিত্রটি সে ঐতিহাসিকভাবেই খল চরিত্র। রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যে তাই - "হিন্দু" দুশ্চরিত্র , বা "মুসলমান" দুশ্চরিত্র নেই; আছে "দুশ্চরিত্র" হিন্দু, আছে "দুশ্চরিত্র" মুসলমান। এ দুয়ের পার্থক্য আমাদের বুঝতে হবে।

'হিন্দুমুসলমান' নামে একটি লেখা কালান্তর নামক তাঁর প্রবন্ধ সংকলনে পাওয়া যায়। শ্রীযুক্ত কালিদাস নাগকে লেখা তাঁর একটি চিঠিই ছিল এটা, যাতে অবিভক্ত ভারতীয় উপমহাদেশে হিন্দু - মুসলিম মিলনে বাঁধা কিসে, তা নিয়ে তিনি সংক্ষিপ্ত পরিসরে আলোচনা করেন। হাল আমলের ফেসবুকের ৫০০ শব্দের স্ট্যাটাসের সাইজের এই রচনায় রবীন্দ্রনাথ যেভাবে ভারতীয় উপমহাদেশে হিন্দুমুসলমানের শত শত বছর ধরে চলে আসা বিচ্ছিন্নতার গোড়ায় হাত দেন এবং তাঁর থেকে উত্তরণের সূত্র উল্লেখ করেন, তাতে বোঝা যায় রবীন্দ্রনাথে আর আমাদের মাঝে তফাৎ কোথায়। তিনি সাম্প্রদায়িক বিচ্ছিন্নতা চান নি, তিনি সম্প্রদায়ে - সম্প্রদায়ে সংযোগ চেয়েছিলেন।

লেখাটিতে প্রাথমিকভাবে তিনি খ্রিস্টান ও মুসলমান উভয় ধর্মের আঙ্গিকগত কিছু ত্রুটি অন্বেষণ করে উল্লেখ করে বলেন,

- "তাদের ধর্ম গ্রহণ করা ছাড়া তাদের সঙ্গে মেলবার অন্য কোন উপায় নেই।"

কিন্তু কিছুদূর পর তিনি হিন্দু ধর্মেরও ত্রুটি উল্লেখ করে বলেন,

- "হিন্দু ধর্ম মুখ্যভাবে জন্মগত আচারমূলক হওয়াতে তাঁর বেড়া আরও কঠিন। মুসলমানধর্ম স্বীকার করে মুসলমানের সাথে সমানভাবে মেশা যায়, হিন্দুর সে পথও অতিশয় সংকীর্ণ। আহারে ব্যাবহারে মুসলমানের সঙ্গে সমানভাবে মেলা যায়, হিন্দুদের সে পথও অতিশয় সংকীর্ণ। আহারে ব্যাবহারে মুসলমান অপর সম্প্রদায়কে নিষেধের দ্বারা প্রত্যাখ্যান করে না, হিন্দু সেখানেও সতর্ক। তাই খিলাফৎ উপলক্ষে মুসলমান নিজের মসজিদে এবং অন্যত্র হিন্দুকে যত কাছে টেনেছে, হিন্দু মুসলমানকে তত কাছে টানতে পারে নি। আচার হচ্ছে মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্বন্ধের সেতু, হিন্দু সেখানে পদে পদে নিজের বেড়া তুলে রেখেছে।"

তাঁর হিন্দু - মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের আচরণগত সমস্যায় হিন্দু - মুসলিম উভয়কেই দোষারোপ করার প্রবণতা থেকে বোঝা যায় - রবীন্দ্রনাথ আর যাই হোন, চিন্তার দিক দিয়েও সাম্প্রদায়িক ছিলেন না। তিনি তার ন্যায়পরায়ণ বিবেকের কঠিন নিক্তিতে দুই আদর্শকে চাপিয়ে মানুষ হিসেবে বিচার করেন দুটো জীবন ব্যবস্থা। এই উপসংহারকে আরও পোক্ত করে তাঁর চিঠিতে ভারতের হিন্দু - মুসলমান উভয় জাতির সম্মিলনের আশাবাদী সমাপনী সূর -

"হিন্দু মুসলমানের মিলন যুগপরিবর্তনের অপেক্ষায় আছে। কিন্তু এ কথা শুনে ভয় পাবার কোন কারণ নেই; কারণ অন্য দেশে মানুষ সাধনার দ্বারা যুগপরিবর্তন ঘটিয়েছে; গুটির যুগ থেকে ডানা মেলার যুগে বেরিয়ে এসেছে। আমরাও মানসিক অবরোধ কেটে বেরিয়ে আসব ..." (হিন্দুমুসলমান, কালান্তর, পৃষ্ঠা ৮৯ -৯০)

৬।

প্রশ্নটি প্রাসঙ্গিকভাবে তাই এসেই পড়ে যে - রবীন্দ্রনাথের ধর্মবিশ্বাস তবে কিরকম ছিল?

রবীন্দ্রনাথের ঈশ্বরচেতনার সবচে সুন্দর পরিচয় পাওয়া যায় তাঁর কবিতায়, এবং গীতবিতানের পূজাপর্বের গানে। সে সূত্রেই জানা যায় যে তাঁর ঈশ্বর একাধিক নন, একজন। সে ঈশ্বর নিরাকার, এককব্রহ্ম। পিতামহ, প্রপিতামহের সূত্রে পাওয়া ব্রাহ্মধর্মের প্রবল প্রতাপের মধ্যে বড় হওয়া রবীন্দ্রনাথকে তাই দেখা যায় তাঁর "গোরা" উপন্যাসে নামধারী নায়কের ব্রাহ্মণ্যবাদের কৌলীন্যকে পরিচয়জাত বিভ্রান্তির বিষম একঘায়ে ধুলায় লুটাতে।

রবীন্দ্রনাথের ধর্মভাবে পরিস্ফুটিত হয় ছিন্নপত্রাবলীর এই চিঠিতে -

"আমার যে ধর্ম, এটা নিত্যধর্ম, এর উপাসনা নিত্য উপাসনা। কাল রাস্তার ধারে একটা ছাগমাতা গম্ভীর অলস স্নিগ্ধভাবে ঘাসের উপর বসেছিল এবং তাঁর ছানাটা তাঁর গায়ের উপরে ঘেঁষে পরম নির্ভরে গভীর আরামে পড়েছিল - সেটা দেখে আমার মনে যে সুগভীর রসপরিপূর্ণ প্রীতি এবং বিস্ময়ের সঞ্চার হলো আমি সেইটেকেই ধর্মালোচনা বলি। এই সমস্ত ছবিতে চোখ পড়বা মাত্রই সমস্ত জগতের ভিতরকার আনন্দ এবং প্রেমকে আমি অত্যন্ত প্রত্যক্ষ সাক্ষাৎভাবে আমার অন্তরে অনুভব করি। এ ছাড়া অন্যান্য যা কিছু ডগমা আছে, যা আমি কিছুই জানি নে এবং বোঝাবার সম্ভাবনা দেখি নে, তা নিয়ে আমি কিছুমাত্র ব্যস্ত হইনে। যেটুকু আমি পসিটিভলি জানতে পেরেছে সেই আমার পক্ষে যথেষ্ট, তাতেই আমাকে পরিপূর্ণ সুখ দেয়।" (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ছিন্ন পত্রাবলী, চিঠি ১৮৭, ১৩০১ বঙ্গাব্দ, পৃষ্ঠা ২৪৭)

সৃষ্টির মাঝে স্রষ্টাকে খুঁজে ফেরার তাড়া রবীন্দ্রনাথকে এককাতারে এনে দাঁড় করিয়ে দেয় পারস্যের রুমির সাথে, হাফিজের সাথে, পাঞ্জাবের কবিরের সাথে, বুল্লে শাহের সাথে, নদীয়ার নিতাই চাঁদ , নিত্যানন্দ ঠাকুরের সাথে, ছেউড়িয়ার সিরাজ সাঁই - লালন ফকিরের সাথে। সারাজীবন কঠোর যুক্তিবাদী রবীন্দ্রনাথকে এই একজায়গায় , ঈশ্বরভাবনার ক্ষেত্রে আবিষ্কার করা যায় যুক্তিকে একপাশে সরিয়ে রেখে ভক্তিকে অবলম্বন করবার উপযোগে লিপ্ত -

"জানি শুধু তুমি আছ তাই আছি তুমি প্রাণময় তাই আমি বাঁচি,
যতো পাই তোমায় আরো ততো যাচি যতো জানি ততো জানি নে।
রয়েছ নয়নে নয়নে ..."

প্রকৃতির মাঝে ঈশ্বরের রূপ, এবং একই সঙ্গে ঈশ্বরবন্দনার অনুষঙ্গের আজীবন অন্বেষক রবীন্দ্রনাথকে সুযোগ সুবিধামত কেটে ছিঁড়ে, কনটেক্সট বিচ্ছিন্ন অবস্থায় উপস্থাপন করে নিজেডের দলে, নিজেদের আত্মপরিচয়ে ভেড়াবার রাজনীতি অঙ্গ বঙ্গে কম হয় নি।

প্রয়াত অধ্যাপক হুমায়ূন আজাদ তাঁর "আমার অবিশ্বাস" প্রবন্ধে উল্লেখ করেন -

"রবীন্দ্রনাথের পরমসত্ত্বায় বিশ্বাসের সাথে প্রথাগত ধর্মের বিশেষ মিল নেই; তাঁর বিশ্বাসে প্রথাগত ধর্মের স্বর্গনরক নেই, আবশ্যিক আরাধনা নেই, তাঁর পরমসত্ত্বা সৃষ্টিকে শাস্তি দেয়ার জন্যে ব্যগ্র হয়ে নেই। তিনি পরমসত্ত্বার সাথে পাতিয়েছিলেন এক ব্যক্তিগত সম্পর্ক, যা অনেকটা প্রবল শক্তিমান প্রেমিকের সাথে আবেগকাতর অসহায় প্রেমিকার সম্পর্কের মতো; তাঁর পরমসত্ত্বা অনেকটা ধর্ষকামী - যে সুখ পায় পীড়ন করে, তাঁর পীড়ন মধুময়, আর তিনি নিজে অনেকটাই মর্ষকামী - যিনি সুখ পান পীড়িত হয়ে, পরমসত্ত্বার পীড়নে দলিত দ্রাক্ষার মত তাঁর ভেতর থেকে মধু উৎসারিত হয়। সম্পর্কটি অনেকখানি হৃদয়গত ও শারীরিক।"

আজাদের রবীন্দ্রনাথের আধ্যাত্মিকতার পাঠে যে ভুল, সেই একই ভুলে নিমজ্জিত তাঁর অনুসারী বাংলার নাস্তিক্যবাদের প্রচার প্রসারিরা। খুব বেশী ভোগবাদী জীবনদর্শনে বা কার্পেডিয়াম থিমে বিশ্বাসী হলে যেটা হয় - সেটা হচ্ছে ফ্রয়েডিয়ান সাইকোলজির অনুসরণে সবকিছুতেই যৌনতার তৎপরতা খোঁজার চেষ্টা। মনের আকাশে দিনমান ভেসে বেড়ায় উত্থিত ফ্যালাস। রবীন্দ্রনাথের ঈশ্বর যে যুক্তির ঈশ্বর নন, রবীন্দ্রনাথের ঈশ্বর যে পার্থিব কোন মূর্ত ধারণা নন - সে বিভেদে অক্ষম আজাদ রবীন্দ্রনাথ এবং তার আধ্যাত্মিকতাকে সাধারণ মানব মানবীর প্রেমের যে ফ্রেমওয়ার্কে ফেলে রবীন্দ্রনাথের ঈশ্বরচিন্তার ব্যাখ্যাদানের চেষ্টা করেন। এটা একটা পদ্ধতিগত ফ্যালাসি - যেটা আজাদ এবং তাঁর অনুসারীরা পরবর্তীতে, এমনকি এখন পর্যন্ত, জেনেবুঝে প্রয়োগ করে সাধারণ বিশ্বাসীদের অস্বস্তিতে ফেলার চেষ্টা করে। আধ্যাত্মচেতনা, বা ঈশ্বরচেতনা পদার্থবিদ্যার সূত্র দিয়ে মাপা সম্ভব না। মানবীয় আবেগ অনুভূতির সাথে তাঁর এক দূরবর্তী সমীকরণ আছে , তাও এক মেরু হতে আরেক মেরু পর্যন্ত দূর।

আবার বাংলাদেশে একশ্রেণীর চিন্তককে দেখা যায় রবীন্দ্রনাথকে নাস্তিক প্রমাণ করবার চেষ্টায়েও রত অবস্থায়। এধরণের চেষ্টা আমাদের রবীন্দ্রনাথ ও তার ঈশ্বরকে আবিষ্কারের প্রচেষ্টাকে আরও ধোঁয়াশায় ঢেকে দেয়। মৃত্যুর দিনকয় আগে যিনি তার জীবনের শেষ কবিতাটি রচনা করেন এই শব্দচয়নে -

"তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি
বিচিত্র ছলনা-জালে,
হে ছলনাময়ী।
মিথ্যা বিশ্বাসের ফাঁদ পেতেছ নিপুণ হাতে
সরল জীবনে।
এই প্রবঞ্চনা দিয়ে মহত্ত্বেরে করেছ চিহ্নিত;
তার তরে রাখ নি গোপন রাত্রি।
তোমার জ্যোতিষ্ক তারে
যে পথ দেখায়
সে যে তার অন্তরের পথ,
সে যে চিরস্বচ্ছ ,
সহজ বিশ্বাসে সে যে
করে তারে চিরসমুজ্জল।
বাহিরে কুটিল হোক অন্তরে সে ঋজু,
এই নিয়ে তাহার গৌরব।
লোকে তারে বলে বিড়ম্বিত।
সত্যেরে সে পায়
আপন আলোকে ধৌত অন্তরে অন্তরে।"

সেই রবীন্দ্রনাথকে নাস্তিক ও নাস্তিক্যবাদের সমর্থক প্রমাণের চেষ্টা পরিলক্ষিত হয় মূর্ধন্য প্রকাশনী থেকে কাজল বন্দ্যোপাধ্যায় বীরোচিত "রবীন্দ্রনাথ ও ধর্মভাবনা" গ্রন্থে। রবীন্দ্রনাথকে নাস্তিক বা নাস্তিক ভাবনার প্রচারক প্রমাণ করতে পারলে কারো সুবিধে হয় , কি সুবিধে হয়, ২০২০ সালের বাংলাদেশে বসে মনে হয় সে কথা ভাববার সময় এসেছে।

আবার আমরা রবীন্দ্রনাথকে হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িকতার ধ্বজাধারী হিসেবে প্রচার করতেও আমরা দেখি। যারা এই বিশ্বাসের জায়গা থেকে লেখালিখি করেন, তাদের অনেককেই সলিমুল্লাহ খানের উদ্ধৃতি দিতে দেখা যায়।

সন্দেহ নেই সলিমুল্লাহ খান রবীন্দ্রনাথের অনেক কিছুই পছন্দ করেন না। রবীন্দ্রনাথের প্রতি তাঁর ক্ষোভ অনেক, এবং নানাভাবে রবীন্দ্রনাথকে ব্যাঙ্গ করার মাধ্যমে তিনি তাঁর ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটান। অনেক উদাহরণ আছে, সাম্প্রতিকতম উদাহরণ হচ্ছে - ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক মুহাম্মদ আজমের প্রমিত বাংলা সমাচার বইয়ের আলোচনায় বাতিঘরে বসে হুট করে বলে ওঠা - "রবীন্দ্রনাথ ছিল অনেকটা মুহাম্মদ আজমের মত, মানে সবসময় চড়া গলায় কথা বলতে পছন্দ করতো আর কি ..."

রবীন্দ্রনাথের প্রতি সলিমুল্লাহ খানের এই ব্যক্তিগত উষ্মার কারণ কি - এইটা নিয়েও চিন্তার একটা স্পেস আমি পাঠককে ছেড়ে দিতে চাই। আমাকে যদি প্রশ্ন করেন আমি বলবো - শুধুমাত্র একজন বুদ্ধিমান ব্যক্তির পক্ষেই এটা বোঝা সম্ভব যে ঐশ্বরিক ক্ষমতাসম্পন্ন লেখকের সামনে একজন বুদ্ধির ফেরিওয়ালার প্রয়োজন কত সামান্য! কত তুচ্ছ! কত তুচ্ছ!

৭।

আলোচনার একদম শেষ অধ্যায়টিতে এসে আমি একথা আমার পাঠককে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, শুধুমাত্র রবীন্দ্রনাথের সাথে আমার একান্ত ব্যক্তিগত , বা পারিবারিক সম্পর্কের পাঁচালী জনসমক্ষে গাইতে আমি রবিঠাকুরের ধর্মীয় ভাবনা বা তার মানসে সাম্প্রদায়িকতার আলোছায়া নিয়ে এই আলোচনার হাটবাজার খুলে বসি নি। আমার উত্থিত যেকোনো আলাপের মূলে থাকে ২০২০ সালের বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে আলোচিত বিষয়বস্তু কিভাবে আচার্য-বিচার্য- গৃহীত বা বর্জিত হতে পারে তার তত্ত্বতালাশ।

উপরের আলোচনার প্রেক্ষিতে আমার প্রস্তাবনা হচ্ছে, রবীন্দ্রনাথকে সাম্প্রদায়িকতার নিগড় থেকে মুক্ত করে, তাকে সাম্প্রদায়িকতার অতিক্ষুদ্র চাদর থেকে অবমুক্ত করে ২০২০ সালের বাংলাদেশের জনসাধারণের সামনে উপস্থাপন করলে সেটা বুদ্ধিবৃত্তিক সততা হবে তো বটেই, একই সঙ্গে তা হবে বাংলাদেশের আপামর জনতার জন্যে সুবিধাজনক একটি অবস্থান।

ব্যক্তিপর্যায়ে বলুন, বা রাষ্ট্রীয় / জাতিক পর্যায়ে, বাংলাদেশী হিন্দু - মুসলিম, বা অন্য যেকোনো জাতি বা সম্প্রদায়ের মানুষেরই পক্ষেই রবীন্দ্রনাথের চিন্তা থেকে, দর্শন থেকে, সাহিত্য থেকে, গান থেকে অনেক কিছু পাওয়ার আছে, নেয়ার আছে। রবীন্দ্রনাথ হিন্দুত্ববাদের প্রচারি, ইসলাম বিদ্বেষী , বা নাস্তিক - এই ধরণের যেকোন সাম্প্রদায়িকতার ট্যাগে তাকে ফেলে দিলে তা রবীন্দ্রনাথের প্রতি মিথ্যাচার করা তো বটেই, রবীন্দ্রনাথ নিজেও তার পাঠ যে রূপে চেয়েছিলেন, প্রচেষ্টাটি হবে তার বিপরীতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের ইচ্ছের প্রতি ঘোরতর অসম্মান দেখানো।

কালান্তর প্রবন্ধে তিনি বলেন -

"যে মানুষ সুদীর্ঘ কাল থেকে চিন্তা করতে করতে লিখেছে তাঁর রচনার ধারাকে ঐতিহাসিকভাবে দেখাই সংগত। ... রাষ্ট্রনীতির মত বিষয়ে কোন বাঁধা মত একেবারে সুসম্পূর্ণভাবে কোন এক বিশেষ সময়ে আমার মন থেকে উৎপন্ন হয় নি - জীবনের অভিজ্ঞতার সঙ্গে সঙ্গে নানা পরিবরতনের মধ্যে তাঁরা গড়ে উঠেছে। সেই সমস্ত পরিবর্তন - পরম্পরার মধ্যে নিঃসন্দেহে একটা ঐক্যসূত্র আছে। সেইতিকে উদ্ধার করতে হলে রচনার কোন অংশ মুখ্য, কোন অংশ গৌণ, কোনটা তৎসাময়িক, কোনটা বিশেষ সময়ের সীমাকে অতিক্রম করে প্রবহ্মান , সেইটে বিচার করে দেখা চাই। বস্তুত সেতাকে অংশে অংশে বিচার করতে গেলে পাওয়া যায় না, সমগ্রভাবে অনুভব করে তবে তাকে পাই।" (কালান্তর, পৃষ্ঠা ১২৭)

আবু সাঈদ আইয়ুব থেকে নিয়ে হালের চৈন্দ্রিল ভট্টাচার্য, সত্যজিৎ রায় থেকে নিয়ে ঋতুপর্ণ হয়ে জয় গোস্বামী, এবং এদের মধ্যিখানে অনুল্লেখিত বঙ্গের অনেক অনেক জ্যোতিষ্ক - রবীন্দ্রনাথের লেখাকে পরিশুদ্ধ হবার জলের সাথে তুলনা করেছেন। সারাদিনের শারীরিক পঙ্কিলতা দূর করবার জন্যে একবার স্নান করা যেমন জরুরী , তাদের কাছে সারাদিনের মানসিক পঙ্কিলতা দূর করবার জন্যে একবার গীতবিতানের পাতা খুলে বসা জরুরী।

রবীন্দ্রনাথের ঈশ্বরভাবনা একজন আচরি মুসলমানের বিশ্বাসের জন্যেই বা ক্ষতিকর হতে যাবে কেন? রবীন্দ্রনাথের পূজাপর্বের গানসমূহে তার যে ঈশ্বরভাবনার নির্যাস, একজন প্রাকটিসিং মুসলিম হয়ে আমি তারসঙ্গে যেভাবে নিজেকে সম্পৃক্ত করতে পেরেছি, যেভাবে আমার ঈশ্বর চিন্তার সাথে রবীন্দ্রনাথের ঈশ্বর চিন্তার মিল খুঁজে পেয়েছি, তা অনেক মসজিদের মিম্বরে বসা অনেক ধর্মগুরুর আমবয়ানে বর্ণিত আল্লাহতা'লার রূপের সাথে পাই নি। পাই নি বলতে, আমাকে সেরূপে তা অনুপ্রাণিত করে নি।

আমির খসরুর আল্লাহর উদ্দেশ্যে পড়া সেই ফার্সি বয়েত স্মরণ করা যাক -

"মান তু সুদাম তু মান সুদি, মান তান সুদাম তু জা' সুদি
তাকাস্ না গো ইয়াদ বাদ আজি, মান দিগারাম তু দিগারি"

( অনুবাদঃ আমি তুমি এবং তুমি আমিতে পরিণত হয়েছি,
আমি শরীরে পরিণত হয়েছি আর তুমি আমার আত্মা
আজ হতে কেউ বলতে পারবে না যে
আমি তুমি থেকে বিচ্ছিন্ন কেউ ...)

রবীন্দ্রনাথের সেই বিখ্যাত গান স্মরণ করা যাক -

"নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে রয়েছ নয়নে নয়নে
হৃদয় তোমারে পায় না জানিতে হৃদয়ে রয়েছ গোপনে"

চিন্তা করে দেখুন - আমির খসরুর ফার্সি বয়েত আর রবীন্দ্রনাথের এই গানের এসেন্স কি ভিন্ন কিছু?

আমার জীবনের একটা বড় অংশ কেটেছে রাত তিনটা চারটা পর্যন্ত জেগে বাসায় পিয়ানোর সুরে -

"তোমায় গান শোনাবো তাই তো আমায় জাগিয়ে রাখো ,
ওগো ঘুম ভাঙ্গানিয়া তোমায় গান শোনাবো,
বুকে চমক দিয়ে তাইতো ডাকো
ওগো দুখ জাগানিয়া তোমায় গান শোনাবো ..."

রবিঠাকুরের এই গান গেয়ে গেয়ে। আমার মনে বার বার প্রশ্ন এসেছে - কে এই ঘুম ভাঙ্গানিয়া? কে এই দুঃখ জাগানিয়া? কে বুকে চমক দিয়ে আমায় জাগিয়ে রাখে এই শেষরাতে? এই প্রশ্নোত্তরের জবাব খুঁজতে ব্যারথ হয়ে সাহায্য নিয়েছি লালনের কালামে -

"পারে লয়ে যাও আমায় - পারে লয়ে যাও আমায়"


এটা গেল একটি দিক। রবীন্দ্রনাথের চিন্তা, দর্শন, কবিতা, মুক্তোর খণ্ডের মত টুকরো টুকরো ছোটগল্পের সংকলন - এসব থেকেই আমি , একজন বাঙ্গালী মুসলিম হিসেবে দু'হাতে নিয়েছি, কারণ রবীন্দ্রনাথকে কখনো আমার আংশিক, বা খণ্ডিত সত্যের প্রচারক বলে মনে হয় নি। তিনি যা বলেছেন, বিশ্বাস করেন বলেই বলেছেন। মুসলমানদের কোন সমালোচনা যদি তিনি করে থাকেন - সে সমালোচনা সে মুহূর্তে তাদের প্রাপ্য বলেই করেছেন। সেখান থেকে বাঙ্গালী মুসলমানেরা একদিন ভুল শুধরে নিজ আত্মপরিচয়ে ভর করে দাঁড়াবে, এই স্বপ্নই দেখেছেন তিনি। একপেশে সমালোচনা তো করেন নি। বঙ্গীয় হিন্দু সমাজের প্রতি তারমত বুদ্ধিদীপ্ত, প্রখর সমালোচক সে সময়ে আর কাকেই বা পাওয়া যায়?

এত সব আলোচনার প্রেক্ষিতে হয়তো বোঝাতে সক্ষম হয়েছি যে, যে যতই রবীন্দ্রনাথকে সাম্প্রদায়িকতার বিষ জর্জর অবস্থায় আমার সামনে উপস্থিত করুক না কেন, আমার মনের পটে আমি রবিঠাকুর কে বরাবর পারস্যের মহাকবি হাফিজের মাজারে শ্রদ্ধাবনত অবস্থায় দণ্ডায়মান দেখতে পাই। রেজা শাহ পেহলভির দাওয়াতে পারস্যদেশ ভ্রমণরত এই ব্যক্তিই রবীন্দ্রনাথ, যিনি মানুষকে তার ধর্ম পরিচয়ে চিহ্নিত করেন নি, চিহ্নিত করেছেন বরাবর তার কর্মপরিচয়ে।


লেখাটি আমি আমার আজীবন রবীন্দ্রপ্রেমী বাবাকে উৎসর্গ করছি।

এই পর্যন্ত কষ্ট করে যে পাঠক এলেন তাঁর জন্যে আমার রবীন্দ্রসঙ্গীত গাওয়ার একটি দুঃসাহসিক প্রচেষ্টা উপহার দিয়ে কষ্ট বাড়ানোর প্রচেষ্টা - কী সুর বাজে আমার প্রাণে, আমি জানি মনো জানে ...

সর্বশেষ এডিট : ০১ লা জানুয়ারি, ২০২১ রাত ১০:০৮
১০টি মন্তব্য ৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বিসিএস-পরীক্ষার হলে দেরিঃ পক্ষ বনাম বিপক্ষ

লিখেছেন BM Khalid Hasan, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



বর্তমানের হট টপিক হলো, “১ মিনিট দেরি করে বিসিএস পরীক্ষার হলে ঢুকতে না পেরে পরীক্ষার্থীর স্বপ্ন ভঙ্গ।” প্রচন্ড কান্নারত অবস্থায় তাদের ছবি ও ভিডিও দেখা যাচ্ছে। কারণ সারাজীবন ধরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের কার কি করা উচিৎ আর কি করা উচিৎ না সেটাই আমারা জানি না।

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:২৮




আমাদের কার কি করা উচিৎ আর কি করা উচিৎ না সেটাই আমারা জানি না। আমাদের দেশে মানুষ জন্ম নেয়ার সাথেই একটি গাছ লাগানো উচিৎ । আর... ...বাকিটুকু পড়ুন

মানবতার কাজে বিশ্বাসে বড় ধাক্কা মিল্টন সমাদ্দার

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ২:১৭


মানুষ মানুষের জন্যে, যুগে যুগে মানুষ মাজুর হয়েছে, মানুষই পাশে দাঁড়িয়েছে। অনেকে কাজের ব্যস্ততায় এবং নিজের সময়ের সীমাবদ্ধতায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারে না। তখন তারা সাহায্যের হাত বাড়ান আর্থিক ভাবে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

জব্বারের বলীখেলা ও বৈশাখী মেলা-২০২৪

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৩৭



ছবি সৌজন্য-https://www.tbsnews.net/bangla




ছবি- মঞ্চে তখন গান চলছে, মধু হই হই আরে বিষ খাওয়াইলা.......... চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী গান।

প্রতি বছরের মত এবার অনুষ্ঠিত হল জব্বারের বলীখেলা ও বৈশাখী মেলা-২০২৪। গত ২৪/০৪/২৪... ...বাকিটুকু পড়ুন

ডাক্তার ডেথঃ হ্যারল্ড শিপম্যান

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:০৪



উপরওয়ালার পরে আমরা আমাদের জীবনের ডাক্তারদের উপর ভরশা করি । যারা অবিশ্বাসী তারা তো এক নম্বরেই ডাক্তারের ভরশা করে । এটা ছাড়া অবশ্য আমাদের আর কোন উপায়ই থাকে না... ...বাকিটুকু পড়ুন

×