somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বরেন্দ্রভূম থেকে জাহাঙ্গীরনগর - বাংলার চিত্রকলার ইতিহাস, পর্ব - ১০

১৭ ই জুন, ২০২০ দুপুর ২:১৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
শিল্পাচার্য অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সময়কাল, সাধনা, ও সাংগঠনিক প্রচেষ্টার কাছে বাংলার চিত্রকলার ঋণ




ছবিঃ অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৭১ - ১৯৫১)


"অবনীন্দ্রনাথের প্রতিভার সবচে বড় পরিচয় তার ছবি। চিত্রকর অবনীন্দ্রনাথকে জানতে হলে, তাঁর ছবি দেখা ছাড়া অন্য কোন পথ নেই। আধুনিক ভারতীয় চিত্রের ইতিহাসে চিত্রকর অবনীন্দ্রনাথের আর একটি পরিচয় নূতন আদর্শের প্রবর্তক রূপে; এদিক দিয়ে তাঁর একটি বিশেষ ঐতিহাসিক মূল্য আছে। চিত্রকর অবনীন্দ্রনাথের চেয়ে ভারতীয় চিত্রের পুনরুদ্ধারকারী এবং নবযুগের প্রবর্তক অবনীন্দ্রনাথের খ্যাতি কোন অংশে কম নয়। অবনীন্দ্রনাথের প্রতিভার ঐতিহাসিক মূল্য তথ্যের দ্বারা বিচার করা সম্ভব নয়। তথ্যের সাহায্যে বা যুক্তিতর্কের দ্বারা তাঁর সৃষ্টির জগতে আমরা প্রবেশ করতে পারবো না।" (মুখোপাধ্যায়, ২৪৯)

যদি একটি প্যারাগ্রাফের মধ্যে অবনঠাকুরের জীবনী লিখতে বলা হয়, শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতীর শিল্পতত্ত্বের প্রয়াত শিক্ষক বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়ের লেখা উপরের প্যারাগ্রাফটির চে' যথার্থ বাক্যমালা আর খুঁজে পাওয়া যাবে কিনা, সে বিষয়ে আমি সন্দিহান। অবনীন্দ্রনাথের সাথে শৈশব থেকে আমার ব্যক্তিগত একটি সম্পর্ক ছিল তাঁর শিশুসাহিত্যের হাত ধরে। পরিণত বয়সে, বাংলার শিল্পকলার ইতিহাস পড়তে - পড়াতে গিয়ে "শিল্পাচার্য" অবনঠাকুরের সাথে আমার পরিচয়, এবং আবিষ্কার যে - যতই তাঁকে প্রাচ্যকলা আন্দোলনের উদ্গাতা, এবং বাহকের সম্মাননা দেয়া হোক না কেন, তাঁর আঁকা ছবি না দেখলে তিনি ঠিক কোন আন্দোলনটির প্রতিষ্ঠাতা প্রাণপুরুষ ছিলেন, তা বোঝা যাবে না। অবন ঠাকুর ভারতে সর্বাধিক চর্চিত শিল্পী ও শিল্পগুরুদের অন্যতম। তাঁকে ও তাঁর শিল্প সাধনাকে ঘিরে এত বেশী লেখালিখি হয়েছে , যেটা যেকোনো শিল্পী তাঁর শিল্প জীবনের শুরুতে কল্পনাতেও আনতে পারেন না। মাসখানেক আগেই তো, বিশ্ব সাহিত্যকেন্দ্রে বাতিঘর পুস্তকবিতানে অবন ঠাকুরের শুধুমাত্র আঁকা ছবির একটি ইংরেজি অ্যালবাম খুঁজে পেয়েছিলাম, বাংলাদেশী টাকার অঙ্কে যার মূল্যমান ১০,০০০। দীর্ঘশ্বাস বুকে চেপে ফিরে আসতে হয়েছিল। আগাগোড়া প্লাস্টিকের মোড়কে মোড়ানো বিলেতি বইটি খুলে দেখারও সুযোগ হয় নি। হয়তো কোন এক শিল্পরসিক মহাজনের বৈঠকখানার ঔজ্জ্বল্য বৃদ্ধি করবে কিতাবখানা। আমাদের মত সাধারণ মানুষের জন্যে নীলক্ষেত প্রিন্ট ছাপাই বইই সই! টেনেটুনে কোলকাতার বইপত্তর।

সে যাক। অবন ঠাকুরের উত্থানের সময়কালটি বোঝা, অবন ঠাকুরের উত্থানের জরুরত বুঝবার ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক। সে চেষ্টা করা যাক।

যে বছর অবনঠাকুর কোলকাতা আর্ট কলেজের দায়িত্ব নিচ্ছেন, ঠিক সে বছরই অ্যামেরিকার মধ্যস্ততায় সংঘটিত পোর্টসমাউথের সন্ধিতে জাপানের কাছে প্রতাপশালী রুশ জার সম্রাট তাদের প্রায় দেড় বছর ধরে চলা রুশ - জাপান যুদ্ধে নতি স্বীকার করে। বলছি ১৯০৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসের কথা। চীনের কিছু অংশ, জাপানের আসেপাশের কিছু দ্বীপ, এবং কোরিয়ার দখল নিয়ে দেড় বছর ধরে চলা এ যুদ্ধে জাপান, রুশ সেনাবাহিনীকে নাকানিচোবানি খাইয়ে পরাজিত করে। অ্যামেরিকার বুকে বসে যে লজ্জাজনক সন্ধিপত্রে রুশ সাম্রাজ্য সই করে, তাঁর ফলে জাপানের অধীনে আসে চীনের পোর্ট আর্থার, লিয়াওতুং উপদ্বীপ, মাঞ্চুরিয়ায় রাশিয়ার তৈরি রেলপথের একটা বড় অংশ, জাপানের উত্তরের শাখালিন দ্বীপের অর্ধেক, এবং রাশিয়া কোরিয়ার উপর নিজের অধিকার ত্যাগ করে। ( নেহরু, ১৯৯১ঃ ৪৩৬)

পরাক্রমশালী রুশ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে জাপানের বিজয় ভারতীয় উপমহাদেশে জনগণের মনে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের আগুণ দাউদাউ করে জ্বালিয়ে দেয়। প্রায় দেড়শ' বছরের পরাধীনতার ইতিহাসে জর্জরিত জাতিটি তখন নিজের মুক্তির আকঙ্খায় উন্মুখ। সকলের মনে তখন এই গুঞ্জরন, যদি জাপানীরা রুশিদের পরাজিত করতে পারে, ভারত কেন পারবে না দখলদার ইংরেজদের হঠাতে? বাংলা তখন ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী। শিক্ষায় ও জ্ঞানে বাঙ্গালীরা তখন ভারতে নেতৃস্থানীয়। বিদ্রোহ শুরু হল নানা দিক থেকে, নানা আঙ্গিকে। বিদ্রোহের রসদ যোগালেন শিক্ষিত বাঙ্গালীরা, এমনকি সাদা চামড়ার অনেক ঔপনিবেশিকতা বিরোধী সাহেবও। কোলকাতা সরকারী আর্ট স্কুলের অধ্যক্ষ, আর্নেস্ট বিনফিল্ড হ্যাভেল ছিলেন সে সাহেবগোষ্ঠীর একজন। তাঁর বিশ্বাস ছিল, ভারতীয় কুটির শিল্পের জাগরণ ছাড়া এদেশে শিল্পকলার বিকাশ সম্ভব নয়। তাঁর সমস্ত শিল্পপরিকল্পনা গড়ে উঠেছিল এ ধারণাকে কেন্দ্র করেই ( মুখোপাধ্যায়, ১৯৮৪ঃ ১২২)। হ্যাভেলের হাত ধরেই অবন ঠাকুরের স্বদেশীয়ানার ষোল আনার অন্তত চারআনার পাঠ, কোলকাতা আর্ট কলেজের উপাধ্যক্ষের পদ অলঙ্করণ, এবং নানামুখি স্বদেশী শিল্পকলার চর্চা।

২।

অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে 'শিল্পাচার্য' অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরঃ প্রস্তুতির দিনলিপি



চিত্রঃ অভিসারিকা (১৮৯৭ - ১৯০০)

বঙ্গীয় শিল্পকলায় অবন ঠাকুরের বহুল ব্যবহৃত একটি উক্তি হল -

"আর্ট স্কুল আর্টিস্ট গড়িতে পারে না, আর্টিস্টের হাতের সরঞ্জাম জোগাইতে পারে মাত্র। আগে আর্টিস্ট হও 'তবে আর্ট স্কুলে আসিও।" ( বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়, ১৯৮৪ঃ ১২৩)

তাঁর এই উক্তি আমাদের দ্বিধান্বিত করে।

আর্টিস্ট গড়া যদি আর্ট স্কুলের কাজ না ই হয়, তবে আর্ট স্কুলে পড়ে মানুষ হবে কি?
আর, যদি আর্টিস্ট গড়া আর্ট স্কুলের কাজ না ই হয়, তবে আর্টের নামে স্কুল প্রতিষ্ঠা করারই বা উপযোগিতা কোথায়?

অবনীন্দ্রনাথের উক্তিটি বুঝতে হবে তাঁর জীবনের সাথে মিলিয়ে।

জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়িতে রবীন্দ্র-ভ্রাতা গুণেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ঘরে অবনীন্দ্রনাথের জন্ম হয় ১৮৭১ সনে। রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে তাঁর জেঠু হলেও, দু'জনের বয়সের তফাৎ ছিল তাদের মাত্র ১০ বছরের। জন্মের মুহূর্ত থেকেই জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়িতে যে পরিবেশে অবনীন্দ্রনাথ বেড়ে উঠেছিলেন - তা কারো মনের মধ্য চারু ও কারুবাসনার লেশমাত্র থাকলেও তাকে প্রজ্বলিত অগ্নিকুণ্ডে পরিণত করতে সক্ষম ছিল। তিনি শুধুই চোখ মেলে যা দেখা যায় তা খাতায় এঁকে ফেলার মত দীন-হীন শিল্পসাধক হিসেবেই বেড়ে ওঠেন নি কেবল, বিশ্ব ও বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাস তাঁর নখদর্পণে থাকায় তাঁর মানসিকতা ছিল যুগপৎ শৈল্পিক ও সাহিত্যিক। সব্যসাচী অবন অঙ্কনে বিখ্যাত হলেও তাঁর সাহিত্য রচনার হাত ছিল টাটকা, সদ্য পাটভাঙ্গা কাপড় এর মতই মখমলি। চিত্রকলারও পূর্বে, এবং তার মতই বিশেষায়িত রূপে অবনঠাকুরের সম্পর্ক ছিল বাংলা কথাসাহিত্যের সঙ্গে। শিল্প সমালোচক অশোক মিত্রের ভাষায় -

"সাহিত্যে যখন ঠেকে যেতেন বা ক্লান্তি আসতো তখন চলে যেতেন ছবিতে; ছবিতে যখন আটকে যেতেন বা ব্যতিব্যস্ত হতেন তখন চলে যেতেন সাহিত্যে। সেই হেতু প্রায়ই তাঁর ছবি ও গদ্য হত অভিন্নাত্মা। ছবিতে আসতো সাহিত্যিক কল্পনা, বিষয়, মন। গদ্যে আসতো চিত্রময় কল্পনা, নিছক চিত্ররূপ। দুই জগতে তিনি ছিলেন জন্মগত উভচর।" ( মিত্র, ১০৫)

এক্ষেত্রে বলা প্রয়োজন, চিত্রকলার ছাত্র হিসেবে অবনীন্দ্রনাথ শিখেছিলেন যেমন পৃথিবীর সেরা সব শৈলীর, স্ব স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত শিল্পগুরুদের কাছ থেকে, তাঁর শিল্পমানস তৈরি হয়েছিল সময়ের সেরা দার্শনিকদের হাতে। তাই আর্ট রপ্ত করবার বহু আগেই অবনীন্দ্রনাথ মনে মনে আর্টিস্ট। প্রত্যেক গুরুর প্রচেষ্টা থাকে ছাত্রদের নিজের পদ্ধতিতে গড়েপিটে নিতে, আর সে সূত্রেই শিল্পরসিকদের উদ্দেশ্যে অবন ঠাকুরের প্রাগুক্তি - "আর্টিস্ট হয়ে তারপর আর্ট স্কুলে এসো" ।

অল্পবয়সে অবনীন্দ্রনাথ দু'জন ইউরোপীয় শিক্ষকের কাছে কালি - তুলির প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন। তাদের মধ্যে প্রথমজন, মিঃ পামার ছিলেন ইংরেজ। তিনি অবন ঠাকুরকে স্কেচ এবং এবং পারস্পেক্টিভ ড্রয়িং শেখান। ড্রাফ্‌টসম্যানশিপ, বা নকশাঅঙ্গনের প্রারম্ভিক দক্ষতাও তিনি মিঃ পামারের কৃপায় রপ্ত করেন। অবনীন্দ্রনাথের দ্বিতীয় শিক্ষক ছিলেন ইটালিয়ান মাস্টারমশাই গিলার্দি, যার কাছে তিনি শেখেন রঙ্গের ব্যবহার। শেখেন কেবল প্যাস্টেল কালার ব্যাবহার করেও ভিন্ন ভিন্ন টোন এবং টোনালিটির মাধ্যমে কীভাবে ইউরোপিয়ান মহারথী চিত্রকরদের তেলরঙ্গের বর্ণবিভঙ্গ ফুটিয়ে তোলা যায়, তাঁর গুঢ়তত্ত্ব। অশোক মিত্র বলেন -

"ইংরেজি টেকনিকে ড্রয়িং আয়ত্ত থাকার ফলে, এবং ভিনিশান টেকনিকে রঙের বিচিত্র সমস্যা সম্বন্ধে পূর্ণ জ্ঞান থাকার ফলে তিনি অচিরেই এদেশে ইওরোপীয় নীতিতে প্রতিকৃতি বা পোর্ট্রেট আঁকায় অসামান্য দক্ষতা লাভ করেন। পোর্ট্রেট শিল্পে তাঁর সমকক্ষ আমাদের দেশে কেউ ছিল না।" (মিত্র, ১০৬)


চিত্রঃ অবন ঠাকুরের প্যাস্টেলে অঙ্কিত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পোর্ট্রেট

এই সমস্ত দক্ষতা অর্জনের পর, নিজের বাড়িতে স্টুডিও বসিয়ে ইউরোপীয় কেতায় নর্থলাইট, বা উত্তরের আলোতে ঘষে ঘষে ক্যানভাসে তেলরঙের ছবি একেছেন তিনি একটা লম্বা সময় ধরে। কিন্তু অনুকরণের এ পদ্ধতিতে তিনি শান্তি পাচ্ছিলেন না। চাচ্ছিলেন একান্ত নিজের মত করে নতুন কিছু করতে। পরামর্শক দার্শনিক হিসেবে দায়িত্ব পালন করলেন খুড়ো রবীন্দ্রনাথ। তারই পরামর্শে বৈষ্ণব পদাবলীর অনুকরণে বছর দুয়েক ধরে ছবি এঁকে শেষ করলেন তাঁর "কৃষ্ণলীলা সিরিজ"। সিরিজের সমাপ্তি হয় ১৮৯৫ সনে। আর এই কৃষ্ণলীলা সিরিজের ছবির প্রদর্শনীতেই কোলকাতা আর্ট স্কুলের অধ্যক্ষ এ বি হ্যাভেলের সাথে অবনীন্দ্রনাথের দেখা হয় ১৮৯৭ সনে। (ভট্টাচার্য, ১২৩)



চিত্রঃ অবনীন্দ্রনাথ অঙ্কিত কৃষ্ণলীলা সিরিজের একটি ছবি (১৮৯৫ - ৯৭)

শিল্পগুরু হ্যাভেলের সাথে মিথস্ক্রিয়াঃ

কোলকাতা আর্ট স্কুলের অধ্যক্ষ আর্নেস্ট বি হ্যাভেল কোন চিত্রদর্শন বুকে নিয়ে কোলকাতার মাটিতে পা রেখেছিলেন, যারা ভুলে গিয়েছেন তাদের আর একবার স্মরণ করিয়ে দিই। হ্যাভেলের মত ছিল, কোলকাতা আর্ট স্কুল প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ক্রমাগত পাশ্চাত্য ধাঁচের অনুবর্তী চিত্রশিক্ষা ভারতীয় শিল্পপ্রজ্ঞাভিখারিদের ক্রমশই নিজ নীড় থেকে দূরবর্তী কোন দিকচক্রবালে পাক খাইয়ে মারছে। হ্যাভেলের ভাষায়-

"Nowhere does art suffer more from charlatanism than in India ... There is no respect for art in the millionaire who invests his surplus wealth in pictures and costiliest furniture so that his taste may be admired r his wealth envied by his poor brethren."

(E. B. Havel, "The Basis for Artistic and Industrial Revival in India, Mukhopadhya, 250)

তিনি ওরিয়েন্টাল বা প্রাচ্যদেশীয় কলাশিল্পের ওপর জোর দিয়ে, এই সংক্রান্ত পড়াশোনার খরচ কমিয়ে দিয়ে, আর্ট স্কুল সংলগ্ন আর্ট গ্যালারী থেকে ক্লাসিক ইউরোপীয় কেতায় আঁকা ছবি ও ভাস্কর্যসমূহ হটিয়ে, ভারতের পরম্পরাজাত চিত্ররাজি দিয়ে গ্যালারী ঢেলে সাজান। আর এ সবই তিনি করেন ১৮৯৬ সালে, কোলকাতা আর্ট স্কুলের দায়িত্ব নেয়ার ঠিক এক বছরের মধ্যেই। (ভট্টাচার্য, ১২১-২২)

অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে তাঁর পরিচয় হওয়ার ঘটনাটি অবিভক্ত বঙ্গের চিত্রকলার ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত। হ্যাভেল পাশ্চাত্য রুপকলার অন্ধ নিগড় থেকে ভারতীয় চারু ও কারুশিল্পকে মুক্ত করার যে ব্রত হ্যাভেল মনে পোষণ করতেন, তাঁকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেয়ার জন্যে উপযুক্ত মানুষের খোঁজে ছিলেন, কেননা, একটি অঞ্চলের মানুষের যেকোনোবিধ মুক্তির আন্দোলনের সুর তোলা, ঐক্যতান তৈরি, এবং আন্দলন গড়ে তোলার দায়িত্ব প্রথমত এবং প্রধানত সে অঞ্চলের মানুষেরই। ফলশ্রুতিতে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাজ, তাঁর চিন্তা চেতনার সাথে পরিচিত হয়ে হ্যাভেল ভরসা পান যে, যে জাতিকে শিল্পচর্চা শেখানোর দায়িত্ব নিয়ে তিনি হাজারো মাইল পাড়ি দিয়ে সুদূর ইংল্যান্ড থেকে ঔপনিবেশিক ভারতের রাজধানী কোলকাতায় এসে পৌঁছেছেন, সে জাতির শিল্পভাবনার জগতকে ঔপনিবেশিকতার নিগড় থেকে মুক্তির লড়াই তাঁর একা করবার প্রয়োজন পড়বে না। পাশে, বরং সম্মুখে তিনি অবন ঠাকুরকে পাবেন।

১৮৯৭ থেকে ১৯০৫ পর্যন্ত তাদের মিথস্ক্রিয়া ছিল অপ্রাতিষ্ঠানিক। ১৯০৫ সালে অবন ঠাকুর কোলকাতা আর্ট স্কুলে উপাধ্যাক্ষ হিসেবে সংযুক্ত হন। তাঁর আগেই হ্যাভেলের কাছে অবন ঠাকুর মুঘল মিনিয়েচার আর্টের কলাকৌশল রপ্ত করেন। এ বিষয়টি আমাকে আলোড়িত করে যে, ভারতীয় পরম্পরাজাত চিত্রকলার অন্যতম নিদর্শন মুঘল মিনিয়েচারের ফর্ম, অবন ঠাকুর শেখেন এক ইংরেজ শিল্পগুরুর কাছ থেকে। শুধু শেখা-শেখানো নয়, দেশে বিদেশে অবনীন্দ্রনাথের ছবির প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করে দিয়ে, প্রাথমিক সময়ে যখন অবন ঠাকুরের ছবি সমালোচকদের তীক্ষ্ণ বানে বিদ্ধ হচ্ছিল তখন তাঁর চিত্রকলার সম্ভাবনা নিয়ে ইংরেজিতে প্রবন্ধ লিখে দেশে এবং বিদেশে বাংলার চিত্রকলার সাথে অবন ঠাকুরের নামকে পাশাপাশি লিপিবদ্ধ করবার গুরুদায়িত্বও হ্যাভেল পালন করেন।

জাপানি অনুপ্রেরণা, শিল্পগুরু ওকাকুরা কাকুজোর সংস্পর্শ


১৯০১- ০২ সালে সিস্টার নিবেদিতার প্রেষণে "এশিয়া ইজ ওয়ান", তথা এশিয়ার আত্মিক স্বরূপ অভিন্ন বাণী বহন করে যখন শিল্পতাত্ত্বিক এবং দার্শনিক ওকাকুরা কাকুজো শান্তিনিকেতনে আসেন, তখনও অবনীন্দ্রনাথ কোলকাতা আর্ট স্কুলের দায়িত্বভার কাঁধে নেন নি। জাপান তখন এশিয়ার উঠতি শক্তি। জাপানের কাছ থেকে শিল্প ও নন্দনতত্ত্বের দীক্ষা নেয়ায় তখন মানসিক দৈন্যতায় ভুগবার কোন কারণ ছিল না।

অবনঠাকুরের লেখা থেকে পাওয়া যায় , ওকাকুরা দেশলাইয়ের কাঠি সাজিয়ে জাপানী কম্পোজিশান শেখাতেন। সেই সূত্রেই ওকাকুরা দু'রকম কম্পোজিশনের কথা উল্লেখ করেন। দুর্বল কম্পোজিশনকে তিনি সরীসৃপের সাথে তুলনা করে বলেন - এই শ্রেণীর ছবিকে দুই-তিন টুকরো করলেও তাঁর স্বতন্ত্রতা বজায় থাকে। উত্তম কম্পোজিশনকে তিনি তুলনা করেন মানুষের শরীরের সঙ্গে। মানুষের শরীরের যেকোনো অংশে ছুঁচ ফোটালে যেমন সমস্ত শরীর সেই আঘাতে সচকিত হয়ে ওঠে, তেমনি ভালো কম্পোজিশনের ক্ষুদ্র অংশ কেটে নিলে সমস্ত ছবি এই ক্ষুদ্র অংশের অভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়।

শিল্পী জীবনের পূর্ণ বিকাশের জন্যে ওকাকুরা উল্লেখ করেন - ট্র্যাডিশন, নেচার, এবং অরিজিন্যালিটি - এই তিনের সমন্বয়। তিনি বলেন, প্রকৃতি পর্যবেক্ষণের অভাবে শিল্প পুনরাবৃত্তিতে পরিণত হয়, পরম্পরার অভাবে শিল্পরূপ হয় অপরিণত ও অমার্জিত, মৌলিকতার অভাবে শিল্প হয় প্রাণহীন। মৌলিকতা বলতে তিনি জীবনের স্পন্দন বা মৌলশক্তির প্রকাশকে বুঝিয়েছিলেন। ব্যক্তিগত প্রতিভার আশ্রয় ব্যতীত এই শক্তির প্রকাশ সম্ভব নয়।

ছবি কীভাবে দেখতে হয়, এ ব্যাপারেও ওকাকুরা দিকনির্দেশনা ছিল। তাঁর মতে - ছবির পূর্ণাঙ্গ আবেদন দেখতে হয় দূর থেকে। আঙ্গিকের দক্ষতা বুঝতে হয় ছবির কাছে গিয়ে। (মুখোপাধ্যায়, ১৩০-৩১)

রবীন্দ্রনাথের অনুরোধে ওকাকুরা জাপানে ফিরে গিয়ে ইয়োকোয়ামা টাইকান, জোশিয়া কাৎসুতা, ও হিসিদা সুনসো নাম্নী তিন জাপানি শিল্পীকে কোলকাতায় পাঠিয়ে দেন। এরমধ্যে টাইকান, আর হিসিদার কাছে অবন ঠাকুর সময় নিয়ে শেখেন জাপানি কালি - তুলি, আর ওয়াশের কাজ। (ভট্টাচার্য, ১২৫-২৬)

অবনীন্দ্রনাথ বরাবরই বলেছেন শেখার জন্যে উদগ্রীব উন্মুক্ত মন হচ্ছে শিল্পীর সবচে বড় শিক্ষক। সে সূত্রে অবনীন্দ্রনাথ প্রকৃতি থেকে, পরিবেশ থেকে, পরম্পরা থেকে নিজেকে নিজে শিক্ষিত করে গেছেন ক্রমাগত। কিন্তু শিল্পী জীবনের শুরুর দিকে প্রথাগত শিক্ষক হিসেবে ইংরেজ স্কেচ শিক্ষক পামার, ইতালিয়ান রঙের শিক্ষক গিলার্দি, মুঘল মিনিয়েচার ফর্মের শিক্ষক হ্যাভেল, জাপানী ওয়াশ টেকনিকের গুরু টাইকান ও হিসিদার সংস্পর্শ অবনীন্দ্রনাথকে ঈর্ষনীয় পর্যায়ে তুলে নিয়ে যায়। শুধু তাই নয়, শিল্প ও নন্দনতত্ত্বের তাত্ত্বিক হ্যাভেল, ওকাকুরা, এবং সার্বক্ষণিক পরামর্শক হিসেবে রবীন্দ্রনাথকে পাওয়া যে সুফল অবনীন্দ্রনাথের জীবনে বয়ে আনে, তা শুধু বঙ্গীয় নয় বরং অবিভক্ত ভারতের চিত্রকলার জন্যেই এক আশীর্বাদ হিসেবে প্রতিভাত হয়েছিল।


চিত্রঃ বুদ্ধ ও সুজাতা (১৮৯৭ - ১৯০০)

৩।

কোলকাতা আর্টস্কুলের উপাধ্যক্ষ অবনীন্দ্রনাথের শিক্ষকজীবন (১৯০৫ -১৯১৫)ঃ


"আমি দেখিয়াছি তোমরা কোন একটা সুন্দর দৃশ্য লিখিতে গেলে বাগানে কিম্বা নদীতীরে গিয়া গাছপালা ফলফুল জীবজন্তু দেখিয়া দেখিয়া লিখিতে থাক। এই সহজ ফাঁদে সৌন্দর্যকে ধরিবার চেষ্টা দেখিয়া অবাক হইয়াছি। তোমরা কি জানো না সৌন্দর্য বাহিরের বস্তু নয়, কিন্তু অন্তরের? অন্তর আগে কবি কালিদাসের মেঘদূতের রুপবরষায় সিক্ত কর তবে আকাশের দিকে চাহিয়া দেখিও, নব মেঘদূতের নূতন ছন্দ উপভোগ করিয়ে; আগে মহাকবি বাল্মীকির সিন্ধুবর্ণন, তবে তোমার সমুদ্রের চিত্রলিখন।" (প্রবাসী, কার্তিক ১৩১৬ বঙ্গাব্দঃ ৪৮৩)

ছাত্রদের উদ্দেশ্যে অবনীন্দ্রনাথের এই উক্তিটিকে শিক্ষক অবনীন্দ্রনাথের মূলনীতি ধরে তাঁর শিক্ষকজীবনের একটি সংক্ষিপ্ত মূল্যায়ন প্রচেষ্টা আরম্ভ করা যাক ।

শিল্প ঐতিহাসিক অশোক ভট্টাচার্যের লেখনী থেকে আমরা জানতে পারি, অবনীন্দ্রনাথ ঠিক কি কি পদক্ষেপ নেয়ার মাধ্যমে কোলকাতা আর্ট স্কুলে নিজের উপাধ্যক্ষের কার্যকালকে বিশেষায়িত করেছিলেন। তিনি বলেন, ১৯০৫ থেকে নিয়ে ১৯১৫ সালের মধ্যবর্তী এ দশ বছর অবন ঠাকুরের শিল্পী জীবনের জন্যে বিশেষ গুরুত্ব বহন করে তিনটি কারণে -

প্রথমত, এই সময়ের মধ্যে তিনি নিজের চিত্ররীতিকে একটি সুনির্দিষ্ট চরিত্র দানে সক্ষম হন।
দ্বিতীয়ত, এই সময়কালেই তিনি তার প্রথম দিককার ছাত্রদের মধ্য থেকে নিজের যোগ্য উত্তরসুরী তৈরি করতে সক্ষম হন।
তৃতীয়ত, সংগঠকের দায়িত্ব নিয়ে এই সময়কালের মধ্যেই তিনি নবপ্রবর্তিত শিল্পধারাকে তিনি দেশে বিদেশে ছড়িয়ে দিয়ে তাঁকে প্রতিনিধিত্বমূলক ভারতীয় শৈলীর মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেন। (ভট্টাচার্য , ১২৭)

১৯০৫ সালে , আর্ট স্কুলে দায়িত্ব গ্রহনের পরপরই অবনীন্দ্রনাথ আর্ট স্কুলের দেয়ালে জয়পুর রীতিতে ভিত্তিচিত্র আঁকলেন - 'কচ ও দেবযানী' নামে। তাঁর, আর হ্যাভেলের যৌথ উদ্যোগে আর্ট স্কুলের ঘরের দেয়ালে দেয়ালে টাঙ্গানো হল উৎকৃষ্ট মুঘল, পারসিক, রাজপুত, তিব্বতি ঘরানার ছবি। তাছাড়া তিনি ছাত্রদের বলতেন সংলগ্ন মিউজিয়ামে গিয়ে সেখানকার মূর্তি ও সেই সঙ্গে কর্মরত মানুষগুলিকে ভালো করে লক্ষ্য করতে - যাতে কেবল আদর্শ রূপই নয়, মানুষের প্রতিদিনের বাস্তব চেহারাটার সঙ্গেও তাদের পরিচয় ঘটে। এরও অতিরিক্ত ছিল ভারতীয় চিরায়ত সাহিত্যের সঙ্গে পরিচিত করে তোলার ব্যবস্থা। পণ্ডিত রেখে ছাত্রদের শোনানো হত রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ, কাব্য , এমনকি অলঙ্কারশাস্ত্রের মূল কথাগুলি। অবনীন্দ্রনাথ নিজেও মুখে মুখে গল্পের ছলে ছাত্রদের দেশী ছবি ও মূর্তির সঙ্গে বিদেশী ছবি ও মূর্তির তফাৎ বুঝিয়ে দিতেন। মনে হয়, প্রাচীন ও মধ্যযুগের ভারতের গুরুশিষ্য - পরম্পরার আদর্শ সামনে রেখেই তিনি তাঁর ছাত্রদের চিত্রবিদ্যা শিখিয়েছিলেন। (ভট্টাচার্য, ১২৯)

শিল্পতাত্ত্বিক বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়ের মতে, অবনীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর অনুবর্তীদের আত্মিক যোগ অতি ঘনিষ্ঠ থাকলেও প্রথম অনুবর্তীদের চিত্রাঙ্কনের সঙ্গে অবনীন্দ্রনাথের ছবির পার্থক্য ছিল যথেষ্ট। এই পার্থক্যের সর্বপ্রধান কারণ অবনীন্দ্রনাথের শিক্ষানীতি। তিনি তাঁর ছাত্রদের কখনোই নিজের মত শিখিয়ে পড়িয়ে শিল্পী বানানোর প্রচেষ্টা করেন নি; বরং যে শিল্পদৃষ্টির অধিকারী হলে শিল্পী প্রকৃতি ও পরিবেশ থেকে নিজের প্রয়োজনীয় উপাদান সংগ্রহ করে নেবে, শিক্ষার্থীদের সেই চোখ তৈরির জন্যে অবন ঠাকুর ছিলেন সতর্করূপে সচেষ্ট। সে সূত্রেই অবনীন্দ্রনাথ শিল্পসৃষ্টির অনুকুল পরিবেশ প্রবর্তনের চেষ্টা করেছিলেন। আঙ্গিকগত শিক্ষার বাঁধা পথ তিনি অনুসরণ করেন নি। তিনি নিজে যেমন একান্তভাবে কোন পরম্পরাকে আঁকড়ে থাকেন নি, তেমনি তাঁর অনুবর্তীদের পরম্পরা অপেক্ষা অন্তরের উপলব্ধিকে অনুসরণ করতে উপদেশ দিয়েছিলেন। তাঁর শিক্ষানীতি ছিল এমনই উদার। এছাড়াও, শিল্পশিক্ষাকে যান্ত্রিক অভ্যাসের বন্ধন থেকে মুক্ত করা ছিল তাঁর অন্যতম প্রধান লক্ষ্য -

" তুলি কম্পাস মহাস্ত্র বটে কিন্তু তাদের প্রয়োগের মন্ত্রগুলোও সঙ্গে সঙ্গে না শিখিলে কি হইবে।" (আর্ট ও আর্টিস্ট, ভারতশিল্পঃ ৮৩)

প্রত্যেক শিল্পীকে পরম্পরার সাহায্যে, অথবা ব্যক্তিগত পরীক্ষা - নিরীক্ষার দ্বারা শিল্পচর্চার আঙ্গিক বা টেকনিকগুলো আয়ত্ত করতে হয়। এই প্রয়োজনীয় শিক্ষাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করা সম্ভব নয়। যেহেতু অবনীন্দ্রনাথ কোলকাতা আর্টস্কুলের উপাধ্যাক্ষ থাকাকালে পরম্পরার অনুশীলন বাধ্যতামূলক করেন নি, কাজেই শিল্পীরা পরীক্ষা - নিরীক্ষার পথ গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। কাজটা অনেক শিক্ষার্থী জন্যই সহজ ছিল না। তবুও, প্রত্যক্ষ উপলব্ধির দ্বারাই যে শিল্পসৃষ্টির নূতন পথ অনুসন্ধান করতে, এই মতাদর্শে অবনীন্দ্রনাথ ছিলেন বরাবরই অনড়, একারণেই তিনি শিক্ষক হিসেবে সর্বদা তাঁর অনুবর্তীদের শিল্পী - মন জাগিয়ে তোলারই চেষ্টা করেছেন। আঙ্গিকগত সমস্যা সমাধান প্রত্যেক শিল্পীর নিজে করে নিতে হয়, এই সত্যটি অবনীন্দ্রনাথ নিজে প্রত্যক্ষ করেছিলেন বলেই আঙ্গিক চর্চার কোন নির্দিষ্ট পথে তিনি তাঁর ছাত্রদের চালিত করেন নি। বলা যেতে পারে, শিল্পী মন জাগলেই আঙ্গিক আপনা থেকে শিখে নেয়া যাবে - এই ছিল অবনীন্দ্রনাথের শিক্ষার লক্ষ্য। তবে সকল শিল্পীর মন সমানভাবে জাগে না, তাই অভ্যাসের পথে শিল্পী - মনকে জাগিয়ে তুলতে হয়, এই অভ্যাসগত শিক্ষারই ওপর নাম আঙ্গিকের চর্চা। কাজেই ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় অবনীন্দ্রনাথকে আঙ্গিকগত বিষয় হাতে - কলমে শেখাতে হয়েছিল। (মুখোপাধ্যায়, ১২৪)

রূপনির্মাণের ক্ষেত্রে অবনীন্দ্রনাথের প্রভাব তাঁর শিক্ষার্থীদের মধ্যে তেমনভাবে লক্ষ্য করা যায় না। পৌরাণিক বিষয়বস্তুর ছবির নায়ক নায়িকার চরিত্র অবন তাঁর শিক্ষার্থীদের কোলকাতা শহরের জনতার স্রোতের মধ্য থেকে খুঁজে নিতে বলতেন। অবনঠাকুরের সহকারী ঈশ্বরী প্রসাদের কাছ থেকেই কোলকাতা আর্ট স্কুলের শিক্ষার্থীরা রূপনির্মিতির করণকৌশল চর্চা করতেন।

বর্ণপ্রয়োগের ক্ষেত্রে অবশ্য অবনীন্দ্রনাথের শিক্ষার প্রভাব তাঁর ছাত্রদের উপর স্পষ্ট। জলরঙের ব্যবহার তিনি নিজে রীতিমত প্রথাগতভাবে শিক্ষা করেছিলেন। অনুরূপ শিক্ষা তাঁর ছাত্রদের ছিল না বলেই অবন ঠাকুরের কাছে সে শিক্ষালাভের সুযোগ তাদের হয়েছে। বর্ণের স্তরভেদ, বর্ণদ্যুতি বা টেক্সচার, ছবির ফিনিস, বর্ণের মিশ্রণ, বর্ণলেপন পদ্ধতি অবনীন্দ্রনাথের মধ্যস্ততায় তাঁর অনুবর্তীরা আয়ত্ত করার চেষ্টা করেছিলেন। ছাত্রদের ছবির উপর ওয়াশ দেয়ার কথা অবনীন্দ্রনাথ নিজেই উল্লেখ করেছেন।

অবনীন্দ্রনাথ শিখিয়ে পড়িয়ে শিল্পী তৈরি করার চেষ্টা করেন নি। যারা শিল্পীমন নিয়ে এসেছিলেন, তাঁরা অবনীন্দ্রনাথের শিল্পাদর্শের দ্বারা যতটা উপকৃত হয়েছিলেন, অপেক্ষাকৃত সাধারণ শিক্ষার্থীর পক্ষে এই শিক্ষানীতি তেমন কার্যকর হয় নি। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা দরকার অবনীন্দ্রনাথ সে সময় বহুসংখ্যক শিক্ষার্থীর তত্ত্বাবধান করেন নি। (মুখোপাধ্যায়, ১২৫-২৬)

নন্দলাল বসু, বিশ্বভারতীর কলাভবনের বিস্তার যার হাতে, তিনি ছিলেন অবনীন্দ্রনাথের প্রথম দিককার অন্যতম ছাত্রদের একজন। তিনি অবন ঠাকুরের শিক্ষণ পদ্ধতির ব্যাপারে বলেন -

"ছবি আঁকার বিশেষ কোন পদ্ধতি না শেখালেও আমরা তাঁর ছবি আঁকা দেখে নূতন নূতন ছবি আঁকা শুরু করেছিলাম। তখন জানতেও পারি নি কি করে ছবি আঁকতে শিখলাম। তাঁর ছবি শেখানোর এমনই সহজ পদ্ধতি ছিল।" (ভট্টাচার্য, ১২৯)

অসিতকুমার হালদার, অবন ঠাকুরের প্রথম দিকের ছাত্রদের একজনও সাক্ষ্য দেন এই ব্যাপারে, যে, অবনীন্দ্রনাথ ছাত্রদের সামনে বসে কাজ করার মধ্য দিয়ে তাদের নিজের নিজের কল্পনাশক্তি ও রুচিকে উন্নত করে তুলতে অনুপ্রাণিত করতেন। তিনি কোন সময়েই তাঁর ব্যক্তিত্বের দ্বারা তাঁদের আচ্ছন্ন করতে চাইতেন না।

হ্যাভেল বা অবনীন্দ্রনাথের প্রভাবে দেশের মধ্যে ভারত - শিল্প সম্বন্ধে আগ্রহ জাগলেও আর্টস্কুলের মধ্যে এই আন্দোলনের প্রভাব অথবা নূতন আদর্শ হ্যাভেল বা অবনীন্দ্রনাথ সক্রিয় করে তুলতে পারেন নি। কলোনিয়াল আর্টের দুর্গরূপে সরকার প্রতিষ্ঠিত আর্ট স্কুলগুলিকে সকল সময় বাইরের প্রভাব থেকে মুক্ত রাখবার চেষ্টা হয়েছে। আজও এই অবস্থার খুব বিশেষ কোন পরিবর্তন ঘটে নি। তদুপরি, আর্ট স্কুলের ভেতর থেকেই বরং ছাত্রবিদ্রোহ ঘটেছে, স্বদেশী আর্ট দ্বারা ইউরোপীয় মডলিং এ চিত্রকলা চর্চা প্রতিস্থাপিত হবার পর। জুবিলী আর্ট একাডেমী, কোলকাতা আর্ট স্কুল থেকে বেরিয়ে আসা পাশ্চাত্য রীতিতে চিত্রকলা চর্চায় আগ্রহী শিক্ষার্থীদের আর্ট স্কুল ছিল। এর নেতৃত্বে একসময় এগিয়ে আসেন যামিনীপ্রকাশ গঙ্গোপাধ্যায়, যিনি সম্পর্কে ছিলেন অবনীন্দ্রনাথের ভ্রাতুষ্পুত্র। (ভট্টাচার্য, ১৪৫)

অবনীন্দ্রনাথের ব্যক্তিত্ব ও উদার শিক্ষানীতি এবং তাঁর সংগ্রহালয় সব মিলে তৎকালীন শিল্পীমহলে যে নূতন উদ্দীপনা জাগিয়েছিল তারই প্রভাবে, কোলকাতা সরকারী আর্ট স্কুলের দায়িত্ব ছেড়ে দেয়ার পরেও সমাজের নানা স্তর থেকে শিল্প সৃষ্টির ইচ্ছা নিয়ে অবনীন্দ্রনাথের বাসভবনে বৃহৎ জনতার সমাগম হয়। ছাত্র, শিক্ষক ও সরকারী চাকুরে সকলেই ভারতীয় শিল্পচর্চা করতে ইচ্ছুক। ইচ্ছুক ব্যক্তি মাত্রই ঘরে বসে ছবি এঁকে অবনীন্দ্রনাথের কাছে উপস্থিত হতে পারতেন, এবং অবনীন্দ্রনাথের কাছ থেকে শিল্পবিষয়ক উপদেশ গ্রহণ করতেন। বলা চলে যে আর্টস্কুলের প্রাচ্য শিল্পবিভাগ অপেক্ষা অবনীন্দ্রনাথের বাসভবন সে সময় শিল্পশিক্ষা পদ্ধতির প্রধান কেন্দ্রস্থল ছিল। (মুখোপাধ্যায়, ১২৮-২৯)

অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রথম সারির কৃতবিদ্য ছাত্রদের মধ্যে আছেন - সুরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়, নন্দলাল বসু, অসিতকুমার হালদার, দুর্গেশচন্দ্র সিংহ, ক্ষিতীন্দ্রনাথ মজুমদার, কে ভেঙ্কটাপ্পা, সমরেন্দ্রনাথ গুপ্ত, শৈলেন্দ্রনাথ দে, হাকিম মহম্মদ খান প্রমুখ। উল্লেখ্য যে, উপরুক্ত প্রায় সকল শিল্পীর কর্মযজ্ঞের ব্যাপারে শিল্পঐতিহাসিকরা কিছু কিছু শব্দব্যয় করে তাঁদের নামকে অবিভক্ত বঙ্গের শিল্পকলার ইতিহাসে অক্ষয় করে রাখলেও, হাকিম মহম্মদ খানের ব্যাপারে বঙ্গীয় শিল্পকলার ঐতিহাসিক একটা অবজ্ঞা, অবহেলা পরিলক্ষিত হয়। পরম্পরাজাত মুঘল শিল্পকলা - মুসলিম ঘরানার শিল্পীদের হাত হয়েই বঙ্গীয় শিল্পকলার জগতে প্রবেশ করলেও, বঙ্গীয় শিল্পকলার শিক্ষার্থী হিসেবে হাতেগোনা যে দু'একজন মুসলিম চিত্রকর/শিক্ষার্থীর নাম কালেভদ্রে আমাদের চোখে পড়ে, বঙ্গীয় শিল্পকলার ইতিহাসের বিবিধ বইয়ে, তাতে তাঁদের ঠিকুজী কুলুজী, কর্মযজ্ঞের ব্যাপারে সংক্ষিপ্ততম ফুটনোটেরও অনুপস্থিতি, বা তাঁদের পরিচয় ও কাজ বেমালুম উবে যাওয়ার ইতিবৃত্ত বঙ্গীয় শিল্পকলার ইতিহাসের নিরপেক্ষ পাঠক হিসেবে আমাদের কষ্ট দেয়।

৪।

ইন্ডিয়ান সোসাইটি অফ ওরিয়েন্টাল আর্টের প্রতিষ্ঠা, এবং শিল্প সংগঠক অবনীন্দ্রনাথঃ


১৯০৭ সালের ৬ এপ্রিল, ব্রিটিশ রাজের কিছু গন্যমান্য কর্তাব্যক্তিকে সাথে নিয়ে, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে যুগ্ন-সম্পাদক ঘোষণা করে যাত্রা শুরু করে 'প্রাচ্য শিল্পসভা', বা ইন্ডিয়ান সোসাইটি অফ ওরিয়েন্টাল আর্ট। এই সভার পৃষ্ঠপোষক সকলেই ছিলেন ভারতের আধ্যাত্মিক সাধনার প্রতি গভীরভাবে আস্থাবান, এবং জাতীয়তাবাদী। (মুখোপাধ্যায়, ১২৬) এই সোসাইটির হয়ে কর্মরত অবনীন্দ্রনাথকে আমরা শিল্প সংগঠক রূপে পাই। ইন্ডিয়ান সোসাইটি অফ ওরিয়েন্টাল আর্ট স্রেফ নামকাওয়াস্তে একটি সংগঠন ছিল না, বরং দারুণ কর্মদক্ষতার মধ্য দিয়ে অবনীন্দ্রনাথ - হ্যাভেলের ভারতীয় চিত্রকলার স্বদেশী ভাষা নির্মাণে যে সচেতন রাজনৈতিক প্রচেষ্টা ছিল, তাঁর মুখপাত্র হিসেবে অগ্রসর হতে থাকে।

সোসাইটি প্রাথমিকভাবে কোলকাতায়, পরে কোলকাতার বাইরে ভারতের বিবিধ প্রদেশে, এবং পরবর্তীতে বিদেশেও নব্যভারতীয় চিত্রআঙ্গিকে অঙ্কিত চিত্রকলার প্রদর্শনী আয়োজন করতে থাকে। ফরাসী শিল্পী আদ্রে কার্পেলের উদ্যোগে ১৯১৪ সালে প্যারিসে নব্যভারতীয় চিত্রকলার প্রথম প্রদর্শনী হয়। ফ্রান্সের সবগুলো প্রধান প্রধান দৈনিকে উক্ত চিত্র প্রদর্শনী এবং চিত্ররীতি - কোলকাতার শৈলী হিসেবে স্বীকৃত এবং সমাদৃত হল। দা ষ্টেটসম্যান পত্রিকায় শিরোনাম তৈরি হল - "একজিবিশন অব ইন্ডিয়ান পেইন্টিংস ইন প্যারিস - দি ট্রায়াম্ফ অব অবনীন্দ্রনাথ!!!"

প্রদর্শনীর সঙ্গে সঙ্গে , প্রাচ্যকলা সঙ্ঘের উদ্যোগে অবনীন্দ্রনাথ, নন্দলাল প্রমুখ শিল্পীর ছবির প্রামাণ্য মুদ্রণের মাধ্যমেও তাঁর প্রচার করা হয়। জাপানি, ও ইংরেজ মুদ্রণযন্ত্র, এবং ছবি তুলে অঙ্কিত চিত্রের ফটোকপি নির্মাণের মাধ্যমে তাঁদের শিল্পীদের অঙ্কিত ছবি নিজেদের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়ার বন্দোবস্ত হয়।

প্রাচ্যকলা সঙ্ঘের উদ্যোগে যে কেবল ভারতীয় বা প্রাচ্যদেশীয় কলাশিল্পের প্রদর্শনী হত, বা ওতেই সঙ্ঘের কার্যক্রম সীমাবদ্ধ রাখা হয় তা নয়। সদাপরিবর্তনশীল বৈশ্বিক শিল্পকলার গতিপথের দিকে তাঁদের ছিল সচেতন নজর। ১৯২২ সালে সঙ্ঘের চতুর্দশ বাৎসরিক প্রদর্শনীতে স্বদেশী ভাবধারায় অঙ্কিত চিত্রের পাশাপাশি জার্মান বাউহাউজ স্কুলের শিল্পী ভাসিলি কান্দিনিস্কি, পল ক্লি, লায়োনেল ফেনিংগার প্রভৃতি শিল্পীর চিত্রকলার প্রদর্শনী করা হয়।

এছাড়াও, যেকোনো সামাজিক আন্দোলনকে পরিচালিত/ অগ্রসর করবার জন্যে প্রয়োজন পড়ে তাঁর মুখপাত্ররূপে একটি পত্রিকার। সেই সূত্রেই ১৯১৯ সাল থেকে ইন্ডিয়ান সোসাইটি অফ ওরিয়েন্টাল আর্টের মুখপাত্ররূপে 'রূপম' পত্রিকা প্রকাশিত হওয়া শুরু করে। অশোক ভট্টাচার্য বলেন -

" 'রূপম' পত্রিকাটি সোসাইটির মুখপত্র হিসেবে এমন এক মহত্ত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল যার তুলনা তাঁর আগে বা পড়ে প্রকাশিত কোন ভারতীয় শিল্প - বিষয়ক পত্রিকার সঙ্গেই করা যায় না ... অভিজাত সচিত্র পত্রিকাটিতে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ প্রাচ্যকলাবিদ লেখকদের একত্রিত করে ভারতীয় ও অন্যান্য প্রাচ্যদেশীয় প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় কলাশিল্পের গবেষণাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সক্ষম হন। সেই সঙ্গে উত্তম মুদ্রণে নব্যবঙ্গীয় চিত্রকলার শ্রেষ্ঠ প্রতিনিধিদের ছবি ও তাঁদের উপর আলোচনা ছেপে এই কলাশৈলীকে দ্রুত পৃথিবীময় ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়।"

দেশে-বিদেশে নব্যভারতীয়/ কোলকাতা স্কুল অফ আর্টের শিল্পকলা প্রদর্শনী, শিল্প সমালোচনার কাগজ প্রকাশ করে নন্দনতত্ত্ব নিয়ে বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনার শুরুয়াদ ছাড়াও আর একটি বিশেষ কাজ, যা এই সঙ্ঘের মাধ্যমে হয়, তা হল, ১৯১৫ সালে কোলকাতা আর্ট স্কুল ছেড়ে দেয়ার পরে, বিশ ও ত্রিশের দশকে, অবনীন্দ্র রীতির দ্বিতীয়পর্বের শিল্পীরা উঠে এসেছিলেন এই সোসাইটির শিল্প - বিদ্যালয় থেকেই। (ভট্টাচার্য,১৩৯-৪৩)

৫।

অবনীন্দ্র চিত্রকলার বৈশিষ্ট্যঃ


ফিরে যাওয়া যাক সেই গোড়ার বাক্যে, যেখানে বলেছিলাম - অবনীন্দ্র প্রতিভার সবচে বড় স্মারক তাঁর অঙ্কিত ছবি। শিল্পী অবনীন্দ্রনাথকে বুঝতে হলে তাঁর ছবি দেখার কোন বিকল্প নেই। অবনীন্দ্রনাথের অঙ্কিত সমস্ত ছবির ছিটেফোঁটা হয়তো এ এ লেখায় উঠে আসবে, তাঁর চিত্রাঙ্কনের স্টাইল নিয়ে কিছু আলোচনা করে নেয়া যাক তাঁর আগে।

অবন ঠাকুরের চিত্রকলার প্রাথমিক বৈশিষ্ট্য, এবং উদ্দীপনা কি - যদি আমাকে এ প্রশ্ন করা হয়, আমার উত্তর হবে তাঁর চিত্রকলা ত্রিমুখী, তথাঃ বুদ্ধিবৃত্তিক, ইতিহাসনির্ভর, এবং ইন্দ্রীয়জাত।

কীভাবে এ তিনটি বৈশিষ্ট্য একত্রে এক সারিতে আলোচিত হতে পারে, যেখানে অন্তত প্রথম ও তৃতীয় বিষয়বস্তু বিপরীতমুখী বলেই মনে হয়?

অবন ঠাকুরের চিত্রকলা বুদ্ধিবৃত্তিক, বা বুদ্ধির তাড়নাজাত - এই অর্থে যে, তিনি পৃথিবীর উল্লেখযোগ্য সকল শিল্পধারার থেকেই দেদারসে শিখেছেন, দুহাত ভরে নিয়েছেন চিত্রকলার আঙ্গিক এবং করণকৌশল। তারপর, গুরুপরম্পরায় লব্ধ সে জ্ঞান তিনি ভেঙ্গেছেন, আবার গড়েছেন, আবার ভেঙ্গেছেন, ছেনেছুনে দেখেছেন। এ পুরো প্রক্রিয়ায় তিনি বরাবরই বুদ্ধিবৃত্তিক একটি সিদ্ধান্তে অনড় ছিলেন যে, তাঁকে এমনএকটা শিল্পকৌশল বা আঙ্গিক তৈরি করতেই হবে, যেটা দেখেই মনে হবে ভারতের, বা ভারতীয়। সময় ছিল স্বদেশী আন্দোলনের, সেটা তেতে ওঠার, তেতে থাকারই সময়। অবন ঠাকুরের শারীরিক তেতে ওঠার খবর আমরা জানি না বটে, কিন্তু শিল্পীমানসের তেতে থাকার খবর তাঁর আঁকা ছবিতে টের পাওয়া যায়। প্রসঙ্গতই এসে পড়ে ১৯০৫ সালে আঁকা তাঁর ভারতমাতা ছবিটির কথা। গেরুয়াবসনে, সিঁদুর - শাখাসিদ্ধ কান্তিময় নারীমূর্তি বঙ্গভঙ্গের বছরে আঁকা অবন ঠাকুরের স্মরণীয় ছবি, যা ঔপনিবেশিক শাসকের নিগড়ে বন্দী মুক্তিকামী ভারতের সনির্বন্ধ প্রতিচ্ছবি।



চিত্রঃ ভারতমাতা (১৯০৫)

অবনীন্দ্র চিত্রকলাকে ইতিহাস সচেতন বলার কারণ তাঁর সিরিজ পেইন্টিং সমূহ। শিল্পী জীবনের শুরুতে, যখন তিনি ক্রমশ নিজের ভাষা তৈরি করবার চেষ্টা করছেন, তখন তিনি আঁকলেন, রবীন্দ্র - পরামর্শমতে কৃষ্ণলীলা সিরিজ। তারও আগে ১৯০০ সালে প্রদর্শিত হয় তাঁর অঙ্কিত পদ্মাবতী, ও বেতাল পঞ্চবিংশতি সিরিজের কিছু ছবি। আবার ১৯০৬ থেকে ১৯১১, এই পাঁচ বছর সময়কালে তিনি পারস্যের কবি উমর খৈয়ামের রুবায়াতের অনুসারে আঁকেন সিরিজ ছবি - ওমর খৈয়াম চিত্রমালা। তাঁর আগে-পরে, আমরা দেখি, অবনীন্দ্রনাথ প্রায়ই তাঁর চিত্রাঙ্কনের বিষয়বস্তু হিসেবে বেছে নিচ্ছেন ঐতিহাসিক ঘটনাবলিকে। প্রসঙ্গত এসে পড়ে তাঁর যৌবনে আঁকা অন্তিম শয্যায় শাহজাহান ছবিটির কথা। মুঘল সম্রাট শাহজাহানের অন্তিম শয্যার দৃশ্য অবলম্বনে আঁকা ছবিটিতে আমরা দেখি মুমূর্ষু শাহজাহান তাকিয়ে আছেন দূর তাজমহলের দিকে, কাতর দৃষ্টিতে, তাঁর পদপার্শ্বে বসে আছে সেবাদায়িনী। সম্রাট শাহজাহানের ভ্রুক্ষেপও নেই তাঁর দিকে। শাহজাহান কী তাজমহলের দিকে তাকিয়ে ভাবছেন তাঁর অকালে হারানো স্ত্রী মুমতাজের কথা, নাকি অমর সব শৈল্পিক স্থাপত্যের পৃষ্ঠপোষকতা করার পরেও মানুষের জীবন কতটা ভঙ্গুর, কতটা নশ্বর - তিনি ডুবে আছেন সে চিন্তায়? ছবির দর্শককে এ দোদুল্যমান অবস্থাতেই ছেড়ে দিয়ে ছবির রচয়িতা অবনীন্দ্রনাথ নিজের দায়িত্ব সম্পন্ন করেন সার্থকভাবে। ১৯০২ - ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দে দিল্লী - দরবার উপলক্ষ্যে আয়োজিত রাজকীয় প্রদর্শনীতে ছবিটি পুরস্কৃত হবার পরেই মূলত অবনীন্দ্রনাথের খ্যাতি ভারত জুড়ে ছড়িয়ে পরে।




চিত্রঃ ওমর খৈয়ামের রুবাইয়াত অবলম্বনে (১৯০৬ -১১)



চিত্রঃ অন্তিম শয্যায় শাহজাহান (১৮৯৭ - ১৯০০)

বাকি রইল তাঁর ইন্দ্রিয়পরায়নতা, বা, আবেগ - অনুভূতি সঞ্চরিত শিল্পীমানস, যা , আমার মতে, অবনীন্দ্রনাথের ছবি আঁকার অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে বারংবার। আমার এই চিন্তার সাথে মিলে যায় বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়ের এ উক্তি - "সামাজিক বা নৈতিক আদর্শ অপেক্ষা 'অহেতুক' তাঁর শিল্প - প্রেরণাকে সজীব ও সক্রিয় রেখেছিল। জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এই অহেতুক ইচ্ছার দাঁড়াই তিনি চালিত হয়েছিলেন। পারিপার্শ্বিক প্রভাব অপেক্ষা অবনীন্দ্রনাথের মানসিক লক্ষণ বারংবার তাঁর শিল্পে প্রতিফলিত হয়েছে।" ( অবনীন্দ্র-চিত্র, মুখোপাধ্যায়, ১৯৬৩)



চিত্রঃ শেষের বোঝা (১৯১২)

একটি ছবির কথাই আলাদা করে উল্লেখ করা যাক। ছবিটির নাম 'শেষের বোঝা' (১৯১২)। ছবিটিতে দেখা যায় ক্লান্ত একটি উট, উষর মরুর বুকে, প্রজ্বলিত অগ্নিকুণ্ডের মত সূর্যের তেজে ক্লান্ত হয়ে হাঁটু গেড়ে শেষ বিশ্রামটুকু নিয়ে নিচ্ছে। ছবিটিতে আছে ব্যক্তিগত, এবং সার্বজনীন আবেগের মিশেল।

অবনীন্দ্রনাথের রং এর ব্যাবহার, এবং তাঁর বিখ্যাত ওয়াশ টেকনিক

শিল্প সমালোচক অশোক মিত্রের লেখা থেকে ধার করে বলি - এটা একটা বহুল প্রচলিত ধারণা যে, অবনীন্দ্রনাথ যে টেকনিকে ছবি ওয়াশ করতেন, সেটা সরাসরি জাপানী রীতির অনুকরণ। কিন্তু অশোক মিত্র দাবী করেন, এটা ওয়াশ টেকনিক নিয়ে অবনীন্দ্রনাথের নিজস্ব পরীক্ষা নিরীক্ষার ফসল, এবং তাঁর ভিত্তি বিলেতি জলরঙের টেকনিকের উপর। খুব ভালো কার্টিজ পেপার কাঠের উপর মাউন্ট না করিয়ে বরং তাঁর ওপর পেতে বসাতেন। তারপর রঙের প্রলেপ দিতেন। রঙের এক লেয়ারের ওপর আরেক লেয়ার দিতেন। কাগজ তুলে নিয়ে কাঠের ওপর ভেজা কাপড় বুলিয়ে তার ওপর আবার সেই কাগজ বিছিয়ে দিতেন। এর ফলে ওপরের রঙের লেয়ারটিকে ভেতরের লেয়ার শুষে নিত। শুষে নিয়ে শুকিয়ে যাবার পর তাঁর উপরে আর একটি লেয়ার। এভাবে ছবির রং পাকা করতেন তিনি। ভিজে গেলেও তাঁর ছবির রং ধেবড়ে যেতো না। ছবি তৈরি হয়ে যাওয়ার পর তিনি তুলি দিয়ে ছবির উপর জল টেনে ওয়াশ দিতেন। কখনো বা সমস্ত ছবিটাই জলে ডুবিয়ে নিতেন। এ ওয়াশ টেকনিকই অবনীন্দ্র উদ্ভাবিত ওয়াশ টেকনিক, যা ওরিয়েন্টাল আর্টের এক মুখ্য অনুষঙ্গ।

বাল্যাবস্থায় শেখা প্যাস্টেল কালারের ব্যবহার তিনি কোনদিনও ত্যাগ করেন নি। বর্ণ বা রঙের ব্যবহারে অবনীন্দ্রনাথকে ইটালিয়ান, এমনকি আরও একধাপ আগিয়ে ভিনিশান বলা চলে। কিন্তু রেখা এবং নকশাঙ্কনে ইংরেজ গুরুর কৃপায় তিনি বরাবরই ইংরেজি চিত্রঘেষা রইলেন, ফলে তাঁর ড্রয়িং রইল আজীবন রিয়েলিস্টিক, বা বাস্তবপন্থী। তাতে রইল পারস্পেক্টিভের স্পষ্ট উপস্থিতি। অপরদিকে তিনি পরম্পরাগত শিক্ষা, এবং স্বদেশী বিষয়াদিকেও ভুলতে পারলেন না। ফলে তার ছবিতে এলো পারসিক মিনিয়েচারের কম্পোজিশন, সেই সঙ্গে পারসিক মিনিয়েচারের অলঙ্কার - নির্ভর মেজাজ।


চিত্রঃ গণেশ জননী, পারসিক কলম, স্বদেশী অনুপ্রেরণা


চিত্রঃ মুঘল মিনিয়েচার ফর্মে আঁকা আরব্যরজনীর আখ্যান সিন্দবাদ (১৯৩০ - )



চিত্রঃ আরব্যরজনী সিরিজের আলীবাবা (১৯৩০ -) চেহারার আঙ্গিকে ভারতীয়/বাঙ্গালী




চিত্রঃ উজির ও উজির কন্যা শেহেরজাদ , আরব্যরজনী সিরিজ (১৯৩০ -)

তাঁর শেষের দিকের আরব্য উপন্যাসের চিত্ররাজিতে মুখ, অবয়ব, অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, ভঙ্গী, সবই হত পোর্ট্রেট। অবনীন্দ্রনাথ হয়তো হলেন আলিবাবা, গগনেন্দ্রনাথ হয়তো হলেন কাশেম, রবীন্দ্রনাথকে বানানো হল খলিফা হারুন অর রশিদ, অন্দরমহলের কোন মহিলা হয়তো হলেন মর্জিনা। উল্লেখ্য যে ভারতীয় চিত্রজগতের যে দুটি রাজ্যে তাঁর দান সবচে বেশী, তাঁর একটি হল এই পোর্ট্রেট। উল্লেখ্য যে মুঘল পরম্পরায়ও কিছু উল্লেখযোগ্য পোর্ট্রেটের কাজ আছে, কিন্তু তার অধিকাংশই প্যাস্টেলে আঁকা। তেলরঙ ভারতীয় উপমহাদেশের জলবায়ুর সাথে খুব একটা সাযুজ্য রাখে না বলেই মুঘল চিত্রকরেরা সে পথে হাঁটেন নি। এই সমস্যার সম্মুখীন হয়ে অবনীন্দ্রনাথ এমন সব রং বাছলেন যা ম্লান, গম্ভীর, ধূসর বা ছাই, ব্রাউন, মোটেই মুখর বা গমগমে নয়, তাতে উজ্জ্বল রঙের সামান্য স্পর্শ দিয়ে উজিয়ে দিলেন। কিন্তু প্যাস্টেল পোর্ট্রেটে শরীরের চামড়ার বুনন বা টেক্সচার তিনি যেমন আনলেন তা ভারতবর্ষে তৎকালীন সময়ে আর কেউ আনতে পারেন নি। এখানেও তিনি রঙের লেপের পর লেপ দিয়ে, বর্ণের সঙ্গে বর্ণ মিশিয়ে আস্তে আস্তে টোন আনলেন, তাঁর সংশ্লেষণে আনলেন বর্ণালীবিভঙ্গ, বা টোনালিটি। শেষে গিয়ে যেটা দাঁড়াত, তাতে থাকতো হীরে জহরতের দ্যুতি। উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায় যমুনাদেবীর পোর্ট্রেট (১৯২৬)।


চিত্রঃ যমুনা দেবী (১৯২৬)


চিত্রঃ 'আমার মা'



চিত্রঃ জেবুন নিসা



চিত্রঃ রক্ষিতা

অবন ঠাকুরের অপর অবদান প্রাকৃতিক দৃশ্য, বা ল্যান্ডস্কেপে। তাঁর ল্যান্ডস্কেপগুলোও এক অদ্ভুত দ্বিমুখী বুননে সৃষ্টি, কারণ, তাঁর রঙের ব্যাবহার, যেমনটা কিনা আগেই বলেছিলাম, একান্তই ইউরোপীয় হলেও চিত্রে সৃষ্ট মুড একান্তই দেশী। ল্যান্ডস্কেপ ড্রয়িং এ তাঁর রীতি ন্যারেটিভ, কিন্তু প্রত্যেক ন্যারেটিভ আবার একটি নির্দিষ্ট মুডকে কেন্দ্র করে। তাঁর সবচে সার্থক ল্যান্ডস্কেপ হচ্ছে পূর্ববঙ্গের দৃশ্যরাজিতে যে ছবির সারিতে তিনি পূর্ববঙ্গের নদনদী, জল, গাছপালা, ঘাস, চর , নৌকা, গ্রাম, উদ্ভিদের বর্ণনায় এক অপূর্ব স্থানীয়ভাব এনেছেন, যে ধরণের স্থানীয় ভাব এসেছে রবীন্দ্রনাথের পদ্মার বুকে লেখা শিলাইদহর চিঠিতে, বা তারাশংকরের উপন্যাসে। অথচ ম্যাড়ম্যাড়ে, ম্লান, ধূসর এবং ব্রাউন রঙের উপর সামান্য উজ্জ্বল রঙের ছিট এনে সমস্ত ছবি অপূর্ব ঔজ্জ্বল্যে উদ্ভাসিত করার যে রীতি তিনি পূর্ববঙ্গের ল্যান্ডস্কেপে দেখান, তা শুদ্ধ ইউরোপীয় রীতি। যেমন পূর্ববঙ্গের নদীর পাশে গাছের ছায়াঘেরা ম্লান গ্রামের পাণ্ডুর আকাশের ছবির মধ্যে তিনি নিশ্চিত হাতে এঁকে দিলেন টকটকে একটি লাল ঘুড়ি। ফলে সারা ছবি ভাস্বর হয়ে উঠলো। এই স্থানীয় ভাব এসেছে তাঁর কথকঠাকুর, মৃত নাতির পুরনো খেলনা নিয়ে বসা বুড়ি, ছড়ানো খেলনার মধ্যে বসা ছোট ছেলের ছবিতে। মুড আনতে তিনি সিদ্ধহস্ত ছিলেন। দৃষ্টান্তস্বরূপ উল্লেখ করা যায় তাঁর নুরুদ্দিনের বিয়ে ছবিটির কথা। সম্পূর্ণ ইউরোপীয় আঙ্গিকে আঁকা ছবিটির মেজাজ, আমেজ সবই চৈনিক। (মিত্র, ১০৮-১১০)



চিত্রঃ 'নুরুদ্দিনের বিয়ে' , ছবিতে মুড তৈরিতে অবনীন্দ্রনাথের সিদ্ধহস্ততার স্মারক একটি ছবি

এতদসত্যেও বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায় বলেন, অবনীন্দ্রনাথের ছবির সবচে বড় সম্পদ তাঁর স্টাইল। অথচ তাঁর স্টাইল নিয়েই সমকালীন শিল্পসমালোচকরা বেশী কথা বলেন নি প্রধানত দুই কারণে। এক, কেবলই তাঁকে ভারতীয় দার্শনিক ও আধ্যাত্মিক কোটাভুক্ত করে কোণে ঠেলে দেয়ার প্রচেষ্টা; দুই, খ্যাতির তুঙ্গে টাকা অবস্থায় তাঁর কাছে সকলের প্রত্যাশা ছিল ভারতীয় শিল্পী হিসেবেই - এই জন্যেই তাঁর স্টাইলের বৈশিষ্ট্য চোখে পরে নি। বরং প্রাচীনের সঙ্গে তুলনা করে তিনি কতটা মোগলের কাছে পৌঁছেছেন সেটাই দেখবার চেষ্টা হয়েছিল। বিশুদ্ধ প্রাচীন দেশী আর্ট নয়, বরং আশ্চর্য ক্ষমতার দ্বারা বিভিন্ন পদ্ধতির সংমিশ্রণে ভারতীয় চিত্রকলার যে আধুনিক রূপটি তিনি রচনা করেন, এটাই তাঁর স্টাইল। তাঁর ছবির ভাবের আলোচনার আড়ালে এই স্টাইল নিয়ে আলোচনা প্রায় খুব একটা হয় ই নি বলতে গেলে। (মুখপাধ্যায়, ২৫৮ - ৫৯)

৬।

সমালোচনার সম্মুখীন অবনীন্দ্রনাথের শিল্পআঙ্গিকঃ


১৯১১ সালে, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম যখন গোটা ভারত জুড়েই পরিচিত, শিল্পী হিসেবে, সে সময় শিল্পীর অঙ্কিত চিত্রকর্মের আঙ্গিকগত ত্রুটির সমালোচনা করেন সময়ের সেরা চিত্র সমালোচক আনন্দ কুমারস্বামী। ঐ বছরের 'ফেস্টিভল অফ এম্পায়ার' প্রদর্শনীতে অবন ঠাকুরের ছবি দেখে তিনি লিখলেন -

"তাঁদের ছবিতে এক বিশিষ্ট ভারতীয় ভাব আছে, এটা খুব উল্লেখযোগ্য কথা। কিন্তু তবুও তাঁরা ইউরোপীয় ও জাপানী প্রভাব থেকে মুক্ত নয় ... যার কাছ থেকে তাঁরা প্রেরণা পেয়েছেন সেই অজন্তা, মুঘল, রাজপুত ছবির তুলনায় এদের কাজে প্রায়ই শক্তির অভাব দেখা যায়। যেন কোথায় একটা শক্ত কাঠামো নেই। এসব কাজকে সার্থক না বলে প্রতিশ্রুতির পর্যায়ে ফেলাই ঠিক হবে।"

তাঁর এক বছর আগে, ১৯১০ সালে, শিল্প সমালোচক রজার ফ্রাই অবন ঠাকুরের স্কুলের ব্যাপারে মন্তব্য করেন -

"এইসব শিল্পীরা তাঁদের পূর্ব পুরুষের সূত্র আয়ত্ত করার যতই আপ্রাণ চেষ্টা করুন না কেন, তাঁদের ছবিতে যে ভাব ধরা দেয়, তা অ্যামেরিকান মাসিক পত্রিকার ছবির ভাব। এসব নকশায় স্বদিচ্ছার অভাব নেই, কিন্তু তবুও দেখলে কষ্ট হয়। ইউরোপীয় ধ্যানধারণার স্পর্শে প্রাচ্য রুচির কি গভীর দুর্নীতিপূর্ণ বিকার ঘটেছে তাঁর সবচে বড় প্রমাণ এই সব ছবি।"

রজার ফ্রাই এর সমালোচনার সূত্র ধরেই কুমারস্বামী আবারো যোগ করেন -

"ফ্রাইয়ের সমালোচনা সমুচিতই বলা যায়। কোলকাতার ছবির অধিকাংশই সুকুমার, কিন্তু তাঁদের বেশীরভাগেরই উদ্ভব ভাবালুতায়, তাদের নকশা দুর্বল, রং তামসিক ... তাঁরা সুন্দর ছবি করতে বড় বেশী ব্যাকুল অথচ সুন্দর ছবি দেখার তাগিদ তাঁরা খুব কমই বোধ করেন। উপরন্ত, কোলকাতার ছবির রঙে, বিশেষ করে জাপানী প্রভাবে প্রভাবিত শ্রীযুক্ত ঠাকুরের ছবির রঙের টোন এত চাপা বা নীচু, যে প্রায়ই ছবির বিষয়বস্তু ঠাহর করা বেশ মুশকিল হয়।" (মিত্র, ১০৭)

শুধু আঙ্গিক, বা করণকৌশলগত (টেকনিক্যাল) সমালোচনা নয়, যে ভাবধারার চিত্রকলার চর্চা হ্যাভেল - ওকাকুরা হয়ে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং তাঁর শিষ্যরা করতেন সেই স্বদেশী নব্য শিল্পাদর্শের প্রেরণাকেও পড়তে হয়েছে সগোত্রীয়দের তুমুল সমালোচনার মুখে।

অবন ঠাকুর তাঁর একটি নিবন্ধে প্রকৃত অর্থে ইউরোপীয় শিল্পে দক্ষতা অর্জন ভারতীয় শিল্পীর পক্ষে সম্ভব নয় এই মত ব্যক্ত করে লেখেন -

"যদি কেউ শিল্পের আধ্যাত্মচেতনার রূপকে অনুভব করতে চান তাহলে তিনি যেন আশ্বিন মাসে বাংলার কোন একটি মন্দিরে উপস্থিত হন - যেখানে সন্ধ্যায় পবিত্র ধূপধুনা পুড়ছে, শাঁখ ঘণ্টা বাজছে, ধূপের ধোঁয়ার মধ্যে আরতির দীপ তুলে নিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছেন পুরোহিত, সামনে জ্যোতির্ময়ী মহিমময়ী দুর্গামূর্তি। যদি কেউ সেই মূর্তির দিকে ভক্তির চোখে তাকান, তাহলে আধুনিক ইউরোপীয় শিল্পের মোহমায়া দূর হয়ে যাবে দেবীকৃপায়, তিনি বুঝবেন সৌন্দর্যের আধ্যাত্মচেতনের রূপকে, যার দ্বারা ভারতীয় শিল্পী মাটিতে গড়েছেন অপরুপ দেবীমূর্তি।"

অবন ঠাকুরের শিল্পাদর্শের বিপরীতে কলম ধরলেন দিগ্বিজয়ী ভারতীয় চলচিত্র নির্মাতা সত্যজিৎ রায়ের দাদা উপেন্দ্রকিশোর রায়, এবং পিতা সুকুমার রায়।

উপেন্দ্রকিশোর লিখলেন -

"আমি অবশ্য ভারতীয় শিল্পকে ইউরোপীয় শিল্পের সমকক্ষ মনে করি না, এবং এ কথাও মনে করি না যে ভারতীয় শিল্প আমাদের প্রতিভা ও মেজাজের অধিক উপযোগী। ... শিল্পে স্বাদেশিকতার গুরুত্ব যথাসম্ভব স্বীকার করেও দৃঢ়তার সঙ্গে বলবো, স্বাদেশিকতাকে শিল্প চরিত্র নির্ধারণের একমাত্র মাপকাঠি করা যায় না। নিজ অনুভূতি ও আদর্শ ই শিল্পীর সর্বাধিক গ্রাহ্যবস্তু; এরসঙ্গে অনেক সময় স্বাদেশিকতার কোন যোগ থাকে না, অথচ তা মহত্তম শৈল্পিক বিকাশের হেতু হতে পারে। তাছাড়া এমন হওয়া খুবই সম্ভব যে , শিল্পীর আদর্শ তাঁর দেশের আদর্শ থেকে পৃথক। সে ক্ষেত্রে শিল্পী যদি স্বীয় আদর্শকে প্রতারণা করে দেশীয় আদর্শকে ধরতে যান তাহলে তিনি শিল্পীরূপে নিজ জন্মগত অধিকারকেই লঙ্ঘন করবেন।"

উপেন্দ্রকিশোরের সমালোচনার ভাষা কিছুটা সহনশীল থাকলেও, তাঁর পুত্র সুকুমার রায়ের সমালোচনা অবন অনুবর্তী শিল্পীগোষ্ঠীর মর্মে গিয়ে আঘাত হানে। ১৯১০ খ্রিস্টাব্দ / ১৩১৭ বঙ্গাব্দের প্রবাসী পত্রিকার আষাঢ় ইস্যুতে তিনি লেখেন -

"শুনিতে পাই আধ্যাত্মিকতাই ভারতশিল্পের প্রাণ ও তাহার শ্রেষ্ঠত্বের কারণ। এই তথাকথিত আধ্যাত্মিকতা কীরূপ বস্তু? চিত্রের নায়ক - নায়িকার চোখেমুখে যদি একটু তন্দ্রার ভাব দেখা গেল, অথবা চারদিকে কুহেলিকার সৃষ্টি করিয়া শিল্পী যদি তন্মধ্যে একটু আলোকের আভাস দিলেন তবেই কি আধ্যাত্মিকতার চূড়ান্ত হইল? তদুপরি যদি চিত্রে ভাবের অস্পষ্টতা লক্ষিত হয়, এবং নায়ক নায়িকা যদি অ্যানাটমি শাস্ত্রকে বৃদ্ধাঙ্গুস্ঠ দেখাইয়া তাহাদের অস্থিহীন অঙ্গভঙ্গীর কিঞ্চিত বাড়াবাড়ি করিয়া বসেন তবে তো সোনায় সোহাগা!" (ভট্টাচার্য, ১৩৬-৩৮)

অবনীন্দ্রনাথের শিল্পাদর্শ, এবং ছবি আঁকার ধরনের ব্যাপারে এই সমালোচনাগুলো আমরা বঙ্গীয় চিত্রকলার ইতিহাসের বিবিধ বইয়ে পাই। এই সমস্ত কড়কদার বাক্যবিন্যাসের ব্যাপারে আমার মত হল এই যে, শিল্পী - শিল্পসংগঠক - শিল্পাচার্য অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ব্যাপারে এ সমস্ত কঠোর, চটুল, এবং মুখরোচক সমালোচনা শিল্পকলার ইতিহাসের বইয়ে থাকার ফলে বঙ্গীয় শিল্পকলার ইতিহাসের পাঠককে সচকিত হয়ে নড়েচড়ে বসতে হয় এই চিন্তা করে যে - এমন ভাষায় স্বয়ং অবনঠাকুরের শৈলীরও সমালোচনা করবার প্রয়োজন পড়েছিল! তবে কি আমরা তাঁকে তাঁর প্রয়োজনের অধিক সম্মান দিয়ে ফেলছি?

বস্তুত, সমালোচকের কাজই তো এটা। জীবনানন্দের ভাষায় -

"ব’সে আছে সিংহাসনে—কবি নয়—অজর, অক্ষর
অধ্যাপক, দাঁত নেই—চোখে তার অক্ষম পিঁচুটি;
বেতন হাজার টাকা মাসে—আর হাজার দেড়েক
পাওয়া যায় মৃত সব কবিদের মাংস কৃমি খুঁটি;
যদিও সে সব কবি ক্ষুধা প্রেম আগুনের সেঁক
চেয়েছিলো—হাঙরের ঢেউয়ে খেয়েছিলো লুটোপুটি।" (
সমারুঢ়, সাতটি তারার তিমির, ১৯৪8)

আমাদের মনে রাখতে হবে যে, অবন ঠাকুরের ব্যাপারে এ সমস্ত সমালোচনা তাঁর নির্দিষ্ট সময়ের, নির্দিষ্ট কাজের প্রেক্ষিতে। সময়ের সাথে শিল্পী অবন ও পরিবর্তিত হন, এসব ত্রুটির মেরামত করে নেন, বা ত্রুটি বলতে একসময় যা চিহ্নিত হত, সেটাই সর্বজনগ্রাহ্য শিল্পরীতি হিসেবে গৃহীত হয়। ফলে সমালোচকের মুখেও তালা পড়ে, অন্তত খানিকটা পরিশীলিত ভাষা ব্যাবহারে তাঁদের প্রবৃত্তি হয়। কাজেই নিজের কাজকে ফিরে দেখবার, ভুলত্রুটি যা কিছু আছে, তা শুধরে নেবার সুযোগ তৈরিতেও সমালোচনা প্রয়োজন। এতকিছুর পরেও যদি অবন ঠাকুরের প্রবর্তিত শৈলীর উপযোগিতা না ই থাকতো তবে তাঁকে নিয়ে দিস্তার পর দিস্তা পৃষ্ঠা খরচ করে গবেষণা প্রবন্ধ, নিবন্ধ লেখা হত না। বাংলার শিল্পকলার ইতিহাসে একটি অমর স্থান তারজন্যে সুনির্দিষ্ট হত না।

শিল্প সমালোচক ও ইতিহাসবিদ অশোক মিত্র খানিকটা সে সুরেই বলেন - "কুমারস্বামী বা ফ্রাই (অবন চিত্রের) যে যুগের কথা বলেছেন, ভাগ্য ক্রমে অবনীন্দ্রনাথের জীবনে তা চিরস্থায়ী হয়নি।" (মিত্র, ১০৭) ভিন্নভিন্ন শিল্পধারাকে নিয়ে যে অভূতপূর্ব পরীক্ষানিরীক্ষা তিনি বাংলায় বসে করেছেন, যদি তিনি দ্বিতীয় শ্রেণীর শিল্পী হতেন, তবে তাঁর পদস্থলন অনিবার্য ছিল। কিন্তু তিনি যে তা ছিলেন না, সে কথা বলাই বাহুল্য।

৭।

সমাপ্তির পথেঃ


অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আলোচনা, ২০২০ সালের বাংলাদেশের শিল্পী ও বঙ্গীয় শিল্পকলার ইতিহাস চর্চা যারা করেন, তাঁদের জন্যে কেন গুরুত্বপূর্ণ, এ ব্যাপারে আমার ব্যক্তিগত বোঝাপড়া থেকে শেষ কিছু বাক্য উচ্চারণ করি।

প্রথম কথা হল এই, অবন ঠাকুরের ছবির মধ্য দিয়েই শিল্পী অবনকে চিনতে হবে। তাঁর চিত্রকলার নান্দনিকতার বিচার করতে হবে তাঁর টেকনিক বা করণকৌশলের কাঁটাছেঁড়ার মাধ্যমে। টেকনিকের দিক থেকে তিনি তাঁর সময়ের সবচে অগ্রসর শিল্পীদের একজন ছিলেন - এ আমার দ্বিধাহীন উচ্চারণ। বাকি রইল ছবির ভাব, এবং ছবির রস। তিনি সময়ের প্রতি দায়বদ্ধ ছিলেন, একই সঙ্গে দায়বদ্ধ ছিলেন অন্তরের প্রেরণার প্রতি। যে সময় যে ছবিটি আঁকা প্রয়োজন ছিল, এঁকেছেন। যে সময় যে ধরণের ছবি আঁকতে মন টেনেছে, তাও এঁকেছেন। দ্ব্যার্থহীনভাবে নিজের অন্তরের ডাকের প্রতি সাড়া দেয়া, সঙ্গে সঙ্গে কলাকৈবল্যবাদীদের মতো স্রেফ আঁকার খাতিরেই না এঁকে শিল্পগুরুর দায়িত্বপালন - শিল্পী হিসেবে এই ভারসাম্য রক্ষার বিষয়টির আবেদন আমাদের মধ্যে এখনো আছে, থাকবে।

অবনীন্দ্রনাথের দ্বিতীয় প্রাসঙ্গিকতা হল তাঁর সাম্প্রদায়িকতার ছুঁৎমার্গহীন শিল্পীমানসে। ইতিহাস রচয়িতারা তাঁদের অস্তিত্বের নিগুঢ় বুননের ফলেই সাম্প্রদায়িক চরিত্রের অধিকারী হন। কিন্তু শিল্পীর সাম্প্রদায়িকতা পৃথিবীর বুকে কেয়ামত রচনা করে। অবন ঠাকুর ছিলেন তাঁর সময়ের সবচে আধুনিক শিল্পী। তাঁর ছাত্রদের মধ্যে কেউ কেউ গোঁড়া হিন্দুত্ববাদকেই ভারতীয় শিল্পচর্চার একমাত্র অনুষঙ্গ বিবেচনা করলেও অবন ঠাকুরের মতামত সেরকম ছিল না, তা তাঁর ছবির টেকনিক এবং বিষয়বস্তুর বৈচিত্র্য দেখলেই বোঝা যায়। একদিকে যেমন তিনি এঁকেছেন কৃষ্ণলীলা সিরিজ, অপরপক্ষে তিনি এঁকেছেন রুবাইয়াৎ এ ওমর খৈয়ামের সিরিজ চিত্রমালা। তিনি অ্যারাবিয়ান নাইটস এর ওপরও ছবি এঁকেছেন ধারাবাহিক ভাবে, কিন্তু ইরাক - বসরায় সংঘটিত ঘটনাবলীর চরিত্রগুলোর চেহারা ফুটিয়ে তুলেছেন ভারতীয়, আরও নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে কোলকাতার চিরচেনা বাঙ্গালী নারী-পুরুষের আদলে। মুঘলরা অনাধিকারবলে ভারত দখল করে শাসন করেছে, এই বলে মুঘল পরম্পরাজাত চিত্রকলার প্রতি উন্নাসিকতা দেখান নি তিনি। বরং খুব যত্ন করে শিখেছেন মুঘল মিনিয়েচার আর্ট। সে টেকনিক তাঁর ছবিতে ফুটে উঠেছে বারংবার। আমাদেরও, ২০২০ সালের বাংলাদেশে বসে হিন্দুপুরাণ, ইরান-তুরান হতে আগত ইসলামী সভ্যতা, ব্রাত্য বাংলার মোটিফসহ শিল্পকলার যেখানে থেকে যা নেয়া সম্ভব, সবকিছুই কুড়িয়ে নিয়ে নিজেদের ঋদ্ধ করার প্রক্রিয়া অবনীন্দ্রনাথের থেকে শেখার আছে।

তিনি ছিলেন মহান শিল্পগুরু, শিল্প সংগঠক। তাঁর ছাত্রদের হাতে গোটা ভারতবর্ষের শিল্পচর্চার আধুনিকায়ন হয়। এছাড়াও সবশেষে অবনীন্দ্রনাথের থেকে যা নেয়ার আছে আমাদের আজও তা হল একই সঙ্গে শিল্পী এবং শিল্পতাত্ত্বিক হবার অনুপ্রেরণা। শিল্পতত্ত্বের মূল আলোচক হবার দাবীদার যে শিল্পী নিজেই - এ ধারণার প্রতিষ্ঠাতা , এবং জলজ্যান্ত প্রমাণ ছিলেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বাংলাদেশের শিল্পীদের নিজের কাজ ব্যাখ্যা করতে বললে তাঁরা ভাবের কথা বলেন, টেকনিকের ব্যাপারে কিছু উত্তর দেন, কিন্তু তুলনামূলক শিল্পকলার রসতত্ত্বের আলোচনায় নিশ্চুপ হয়ে যান। এমনটা হওয়ার কথা নয়, হওয়া উচিৎ ও নয়। এদিক থেকে অবনীন্দ্রনাথ এখনো আমাদের অনুপ্রেরণা। বাংলার নন্দনতত্ত্বের ব্যাপারে যেকোনো আলোচনায় অবন ঠাকুরের বাগীশ্বরী শিল্প প্রবন্ধাবলী আমাদের জন্যে এক রত্নভাণ্ডার স্বরূপ। সেই বাগীশ্বরীর প্রথম বক্তৃতায় তিনি উল্লেখ করেন -

"প্রত্যেক শিল্পীকে স্বপ্ন ধরার জাল নিয়ে বুনে নিতে হয় প্রথমে, তারপর বসে থাকা - বিশ্বের চলাচলের পথের ধারে নিজের আসন নিজে বিছিয়ে চুপটি করে নয় - সজাগ হয়ে।" ('শিল্পে অনাধিকার', অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, পৃষ্ঠা ১)

সেই স্বপ্ন ধরার জাল নিয়েই তো, ১৯৫১ সালে ৮০ বছর বয়সে দেহাবসানের পূর্ব পর্যন্ত সজাগ চিত্তে বসে থাকা অবস্থায় অবনীন্দ্রনাথকে আমরা আবিষ্কার করি। একই সঙ্গে ধ্যানমগ্ন এবং সজাগ এক শিল্পী ও শিল্পগুরু, যিনি নিজের মত করে বুনে নিয়েছেন স্বপ্ন ধরার জাল। নাম তাঁর 'বেঙ্গল আর্ট' বা 'কোলকাতা শৈলী', অনুপ্রেরণা তাঁর স্বদেশীয়ানা, ভাব তাঁর বৈশ্বিক। ২০২০ সালের প্রেক্ষিতেও তাই আমাদের বারবার ফিরে যেতে হবে অবন ঠাকুরের ছবির কাছে, তাঁর শিল্পাদর্শের কাছে, তাঁর শিল্পদর্শনের কাছে।

ঋণস্বীকারঃ

১। চিত্রকথা - বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায় (১৯৮৪), অরুণা প্রকাশনী, কোলকাতা
২। বাংলার চিত্রকলা - অশোক ভট্টাচার্য (১৯৯৪), পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, কোলকাতা
৩। ভারতীয় চিত্রকলা (দ্বিতীয় খণ্ড) - অশোক মিত্র (১৯৯৬), আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কোলকাতা
৪। বাগীশ্বরী শিল্প প্রবন্ধাবলী - অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৯৯৯), আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কোলকাতা
৫। বিশ্ব ইতিহাস প্রসঙ্গ - জওহরলাল নেহরু (১৯৯১), আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কোলকাতা
৬। অধিকাংশ ছবি এই ওয়েবসাইট থেকে নেয়া - Abanindranath Tagore: His Life, Work and Indian Modern Art
৭।সমারুঢ়, সাতটি তারার তিমির(১৯৪৮) - জীবনানন্দদাস

সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা জানুয়ারি, ২০২১ রাত ১০:০৮
৪টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিসিএস-পরীক্ষার হলে দেরিঃ পক্ষ বনাম বিপক্ষ

লিখেছেন BM Khalid Hasan, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



বর্তমানের হট টপিক হলো, “১ মিনিট দেরি করে বিসিএস পরীক্ষার হলে ঢুকতে না পেরে পরীক্ষার্থীর স্বপ্ন ভঙ্গ।” প্রচন্ড কান্নারত অবস্থায় তাদের ছবি ও ভিডিও দেখা যাচ্ছে। কারণ সারাজীবন ধরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের কার কি করা উচিৎ আর কি করা উচিৎ না সেটাই আমারা জানি না।

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:২৮




আমাদের কার কি করা উচিৎ আর কি করা উচিৎ না সেটাই আমারা জানি না। আমাদের দেশে মানুষ জন্ম নেয়ার সাথেই একটি গাছ লাগানো উচিৎ । আর... ...বাকিটুকু পড়ুন

মানবতার কাজে বিশ্বাসে বড় ধাক্কা মিল্টন সমাদ্দার

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ২:১৭


মানুষ মানুষের জন্যে, যুগে যুগে মানুষ মাজুর হয়েছে, মানুষই পাশে দাঁড়িয়েছে। অনেকে কাজের ব্যস্ততায় এবং নিজের সময়ের সীমাবদ্ধতায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারে না। তখন তারা সাহায্যের হাত বাড়ান আর্থিক ভাবে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিসিএস দিতে না পেরে রাস্তায় গড়াগড়ি যুবকের

লিখেছেন নাহল তরকারি, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৫৫

আমাদের দেশে সরকারি চাকরি কে বেশ সম্মান দেওয়া হয়। আমি যদি কোটি টাকার মালিক হলেও সুন্দরী মেয়ের বাপ আমাকে জামাই হিসেবে মেনে নিবে না। কিন্তু সেই বাপ আবার ২০... ...বাকিটুকু পড়ুন

×