somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বাঙ্গাল মস্তিষ্কের বি - উপনিবেশায়ন, নোকতা ৫ঃ হুমায়ূন আজাদ - যে মাজার ভাঙতে হবে

০১ লা আগস্ট, ২০২১ রাত ১১:৪৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


.
১।
হুমায়ূন আজাদ সাহেবের ১৭তম মৃত্যুবার্ষিকী এ মাসের ১২ তারিখ। বাংলাদেশে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ভক্ত - গুণগ্রাহী তৈরি করে রেখে গেছেন তিনি একই সঙ্গে তার চিন্তা, এবং চিন্তা বহিঃপ্রকাশের প্রক্রিয়া অপছন্দ করেন, এমনও অনেক পাঠক বাংলাভাষাভাষীদের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যাবে। সচেতন নাগরিক হিসেবে আমাদের দায়িত্ব, যে কাউকে গ্রহণ বা বর্জন করার প্রক্রিয়াটা যেন তাকে পাঠ করার মাধ্যমে হয়। অর্থাৎ পড়ে গ্রহণ করা, বা খারিজ করা। আমার অভিজ্ঞতায় আমি যদ্দুর জানি, হুমায়ূন আজাদ এই ট্রিটমেন্ট পান নি , এখনও পাচ্ছেন না। যারা তাকে শ্রদ্ধা করেন, তাকে বাংলাদেশের লাইটহাউস 'প্রথাবিরোধী' লেখক হিসেবে মান্য করেন। যারা তাকে অপছন্দ করেন, তাকে লোকমুখে শুনে নাস্তিকদের সর্দার ট্যাগ দেন। আমি এই দুই ধরণের মতবাদকেই দুটো ভিন্ন মাজার হিসেবে গণ্য করছি। প্রথমটি 'ইতিবাচকতার মাজার' , দ্বিতীয়টি 'নেতিবাচকতার মাজার' । যে মাজার ভাঙ্গিয়ে ব্যবসা হয়, সে মাজারই ভাঙ্গতে হবে। কাজেই হুমায়ূন আজাদ নামের মাজারটাও আমি ভাঙ্গতে আগ্রহী। আগ্রহী তার নির্মোহ পাঠে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে আমার বাবার সরাসরি শিক্ষক ছিলেন ডঃ আজাদ সাহেব। সেই সূত্রে আজীবন আমাদের পারিবারিক আলোচনার টেবিলে প্রাসঙ্গিক ছিলেন তিনি, তার চিন্তা, তার লেখা বইপত্র। শৈশবে মুগ্ধ পাঠক ছিলাম তার ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না, আব্বুকে মনে পড়ে, লাল - নীল দীপাবলি এ সমস্ত শিশুতোষ গ্রন্থের (যদিও শেষ বইটিকে এখন আর শিশুতোষ গ্রন্থ বললে বিসিএস প্রত্যাশী বন্ধুরা রাগ করবেন)। ২০০৪ সালের যেদিন তার ওপর ন্যাক্কারজনক প্রাণঘাতী হামলা হয়, তখন আমি হাইস্কুলের ছাত্র। চৌধুরী অ্যান্ড হুসেইন সাহেবের গ্রামার বই থেকে ন্যারেশন সল্ভ করছিলাম বোধয়। আজাদ সাহেবের রক্তাক্ত চেহারা দেখে খুবই ভয় পেয়েছিলাম। এখন এই ঘটনার জন্যে আফসোস করি। আশা করি এরকম ঘটনা বাংলাদেশের মাটিতে আর কখনোই না হোক। যাই হোক, আজাদ সাহেব তার ওপর হামলার স্বল্পদিন পর জার্মানিতে যান, এবং সেখানেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
.
ওনার 'নির্বাচিত প্রবন্ধ', 'শ্রেষ্ঠ কবিতা', মৃত্যুর বছর ২০০৪ সালের বই মেলায় প্রকাশিত তার দীর্ঘ আত্মজৈবনিক সাক্ষাৎকার - 'এই বাংলার সক্রেটিস', তারও আগে রাজু আলাউদ্দিন সাহেবকে দেয়া তার সুদীর্ঘ সাক্ষাৎকার, আহমদ ছফার সঙ্গে মানবজমিনে তার চিঠিচালাচালির মাধ্যমে ঝগড়াঝাটি - হুমায়ূন আজাদ সাহেবের ব্যক্তিমানসের ব্যাপারে একটা ধারণা তৈরি হয়েছে আমার এই লেখাগুলো পড়ে।
.
এসব পড়বার পর, হুমায়ূন আজাদের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, সাহিত্যিক, ধর্মীয়, এবং ব্যক্তিমানস সম্পর্কে ফার্স্টহ্যান্ড যে এম্পেরিক্যাল অভিজ্ঞতা তৈরি হয়েছে আমার, সে ব্যাপারে কিছু নির্মোহ কাটাছেঁড়া , এবং মন্তব্য রেখে যাওয়া প্রয়োজন মনে হয়েছে। আমার এ লেখার উদ্দেশ্যে এটাই। আমার বাঙ্গাল মস্তিষ্কের বি-উপনিবেশায়ন সিরিজের লেখাগুলো একটু বড় হয়। এটাও তাই, কিন্তু শেষপর্যন্ত পড়লে হুমায়ূন আজাদ সাহেবকে আবিষ্কার করবেন এমন নতুন এক আঙ্গিকে, যার সঙ্গে আমরা সাধারণত পরিচিত নই।
.
২।
হুমায়ূন আজাদ সাহেবের ব্যাপারে প্রাথমিক যে অব্জারভেশন আমি উপস্থাপন করতে চাই, তা পুরনো। অনেকেই এই ইস্যুতে হুমায়ূন আজাদ সাহেবের নামে অভিযোগ করেছেন। আমি আমার পাঠলব্ধ অভিজ্ঞতার সূত্রে পুনরায় বলছি।
.
হুমায়ূন আজাদ সাহেবের মেধা অনুবাদকের মেধা। তার প্রবন্ধ, কবিতার অনুপ্রেরণার এক বড় অংশ ধার করা। কখনো তিনি সেই ধারের ক্রেডিট পরিশোধ করেন, কখনো করেন না।
.
যেমন, আমার সাম্প্রতিক পঠনে তার একটি প্রবন্ধ "শিল্পকলার বিমানবিকিকরন" - এ আধুনিক কবিতার ধারণা ও বিশাল বড় প্রবন্ধটির প্রায় পুরো আইডিয়া তিনি ধার করেছেন স্প্যানিশ দার্শনিক - সমালোচক 'হোসে ওরতেগা ঈ গাসেৎ এর কাছ থেকে। আবার "ধর্ম" বা "আমার অবিশ্বাস" - জাতীয় ধর্মের সমালোচনা করা প্রবন্ধগুলির আর্গুমেন্ট তিনি ক্রেডিট দিয়ে - না দিয়ে ধার করেছেন বারট্র্যান্ড রাসেলের কাছ থেকে। একইভাবে হুমায়ূন আজাদ তার 'নারী' গ্রন্থটির জন্যে নিজেকে দাবী করেছিলেন বাংলাদেশে নারীবাদের জনক হিসেবে। বলেছিলেন বাংলাদেশে নারীবাদের কোন জননী নেই, তবে জনক আছে। তিনিই সে জনক। 'নারী' বইটি সেকেন্ড ওয়েভ নারীবাদীদের চিন্তার বঙ্গানুবাদ। এই বইয়ের দ্বিতীয় ভার্শন, 'দ্বিতীয় লিঙ্গ' - প্রকাশের আগে তিনি সিমন দ্য বুভয়া, বা কেইট মিলেটের নাম পর্যন্ত উল্লেখ করেন নি যথাযথভাবে তার লেখায়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে তার এই অসৎ কর্মের ফর্দ অনেক লম্বা, (আজাদ - ছফা বিতর্ক, মানবজমিন পত্রিকা, বা রাজু আলাউদ্দিনের নির্বাচিত সাক্ষাৎকার, পাঠক সমাবেশ দেখতে পারেন)। তার অনেক লেখার ব্যাপারেই অভিযোগ আছে, চিন্তা চুরি করবার। সামনে এগোনো যাক বরং।
.
২।
তার চিন্তাভাবনার সুবৃহৎ অংশ যে আনঅরিজিন্যাল এবং ধারকরা, তার সবচে সহজ প্রমাণ মেলে তার চিন্তার মধ্যে কোহিয়ারেন্স, সিনক্রোনাইজেশন, তথা ধারাবাহিকতার অভাবে ও বক্তব্যের দ্বিমুখীতায় বা কন্ট্রাডিকশনে। যেকোনো বিষয়ে মানুষের নিজস্ব বক্তব্য ধারাবাহিকভাবে তৈরি হয় ও বেড়ে ওঠে। আজাদ সাহেবের লেখায় সে ধারাবাহিকতা নেই।
.
আগামী প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত তার নির্বাচিত 'প্রবন্ধ গ্রন্থ'টি বর্তমানে পড়ছি। তার স্বনির্বাচিত প্রিয় প্রবন্ধ সমূহের সংকলন এটি। এ বইয়ের দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রবন্ধের নাম যথাক্রমে "শিল্পকলার বিমানবিকীকরণ", এবং "মধ্যাহ্নের অলস গায়কঃ রোম্যান্টিক বহিরস্থিত রবীন্দ্রনাথ"। এ দুটি প্রবন্ধ সাহিত্যের একটা নির্দিষ্ট ফর্মের ব্যাপারে, প্রায় একই কন্টেক্সটে দু'রকম বক্তব্য রাখেন তিনি, যা পুরোপুরি সেলফ কন্ট্রাডিকটরি।
.
প্রথম প্রবন্ধে তিনি দেখান, আধুনিক শিল্পীরা শিল্পকলার বিমানবিকীকরণ পদ্ধতিতে কীভাবে রোম্যান্টিক ধারার শিল্পকর্মের হাত থেকে বাঁচান বিশ্বকে। ঠিক তার পরের প্রবন্ধেই, রবীন্দ্রনাথকে একজন মহান রোম্যান্টিক শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করবার উদ্দেশ্যে আধুনিক ও উত্তর আধুনিক চিন্তাধারা কতোটা বাজে ও খাপছাড়া, লেখেন তা নিয়ে। এবং এমত মতামত প্রদানকালে রোম্যান্টিক ও আধুনিক শিল্পকলা - কোনটির ব্যাপারেই তার অবস্থান, বা মতামত স্পষ্ট হয় না।
.
'শিল্পকলার বিমানবিকিকরন' প্রবন্ধে আধুনিক শিল্পকলার প্রশংসা ও রোম্যান্টিক শিল্পকলার নিন্দা করতে গিয়ে তিনি মন্তব্য করেন -
.
"রোম্যান্টিসিজম বেশ তাড়াতাড়ি জয় করে নিয়েছিলো জনগণকে, যাদের কাছে পুরনো ধ্রুপদী শিল্পকলা কখনোই কোন আবেদন জাগাতে পারে নি ... রোম্যান্টিসিজম ছিল জনপ্রিয় শিল্পকলার আদিরূপ ... যাপিত বাস্তবকে উপভোগ করা প্রকৃত শিল্পসম্ভোগ নয়; তা একরকম প্রতারণা, অথচ উনিশশতক তার মাঝেই ঘোরাফেরা করেছে... আমাদের দুটি নোংরা শব্দ 'সুখদুঃখ'। মধ্যবিত্ত বাঙ্গালির মনে রয়েছে একটি দুরারোগ্য দাদ, যা চুলকোলে পাওয়া যায় বিশেষ আনন্দ। ঐ দাদটির নাম 'সুখদুঃখ'। যে লেখক বাঙ্গালিচিত্তের ঐ দাদটি চুলকানোর যত বেশী প্রতিভা রাখেন তিনিই তত বেশি আদরণীয়।"

(শিল্পকলার বিমানবিকীকরণ, হুমায়ূনআজাদের নির্বাচিত প্রবন্ধ, পৃষ্ঠাঃ ১৯ - ৩২)
.
অর্থাৎ রোম্যান্টিকভাবাপন্ন লেখা জনপ্রিয় - চটুল ধারার লেখা, যা দাদ চুলকানোর মতো আরাম দেয় তার পাঠককে, আর সুখদুঃখের গীত গেয়ে 'যাপিত বাস্তবকে উপভোগ করে' রোম্যান্টিক কবি মূলত প্রতারণা করেন তার পাঠকের সঙ্গে। এই হচ্ছে রোম্যান্টিক কবিতার ব্যাপারে আজাদ সাহেবের মতামত, তার প্রথম প্রবন্ধে।
.
রবীন্দ্রনাথের মূল্যায়ন সংক্রান্ত ঠিক তার পরবর্তী প্রবন্ধটিতে আজাদ সাহেব রবীন্দ্রনাথকে একজন মহান রোম্যান্টিক কবি হিসেবে উপস্থাপন করবার চেষ্টা করেন। তা করতে গিয়ে প্রথমে রোম্যান্টিক কবি ও কবিতাকেও পুনঃমূল্যায়ন করবার প্রয়োজন পড়ে আধুনিক কবিতা ও দর্শনের নিরিখে। আগের প্রবন্ধে রোম্যান্টিক শিল্পমানস ও কবিতাকে উত্তুঙ্গ গালাগাল করবার ঠিক ৬ পাতা পরে ৩৮ নং পৃষ্ঠায় এসে আজাদ সাহেব বলেন -
.
"অস্তিত্ববাদী বহিরস্থিতদের জগত শ্বাসরুদ্ধকর, তা বিবমিষা জাগায়, ঐ জগতে বিরাজ করে না কোন মূল্যবোধ। জীবনানন্দের ভাষা ধার করে বলা যায়, অস্তিত্ববাদী বহিরস্থিতদের জগতে সব মূল্যবোধ পচে পচে শুয়োরের মাংস হয়ে যায়। রোম্যান্টিকদের জগত তেমন নয়; সেখানে বিরাজ করে মানবিকতা।"

("মধ্যাহ্নের অলস গায়কঃ রোম্যান্টিক বহিরস্থিত রবীন্দ্রনাথ", নির্বাচিত প্রবন্ধ, পৃষ্ঠা ৩৩ - ৪৬)
.
লেখার উদ্দেশ্য বদলের সঙ্গে সঙ্গে একই বিষয়ের উপর মতামত গেলো উল্টে! মুহূর্তের মধ্যেই আধুনিক অস্তিত্ববাদী দর্শন ও তার সাহিত্য হয়ে গেলো পচা শুয়োরের মাংস, আর রোম্যান্টিকরা আর প্রতারক দাদখুঁজলির মলম বিক্রেতা না থেকে, হয়ে গেলেন মানবিকতার ধ্বজাধারী!
.
এরকম একই বিষয়ে বিরোধাত্মক কথা আজাদ জায়গায় জায়গায় বলেন। আমার মত হল, অন্যের কাছ থেকে বারংবার আইডিয়া ধার করার ফলাফল হল তার এই দ্বিচারিতা। যে ব্যক্তি বারবার নিজের চিন্তাকে পর্যালোচনা করেন, ফিরে আসেন নিজের কাছে নিজে, নিজের মনের গভীর থেকে উঠে আসা সুরের খোঁজে থাকেন - তার চিন্তার ধারাবাহিকতা পাঠ করা যায়। আফসোস, হুমায়ূন আজাদ সাহেব তার পরিণত বয়সের, এমন কি শেষ বয়সের লেখাগুলিতেও এ কাজটি প্রায় করেন নি। যদি তিনি নিজের অরগানিক চিন্তাভাবনা থেকে লিখতেন, তবে তার মনে থাকতো যাকে - যাদের তিনি প্রতারক দাদখুঁজলির মলম বিক্রেতা বলছেন কিছু আগে, হঠাৎ করেই তারা মানবিকতার রক্ষক হয়ে উঠতে পারে না। এরকম আরও অসংখ্য উদাহরণ দেয়া যাবে। সাম্প্রতিক সময়ে আজাদ সাহেবের যা লেখা পড়ছি, তার মধ্যেই আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখি আপাতত।
.
৩।
হুমায়ূন আজাদ ভাষাবিদ। বাংলাভাষার ওপর ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ঋণ নিয়ে তার একটি প্রবন্ধ পড়লাম কয়েকদিন আগে। তাতে তিনি বলেন -
.
"উনিশ শতকের দ্বিতীয়াংশ থেকে, অনেকের মনে, এমন ধারণা জন্ম নিতে থাকে যে ফোর্ট উইলিয়ামের ভেতর ও বাইরের পণ্ডিতদের ষড়যন্ত্রে বাঙলা ভাষা হয়ে উঠতে থাকে সংস্কৃতের উপনিবেশ; নইলে দেশি - তদ্ভব ও ইসলামি শব্দে বাঙলা হয়ে উঠত একটি চমৎকার ভাষা। খুব ভুল ধারণা এটি; সংস্কৃতের সাহায্য ছাড়া বহু - আঞ্চলিক বাঙলা ভাষা আজকের বাঙলা ভাষা হয়ে উঠতে পারতো না...
বাঙলা ভাষায় বিদেশি শব্দ ঢুকেছে ভাষাসাম্রাজ্যবাদী প্রক্রিয়ায়, তার অধিকাংশই চাপিয়ে দেয়া হয়েছে বাঙলা ভাষার ওপর। সংস্কৃতের কাছে ঋণ করা ছাড়া বাঙলা ভাষার একটি শক্তিশালী কাঠামো বিধিবদ্ধ করা অসম্ভব ..."
.
এই যে সংস্কৃত ভাষার প্রতি হুমায়ূন আজাদের এতো ঋণ, এতো ভালোবাসা, এতো কৃতজ্ঞতা, তা হয়তো তিনি ভাষাবিদ বলেই। তিনি তার অ্যাকাডেমিক ফিল্ড আমাদের চে' ভালো বুঝবেন - এতে সন্দেহ কি? কাজেই সংস্কৃতের প্রতি বাঙলা ভাষার যে আবেগ, হুমায়ূন আজাদ সাহেবের সূত্র ধরে আমরা বাংলাদেশী বাঙ্গালিরা চেষ্টা করতে পারি তা মেনে নেয়ার।
.
কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, তিনি বাঙলা ভাষায় তদ্ভব ও ইসলামি শব্দের অনুপ্রবেশকে যেভাবে দেখছেন একটি 'ভাষাসাম্রাজ্যবাদী' ঔপনিবেশিক প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে, তিনি কখনোই সংস্কৃতকে একটি সাম্রাজ্যবাদী ঔপনিবেশিক ভাষা হিসেবে দেখেন নি। সংস্কৃতর বৈষম্য সৃষ্টিকারী ঐতিহাসিক ভূমিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেন নি। অথচ ইংরেজি - আরবি - ফারসির মতো সংস্কৃতও তো আমাদের আদিভাষা নয়। ইরানী - তুরানি - ইংরেজদের মুখের ভাষার মতো সংস্কৃত নিজেও এসেছে এই বাঙলায়, আর্যদের সঙ্গে। ঢাবির বাঙলা বিভাগের অধ্যাপক মোঃ আজম সাহেবের প্রমিত বাঙলা সমাচারে সংস্কৃত ভাষাটির এই ঔপনিবেশিক চরিত্রের কথা উল্লেখ করা হয়েছে তো বটেই, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের প্রফেসর ডঃ নীরুকুমার চাকমা সাহেবের 'বুদ্ধঃ ধর্ম ও দর্শন" বইয়েও আমরা দেখতে পাই - গৌতম বুদ্ধ নিজেও সংস্কৃত ভাষাকে তার বৌদ্ধ মতবাদ প্রচার প্রসারের ভাষা হিসেবে প্রত্যাখ্যান করে গ্রহণ করছেন লোকপ্রচলিত ব্রাত্যজনের মুখের ভাষা পালিকে। সেও তো আজ দু - আড়াই হাজার বছর আগের ঘটনা।
.
সংস্কৃতকে আড়াইহাজার বছর আগেও একটি বিভেদ সৃষ্টিকারী, ঔপনিবেশিক, ব্রাহ্মণ্যবাদী ভাষা হিসেবে বিচার করা হয়েছে, করা হচ্ছে আজও, নানা রিচুয়ালে, এবং গবেষণায়, কিন্তু আজাদ সাহেবের সংস্কৃতের ঔপনিবেশিক চরিত্র নিয়ে শক্ত কোন অবস্থান - মন্তব্য - বক্তব্যের অভাব তার বাঙলা ভাষার ইতিহাসের ব্যাপারে প্রচলিত ন্যারেশনসমূহের ব্যাপারে তার নৈতিক অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
.
৪।
অন্য কেউ তার প্রতিভার মূল্যায়ন না করায় দুঃখভারাক্রান্ত মনে আজাদ সাহেব নারী বইটি লিখবার পর উল্লেখ করেছিলেন, বাংলাদেশে নারীবাদের জননী নেই, জনক আছে। তিনি নিজেই সে জনক। তিনি আদতে নারীদের কতটুকু সম্মানের চোখে দেখেন, তা নিয়ে আমার সন্দেহ তৈরি হয় তার মৃত্যুর এক বছর আগে, ২০০৩ সালে প্রকাশিত প্রবন্ধের সংকলনে। বইটির উৎসর্গের জায়গায়, কাউকে উৎসর্গ করার বদলে তিনি একটি কবিতা লেখেন। পুরো কবিতা উল্লেখ করে আপনাদের ধৈর্যচ্যুতি ঘটাবো না। যতটুকু দরকার ততটুকু উদ্ধৃত করি -
.
"তোমাকে মিনতি করি কখনো আমাকে তুমি বাংলাদেশের কথা তুলে কষ্ট দিও না।
...
তার ধানক্ষেত এখনো সবুজ, নারীরা এখনও রমণীয়, গাভীরা এখনও দুগ্ধবতী,
কিন্তু প্রিয়তমা, বাংলাদেশের কথা তুমি কখনো আমার কাছে জানতে চেও না;
আমি তা মুহূর্তও সহ্য করতে পারি না, - তার অনেক কারণ আছে।"
.
এই কবিতাটি খেয়াল করুন।
.
নারীদের তিনি রমণীয় বলছেন।
.
হুমায়ূন আজাদ সাহেব যখন নারীদের রমণীয় বলেন - তখন তিনি ঠিক কি মিন করেন, হুমায়ূন আজাদ সাহেবের অসংখ্য যৌন সুড়সুড়ি দেয়া লেখা গদ্য কবিতার সঙ্গে আমরা যারা পরিচিত, আমাদের কী তা বুঝতে সমস্যা হয়?
.
ধরুন, আপনার মনে হল - আজাদ সাহেব রমণীয় বলতে এখানে অভিধানে যা বোঝায় তাই মিন করছেন। রমণের উপযুক্ত কোন সত্ত্বা নয়, বরং সুন্দরী নারী, পত্নী ইত্যাদি।
.
তবুও তো তা নারীদের ব্যাপারে একটা অ্যাসেনশিয়ালিস্ট আর্গুমেন্ট তৈরি করে নারীদের একটা মধ্যযুগীয় ছাঁচে - ছকে আটকে ফেলা হল, যে বাংলাদেশের নারীদের নিয়ে তিনি খুশী আছেন, কারণ তারা এখনও সুন্দরী, সুপত্নি, এবং যৌন আবেদনময়ী , নয়কি? নারীদের এই ছকে ফেলা অ্যাসেনশিয়ালিস্ট আর্গুমেন্ট, কোন শিক্ষিত ব্যক্তি করবেন? যদি তিনি নারীবাদ ও নারীমুক্তির প্রবক্তা তো পরের কথা, নারীদের সাধারণভাবে মানুষ মনে করেন?
.
এবং, চূড়ান্তভাবে - একটু খেয়াল করে দেখুন হুমায়ূন আজাদ তার জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে লেখা এই কবিতায় নারীদের সঙ্গে প্যারালাল তৈরি করছেন কিসের সাথে?
.
নারী - গাভী - শস্যক্ষেত।
গাভী দুধ দেয়, ক্ষেতে ফসল ফলে, নারীরা ...
কি করে নারীরা? হুমায়ূন আজাদের তৈরি প্যারালাল থেকে চিন্তা করুন?
.
বাংলাদেশের নারীবাদের স্বঘোষিত জনক যখন নারীদের গাভী আর ফসলি জমির সঙ্গে তুলনা করেন, তখন তাকে আমরা কি বলব?
.
যাই বলি, এতটুকু স্বীকার করতে তো আপত্তি থাকার কথা নয় যে, হুমায়ূন আজাদ আদতে নারীদের অবজেক্টিফাই করেছেন, মনে থেকে নারীদের কখনো সম্মান করেন নাই, ভোগের বস্তু হিসেবেই বিবেচনা করেছেন, এবং দূরবর্তী দৃষ্টিকোন থেকেও তাকে নারীবাদী বলা যায় না। নারীদের প্রতি শ্রদ্ধা যার আছে, জীবন সায়াহ্নে এসে তিনি নারীদের সঙ্গে গাভী আর শস্যক্ষেতের কেন তুলনা করবেন?
.
রিচার্ড ডকিন্স, 'গড ডিলিউশন' বা 'দা সেলফিশ জীন' এর মতো বই লিখে যিনি দুনিয়ার নাস্তিক - মুক্তমনাদের একটা আলাদা স্কুল অফ থটস প্রতিষ্ঠা করেছেন, এই সেইদিন, এ মাসের ১৯ তারিখ অ্যামেরিকার মুক্তমনা এইথিস্টদের মূল অর্গানাইজেশন 'দা অ্যামেরিকান হিউম্যানিস্ট অ্যাসোসিয়েশন' তাকে হিউম্যানিস্ট অফ দা ইয়ার টাইটেল কেড়ে নিয়ে হল অফ ফেম থেকে ধাক্কা দিয়ে বের করে দিলো ট্রান্সজেন্ডার কমিউনিটি নিয়ে ডকিন্স ইনসেনসিটিভ বক্তব্য রেখেছেন অভিযোগে। ((দেখুন)
.
আমাদের মুক্তমনা কমিউনিটি কী আজাদ সাহেবের বিচার কোনদিন করবেন, তিনি নারীদের দুগ্ধবতী গাভী আর ফসলী শস্যক্ষেতের সঙ্গে তুলনা করেছেন বলে?
.
৫।
ধর্ম নিয়ে আজাদ সাহেবের অনেক বক্তব্য - মন্তব্য বাঙ্গালি মুক্তমনাদের "আলোর দিশা" দেখিয়েছে। আমি তার ধর্ম সংক্রান্ত ডিটেইলস আলোচনায় না গিয়ে রবীন্দ্রনাথের ধর্মবিশ্বাস সংক্রান্ত ওনার একটি বক্তব্য উল্লেখ করি -
.
"রবীন্দ্রনাথের পরমসত্ত্বায় বিশ্বাসের সাথে প্রথাগত ধর্মের বিশেষ মিল নেই; তাঁর বিশ্বাসে প্রথাগত ধর্মের স্বর্গনরক নেই, আবশ্যিক আরাধনা নেই, তাঁর পরমসত্ত্বা সৃষ্টিকে শাস্তি দেয়ার জন্যে ব্যগ্র হয়ে নেই। তিনি পরমসত্ত্বার সাথে পাতিয়েছিলেন এক ব্যক্তিগত সম্পর্ক, যা অনেকটা প্রবল শক্তিমান প্রেমিকের সাথে আবেগকাতর অসহায় প্রেমিকার সম্পর্কের মতো; তাঁর পরমসত্ত্বা অনেকটা ধর্ষকামী - যে সুখ পায় পীড়ন করে, তাঁর পীড়ন মধুময়, আর তিনি নিজে অনেকটাই মর্ষকামী - যিনি সুখ পান পীড়িত হয়ে, পরমসত্ত্বার পীড়নে দলিত দ্রাক্ষার মত তাঁর ভেতর থেকে মধু উৎসারিত হয়। সম্পর্কটি অনেকখানি হৃদয়গত ও শারীরিক।" ("বিশ্বাসের জগত" , নির্বাচিত প্রবন্ধ, ১১৮ পৃষ্ঠা)
.
রবীন্দ্রনাথের ঈশ্বর ছিলেন ধর্ষ-মর্ষকামী! আর এই যৌন তাড়নায় "দলিত দ্রাক্ষার" মতো রবীন্দ্রনাথ গিয়ে মিলিত হতেন তার ঈশ্বরের সঙ্গে!
.
তাত্ত্বিক আলোচনা - সমালোচনার বদলে থিওলজিক্যাল আর্গুমেন্টকে নোংরা - টিটকিরিমূলক প্রহসনে পরিণত করবার হোতা হিসেবে আজাদ সাহেব অমর হয়ে থাকবেন অবশ্যই।


.
৬।
আজাদ সাহেব যেহেতু অনুবাদই করতেন অন্যের লেখা এবং চিন্তা, এবং পরিশেষে তা ক্রেডিট দিয়ে না দিয়ে নিজের নামে চালিয়ে দিতেন, তার ফলাফল এই যে, অনেক ক্ষেত্রেই তার লেখা পড়ে মনে হয়, তিনি যা লিখছেন, না বুঝে লিখছেন।
যেমন সেই প্রথমে উল্লেখকৃত প্রবন্ধ শিল্পকলার বিমান বিকীকরণে রোম্যান্টিক শিল্পকলার সমালোচনা করতে গিয়ে তিনি জার্মান রোম্যান্টিক পিরিয়ডের মিউজিশিয়ান রিচার্ড ওয়েগনারের কম্পোজিশনকে উল্লেখ করেন ব্যাভিচারি অনুভূতির উদ্গাতা হিসেবে। বলেন -
.
" 'ত্রিস্তান ও ইজোলড' এ (ওয়েগনারের একটি বিখ্যাত কম্পজিশান) ওয়েগনার ঢেলে দিয়েছিলেন মাথিলডা ওয়েসেনডঙ্কের সাথে তার ব্যাভিচারকে। এ সঙ্গীত উপভোগ করার জন্যে আমরাও কতিপয় ঘণ্টার জন্যে হয়ে উঠি অস্পষ্টভাবে ব্যাভিচারী। ঐ সঙ্গীত আমাদের কাঁদায়, কাঁপায়, ইন্দ্রিয়াতুরভাবে বিগলিত করে। বিটোফেন থেকে ওয়েগনার পর্যন্ত সব সঙ্গীতই মেলোড্রামা।"
.
একটু চিন্তা করে দেখুন, রোম্যান্টিক পিরিয়ডের মিউজিশিয়ান ওয়েগনারের একটি মহান কম্পজিশানকে তিনি উল্লেখ করছেন ওয়েগনারের কোন মিস্ট্রেসের সঙ্গে ব্যাভিচারিক অনুভূতির বহিপ্রকাশ হিসেবে। শুধু তাই নই, তিনি দাবী করছেন, আমরা যখন ওয়েগনারের এই কম্পোজিশন শুনি, আমাদেরও নাকি তা কাঁপিয়ে তাতিয়ে ব্যাভিচারি অনুভূতির স্বাদ নিতে বাধ্য করে! কি জঘন্য উৎকট যুক্তি!
.
সঙ্গীত বা চিত্রকলার মতো বিষয়ে আজাদ সাহেবের গতায়েত বোঝার জন্যে রাজু আলাউদ্দিন সাহেবের নেয়া তার দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে গান - চিত্রকলার ব্যাপারে হুমায়ূন আজাদ সাহেবের কিছু মূল্যায়ন শুনি।
.
গানের ব্যাপারে আজাদ সাহেব বলেন - "গান শোনা অসুস্থতার লক্ষণ।"
.
চিত্রকলার ব্যাপারে তার মন্তব্য - "চিত্রকলা মননকে ধারণ করতে পারে না। পিকাসো বহু ছবি এঁকেছেন, অসাধারণ বলে গণ্য, বিপুল পরিমাণ দাম এবং আমি হাসি কেন একটি ছবির দাম এতো হতে পারে? কি দিয়ে এটি বিচার হয়? ৮০ মিলিয়ন যদি একটি ছবির দাম হয়, তাহলে বুঝতে হবে এর মধ্যে কোন গোলমাল আছে।"

(দুটো মন্তব্যেরই সূত্র - রাজু আলাউদ্দিন, আলাপচারিতাঃ রাজনীতি, সংস্কৃতি, সমাজ ও সাহিত্য বিষয়ক সাক্ষাৎকার, পাঠক সমাবেশ, পৃষ্ঠাঃ ৪১২)
.
তার স্বগতোক্তিতেই বোঝা গেলো সাহিত্য ছাড়া গান - আর চিত্রকলা তিনি খুব একটা বুঝতেন না।
.
এখন, ওয়েগনারের রোম্যান্টিক, বা ব্যক্তিগত অনুভূতি তাড়িত কম্পোজিশনের ব্যাপারে আজাদ সাহেবের মূল্যায়ন যদি এই হয়ে থাকে যে তা ব্যাভিচারি অনুভূতির উদ্গাতা, আমাদের ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ব্যাপারে তিনি কি মতামত দেবেন? ওতে তো কোন বাঁধা ছকে বাজানোর উপায় নেই। নেই কোন স্টাফ নোটেশন। ব্যক্তিগত আবেগের ওপর ভর করেই শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের পরিবেশক ইম্প্রোভাইজ করে করে একটি পরিবেশন তৈরি করে। ব্যাস, বাতিল তাহলে, আজাদ সাহেবের যুক্তি ধরে, আমাদের শাস্ত্রীয় সঙ্গীত? কারণ তা ব্যক্তিগত অনুভূতিজাত?
.
অপরদিকে - আমাদের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে যত ছোট - বড় খেয়ালের বন্দেস, বা লিরিক, তার বড় এক অংশ লিখিত হয়েছে রাধা - কৃষ্ণের প্রেমালেখ্যের ওপর ভিত্তি করে।
.
যেমন, আমার সবচে প্রিয় রাগগুলির একটি, রাগ কিরওয়ানির একটি বন্দেস -
.
"তোরে বিনা মোহে চ্যায়ন নেহি, ব্রিজ কে নান্দলাল..."
হে ব্রজের নন্দলাল কৃষ্ণ, তোমায় ছাড়া আমার চোখের নিঁদ উধাও হয়ে গেছে...
.
এ কি কেবল ব্যাভিচারি আকাঙ্ক্ষা? রাধার, যে গাইছে তার, এবং যে শুনছে তারও?
.
একই সঙ্গে মিরার যত ভজন আছে - কৃষ্ণপ্রেমে মাতোয়ারা হয়ে, তারসবই আমরা ব্যাভিচারী দৃষ্টিভঙ্গীতে দেখবো, বিচার করবো? যখন গাইবো, বা শুনবো তা আমাদের "কাঁপাবে" যৌন তাড়নায়?
.
উৎকট যুক্তি!
.
৭।
হুমায়ূন আজাদ সাহেবের পলিটিকাল কমেন্ট্রী সাহসিকতাপূর্ণ। ধর্মীয় আচার সর্বস্বতার বিরুদ্ধে তার বক্তব্যও গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু ওসব বক্তব্য রাখতে সাহস থাকা লাগে হয়তো, বুদ্ধিজীবী হওয়া লাগে না। তার রাজনৈতিক বিশ্লেষণ ক্ষুরধার নয়। দূরদর্শী তো নয়ই।
.
'এই বাংলার সক্রেটিস' নামক আত্মজৈবনিক সাক্ষাৎকার গ্রন্থে তিনি বলেন -
.
" একটা মেকিয়াভিলীয় ভাবনাও আমার মাঝেমাঝে মনে আসে - আওয়ামিলিগ তো এক সময় জামাতকে নিয়ে রাজনীতি করেছে, তাদের উচিৎ ছিল জামাতকে সঙ্গে রেখে নিষ্ক্রিয় করা। জামাতকে যদি আওয়ামিলিগ সঙ্গে রাখতে পারতো, তাহলে জামাত এতো ক্ষতিকর হয়ে উঠতে পারতো না। জামাত বিএনপিকে জামাতে পরিণত করেছে, কিন্তু আওয়ামিলিগকে জামাতে পরিণত করতে পারতো না। আওয়ামিলিগ কোন মহা প্রগতিশীল দল নয়, জামাতকে সঙ্গে রেখে তাদের নিষ্ক্রিয় করা উচিৎ ছিল আওয়ামিলিগের।

হাসিনার আওয়ামী লিগ তো ক্ষমতায় এসেছিলো জামাতের সাহায্যেই - আমি সমালোচনা করি নি। বরং ব্যাপারটিকে প্রশংসা করে আজকের কাগজে দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখেছিলাম। ... আমার তো মনে হয় জামাত ক্ষমতায় আসতে পারবে না কখনো, তবে জামাতকে সঙ্গে না নিয়ে প্রধান দল দুটোও ক্ষমতায় আসতে পারবে না।" (জামাল উদ্দিন / শরীফা বুলবুল সম্পাদিত এই বাংলার সক্রেটিস, পৃষ্ঠা ৮০)
.
অর্থাৎ, হুমায়ূন আজাদ সাহেবের ধারণা ছিল আওয়ামিলিগ আর জামাতের একসঙ্গে রাজনীতি করা উচিৎ ছিল, কেননা জামাত ছাড়া আওয়ামিলিগ কখনো এককভাবে সরকার গঠন করতে পারবে না, এবং আওয়ামিলিগ তেমন কোন প্রগতিশীল দলও নয়। আমাদের মনে রাখতে হবে, এই মতামত দিচ্ছেন হুমায়ূন আজাদ সাহেব ২০০৩ সালে বসে। তার ১০ বছরের মাথায়ই বাংলাদেশে জামাতের রাজনীতি প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যায়। আওয়ামিলিগ এখনও ক্ষমতায়, কিন্তু তার জামাতের সাহায্য কখনো লাগে নি আর, ক্ষমতায় থাকতে। এই হচ্ছে মৃত্যুর আগের বছরে হুমায়ূন আজাদ সাহেবের পলিটিকাল দূরদৃষ্টি।
.
৮।
আজাদ সাহেবের প্রাণের ওপর যে হামলা হয়েছে - তার মনেপ্রাণে বিরোধিতা করি। যদি ঘাতকদের হামলায় তিনি আক্রান্ত না হতেন, তবে বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম নিজেরা ওনার লেখা পড়েই তার চিন্তার এতো স্ববিরোধিতা, অসততা, অসৌজন্যতা অনুধাবন করে সেভাবে তার মূল্যায়ন করতো। এখন আর সেই সুযোগটা নেই। নির্মোহ বিশ্লেষণের বদলে তার ব্যাপারে আমরা সেন্টিমেন্টাল জাজমেন্ট করি বেশি।
.
তিনি পাকিস্তান সৃষ্টির পর পাকিস্তান জাতীয়তাবাদী সাহিত্যকে সাম্প্রদায়িক সাহিত্য বলে ভূষিত করেছেন, আবার সে সাম্প্রদায়িক সাহিত্যের কর্ণধার সৈয়দ আলী আহসানের সঙ্গে সখ্য রেখে চট্টগ্রাম ইউনিভার্সিটিতে চাকরী নিয়েছেন, সেখান থেকে তার রেফারেন্সে জাহাঙ্গীর নগরে এসেছেন। শেষ জীবনে যখন সৈয়দ আলী আহসান তার কোন ক্ষতি করতে পারবে না - তার নামে উত্তুঙ্গ বদনাম করেছেন। ভালো হতো যদি বাঙলা সাহিত্য থেকে রবীন্দ্রনাথকে বাদ দিতে চাওয়া আলী আহসান সাহেবের সঙ্গে ওনার প্রথম থেকেই কোন সখ্য না থাকতো।
.
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ওনার চাকরী হয় সিন্ডিকেটে ডঃ আহমদ শরীফ ছিলেন বলে। ডঃ আহমদ শরীফ বাংলাদেশের আদি নাস্তিকদের একজন, এবং একজন প্রথিতযশা সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী। কিন্তু তারপরেও সুলতানি আমলের ও মধ্যযুগের সাহিত্যকে ব্রাম্মন্যবাদি ঐতিহাসিকরা যে বাঙলা সাহিত্যের অন্ধকার যুগ বলে ঘোষণা করেছে, '৪৭ এ বঙ্গভঙ্গের পেছনে পূর্ববঙ্গের কৌম মুসলিম সমাজকে দায়ী করেছে - এসমস্ত ব্রাম্মন্যবাদি প্রোপাগান্ডার বিরুদ্ধে ডঃ শরীফ ছিলেন বজ্রের মতো কঠোর। হুমায়ূন আজাদ সাহেব তার গুরুর পদাঙ্ক অনুসরণ করেন নি, তা বলাই বাহুল্য।
.
যে অসততার চর্চা তার চিন্তায় ও ব্যক্তিজীবনে তিনি করে গেছেন তার জের আমাদের টানতে হবে অতি দীর্ঘদিন ধরে। বেঁচে থাকলে হিচেন্স যেমন ইরাক যুদ্ধের সাপোর্ট করে, স্যাম হ্যারিস যেভাবে হোয়াইট সুপ্রিমিস্টদের সাপোর্ট নিয়ে, বা ডকিন্স যেভাবে ট্রান্স কমিউনিটিকে নিয়ে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে আজ অপরাধীর খাতায় নাম লিখিয়েছেন, তেমনভাবেই কিছু একটা বের হয়ে যেতো আজাদ সাহেবের ব্যাপারেও যাতে তাকে আবেগ বাদ দিয়ে নির্মোহ পাঠ করে গ্রহণ বা বর্জনের সিদ্ধান্ত নেয়া যেত। এখন আর সে কাজ সহজ নয়। তবুও, বাংলাদেশে সেকুলার - মৌলবাদীর সমস্যাসঙ্কুল বাইনারি তৈরিতে সবচে শক্তিশালী ভূমিকা রাখা একজন চিন্তক হিসেবে আমরা স্মরণে রাখবো, এবং পাঠ করবো হুমায়ূন আজাদ সাহেবকে। হুমায়ূন আজাদ সেই মাজার, যা আমাদের ভাঙ্গতেই হবে, বাংলাদেশের চিন্তার ইতিহাসকে আরও পরিচ্ছন্নতার সঙ্গে পাঠের নিমিত্তে।
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে জানুয়ারি, ২০২২ দুপুর ২:২৭
৫টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমার কিছু ভুল!

লিখেছেন মোঃ খালিদ সাইফুল্লাহ্‌, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:৪৮

১। ফ্লাস্কে চা থাকে। চা খেতে টেবিলে চলে গেলাম। কাপে দুধ-চিনি নিয়ে পাশে থাকা ফ্লাস্ক না নিয়ে জগ নিয়ে পানি ঢেলে দিলাম। ভাবছিলাম এখন কি করতে হবে? হুঁশ ফিরে এল।... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতিঃ ব্যাঙের বিয়েতে নামবে বৃষ্টি ...

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:০০



অনেক দিন আগে একটা গল্প পড়েছিলাম। গল্পটা ছিল অনেক এই রকম যে চারিদিকে প্রচন্ড গরম। বৃষ্টির নাম নিশানা নেই। ফসলের মাঠ পানি নেই খাল বিল শুকিয়ে যাচ্ছে। এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশি ভাবনা ও একটা সত্য ঘটনা

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:১৭


আমার জীবনের একাংশ জুড়ে আছে; আমি চলচ্চিত্রাভিনেতা। বাংলাদেশেই প্রায় ৩০০-র মত ছবিতে অভিনয় করেছি। আমি খুব বেছে বেছে ভাল গল্পের ভাল ছবিতে কাজ করার চেষ্টা করতাম। বাংলাদেশের প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাকি চাহিয়া লজ্জা দিবেন না ********************

লিখেছেন মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:৩৫

যখন প্রথম পড়তে শিখেছি তখন যেখানেই কোন লেখা পেতাম পড়ার চেষ্টা করতাম। সেই সময় দোকানে কোন কিছু কিনতে গেলে সেই দোকানের লেখাগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়তাম। সচরাচর দোকানে যে তিনটি বাক্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×