১।
"মুসলিম মাত্রই কমবেশী জঙ্গি, তালেবান। মধ্যযুগীয় বর্বর। অনগ্রসর, অনাধুনিক। মুসলিম মাত্রই নারীবিদ্বেষী। তারা জেন্নাতে যেতে চায় - কারণ তাদের ৭২টা হুর, এবং অগণিত গেলমান দরকার। আর দুনিয়ায় দরকার চারটা বৌ, আর যতগুলি দাসীকে সম্ভব - নিয়ে বিছানায় যাওয়া।"
এই হচ্ছে মুসলিমদের পরিচয়, অনলাইনে যারা 'যৌক্তিকভাবে' ইসলামের সমালোচনার দাবী করেন - এমন অমুসলিমদের কাছে। আমি দীর্ঘদিন ধরে মুসলিমদের এই রিপ্রেজেন্টেশন দেখে আসছি ব্লগে, ফেসবুকে। কষ্ট লাগে, নিজের বা নিজের ফেইথের জন্যে না - যারা পরিশ্রম করে মুসলিমদের আইডেন্টিটি নিয়ে ক্যারিকেচার করার জন্যে কসরত করছেন, তাদের জন্য। রিপ্রেজেন্টেশন অফ মুসলিমস, বা কাভারিং ইসলাম - এ সমস্ত শিরোনামে অতীতে অনেক অ্যাকাডেমিক কাজ হয়েছে। তাতে ইসলাম এবং মুসলিম জনগোষ্ঠীর এ ধরণের একপেশে রিপ্রেজেন্টেশনকে ইসলামোফোবিক, স্টেরিওটিপিক্যাল রিপ্রেজেন্টেশন বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
আমি আজ সে তাত্ত্বিক আলোচনায় যাবো না। এ লেখায় আমি চেষ্টা করবো, একজন মুসলিম হিসেবে আমি যে সাইকোলোজি নিয়ে বেড়ে উঠেছি, তা ব্যাখ্যা করতে। নাস্তিকরা কেন নাস্তিক - তার ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ নিয়ে প্রচুর লেখা আছে। তেমনি আমলি জীবন কাটালে পরকালে কি লাভ হবে - এ নিয়েও প্রচুর পরিমাণ লেখা অনলাইনে পাওয়া যায়। কিন্তু একজন প্রাকটিসিং মুসলিম কেন প্রাকটিসিং মুসলিম, নিজের মুসলিম আইডেনটিটি নিয়ে কনশাস, এমন একজন প্রাকটিসিং মুসলিমের চিন্তা চেতনা কীভাবে কাজ করে, তার ধর্মবিশ্বাস তার জীবনে কি কি সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম প্রভাব ফেলে - এমন লেখা অনলাইনে আমি কম পেয়েছি। কাজেই, আমার এ লেখা একজন প্রাকটিসিং মুসলিমের সাইকোলজির ভেতরে ঢোকার জন্যে এক ইউনিক সুযোগ করে দেবে পাঠককে।
উল্লেখ করে রাখি, খৃষ্টধর্মে বিশ্বাসীদের সাইকোলজি বোঝার জন্যে সোরেন কিয়েরকগার্দের থেয়িস্টিক এক্সিস্টেনশিয়ালিস্ট ফিলোসফি দেখা যায়। হিন্দু সাইকোলজি বুঝতে শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসের জীবনী, বা আরও সাম্প্রতিক প্রাকটিসিং হিন্দু সাইকোলজি বুঝতে ডঃ শশী থারুরের লেখা হোয়াই আই অ্যাম এ হিন্দু পড়তে পারেন। বৌদ্ধ ধর্মে বিশ্বাসীর সাইকোলজি কীভাবে গড়ে ওঠে - সেটার ব্যাপারে স্লাইট হিন্ট পাবেন হেরমেন হেসের সিদ্ধার্থ বইতে। বাংলায় বুদ্ধিস্ট সাইকোলজির ব্যাখ্যায় প্রফেসর নিরুকুমার চাকমার লেখা পড়েও আমি উপকৃত হয়েছি।
২।
গতকাল, আমি টানা চল্লিশ দিন (ফজর বাদে) প্রথম তাকবিরে জামাতের সঙ্গে নামাজ আদায় করে শেষ করলাম। কাজটা সহজ ছিল না। একে তো মসজিদে গিয়ে বা জামাতে নামাজ পড়বার ব্যাপারে আমাদের আগ্রহ কম (আমি অন্তত এ বছরের আগে প্রায় ১২ বছর নিয়মিত ছিলাম না জামাতের ব্যাপারে)। তারপর - দিনে চারবার প্রথম তাকবিরে নামাজ ধরতে পারা, তাও টানা চল্লিশ দিন - আরও জটিল এক কাজ। সরকারের করোনা সচেতনতামূলক নির্দেশনা শুনে রমজান মাসে পুরো একমাস বাসায় থেকে নামাজ পড়েছি, এমনকি জুমাও ছুটেছে। ভেতরে তখন থেকেই একটা আফসোস কাজ করা শুরু করে, বরকতের একটা মাস চলে গেলো - কাজে লাগাতে পারলাম না সেভাবে। আমাদের পাশের বাড়ির বাড়িওয়ালা চাচা বুড়ো মানুষ, উনি দেখতাম প্রতিদিন মসজিদে যাচ্ছেন। তারাবীও আদায় করেছিলেন। আমি উনাকে অব্জারভ করলাম। ভাবলাম, বয়স্ক মানুষ যদি করোনার মধ্যে প্রপার নিরাপত্তা নিয়ে, সতর্কতার সঙ্গে নিয়মিত মসজিদে যেতে পারেন, আমি কেন নই? ঈদুল ফিতরের পরের দিন থেকে টানা চল্লিশ দিন প্রথমে জামাতে নামাজ পড়া নিশ্চিত করলাম (ফজর বাদে, ফজর তখনও ঘরেই পড়েছি)। তারপর সিদ্ধান্ত নিলাম চ্যালেঞ্জটা একধাপ এগিয়ে নেবার। তাকবিরে উলা, বা প্রথম তাকবিরে, ইমামের তাকবিরের সঙ্গে নামাজ ধরার অভ্যাস করা। প্রথমে একদিন - দুদিন করে প্রতি ওয়াক্তের নামাজ প্রথম তাকবিরে ধরতে পারছিলাম, তারপর প্রথম তাকবির ছুটে যাচ্ছিল। তারপর একটানা ছ'দিন তাকবিরে উলার সঙ্গে নামাজ পড়লাম। সে স্ট্রেক ছুটে গেলো টানা বৃষ্টিতে একদিন পুরা মহল্লা তলিয়ে গেলে। তারপরদিন থেকে আবারো শুরু করলে এবার টানা আটদিনের মাথায় স্ট্রেক ছুটে গেলো এক আত্মীয়র বাসা থেকে রাতে ফিরতে গিয়ে, জ্যামে আটকা পড়ে। স্ত্রী সাথে ছিলেন। তাকে একা বাহনে রেখে গিয়ে জামাতে নামাজ পড়তে পারি নি। আল্লাহ এসমস্ত ওজরখাহি ওভারলুক করেন নিশ্চয়ই। কিন্তু আমার ইচ্ছা ছিল কোন ওজর না দিয়ে ব্যাপারটাকে অভ্যাসে পরিণত করবার। তারপর, টানা প্রচেষ্টায়, আলহামদুলিল্লাহ, গতকাল, ২৫ অগাস্ট ২০২১, এশার নামাজ পড়ার মাধ্যমে জোহর - আসর - মাগরিব - এশা এই ওয়াক্তের নামাজগুলো টানা চল্লিশদিন জামাতে, প্রথম তাকবিরের সঙ্গে পড়লাম।
এই পাগলামো কেন? এতে কি লাভ হয়েছে আমার? কি পেয়েছি?
এটাই সংক্ষেপে তুলে ধরার ইচ্ছা এই লেখায়।
৩।
প্রথম ইস্যুটা এভাবে উত্থাপন করি। ইসলাম বা মুসলিমদের ফেইথ সম্পর্কে জানতে আগ্রহী এমন কারো সঙ্গে যদি আমার কখনো আলাপ হয়, তখন হয়তো তার মনে প্রথম প্রশ্নটা এরকম হবে - কেন একজন খোদায় বিশ্বাস করা প্রয়োজন? বা আমার খোদার সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্কটা কিরকম?
এই বেসিক প্রশ্নের উত্তর হবে, আমার খোদা, বা আমার খোদার উপর আমার বিশ্বাস / ফেইথ, আমার রুহের বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট।
ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করতে অতীত জীবনের এক ঘটনার সাহায্য নিই।
আজ থেকে প্রায় দশবছর আগে এক বিকেলে, টিএসসির ক্যাফেটেরিয়ায় বসে আছি আমার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চলচিত্র সংসদের বন্ধুদের সাথে। চলচিত্র সংসদের ছেলেপেলে আমরা সবাই ছিলাম কমবেশী আঁতেল কিসিমের। তাদের মধ্যে একজন হার্টব্রেকের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। সাম্প্রতিক সময়ে ওর গার্লফ্রেন্ডের সঙ্গে ওর ছাড়াছাড়ি হয়ে গিয়েছিল। ওর কষ্ট আমরা অনুভব করতে পারছিলাম সামনে বসে। বস্তুত, ব্রেকআপ কষ্টের অভিজ্ঞতাই। যে বা যারা এর ভেতর দিয়ে গিয়েছেন, তাদের জানা থাকার কথা। গলাকাটা মুরগির মতো তড়পাতে হয়। রাত যত গভীর হয়, ততো দমবন্ধ হয়ে আসে। প্রিয় মানুষের চেহারা, স্মৃতি চারদিক থেকে ঘিরে ধরে।
আমার বন্ধু হঠাৎ বলে উঠলো - মানুষ কতো কিছু আবিষ্কার করে ফেলল, পারলো না কেবল স্মৃতির ব্রাশফায়ার থেকে হৃদয়কে বাঁচাতে হৃদয়ের জন্যে এক বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট আবিষ্কার করতে।
আমি প্রচণ্ড ধাক্কা খেয়েছিলাম ওর কথাটা শুনে।
শুধু মানবীয় প্রেম না; হতাশা, বঞ্চনা, না পাওয়ার নানামুখী বেদনা আমাদের প্রায়ই ঘিরে ধরে। পড়াশোনা, চাকুরি, পারিবারিক নানা ইস্যু সংক্রান্ত ব্যারথতা আমাদের অন্তরকে প্রায়ই ঘিরে ধরে। নিজেকে প্রচণ্ড একা মনে হয়। মনে হয় যাওয়ার কোন জায়গা নেই।
সত্য কথা হচ্ছে, যেকোনো হতাশার কানাগলি থেকে আল্টিমেটলি মানুষের নিজেকেই উঠে আসতে হয়। কিন্তু অন্তরে সে জোর জোগানোটা একটা কঠিন কাজ। একজন প্র্যাকটিসিং মুসলিম হিসেবে আমার সবচে বড় শক্তির জায়গা আমার রুহের মধ্যে দেদীপ্যমান নূরে খোদা। খোদার প্রতি আমার বিশ্বাস আমার রুহকে সর্বদা আচ্ছন্ন করে রাখে। যত বড় বিপদই হোক না কেন, আমি যখন সেজদায় মাথা ঝুঁকাই - যখন আমার চোখ থেকে পানি ঝরে টুপটুপ করে আমার আসমানের দিকে তুলে ধরা দুই হাতে পড়তে থাকে, আমি অনুভব করতে পারি, আমার অন্তর, আমার কলব, আমার রুহ প্রোটেকটেড। আমার খোদা আমার রুহের বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট হয়ে দাঁড়িয়ে গেছেন সমস্ত হতাশা আর কষ্টের মাঝখানে। সেই আনন্দে জারিত হয়ে আমি যখন জায়নামাজ থেকে উঠে দাঁড়াই, কসম খোদার, আমি আর সেই আগের দুর্বল মানুষটা থাকি না।
খাজা আজিজুল হাসান মজযুব রাহিমাহুমুল্লাহ যেমন বলেন -
"মুঝে দোস্ত ছোড় দে সব, কোয়ি মেহেরবা না পুঁছে
মুঝে মেরা রব হ্যায় কাফি, চাহে কুল জাহা না পুঁছে
সব রোজ ম্যায়হু মাজযুব, অউর ইয়াদ আপনি রবকি
মুঝে কোয়ি হা না পুঁছে, মুঝে কোয়ি হাঁ না পুঁছে ..."
৪।
আমার খোদার উপর বিশ্বাস, আমার অন্তরে প্লাসিবো এফেক্টের মতো কাজ করে।
প্লাসিবো এফেক্ট কি, তা অনেকে জানেন। যারা নতুন শুনছেন শব্দটা আজকে, তাদের উদ্দেশ্যে সহজে যদি বলি, ঔষধ খাওয়ার পর আমাদের ভেতরে তার সাইকোলজিক্যাল যে এফেক্টটা তৈরি হয়, সেটা প্লাসিবো এফেক্ট। হোমিওপ্যাথি ট্রিটমেন্টের একটা বড় অংশ জুড়ে আছে এই প্লাসিবো ইফেক্ট। এমনকি অ্যালোপেথিতেও এই প্লাসিবো এফেক্টের কাজ আছে। যে ট্যাবলেট আমরা খাই, তা কোন কোন কম্পোনেন্টে তৈরি, তা আম আদমি হিসেবে আমাদের জানা নেই। তা আমাদের অসুস্থ শরীরের কোথায় কোথায় গিয়ে কাজ করবে, তাও আমরা জানি না। কিন্তু আমাদের ভেতরে একটা বিশ্বাস জন্মায় - আমার কাজ আমি করেছি, ঔষধ খেয়েছি, এখন ধীরে ধীরে আমি সুস্থ হয়ে উঠবো ইনশাআল্লাহ।
খোদার উপর বিশ্বাস আমার ভেতরে এমন একটা ইতিবাচক মানসিকতা তৈরি করে। অবস্থা যতই সঙ্গিন হোক, যত বিপদের মধ্যে আমি থাকি, মাথার ওপর আকাশ যতই কালো মেঘে ঘেরা হোক, যতই তাতে মুহুর্মুহু চোখ ঝলসানো বজ্রপাত হোক - আমি নিশ্চিত জানি, এর পেছনে আমার খোদা আছেন। 'ওয়াসিয়া কুরসিয়ু হুস সামাওয়াতি ওয়াল আরদ' - তার কুরসি সমগ্র বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে ঘিরে, আয়াতুল কুরসিতে যেমনটা আমরা পড়ি। বা সূরা নূরের ৩৫ তম আয়াত, 'আল্লাহু নুরুস সামাওয়াতি ওয়াল আরদ'। খোদার নূর আসমান জমিন, জেন্নাত দুনিয়া সবকিছু ঘিরে আছে। আমি তো তার নূরের বাইরে নই কখনো, কোনদিন। এক মুহূর্ত। আমার জীবন অন্ধকার হতে পারে, কিন্তু যে অসীম সমুদ্রের মতো খোদায়ী কনশ্যান্স প্রবাহিত হচ্ছে অনাদি থেকে অনন্ত পর্যন্ত - স্রেফ একবার তাতে ডুব দিয়ে উঠতে পারলে আমি আর আগের পঙ্কিল মানুষটি নই।
বিষয় হচ্ছে, ইতিবাচকতার চর্চা। একজন বিশ্বাসী মানুষ হিসেবে আমার মনে সবসময়, আলহামদুলিল্লাহ, পৃথিবী দেখার এই ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গী থাকে। জীবনে ব্যারথতা এসেছে, যা চেয়েছি তা সরাসরি পাই নি, ধৈর্য ধরেছি, নিজেকে সান্ত্বনা দিয়েছি - যা আসবে ভবিষ্যতে, সেটা আল্লাহর ইচ্ছায় আসবে, এবং তাতেই আমার মঙ্গল। আজকে যখন এই লেখাটা টাইপ করছি, কসম খোদার, পরিকল্পনাকারী হিসেবে খোদার চেয়ে উত্তম এবং দয়াশীল আমি কাউকে পাই নি। কথা হচ্ছে, অন্তরে সে সচেতনতাটা থাকতে হয়, তাহলেই পৃথিবীর রোজকার নিয়মের বেড়াজালে কি ঐশ্বরিক মন্ত্রজাল বেছানো আছে, তা অনুভব করা সম্ভব হয়।
এটা সত্য, পৃথিবীতে শ্রেণী বৈষম্য থাকবেই। গরীব থাকবেই, মধ্যবিত্ত থাকবেই, ধনী থাকবেই। জালেম - মজলুম থাকবেই। কিন্তু সর্বাবস্থায় জীবনের ব্যাপারে একটা কৃতজ্ঞ, ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গী তৈরি, অত্যাচারের জবাবে অত্যাচার না করা, কষ্টের জবাবে সবর করার শিক্ষা - কলবে যার খোদা থাকে, তার জন্যে সহজ হয়ে যায়।
৫।
আমার ধর্মকে আমি প্রচণ্ডরকমের মেডিটেটিভ ধর্ম হিসেবে পেয়েছি। আমরা বুঝি না, কিন্তু সত্য হচ্ছে এই যে - দিনে পাঁচবার মেডিটেটিভ মাইন্ডে খোদার সামনে দাঁড়ানোটা আমাদের নিজেকে মুসলিম দাবী করার অন্যতম চাবিকাঠী। আজকাল মানুষ পয়সা খরচ করে মাইন্ডফুলনেস মেডিটেশন শেখে, অথচ কি আফসোস - মাইন্ডফুলনেস থাকাটা, অন্তত দিনে পাঁচবার বাধ্যগতভাবে জায়নামাজে দাঁড়িয়ে বলা - 'খোদা, আমি কৃতজ্ঞ আপনার প্রতি, আপনি দয়ার সাগর, একদিন আপনার সামনে দাঁড়িয়ে আমার কৃতকর্মের হিসাব আমাকে দেয়া লাগবে, কাজেই আমাকে সরল - সত্য পথের ওপর এস্তেকামত/ দৃঢ়তা দিন, যে পথে আমার পূর্বের সরল সোজা সৎ মানুষ গুলো চলে গিয়েছে, এবং সফলকাম হয়ে গিয়েছে; আপনার অসন্তুষ্টির পথে যেন আমি কস্মিনকালেও না ঝুঁকি।' আমার মুসলিম পরিচয়ের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এবং জায়নামাজে দাঁড়িয়ে এগুলো শুধু বলার জন্যে বলা না, বরং মিন করে বলা, বিশ্বাস করে বলাও দায়িত্ব। শুধুমাত্র তখনই একজন বিশ্বাসীর জীবন বদলাবে। তখনই কেবল তার পরিবর্তন স্বচক্ষে দেখা যাবে।
মানুষের কনশ্যান্স কীভাবে পরিবর্তিত হচ্ছে ২১ শতকে, ভেবে দেখা জরুরী। বিশেষত এই সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে, যখন আমাদের মস্তিষ্ককে বিশেষভাবে বেনিয়াবৃত্তির গ্রাহক হিসেবে মডিফাই করা হচ্ছে। ফেসবুক - ইউটিউব - ইন্সটাগ্রামে সারাদিন অপ্রয়োজনীয় বিজ্ঞাপন আসতে থাকে। আপনার প্রয়োজন ছাড়া আপনি সারাদিন ভার্চুয়াল শপিং মলে ঘুরতে থাকেন। শুধু জিনিসপত্র না, আইডিয়ার বাজারেও পরিণত হয়েছে সোশ্যাল মিডিয়া সাইটগুলো। ভূ - রাজনৈতিক যে সমস্ত ইস্যুতে আপনার কোন লাভলোকসান নেই, সেখানেও আপনি প্রোপ্যাগান্ডা ভিডিও বা পোস্টের জেরে পক্ষ ধারণ করছেন। অনলাইনে ঝগড়া ঝাঁটি করছেন। নিজের জাতিসত্ত্বা, নিজের ধর্মকে ঘৃণা করছেন। নিজেকে প্রতিনিয়ত প্রাসঙ্গিক রাখা লাগছে ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে দিয়ে। মানুষের লাইক - কমেন্ট - ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট - ফলোয়ার কামিয়ে। যথেষ্ট অ্যাটেনশন না পেলে আপনার একা লাগছে। লাইফ মিনিংলেস লাগছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা এমন সব মানুষের জীবন - ছবি - স্ট্যাটাস সার্ফ করে বেড়াচ্ছেন, যার - যাদের জীবন আপনার জীবনে তেমন কোন প্রাসঙ্গিকতাই রাখে না। সবচে বড় কথা, সোশ্যাল মিডিয়ায় আলোচনাগুলো ঝোঁকের ওপর চলে। যেমন কিছুদিন এক ইস্যু, তারপর আরেক ইস্যু। কখনো চঞ্চল চৌধুরীর মায়ের ছবিতে সাম্প্রদায়িক মন্তব্য, তারপর পরিমনি, তারপর তালেবান। আপনার নিজেকে প্রাসঙ্গিক করে রাখতে হলে সব বিষয়ে মন্তব্য করে বেড়াতে হয়। নতুবা মানুষ ভুলে যায় আপনাকে। এভাবে একজন মানুষের পক্ষে নিজের জীবনের একটা স্থির, শক্ত, শক্তিশালী দর্শন - বক্তব্য তৈরি করার প্রক্রিয়া ব্যহত হয়। আপনি স্রেফ ইলেকট্রনিক ইনফরমেশনের ফ্লোর আরেকটা ওয়েভে পরিণত হন।
এই সমাজ বাস্তবতায় আমার ফেইথ, আমার খোদার সামনে দাঁড়ানো, খোদার প্রতি বিশ্বাস, খোদার প্রতি আমার ভালোবাসা আমার জীবনের নোঙ্গর, আমার জীবনের খুঁটি। তা আমাকে সময়ে সময়ে থামিয়ে দেয়। নিজের লাইফকে রিভিজিট করে প্রয়োজনীয় চেইঞ্জ আনতে উদ্বুদ্ধ করে।
৬।
আমার কি দুনিয়ায় চারটা স্ত্রী, বা জেন্নাতে ৭২টা হুর খুব দরকার?
আমি যেটা জানি, আল্লাহর কাছে আমার যুবক বয়স থেকে প্রার্থনা ছিল আমার জন্যে একজন কম্পিটেন্ট জীবনসঙ্গীর খোঁজ, যাকে আমি ভালবাসবো, যে আমাকে ভালোবাসবে, যে আমার জীবনের ক্রাইসিসগুলো বুঝবে, আমি যার জীবনের মৌলিক ক্রাইসিসগুলো বুঝবো, যে আমার পরিবারকে ভালবাসবে, যার পরিবারকে আমি আমার পরিবার হিসেবে বিবেচনা করবো।
খোদা আমার ইচ্ছা একশোতে একশোভাগ পূরণ করেছেন।
আমার স্ত্রী খোদার তরফ থেকে আমার জন্যে উপহার। বিয়ে, বা স্ত্রীর ইস্যুটাকে আমি এভাবেই দেখি। খোদার কাছে এই সম্পর্কের হক যথাযথভাবে আদায় করবার জন্যে প্রতিনিয়ত দোয়া করতে থাকি।
একাধিক বিয়ের যে বিষয় ইসলামে আছে, তার সঙ্গে আনুসাঙ্গিক আরও অনেক শক্ত শক্ত নিয়ম আছে। একাধিক বিয়ের জন্যে দরকারি প্রাসঙ্গিক বিবেচনা আছে। এগুলো বিবেচনায় না এনে ইসলাম পুরুষতান্ত্রিক ধর্ম, সব মুসলিম পুরুষ চার বিয়ের জন্যে লাফায়, যৌনলোভী , লম্পটের মতো - যে বা যারা এ সমস্ত বক্তব্য দেয়, তাদের জন্যে আমার করুণা হয়। একে তো এটা মিসরিপ্রেজেন্টেশন, খিয়ানত। তারপর, এতদূর নীচে নেমে এসে মিথ্যা বলাটা প্রমাণ করে, সে বা তারা নিজেদের জীবনে খুব কষ্টের মধ্যে আছে। নিজের জীবন নিয়ে সন্তুষ্ট একজন মানুষের প্রয়জন পড়ে না মিথ্যাচারের মাধ্যমে একটা বড় জনগোষ্ঠীকে আচানক কষ্ট দেয়ার।
জান্নাতে করার মতো কাজের অভাব আছে? আন্দালুসিয়ার পথেঘাটে হাঁটার অনুমতি চাইবো মহিউদ্দিন ইবন আরাবি রাহিমাহুমুল্লাহর সঙ্গে, মাওলানা জালালুদ্দিন রুমি রাহিমাহুমুল্লাহের সঙ্গে রুমের জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে মসনবি শরীফের বয়েত আবৃত্তি করবো হুয়ারলিং দারভিশদের মতো দুহাত প্রসারিত করে। হাজী ইমদাদুল্লাহ সাহেব যখন মাওলানা কাসেম নানতুয়ী - মাওলানা রশিদ আহমদ গাঙ্গুহি - মাওলানা আশরাফ আলী থানভি রাহিমাহুমুল্লাহকে খোদার ভালোবাসা শিক্ষা দিচ্ছিলেন, হাজী সাহেবের সে দরসগাহে গিয়ে বসবো আমার স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে। রাসুল (সঃ)কে চর্মচক্ষে দেখতে পাবো, দেখতে পাবো আমার রুহের নূর অ্যাহলে বায়েতদের, সাহাবী আজমাইন ও সলফে সালেহিনদের। সবচে বড় আনন্দ হবে যখন খোদা তার আর আমার মধ্যে পর্দা সরিয়ে তার দর্শন দেবেন। খোদাকে দেখবো - চার ডাইমেনশনাল দুনিয়ার বাস্তবতায় বেঁচে থেকে এই আনন্দের স্বরূপ কীভাবে বর্ণনা করা যায়?
যৌন চাহিদাই কি একজন চিন্তাশীল মানুষের জীবনে একমাত্র কামনা?
যারা মুসলিমদের সাইকোলজিকে এই যৌনলোলুপ জায়গায় এনে আটকাতে চায়, তারা বেসিক্যালি তাদের মনমানসিকতা, সেক্সুয়াল রিপ্রেশন উগড়ে দেয় তাদের বক্তব্যে।
৭।
আমি যখন ছোট, ড্রেন থেকে খেলার সময় বল তুলতে চাইতাম না বলে আমাকে কেউ খেলতে নিতে চাইতো না, তখন থেকে আমি আশ্রয় নিয়েছি মসজিদে। পড়াশোনা, পরিবারের দেখভাল, অন্যান্য দায়িত্ব পালনের পর সময় দিয়েছে আমি কে, আমি কি চাই এ সমস্ত প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে। বলা বাহুল্য - ভিন্ন ভিন্ন কনটেক্সটে এই প্রশ্নের উত্তর একেকজন একেকভাবে খুঁজে পায়। আমি পেয়েছি খোদার সামনে আত্মসমর্পণের মাধ্যমে। আমি আলেম ছিলাম না। থিওলজিক্যাল কোন ডিসকাশনে অংশ নেয়ার মতো সামর্থ্য আমার আগেও ছিল না, এখনো নাই। কিন্ত আমার মনে আছে, যারা খোদা প্রেমিক হিসেবে স্বীকৃত আমাদের দেওবন্দী ঘরানায়, তারা পুরনো ঢাকায় এলে আমি তাদের মেহফিলে হাজির হতাম। যখন তারা তাদের নসিহত শেষ করে আসমানের দিকে হাত তুলতেন , আমিও তাদের সঙ্গে হাত তুলতাম, আর খোদার কাছে এই এক দোয়া করতাম - ' খোদা আমার কোন এলম নাই, আমার কোন আমলও নাই যা আপনার কাছে উপস্থাপন করতে পারবো। আমার কেবল একটা অন্তর আছে। এই অন্তর নিয়ে তোমার কাছে হাজির হয়েছি, আমার এই অন্তরকে তুমি তোমার বানায়ে নাও। আমার দিলকে তুমি কবুল করো।'
আমি জীবনে বহু বহু বার পথ হারা হয়েছি। বহুবার পঙ্কিলতার চোরাবালিতে ডুবতে ডুবতে বেঁচেছি। তারপরেও , আজ পরিণত বয়সে, যখন আমার উপার্জনের হালাল পথ আছে, মাথার উপর ছাদ আছে, দেখভাল করার জন্যে সংসার আছে - তখন আমার হাল এই যে, প্রতিবার মনোরম ঠাণ্ডা বাতাস আমাকে ছুঁয়ে গেলে তা আমাকে আমার খোদাকে স্মরণ করিয়ে দেয়। যে কোন সুস্বাদু খাবার আমার জিভে ঠেকলে তা আমার মুখে আগে কৃতজ্ঞতা বাক্য এনে দেয়। প্রতিমুহূর্তে আমি অনুভব করি, আমাকে আমার খোদা ঘিরে আছেন। আমি ডুবে আছি আমার খোদার মধ্যে। এই সমর্পণ, এই ভালোবাসার মধ্য দিয়ে যে ধর্ম শেখে, বলা হয়, এ কখনো মরদুদ হয় না। বিতাড়িত হয় না। খোদাকে যে যুক্তির মধ্য দিয়ে খোঁজে, নিজের মেধার জোরে আবিষ্কার করতে চায় - তার পথভ্রষ্টতার সম্ভাবনা মুহুর্মুহু।
মাওলানা শামসুদ্দিন তাব্রিজের একটা বক্তব্যের প্যারাফ্রেইজ করে লেখাটা শেষ করি। মাওলানা রুমির এ শিক্ষক বলেন - ক্বাবা শরীফকে যদি আসমানে উঠিয়ে নেয়া হয়, তাহলে দেখা যাবে এক অভূতপূর্ব সুন্দর দৃশ্য। দেখা যাবে পৃথিবীর সবমানুষ একে অপরকেই সেজদা করছে।
আপনার ভেতরে খোদার নূর আছে, এটা সবচে বেশী স্পষ্ট হবে তখন, তখন আপনার মানুষের প্রতি ব্যবহার ভালো হবে, ধর্মবর্ণ জাতপাত নির্বিশেষে।
দ্রষ্টব্যঃ
আমার এ লেখায় আমি কেবল একজন মুসলিম হিসেবে আমার সাইকোলজির গঠন ব্যাখ্যা করেছি। খোদাকে আমি কীভাবে অনুভব করেছি, পেয়েছি আমার জীবনে এই বিমূর্ত বিষয়কে শব্দের ঘেরে আটকানোর অপূর্ণ ও ব্যারথ চেষ্টা করেছি। আমার কোন বক্তব্য ইসলামের কোন মাসায়েল - শরিয়াহ ব্যাখ্যা করে না। আমি সে দাবীও করি না। কাজেই আমি কাউকে আমার চিন্তা পদ্ধতি অনুসরণ করার পরামর্শও দিই না। দ্বীন আলেমদের কাছ থেকে শেখাই দস্তুর। আমিও এভাবেই শিখেছি।
(ছবিসুত্রঃ আনসারি ফাইন আর্টস ডট কমের বরাতে পিন্টারেস্টের ওপেন এক্সেস ডোমেইন থেকে কালেক্ট করা। সূরা নূরের ৩৫ তম আয়াতের ক্যালিগ্রাফি।)
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে আগস্ট, ২০২১ বিকাল ৩:০৪