somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ও‌য়েব সি‌রি‌জে চল‌ছে যৌন প্রতি‌যো‌গিতা

০২ রা আগস্ট, ২০২২ রাত ১২:২৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ও‌য়েব সি‌রি‌জে তুমুল যৌন প্রতি‌যো‌গিতা চল‌ছে!

এমএবি সুজন

ওয়েব সিরিজের সেক্সচুয়াল ওয়েবে ধ্বংস হ‌চ্ছে যুব কি‌শোর ও ছাত্র সমাজ! বাড়‌ছে সামা‌জিক ব‌্যা‌ভিচার ও পাশ‌বিক নির্যাতন ! যৌনতা ও পর‌কিয়াকে উস‌কে দি‌চ্ছেন সংশ্লিষ্ট অ‌ভিনয় শি‌ল্পী ও নির্মাতা পরিচালকগণ!
ওয়েব সিরিজ’ শব্দটা এখন আর হয়তো কারও কাছে অপরিচিত নয়। শুধু অনলাইন বা অনলাইন টিভির জন্য তৈরি ও প্রকাশিত ধারাবাহিকের (ধারাবাহিক ভিডিও) নাম ওয়েব সিরিজ। জানা যায়, নব্বই দশকে আমেরিকায় এর জন্ম। আমেরিকান লেখক ট্রেসি রিড লিখিত ‘কোয়ান্টামলিঙ্ক সিরিয়াল’ (১৯৮৮-৯৯) দিয়ে শুরু এর যাত্রা পালা। বিশ শতকের শেষ দিকে স্কট জাকারিনের সৃষ্টি ‘দ্য স্পট’ দিয়ে জনপ্রিয়তার সিঁড়িতে ওয়েব সিরিজের উত্থান। একুশ শতকে এর বিশ্বভ্রমণ, বিনোদনের প্রভাব বিস্তারকারী বিকল্প শ‌ক্তিশালী মাধ্যম হয়ে ওঠা। পার্শ্ববর্তী ভারতেও ও‌য়েব সি‌রি‌জের কদর যাত্রা শুরু অনেক আগে।
অথচ বাংলাদেশে ওয়েব সিরিজের পর্দা ওঠে সবেমাত্র ২০১৭ সালে। ওই বছর ঈদুল ফিতরে টিভির পাশাপাশি ইউটিউব চ্যানেলে একাধিক ধারাবাহিক নাটক প্রকাশ পায়। এর মধ্যে সিএমভির ইউটিউব চ্যানেলে ৭ পর্বের ‘আমি ক্রিকেটার হতে চাই’ ও ‘অ্যাডমিশন টেস্ট’, ‘এল আমোর টিভি’ নামের ইউটিউব চ্যানেলে ‘টেস্টিং সল্ট’, বাংলা ঢোলের উদ্যোগে ভিডিও স্ট্রিমিং প্ল্যাটফরম বাংলাফ্লিক্সে প্রচার পায় বিশেষ নাটক ‘উপহার’। বাংলাদেশে ওয়েব সিরিজের আনুষ্ঠানিক প্রকাশটা মূলত তখন। এরপর ঈদুল ফিতরের ধারাবাহিকতায় ঈদুল আজহায়ও প্রকাশ পায় বেশকিছু নাটক।
আলোচনা বা প্রশংসা নয়, সমালোচনা ও বিতর্ক দিয়েই বাংলাদেশে ‘ওয়েব সিরিজ’-এর যাত্রা। ইতিবাচক নয়, নেতিবাচক দিয়েই ওয়েব সিরিজের দৃষ্টি আকর্ষণ। এমনকি কপালে জনপ্রিয়তার তকমা সাঁটার আগেই সেঁটে গেছে যৌনতা, অশ্লীলতার তকমা।
ওয়েব সিরিজগুলোয় অপ্রাসঙ্গিক ও অহেতুক যৌনতার সুড়সুড়ি, অশালীন সংলাপ ও অঙ্গভঙ্গি, মাদক গ্রহণের দৃশ্যবলীর কারণেই মূলত এ সমালোচনা। বিষয়বস্তু বা শিল্পগুণের বদলে ‘অনাকাঙ্ক্ষিত’ দৃশ্যের বন্দুকে সস্তা ও দ্রুত জনপ্রিয়তা বা বিপুল ভিউয়ার বা সাবস্ক্রাইবার শিকারের চেষ্টা, নাটকগুলোয় খুব দৃষ্টিকটুভাবে পরিলক্ষিত হয়। আর সেই চেষ্টায় এখন যোগ হয়েছে পর্নোগ্রাফি। সম্প্রতি মুক্তি পাওয়া ‘বুমেরাং’-এর ‘তোমার ঘরে বাস করে কয়জনা’ পর্বটি শুরুই হয় অভিনেতা আদনান ফারুক হিল্লোল ও অভিনেত্রী নাজিয়া হক অর্ষার দীর্ঘ বেডসিন দিয়ে। দেশীয় নাটকে এমন পর্নো দৃশ্যের সংযোজন সম্ভবত এই-ই প্রথম। ইন্টারনেটে এমন ভিডিও অহরহ। কিন্তু এমন ভিডিওতে দেশের প্রথম সারির নির্মাতা বা অভিনেতা-অভিনেত্রীদের সাবলীল অংশগ্রহণ অকল্পনীয় ও অবিশ্বাস্য।
পুরো নাটকে প্রিয় পাত্র-পাত্রীদের এমন খোলামেলা ও রগরগে উপস্থিতি- সত্যিই প্রথম দেখাতে চোখ কপালে ওঠার মতো। অন্যদিকে ‘বুমেরাং’-এর ‘ঝড়ো হাওয়া লেগে তার শিখা নিভে যাবে’ পর্বটি আরও বেশি রগরগে ও যৌন উত্তেজক। এমন নাটকে পরিচিত মুখ মৌটুসী বিশ্বাস, ইমি, শ্যামল মাওলা ও তানভীরদের দেখে সত্যি লজ্জায় মুখ ঢাকতে ইচ্ছা হয়। আর ‘সদরঘাটের টাইগার’কে নাটক না বলে ‘গালি ব্যাংক’ বললে অত্যুক্তি হবে না। এমন ‘অশ্লীল গালিময়’ নাটক দেশে, আর হয়েছে কিনা সন্দেহ আছে। অন্যদিকে ‘১৪ আগস্ট’ সিরিজটিতে যৌনতা, সহিংসতা, মাদক, অশ্লীল সংলাপের আড়ালে ঢাকা পড়ে যায় বখে যাওয়া ঐশীর কাহিনী।
অনেকেই হয়তো প্রশ্ন তুলবেন, এসব ভিডিও কীভাবে, কোন বিবেচনায় অশ্লীল- অনলাইনে তো এর চেয়ে জঘন্য ভিডিওর ছড়াছড়ি?
বর্তমান সময়ে বিনোদনের নতুন জগৎ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। যেখানে প্রচার হচ্ছে ছোট ছোট বিভিন্ন ওয়েব সিরিজ। দেশের বিনোদন সংশ্লিষ্টরা এ জগতে পা রাখলেও সেগুলো অশ্লীলতায় ভরা। বিনোদনের মোড়কে নিয়ন্ত্রণহীন এসব প্লাটফর্মে হু হু করে ছড়াচ্ছে অশ্লীল ছবি। অখ্যাত অভিনেতা-অভিনেত্রী ও মডেলদের সাথে এই স্রোতে মিশে গেছে অনেক পরিচিত মুখও। উপরে নিচে কিছু চটকদার শব্দ আর অর্ধনগ্ন স্থির চিত্র দিয়ে আকৃষ্ট করা হচ্ছে দর্শকদের। এসব সিরিজে ব্যবহার করা নানান কুরুচিপূর্ণ উপাদান শুধু সামাজিক অবক্ষয়ই করছে না বরং আমাদের যে নিজস্ব একটি সাংস্কৃতিক পরিচয় আছে সেটিও দিনদিন দূরে সরে যাচ্ছে।
‘শয্যাদৃশ্যের প্রয়োজনে কাহিনী, নাকি কাহিনীর প্রয়োজনে শয্যাদৃশ্য- এ এখন বিরাট ধাঁধা।’ হালের কিছু ওয়েব সিরিজকে ঘিরে ফেসবুকে এখন এমন অসংখ্য মন্তব্যের ঝড়। বাংলাদেশের দর্শক কখনও কল্পনা করেননি, নাটক দেখতে গিয়ে তাদের পর্নো সদৃশ কিছু দেখতে হবে। কখনও ভাবেননি, শালীন-কুলীন প্রিয় অভিনেতা-অভিনেত্রীরা এমন নগ্ন ও অশালীনরূপে তাদের সামনে হাজির হবেন।
আর তাদের ভাষার কী শ্রী! কী অশ্লীল-অশ্রাব্য শব্দ-বাক্য! সংলাপ নয়, এ যেন মুখে ‘খিস্তি-খেউড়ের খই’! সম্প্রতি ‘বুমেরাং’, ‘সদরঘাটের টাইগার’, ‘১৪ আগস্ট’ নামের ওয়েব সিরিজ দেখতে গিয়ে দর্শকরা এমনই বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছেন। অবশ্য তাতে বিব্রত নন শিল্পী-কুশীলব কিংবা নির্মাতা। তাদের কাছে সবকিছুই নাকি ‘গল্পের প্রয়োজনে’! কী সেলুকাস! ভিডিওগুলোয় যৌনতার বাণিজ্যিক সমীকরণ খুব সুস্পষ্ট। সুস্পষ্ট অশ্লীলতার ব্যাকরণ। তাতে দর্শকমনে আশঙ্কা জাগছে- ‘হিট’-এর সোনার হরিণ ধরতে আমাদের নাটক কি এখন তবে যৌনতার ঘোড়ায় ভর করেছে? নাটকের ভিউ পাওয়ার ট্রেন্ড কি তবে পাল্টে যাচ্ছে?
নাট্যরস নিতে গিয়ে দর্শককে কি এখন নিয়মিত, গল্পের প্রয়োজনে(?) রগরগে যৌনরস বা খিস্তি-খেউড় গিলতে হবে? অবশ্য ওয়েব সিরিজ নিয়ে এমন বিতর্ক নতুন কিছু নয়। এই তো কয়দিন আগে যৌনতাসহ বিভিন্ন অভিযোগে জনপ্রিয় ভারতীয় ওয়েব সিরিজ ‘ট্রিপল এক্স’র প্রযোজকদের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা হয়। ২০১৮ সালে নেটফ্লিস্ক, আমাজন প্রাইম ভিডিওসহ আরও কিছু অনলাইন প্ল্যাটফরমের অশ্লীল ও যৌন উত্তেজক ওয়েব সিরিজ সরাতে দিল্লি হাইকোর্টে মামলা হয়। মামলা হয় জনপ্রিয় সেক্রেড গেমস, হাসমুখ বেতাল, পাতাল লকসহ বিভিন্ন ওয়েব সিরিজের বিরুদ্ধে। বাংলাদেশেও বিতর্ক আর ওয়েব সিরিজ যথারীতি হাত ধরাধরি করেই চলছে।
দেশের বিনোদন জগতে কিছু দিন ধরে চলছে সমালোচনার ঝড়। কারণ একটাই, ওয়েব সিরিজের নামে অবলীলায় চলছে অশ্লীলতা। আর এতে অভিনয় করছেন দেশের জনপ্রিয় তারকারা। সেন্সরশিপ না থাকায় জনপ্রিয় নির্মাতাদের নির্মিত ওয়েব ধারাবাহিক, স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রগুলো এখন আর পারিবারিকভাবে দেখার অবস্থায় নেই। কারণ গল্পে থাকছে অশ্লীল সংলাপ এবং সহিংসতার দৃশ্য থাকে এসব ওয়েব সিরিজে। বলা যায় ব্যবসায়িক স্বার্থে দর্শক টানতে বিদেশী অনুষ্ঠানগুলোর সাথে রীতিমতো প্রতিযোগিতায় নেমেছেন দেশের কনটেন্ট নির্মাতা ও অভিনয় শিল্পীরা।
উদ্ভট গল্প, অশালীন দৃশ্য, নোংরা সংলাপ ব্যবহার যেন নতুন কোনো বিষয় নয়। ওয়েব সিরিজের নামে এ এক অতিমাত্রার সুরসুরি ও যৌনতা। অনেকটা নীল ছবির নতুন রূপ। গল্পের প্রয়োজনে গালি ব্যবহার করা হলেও টিভি নাটকের সেই অংশের শব্দটুকু সাধারণত মুছে দেওয়া হয়। মাদকদ্রব্য ব্যবহার ও সেবন করার দৃশ্যে ‘ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর’ লেখা থাকে। কিন্তু সম্প্রতি বেশ কয়েকটি ওয়েব সিরিজে এ ধরনের সচেতনতা লক্ষ্য করা যায়নি।
স্ট্রিমিং প্লাটফর্মে মুক্তি পাওয়ার কথা থাকলেও ইউটিউবে মুক্তি পেয়ে রীতিমতো বিতর্ক উসকে দিয়েছে এই ওয়েব সিরিজগুলো। ফেসবুক, ইউটিউবের মত ওপেন প্লাটফর্মে এসব অশ্লীলতা দেশের নিজস্ব সংস্কৃতির জন্য যেমন অশনি সংকেত, তেমনি তরুণ ও যুব সমাজের জন্য ভয়ংকর হিসেবে দেখছে মূলধারার শিল্পী ও নির্মাতারা।
সত্য ঘটনা অবলম্বনে’ শিহাব শাহীন পরিচালিত ক্রাইম থ্রিলার ‘আগস্ট ১৪’। ঐশী নামে বখে যাওয়া এক মেয়ের গল্প এটি। সে পুলিশ কর্মকর্তার মেয়ে। ২০১৩ সালে যে মেয়েটি মা-বাবাকে নির্মমভাবে খুন করেছিল। আলোচিত সেই ঘটনা নিয়েই নির্মিত হয়েছে সিরিজটি। এই ধারাবাহিকে তুশি চরিত্রে অভিনয় করেছেন তাসনুভা তিশা, শহিদুজ্জামান সেলিম, শতাব্দী ওয়াদুদ, মনিরা মিঠু, শাওন, তানভীর প্রমুখ।
সেখানে দেখা যায়, বন্ধুদের সাথে শারীরিক সম্পর্ক, বাসায় একা নীল ছবি দেখার মুহূর্তসহ নানা কুরুচিপূর্ণ দৃশ্য। থ্রিলারের শুরুতেই বলে নেয়া হয়, এটি ১৮ বছরের কম বয়সী দর্শকের জন্য নয়। আর এমন অশ্লীল দৃশ্যগুলোতে অবলীলায় অভিনয় করেছেন তিশা, যেভাবে আগে কখনোই তাকে দেখা যায়নি।
আদনান ফারুক হিল্লোল ও নাজিয়া হক অর্ষা অভিনীত ওয়েব সিরিজ ‘বুমেরাং’। সিরিজের শুরুটাই চমকে দেবে দর্শককে। পর্দায় বাংলাদেশী অভিনয়শিল্পীদের এত নিবিড় বিছানার দৃশ্য এর আগে কখনো দেখানো হয়েছে কি না, তা নিয়েও ভাবাবে দর্শককে।
অনলাইনে মুক্তি পাওয়া কিছু নাটকে দেখা যায় কতিপয় তারকার খোলামেলা দৃশ্য। সেই সময়ে ‘আবাসিক হোটেল’, ‘হেলেন অব ট্রয়’ সিরিজগুলোতে কিছুটা খোলামেলা দৃশ্য থাকায় বেশ সমালোচনার মুখে পড়েন সেগুলোর নির্মাতা এবং শিল্পীরা।
এ ছাড়া আপিত্তকর হিসেবে সিএমভির ব্যানারে সাত পর্বের ওয়েব সিরিজ ‘দ্য লিস্ট’, ধ্রুব এন্টারটেইনমেন্টের ব্যানারে সাত পর্বের দুই সিরিজ ‘বাঘবন্দী’ ও ‘আবাসিক হোটেল’, কিংবা টয়া অভিনীত ‘পালাবি কোথায়’ উল্লেখযোগ্য।
বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশনের (বিটিআরসি) নির্দেশে সহস্রাধিক পর্নো সাইট বন্ধ করা হয়েছে। মূলত ইন্টারনেট ব্যবস্থাকে নিরাপদ রাখতেই এই উদ্যোগ। আমরা অনেকে পর্নো বলতে চলমান উত্তেজনা সৃষ্টিকারী চিত্রকেই বুঝে থাকি। কিন্তু এর বিস্তর বিশ্লেষণ রয়েছে। পর্নো হচ্ছে যৌন আকাক্সক্ষা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে যৌন সংক্রান্ত বিষয়বস্তুর প্রতিকৃতি অঙ্কন বা পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনাকে বোঝায়। পর্নোগ্রাফি বিভিন্ন মাধ্যমের সাহায্যে উপস্থাপন করা যেতে পারে। এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে বই, সাময়িকী, পোস্টকার্ড, আলোকচিত্র, ভাস্কর্য, অঙ্কন, পেইন্টিং, অ্যানিমেশন, সাউন্ড রেকর্ডিং, চলচ্চিত্র, ভিডিও এমনকি ভিডিও গেম। সে হিসেবে বিবেচনা করলে বর্তমান ওয়েব সিরিজগুলোতে যেভাবে অভিনেতা-অভিনেত্রীরা যে অশ্লীল চিত্র দৃশ্যায়নে লিপ্ত হচ্ছেন তাকে পশ্চিমা সংস্কৃতির অনুকরণই বলা যেতে পারে। যা একজন স্বাভাবিক মানুষের কাম সৃষ্টির জন্য যথেষ্ট।
ওয়েব সিরিজ, সিনেমা বা যে কোনও কিছু নির্মাণ ও প্রচার করার ক্ষেত্রে অবশ্যই আমাদের সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের দিকে খেয়াল রাখতে হবে। আমাদের একটি কৃষ্টি এবং সংস্কৃতি আছে, রয়েছে সমাজের মূল্যবোধ। আমাদের কৃষ্টি-সংস্কৃতিকে অবজ্ঞা করে কোনও কিছু করা কখনোই সমীচীন নয় যা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ।
সাধারণভাবে লজ্জাহীনতা, রুচিহীনতা, অসুন্দর ও অশোভনের সামষ্টিক রূপ হল অশ্লীলতা। অন্যভাবে ‘অশ্লীলতা (Obscenity) হল একটি পরিভাষা, যা এমন সব শব্দ, চিত্র ও কার্যক্রমকে বোঝাতে ব্যবহৃত হয়; যেগুলো সমসাময়িক অধিকাংশ মানুষের নৈতিকতার দৃষ্টিতে অপরাধ বা দোষ হিসেবে বিবেচিত’। তবে বিষয়টি প্রচণ্ড আপেক্ষিক। স্থান-কাল-পাত্র ভেদে ‘অশ্লীলতার’ রূপ বদলায়, বদলায় রং।
সঙ্গমের রগরগে বর্ণনা সংবলিত ডিএইচ লরেন্সের যে ‘লেডি চাটার্লিজ লাভার’-এর কপালে অস্ট্রেলিয়া, জাপান ও ভারতের আদালত ‘অশ্লীল’-এর তিলক এঁকে নিষিদ্ধ করেছে, প্রকাশক-পরিবেশককে শাস্তি দিয়েছে। অথচ একই বইকে ইংল্যান্ড, আমেরিকা ও কানাডার সর্বোচ্চ আদালত দিয়েছে ‘শ্লীল’-এর তকমা। যৌনতার সুড়সুড়িতে ভরা সমরেশ মজুমদারের যে ‘প্রজাপতি’ উপন্যাসকে কলকাতার নিু আদালত ও হাইকোর্ট অশ্লীলের শিরোপা পরিয়ে সব কপি বাজেয়াপ্ত করেছে, ওই উপন্যাসকেই আবার ভারতের সুপ্রিম কোর্ট দিয়েছে ‘শ্লীল’-এর সনদ। শিল্প-সাহিত্যে শ্লীল-অশ্লীল এ দ্বন্দ্বটা তাই অনেকটা বিশ্বজনীন। তা ছাড়া শিল্প বা সাহিত্য শ্লীলতা-অশ্লীলতা বিচারের সুনির্দিষ্ট কোনো পাল্লাও নেই। এ ক্ষেত্রে ‘হিকলিন টেস্ট’ই (Hicklin Test) বিশ্বজুড়ে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য মাপকাঠি। যা অনুভূতিপ্রবণ মনকে কলুষিত করে এবং নৈতিক অধঃপাতে নিয়ে যায়, তাই-ই অশ্লীল। এটাই হচ্ছে, হিকলিন টেস্টের মূল কথা। ইংল্যান্ডের ‘রেজিনা বনাম হিকলিন’ (১৮৬৮) মামলায় এ তত্ত্বের জন্ম।
অশালীন বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধকরণ আইন, ১৯৬৩ বিদ্যমান দেশীয় আইনে এ একটি জায়গায় কেবল অশ্লীলতার সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে। বলা হচ্ছে- অশ্লীলতা হচ্ছে তাই, যা সুস্থ ও সাধারণ মানুষের মনে ইন্দ্রিয় ভোগবাসনা ও অন্যায় চিন্তা জাগানোর কারণ হতে পারে এবং নৈতিক চরিত্র কলুষিত করে তাদের মনকে এমন সব নীতিবিরুদ্ধ কাজে প্রবৃত্ত এবং প্রলুব্দ করতে পারে, যাকে সাধারণভাবে নৈতিকতার পরিপন্থী ভাবা হয় এবং তা জনগণের চারিত্রিক অধঃপতন ও লাম্পট্যের মতো ক্ষতিকর প্রভাব রাখতে পারে (ধারা-২)। অন্য সব ক্ষেত্রে হিকলিন টেস্ট অনুসরণ করা হয়।
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০০১ টেলিযোগাযোগ যন্ত্রপাতির মাধ্যমে কেউ অশ্লীল বার্তা প্রেরণ করলে তাকে সর্বোচ্চ ২ বছর কারাদণ্ড বা ৫ কোটি অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে হবে (ধারা-৬৯)।
এখানে ‘পর্নোগ্রাফি’ মানে, যৌন উত্তেজনা সৃষ্টিকারী কোনো অশ্লীল সংলাপ, অভিনয়, অঙ্গভঙ্গি, নগ্ন বা অর্ধনগ্ন নৃত্য; যা চলচ্চিত্র, ভিডিও চিত্র, অডিও ভিজ্যুয়াল চিত্র, স্থির চিত্র, গ্রাফিক্স বা অন্য কোনো উপায়ে ধারণকৃত ও প্রদর্শনযোগ্য এবং যার কোনো শৈল্পিক বা শিক্ষাগত মূল্য নেই। অনেকেই মনে করেন এ সংজ্ঞামতে, ‘বুমেরাং’-এর মতো ওয়েব সিরিজগুলো ‘পর্নোগ্রাফি’র কাতারে পড়ে। আদালতে দোষী সাব্যস্ত হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা অপরাধের মাত্রানুযায়ী সর্বোচ্চ ২-৭ বছর সশ্রম কারাদণ্ড ও সর্বোচ্চ ১-২ লাখ টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবে [ধারা-২, ৮]।
উল্লেখ্য, পর্নোগ্রাফির অভিযোগে ‘নেশা’ নামক এক মিউজিক ভিডিওর সঙ্গে সম্পৃক্ত ৭ জনের বিরুদ্ধে ঢাকার আদালতে পর্নোগ্রাফি মামলা করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী খন্দকার নাজমুল আহসান। এ ধরনের মামলা বাংলাদেশে এটাই প্রথম। সম্প্রতি ওয়েব সিরিজের নামে যা শুরু হয়েছে, তাতে আগামীতে এ ধরনের মামলার পুনরাবৃত্তি হলে, অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
টিভিতে প্রচারিত নাটকগুলো নির্মাতা সরাসরি দেখাতে পারেন না। এজন্য সংশ্লিষ্ট টিভি চ্যানেলের প্রিভিউ কমিটি বা চ্যানেল কর্তৃপক্ষের অনুমোদন লাগে। ছবির ক্ষেত্রেও একইভাবে আছে সেন্সর বোর্ডের ছাড়পত্র। কিন্তু শুধু অনলাইনে গান বা ভিডিও প্রকাশে এ ধরনের অনুমোদন বা সেন্সরশিপের ব্যবস্থা নেই। নির্মাতারা এ ক্ষেত্রে নিরঙ্কুশ স্বাধীন। আর স্বাধীনতা যেখানে অবারিত, অপব্যবহার সেখানে অবধারিত। তাই ওয়েব সিরিজের অরাজকতা বা অশ্লীলতা ঠেকাতে চাইলে, এখানেও এক ধরনের সেন্সরশিপ সিস্টেম বাধ্যতামূলক রাখা দরকার।
এজন্য সংস্কৃতি বা তথ্য মন্ত্রণালয়ে ‘অনলাইন কনটেন্ট পর্যবেক্ষণ কমিটি’ নামে কমিটি চালু করা যেতে পারে। অনলাইনে কোনো ভিডিও ছাড়ার আগে এ কমিটিতে জমা দিতে হবে। কমিটি সংশ্লিষ্ট ভিডিওতে অশ্লীলতা, মানহানি, ধর্ম অবমাননা, রাষ্ট্রদ্রোহিতামূলক কন্টেন্টের বিষয়টা খতিয়ে দেখবে। তাদের অনাপত্তি পেলেই কেবল ভিডিওটি অনলাইনে ছাড়া যাবে। সরকারের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ এবং বিটিআরসিতেও এ ধরনের একটা সেল থাকতে পারে।
পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইউনিটও বিষয়টি নজরদারি করতে পারে। তা ছাড়া ইউটিউব কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদনক্রমে বাংলাদেশে ইউটিউবের একটা গেটওয়ে খোলা যেতে পারে।
‘সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে’- এ শিরোনামে হুমায়ুন আজাদের একটা কবিতা আছে। আমাদের নাটকও একইভাবে যেন নষ্ট মুনাফাখোরদের দখলে চলে যাচ্ছে। সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমরা, চলচ্চিত্রের ‘অশ্লীল যুগ’ খানিকটা পেরিয়ে এসেছি। এখন নাটকের জগতেও যেন ওই অমানিশার গ্রহণ লেগেছে। মহামারী রূপ পাওয়ার আগেই রোগটার বিনাশ দরকার। জরুরি সমাধান হিসেবে, দুষ্কৃতকারীদের আইনের আওতায় সাজা দিয়ে দৃষ্টান্ত তৈরি করা যেতে পারে। বাংলাদেশের মানুষ নাটকপ্রিয়। তা ছাড়া আমাদের নাটকের উচ্চমানও আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত।
বাংলা চলচ্চিত্র ধ্বংসের পথে, নাটক গোল্লায় যাচ্ছে আর ওয়েব সিরিজ যৌনতার ঢেউয়ে চেপে হাবুডুবু খাচ্ছে। সংশ্লিষ্ট শিল্পী, কলাকুশলী এবং নির্মাতা পরিচালকদের আরো বেশি আইনের আওতায় আনা জরুরি মনেকরি।
#এমএ‌বি‌_খেয়াল
#mabkheaal

সর্বশেষ এডিট : ০২ রা আগস্ট, ২০২২ রাত ১২:২৮
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সৈয়দ কুতুবের পোষ্ট: ভারতের করণীয় কি কি?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ২৫ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১১:৩৩



বাংলাদেশের সাথে সম্পর্ক ভালো রাখার জন্য ভারতের করণীয় কি কি?

০) শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো।
১) বর্ডার থেকে কাঁটাতারের ফেন্চ তুলে নেয়া।
২) রাতে যারা বর্ডার ক্রস করে, তাদেরকে গুলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্বদেশ প্রত্যার্বতন : আমি আশাবাদী হতে চাই

লিখেছেন স্বপ্নের শঙ্খচিল, ২৬ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৩৪

স্বদেশ প্রত্যার্বতন : আমি আশাবাদী হতে চাই
আজ ২৫ তারিখ, ২৫শে ডিসেম্বর ২০২৫ সাল (প্রকৃতির এক অদ্ভূদ খেয়াল) ।



৬ হাজার ৩১৪ দিন পর তারেক জিয়া বীরের বেশে অসংখ্য মানুষের... ...বাকিটুকু পড়ুন

খাম্বার পরবর্তী অধ‍্যায় ,নাকি ১০% বদল হবে‼️অমি খোয়াব ভবনে ঘুমিয়ে , হাওয়া ভবনের আতঙ্কে আতঙ্কিত॥

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ২৬ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৮:৪৮



খালেদা জিয়ার অসুস্থতার নাটক ছিল তারেক জিয়ার দেশে ফেরার রাজনৈতিক ট্রাম্পকার্ড। কথায় আছে,' দুষ্টু লোকের মিষ্টি ভাষা '। বাংলাদেশের রাজনীতিতে দূর্নীতিবাজ ও মাফিয়া গডফাদার তারেক রহমানের দেশে ফেরা... ...বাকিটুকু পড়ুন

খালেদার ১টি প্ল্যান ছিলো, মহা-ডাকাতের ১টি প্ল্যান আছে।

লিখেছেন জেন একাত্তর, ২৬ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১:২৩



২০১৪ সালের ভোটের আগে খালাদা বলেছিলো যে, তার কাছে ১টা প্ল্যান আছে, যা ১ বছরের মাঝে বেকার সমস্যা ও বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান করে দিবে। তিনি প্ল্যানটি প্রকাশ করেননি,... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশে গুমের ঘটনা: শেখ হাসিনার শাসনকালের একটি কালো অধ্যায়

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:৪৯

বাংলাদেশে গুমের ঘটনা: শেখ হাসিনার শাসনকালের একটি কালো অধ্যায়

গুমের শিকার ব্যক্তিদের অতি ক্ষুদ্র কক্ষের ছবিটি বিবিসি ডটকম থেকে নেওয়া।

পরিচিতি

বাংলাদেশে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

×