সময়ের পরিক্রমায় আবারও আর একটি ফুটবল বিশ্বকাপ আমাদের ঘরের দুয়ারে দাড়িয়ে। ফুটবল বিশ্বকাপ এর জ্বরে সারা পৃথিবীর মত কাঁপছে বাংলাদেশও। সারা বছর ক্রিকেটের ভিড়ে ফুটবল আড়ালে থাকলেও ফুটবল বিশ্বকাপ এলে বাঙ্গালীর ফুটবল প্রেম কিংবা উন্মাদনা চোখে পরার মত। প্রতিটি পাড়ায় মহল্লায় ইতিমধ্যেই তাদের পছন্দের দল এর সমর্থক গোষ্ঠী গড়ে উঠেছে। নিজের পছন্দের দলের গুণগান করার পাশাপাশি প্রতিপক্ষ দলের দুর্নাম করায় ব্যস্ত সবাই। বিশেষ করে আর্জেন্টিনা আর ব্রাজিল সমর্থকদের মধ্যকার শীতল যুদ্ধ উপভোগ্য। আর মাত্র কয়েকদিন পরেই ব্রাজিলে শুরু হতে যাচ্ছে বিশ্বকাপের ২০ তম আসর। বিশ্বকাপের পূর্বের আসরগুলোতে জড়িয়ে আছে হাসি- কান্না , সাফল্য - ব্যর্থতার মুহূর্ত। আসুন ফিরে দেখি বিশ্বকাপ ফুটবলের কিছু বিতর্কিত, কলঙ্কিত এবং স্মরণীয় মুহূর্ত।
ইউটিউব লিংকঃ Sheikh Fahad Al-Ahmad Al-Sabah ১৯৮২ বিশ্বকাপ
বিশ্বকাপ ফুটবল এর ইতিহাসে সবচেয়ে বিতর্কিত ঘটনার অন্যতম ১৯৮২ সালে স্পেনে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপে ফ্রান্স এবং কুয়েতের মধ্যকার ম্যাচ। ২১শে জুন ১৯৮২ প্রথম রাউন্ডের ম্যাচে মুখোমুখি হয় দুই দল। খেলার দ্বিতীয়ার্ধে ফ্রান্স মিডফিল্ডার Alain Giresse এর গোলকে কেন্দ্র করে বিতর্কের সূত্রপাত। কুয়েত খেলোয়াড়দের দাবী তারা বাঁশির আওয়াজ শুনে খেলা থামিয়ে দেয়। আর সেই সময় Alain Giresse গোলটি করেন। তারা গোল বাতিলের দাবী জানায় রেফারিকে। গ্যালারীতে বসে থাকা তৎকালীন কুয়েত ফুটবল ফেডারেশন এর প্রেসিডেন্ট Sheikh Fahad Al-Ahmad Al-Sabah কুয়েতের খেলোয়াড়দের মাঠ থেকে বেড়িয়ে আসতে নির্দেশ দেন। পরবর্তীতে নিজেই গ্যালারী ছেড়ে মাঠে প্রবেশ করেন এবং রেফারির সঙ্গে তর্কে লিপ্ত হন। রেফারি Miroslav Stupar দীর্ঘ সময় আলোচনার পর উক্ত গোলটি বাতিল করেন। উক্ত ঘটনার জন্য রেফারি Miroslav Stupar তার আন্তর্জাতিক রেফারি সনদ হারান এবং Sheikh Fahad Al-Ahmad Al-Sabah কে মাত্র ১০০০০ ডলার জরিমানা গুনতে হয়।
ইউটিউব লিংকঃ নেদারল্যান্ড বনাম পর্তুগাল ২০০৬ বিশ্বকাপ
বিশ্বকাপ ফুটবলের সবচেয়ে কলঙ্কিত ম্যাচের একটি ছিল ২০০৬এ জার্মানিতে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপে নেদারল্যান্ড ও পর্তুগালের মধ্যকার ম্যাচটি। রাউন্ড অফ সিক্সটিন এ এই দু দল মুখোমুখি হয়। ২৫ শে জুন ২০০৬এ ম্যাচটির দায়িত্বে ছিলেন রাশিয়ান রেফারি Valentin Ivanov। ম্যাচ শেষ হবার আগ পর্যন্ত রেফারিকে দুই দলের খেলোয়াড়দের মোট ১৬ টি হলুদ কার্ড এবং ৪ বার লাল কার্ড দেখাতে হয়েছে। নেদারল্যান্ড এবং পর্তুগাল দু দলেরই ফেয়ার প্লের জন্য সুনাম রয়েছে কিন্তু বিশ্বকাপ ফুটবলের সবচেয়ে কলঙ্কিত ম্যাচের কালিমা এই দুই দেশই বহন করে চলছে। খেলা শেষে অবশ্য কেউ কেউ ম্যাচটাকে রাঘবি ম্যাচের সাথে তুলনা করেছে। ফিফা প্রেসিডেন্ট Sepp Blatter এই ম্যাচের সম্পর্কে বলেন, ম্যাচে দুর্বল পারফরমেন্স এর জন্য রাশিয়ান রেফারি Valentin Ivanov এর উচিত ছিল নিজেকে নিজেই হলুদ কার্ড দেখানো।
ইউটিউব লিংকঃ ১৯৭৮ সালের বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা
বিতর্ক এবং আর্জেন্টিনায় অনুষ্ঠিত ১৯৭৮ সালের বিশ্বকাপ একই সূত্রে গাঁথা। বিশ্বকাপের দু বছর আগে সামরিক ক্যু এর মাধ্যমে সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা দখল বিশ্বকাপ আয়োজনে সংশয় দেখা দেয়। প্রথম রাউন্ডে আর্জেন্টিনার প্রতিটি খেলা রাতে অনুষ্ঠিত হওয়া নিয়ে প্রথম বিতর্কের সৃষ্টি। সব বিতর্ককে পেছনে ফেলে দ্বিতীয় রাউন্ডে আর্জেন্টিনা বনাম পেরুর ম্যাচে। ফাইনালে যাবার জন্য আর্জেন্টিনার ৪-০ গোলে জিততে হত, নয়ত ব্রাজিল ফাইনালে খেলার যোগ্যতা অর্জন করবে। আর্জেন্টিনা ঐ ম্যাচে ৬-০ গোলে জয় লাভ করে ফাইনালে খেলার যোগ্যতা লাভ করে। প্রথম অর্ধে ২-০ গোলে এগিয়ে থাকে আর্জেন্টিনা। দ্বিতীয়ার্ধে আরো ৪ টি গোল করে। দ্বিতীয়ার্ধে পেরুর খেলোয়াড়দের বডি ল্যাংগুয়েজ অনেক প্রশ্নের জন্ম দেয়। ঐ ম্যাচটি নিয়ে পরবর্তীতে অনেক গল্প কথা চালু হয়। কারো কারো মতে তৎকালীন সামরিক জান্তার হুমকির মুখে পেরুর খেলোয়াড়রা ম্যাচটিতে ইচ্ছাকৃতভাবে বিশাল ব্যবধানে হেরে যায়। আবার কারো মতে আর্জেন্টিনা থেকে অর্থনৈতিক ও বানিজ্য সুবিধার বিনিময়ে পেরু ম্যাচটাতে হার মানে। যদিও এ ধরণের অভিযোগের কোন তথ্য প্রমাণ কেউ হাজির করতে পারেনি। তারপরও বিশ্বকাপের বিতর্কিত ম্যাচের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে এই ম্যাচটি।
ইউটিউব লিংকঃ জিনেদিন জিদান
জার্মানিতে অনুষ্ঠিত ২০০৬ সালের বিশ্বকাপ ফাইনাল ম্যাচ ফ্রান্স এবং Zinedine Zidane ভক্তদের জন্য এক মর্মপীড়াদায়ক ম্যাচ। ১৯৯৮ এর ফ্রান্সের বিশ্বকাপ জয়ের নায়ক Zinedine Zidane একাই দলকে টেনে নিয়ে গিয়েছিলেন ফাইনালে। খেলার প্রথমার্ধে ৭ মিনিটেই প্যানাল্টি থেকে গোল করেন Zinedine Zidane। ১২ মিনিটের ব্যবধানে Marco Materazzi গোলে সমতায় ফিরে ইতালি। নির্ধারিত ৯০ মিনিট আর কোন গোল না হওয়ায় ম্যাচ গড়ায় এক্সট্রা টাইমে। অতিরিক্ত সময়ে Zinedine Zidane এর একটি হেড ইতালির গোলরক্ষক বুফনের হাতে লেগে ক্রসবারে আঘাত হানে। Zinedine Zidane দলকে জয় এর দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু ১০৭ মিনিটে Zinedine Zidane এর সেই বিখ্যাত হেড অবাক করে বিশ্ববাসীকে। এবারের হেডটি বলে নয় সরাসরি মারলেন ইতালির Marco Materazzi এর বুকে। সরাসরি লাল কার্ড দেখে মাঠের বাইরে চলে যান ফ্রান্সের আশার প্রদীপ Zinedine Zidane। প্যানাল্টি শুট আউটে ৫-৩ গোলে ইতালির কাছে হেরে যায় ফ্রান্স। মুহূর্তেই হিরো থেকে ভিলেনে পরিণত হন Zinedine Zidane।
ইউটিউব লিংকঃ ব্যাটেল অফ সান্তিয়াগো
চিলিতে অনুষ্ঠিত ১৯৬২ সালের বিশ্বকাপে ইতালি এবং চিলির মধ্যকার ম্যাচটি বিশ্বকাপের আর একটি কলঙ্কিত ম্যাচ। ম্যাচটিকে অবশ্য ফুটবল ম্যাচ না বলে মার্শাল আর্টস এর প্রদর্শনী বলাই ভাল। ফ্লাইং কিক, কিল - ঘুষি কি ছিল না সেই ম্যাচে। কাউকে কাউকে কাবাডি খেলতেও দেখা যায় সেই ম্যাচে। মাঠের যুদ্ধাবস্থা নিয়ন্ত্রনের জন্য তিনবার পুলিশের সাহায্য নিতে হয় রেফারিকে। ২রা জুন ১৯৬২ সালের ঐ ম্যাচটি ব্যাটেল অফ সান্তিয়াগো নামে পরিচিত। ম্যাচ শেষে ইতালি টিমকে পুলিশের প্রোটেকশনে মাঠ থেকে বেরুতে হয়। উক্ত ম্যাচের দায়িত্ব পালনকারি ডাচ রেফারি Leo Horn ঐ ম্যাচ সম্পর্কে বলেন , “I wasn’t reffing a football match, I was acting as an umpire in military maneuvers.”
ইউটিউব লিংকঃ ম্যারাডোনা- হ্যান্ড অফ গড
ডিয়াগো ম্যারাডোনা ফুটবলের একজন জীবন্ত কিংবদন্তী। সাফল্যের পাশাপাশি বিতর্কও ম্যারাডোনার পিছু ছাড়ে নি। মাদকাসক্ত এবং নারী কেলেঙ্কারি নিয়ে বিতর্ক ছিল ম্যারাডোনার নিত্য দিনের সঙ্গী। কিন্তু ম্যারাডোনার ফুটবল দক্ষতা নিয়ে কারো প্রশ্ন তোলার অবকাশ ছিল না। সেই ম্যারাডোনাই জন্ম দেন ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা বিতর্কের। ম্যারাডোনার একটি গোল যা " হ্যান্ড অফ গড" নামে পরিচিত। মেক্সিকোতে অনুষ্ঠিত ১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে মুখোমুখি হয় আর্জেন্টিনা এবং ইংল্যান্ড। প্রথমার্ধ গোল শূন্য ড্র এর পর দ্বিতীয়ার্ধের ছয় মিনিটের মাথায় ইংল্যান্ড এর ডিবক্সের ভিতর উড়ে আসা বলকে হেড দিতে লাফিয়ে উঠেন ম্যারাডোনা এবং ইংল্যান্ডের গোলরক্ষক পিটার শিল্টন। আশ্চর্যজনক ভাবে পিটার শিল্টন এর থেকে ৮ ইঞ্চি খাটো ম্যারাডোনা লাফিয়ে হেড দিয়ে গোল করেন। যদিও স্পষ্টই দেখা যাচ্ছিল ম্যারাডোনা হাত দিয়ে বল জালে পাঠাচ্ছেন কিন্তু রেফারি কিংবা লাইন্সম্যান দেখতে ব্যর্থ হন। ম্যারাডোনার এই গোলটি বিশ্বকাপ ফুটবলের অন্যতম বিতর্কিত গোল হিসাবে টিকে আছে।
ইউটিউব লিংকঃ লুইস সুয়ারেজ
সাউথ আফ্রিকায় অনুষ্ঠিত ২০১০ সালের বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে মুখোমুখি হয় ঘানা এবং উরুগুয়ে। নির্ধারিত সময়ের খেলা ১-১ গোলে শেষ হয়। ম্যাচ গড়ায় অতিরিক্ত মিনিটে। আফ্রিকার শেষ প্রতিনিধি ঘানা দাপটের সাথেই মোকাবেলা করছিল ল্যাটিন আমেরিকার জায়ান্ট উরুগুয়ের সাথে। ভাগ্য সুপ্রশন্য থাকলে ঘানা চলে যেতে পারত সেমিফাইনালে। কিন্তু বাঁধা হয়ে দাঁড়ান লুইস সুয়ারেজ, না ফুটবল নৈপুণ্যে নয়। তার কাপুরুষোচিত আচরণে উরুগুয়ে চলে যায় সেমিফাইনালে। অতিরিক্ত মিনিটের শেষ মিনিটে ঘানার স্ট্রাইকার ডমিনিক আদিয়াস এর হেড থেকে বল যখন নিশ্চিত গোল লাইন অতিক্রম করছিল। তখন সুয়ারেজ ইচ্ছাকৃতভাবে হাত দিয়ে বল ঠেকান। যার ফলে সরাসরি লাল কার্ড দেখে মাঠ থেকে বেড়িয়ে যেতে হয় তাঁকে। কিন্তু পেনাল্টি থেকে ঘানা গোল করতে ব্যর্থ হয়। এবং পরবর্তীতে টাইব্রেকারে উরুগুয়ের কাছে পরাজিত হয়ে বিশ্বকাপ থেকে ঘানা বিদায় নেয়।
শত বিতর্ক থাকলেও বিশ্বকাপ ফুটবল এর আবেদন দিন দিন বেড়েই চলছে। বিশ্বকাপ ফুটবলের জনপ্রিয়তা এখন গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকের চেয়ে কোন অংশে কম নয়। বিশ্বকাপ ফুটবলের উন্মাদনায় আমাদের ঘরোয়া ফুটবলও ফিরে পাক তার পুরনো ঐতিহ্য। আর্জেন্টিনা- ব্রাজিল এর মত মোহামেডান - আবাহানির সমর্থকরা যেন আবার মেতে উঠতে পারি সমর্থন যুদ্ধে।