সারাজীবন ধরে ইচ্ছে ছিলো,আর যাই হোক, অন্তত সঞ্চয়িতা আর সঞ্চিতা আমি কোনোদিনও কিনবোনা।আমার বইয়ের তাক হাহুতাশ করে উঠতো!এমন বইবিদ্বেষী ইচ্ছে আবার থাকতে আছে নাকি?আমি বলতাম, বইবিদ্বেষী হবে কেন?ও দু'টো বই আমাকে পুরষ্কার হিসেবে ঘরে আনতে হবে,এই হলো কথা।ইচ্ছেটা অদ্ভুত ছিলো।তবে আমার কাছে ভালোবাসার। কবিতা ভালোবাসতাম যে! একসময়ের মুখচোরা স্বভাবের জন্য মনে হতো কবিতা আবার সবার সামনে গিয়ে আবৃত্তি করে কী করে? এও কি সম্ভব?
হাজার প্রশ্নকে নিজের মাঝে বন্দী করে আমি ছুটে চললাম বহুদূর।আর আমার মুখচোরামী এক পা এগোয় তো দুই পা দাঁড়িয়ে থেকে আকাশ দেখে।আমি বেজায় দিশেহারা।
একদিন সব ভুল ভাঙলো।আমাকে জোর করে তুলে দাঁড় করিয়ে দেয়া হলো কবিতা বলতে।মা তখন দর্শক সারিতে বসে। আমি দুরুদুরু বুকে এদিক ওদিক তাকালাম।একদম জোর করে কী করে পাঠাবে? আমার জেদের পৃথিবীজোড়া নাম।আমার সায় ছিল বৈকি,নাহয় কবিতা শিখতে গেলাম কেন? মাকে বলতাম, "মা,কোনোদিন কবিতার মত জিনিস মানুষের সামনে গিয়ে ন্যাকামো করে পড়তে পারবোনা।" মা বলতো, "ন্যাকা হবে কেন? দু'একজনকে দেখে সেটাকেই কবিতা ভেবে নিলি? " আমি চুপচাপ বসে খেতে থাকি।ভাবতে থাকি,সত্যিই তো।একুশে ফেব্রুয়ারির দিন যে কবিতাগুলো শুনি তাতে কি ন্যাকামো থাকে আদৌ? আমার ছোট্ট মাথায় চিন্তারা মেলা বসায়।আমি ভাবতেই থাকি।
টিমটিমে আলোর ভাঙা হলরুমের স্টেজ থেকে কী করে যেন চলে গেছিলাম দু'বছর আগের ভাত মাছের দুপুরে! হঠাৎ হুঁশ ফিরে দেখি জেলার সবচাইতে অসাধারণ আবৃত্তিকার আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। আমি সব শীত, গ্রীষ্ম ঠেলে চোখ বুজি।এবার তো শুরু করতেই হবে।বিচারকদের চশমার মোটা ফ্রেম আর দর্শকদের গুনগুন শব্দের মাঝে আমার মায়ের নিঃশ্বাস আলাদা করে আমি অনুভব করি।তারপর কী যে হলো বলতে পারবোনা।জীবনে কোনোদিন একা একা স্টেজে উঠতে সাহস না করা মেয়েটা অদ্ভুত এক ঢঙে সেদিন বলে গেল,"মনে করো,যেন বিদেশ ঘুরে/মাকে নিয়ে যাচ্ছি অনেক দূরে/তুমি যাচ্ছো পালকিতে মা চ'ড়ে/দরজা দু'টো একটুকু ফাঁক করে/আমি যাচ্ছি রাঙা ঘোড়ার প'রে/টগবগিয়ে তোমার পাশে পাশে...." সত্যিই আমি আমার মায়ের বীর ছেলে হয়ে মাকে ঘুরিয়ে নিয়ে এলাম এক অচেনা জোড়া দীঘির মাঠ থেকে।হঠাৎ যুদ্ধ টুদ্ধ শেষ করে তাকিয়ে দেখি,আমি সেই পুরনো হলঘরের টিমটিমে বালবের নিচে ঠায় দাঁড়িয়ে,চারদিক থেকে ঝাপসা ঝাপসা করতালি শুনতে পাচ্ছিলাম, কিন্তু আমার মাথা ঘুরছিলো,বুঝতে পারছিলাম না কী হচ্ছে।তাকিয়ে দেখি মাইকটুকুও কাঁপছে,আর সামনে তাকাতেই মায়ের চোখে জল।আমারও কেন যেন চোখে জল এসে গেল।কিচ্ছু শুনতে পাচ্ছিলাম না,এর মাঝেই বিচারকমহাশয় মাইক হাতে নিয়ে কী যেন বললেন,বুঝতে পারলাম না। তাও মাথা নেড়ে নেমে চলে এলাম। মায়ের কাছ ঘেঁষে বসা হলোনা, ওখানে অন্য কেউ বসে ছিল।দূরে বসে আর মায়ের দিকে তাকাতে সাহস পেলাম না। যদি কান্না পায় আবার? ক্লাসের ছেলেমেয়েগুলো তো খ্যাপাবে আমায়! এমনিতেই নতুন এসেছি স্কুলটায়, তার উপর ক্লাসের এক কোণায় গিয়ে বসে থাকি!
আমার অবাক হবার শুরু হলো তখন,যখন দেখলাম সবাইকে ডিঙিয়ে আমার নামটাই সবার আগে! ক্লাসের সবাই আমাকে চিনতে উঠে পড়ে লাগলো।আমি পারলে লজ্জায় মাটির সাথে মিশে যাই।এটা কী করে হলো? মা আমাকে জড়িয়ে ধরলো।ওইদিনের মত খুশি এরপর কবে হয়েছিলাম জানিনা!
এরপর থেকেই আমার ইচ্ছে সঞ্চয়িতা আর সঞ্চিতা পুরষ্কার পাওয়ার। অনেক জায়গায় গেলাম।আশা করলাম এই দুটোর একটার। কিন্তু না! এরা তো আর সামনে ধরাই দিচ্ছেনা! তবে কি নজরুল আর রবীন্দ্রনাথ আমায় পছন্দ করলেন না?এই চিন্তায় দিন কাটে আমার।একদিন আচমকাই স্কুলের এক প্রোগ্রাম।কী কবিতা পড়েছিলাম ভুলে গেছি।কিন্তু ক্লাসের পর এতক্ষণ বসে থাকতে কষ্ট হচ্ছিল,মাথা ধরছিল বারবার।কে যেন বললো তোমার নাম আছে,বসো! তাই ফিরলাম না।কোনোমতে পুরষ্কারের প্যাকেট হাতে নিয়ে বাড়িতে এসে আমি সে কী খুশি হয়েছিলাম মনে পড়ে! বইটার নাম সোনালী অক্ষরে লেখা ছিল সেদিন।"সঞ্চিতা"! আমার আরাধ্য এক নাম! এরপর কাটতে লাগলো সেই বছর।কবিতা পড়ি বলে মা নিজেই কিনে দিতে চাইতো।বাবাও।আমি বলতাম,"না"। ওঁরা অবাক হতো।একটা ছোটখাটো রবি ঠাকুরের বই ছিল আমার কাছে। তা দিয়েই চলতাম।নাম ছিলো "জল পড়ে পাতা নড়ে"। সে বইয়ের পাতা কত নাড়িয়েছি মনে পড়ে আজও।একদিন আমি সেই বইও ধার দিয়ে এলাম! এভাবে বছর যেতে না যেতেই রবি ঠাকুরের কবিতা কিছু থাকলেও,তার কবিতার আশীর্বাদ পেলোনা আমার বইয়ের তাক।তবুও আমার জেদ,ওটা আমার অর্জনের তালিকাতেই রাখবো।একদিন স্কুলের পুরষ্কার বিতরণীর দিন এলো।লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছি পুরষ্কার আনব বলে।হঠাৎ দেখি এক বান্ধবীর হাতে সেই বই! আমি একটা চিৎকার দিতেই সে বললো,"এতে চিৎকার দেয়ার কী আছে? আমি কেন গল্পের বই পেলামনা বলতে পারিস?" আমি কিছু বললাম না,আমার জেদের গল্প বলতে গেলে এক ফাঁকে মাইক থেকে আমার নামটাই যদি ফসকে যায়? মনোযোগ দিয়ে শুনতে লাগলাম,আর ও সবাইকে বলতে লাগলো আমার এই অদ্ভুত খুশির কথা! হঠাৎ আমার নাম এলো।ততদিনে আমি শিখে গেছি মঞ্চে ওঠা,হাত মেলানো,সুন্দর করে হেসে কী করে পুরষ্কার নিতে হয়,সে কৌশলটুকুও! এগিয়ে গেলাম,কেউ দেখে বলতেও পারবেনা এই মেয়েটা একদিন মুখ লুকোতো। চোখ মেলতেই দেখি রবি ঠাকুর স্নিগ্ধ চোখে তাকিয়ে আমার দিকে।আমার বইয়ের ওপর তাঁরই ছবি।তাঁরই কবিতাভরা বই হাতে নিয়ে নেমে এলাম মঞ্চ থেকে।সেদিন সেই ঘটনা শোনালাম অনেককে! কেউ হাসলো, কেউ খুশি হলো,কেউ পেলো ক্লাসের ফাঁকে গল্প করার জন্য একটা মজার কাহিনী! আর বাসায় গিয়ে আমি বইয়ের তাকে পাশাপাশি রেখে দিলাম দু'টো নাম।সঞ্চয়িতা এবং সঞ্চিতা।মাকে দেখালাম,মা আমার দিকে তাকিয়ে কী মিষ্টি করে হাসলো!তারপর কী যেন ভাবতে ভাবতে নিজের কাজে চলে গেলো।
মাকে তো সবাই ভালোবাসে।নতুন করে কি মায়ের প্রেমে পড়া যায়? যাবেনা কেন? আমি কি সেদিন নতুন করে আবার আমার মায়ের প্রেমে পড়িনি?
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে জানুয়ারি, ২০১৯ ভোর ৪:৪০