(প্রথম পর্বের লিঙ্ক - Click This Link)
১৯শে ডিসেম্বর, ২০১৮
আজকে সারাদিনে যা যা ঘটলো, সেই অভিজ্ঞতা আমার সারাজীবনের যে একটা অন্যতম সম্পদ হয়ে থাকবে, এ আমি বুঝতে পারছি। যতদূর সম্ভব যথাযথরূপেই বর্ণনা করবার চেষ্টা করছি।
আজ সকাল থেকেই বাড়িতে বিভিন্ন লোকের আনাগোনা লেগে ছিলো। লোকসংখ্যা নেহাত কম নয়। শ’খানেক তো হবেই। ঐ ছোট্ট বাড়িতে তিলধারণের জায়গা ছিলো না। তাদের উপলক্ষ্য নাবিকজেঠুর জন্মদিন উদযাপন, আর লক্ষ্য ছিলো তাঁকে বিদায় সংবর্ধনা জানানো। বিদায় সংবর্ধনা কেন, সে ব্যাপারে আমি কিছুই জানতাম না। আজ জানলাম, নাবিকজেঠু আর এখানে থাকবেন না। আগামী কয়েকদিনের মধ্যেই তিনি তাঁর বড়ো ছেলের কাছে চলে যাবেন। এই অশক্ত শরীরে আর তাঁর পক্ষে যে এইভাবে আত্মীয়স্বজনবিহীন হয়ে থাকা সম্ভব নয়, এটা তিনি উপলব্ধি করেছেন জেনে আমার খুব ভালো লাগলো। যদিও এটা তাঁর মনের ইচ্ছা নয়। কিন্তু এবার তাঁকে যেতেই হবে। নিজের জন্মদিনে প্রায় শ’খানেক লোকের মাঝে মধ্যমণি হয়ে ঐ বারান্দাটার সেই আরামকেদারাটায় বসে তিনি যখন বক্তৃতা করছিলেন, তাঁর ভেতরে চেপে থাকা কষ্টটা বোঝা যাচ্ছিলো। তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এই মানুষগুলোকে তিনি খুব ভালোভাবে চেনেন। আর এদের তিনি চেনেন এক অভূতপূর্ব কারণে যা শুনে আমার মন আজ আশ্চর্যরকমের ভারাক্রান্ত।
তাঁর কথা তাঁর ভাষাতেই লেখার চেষ্টা করি। নাবিকজেঠু তাঁর জন্মদিনে ফুলে মালায় সজ্জিত হয়ে ধোপদুরস্ত ধুতি-পাঞ্জাবী পরে বলতে শুরু করলেন, ‘শুরুটা করি একেবারে গোড়া থেকেই। আমি যখন প্রথম এখানে আসি, সেটা প্রায় দশ বছর আগে। এখানকার নির্জন প্রকৃতি বরাবরই আমাকে বিশেষভাবে আকর্ষণ করতো। আমি নিস্তব্ধ সকালে, নির্জন দুপুরে, পড়ন্ত বিকেলে সমুদ্রের এই নৈসর্গিক শোভা দেখতাম। আর বিকেলবেলায় ঘুরতে বেরোনো ছিলো আমার অন্যতম প্রধান শখ। একদিন একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটলো। দেখলাম, বছর কুড়ি-বাইশের একটা মেয়ে এই মরণখাদের সামনে বসে বসে একটা ছোট ডায়রি খুলে কিসব লিখছে। আমি সেদিন বিকেলে ঘুরতে বেরোচ্ছিলাম। ওর দিকে তাকালাম, কিন্তু কোন প্রশ্ন করলাম না। ফেরবার পথে দেখি মেয়েটা আর নেই।
কিন্তু পরেরদিন আবার মেয়েটাকে দেখতে পেলাম। ঐ একই জায়গায় এসে বসে ডায়রিতে কিসব লিখছে। আমি সেদিনও বিশেষ আমল দিলাম না। এমনি করে দু-তিনদিন ধরে রোজই অমনভাবে ওকে লিখতে দেখে আমার খুব কৌতূহল হলো। একদিন ওকে জিগ্যেস করলাম, ‘কি রে? এখানে রোজ বসে বসে কি লিখিস তুই? কবিতা বুঝি?’ মেয়েটা আমার দিকে এক মুহূর্তের জন্য তাকিয়ে বলে উঠলো, ‘না, কবিতা নয়। হিসেব করছি।’ আমি আরেকটু কৌতূহলী হয়ে বললাম, ‘কিসের হিসেব?’ সে প্রথমত আমাকে বলতে চাইছিলো না। পরে ধীরে ধীরে আমি ওর সাথে ভাব জমালাম। ওকে ঘরে নিয়ে এসে এক কাপ কফি খাওয়ালাম। সঙ্গে আরো কিছু খাবার ছিলো। ও দেখলাম বেশ খুশী হলো। তারপর সে আমাকে যা বললো, তা অনেকটা এরকম। সে একটা ছোট মোটেলে কাজ করে। সম্ভবত ঘর পরিষ্কার করার কাজ। তাতে সে যত টাকা পায়, তার এক অংশ সে জমায়। আর তার বর ছিলো এক নম্বরের নেশাখোর আর জুয়াড়ি। সে মেয়েটার সব টাকা জোর করে ছিনিয়ে নিতো। মেয়েটা তাই আগেভাগে তার কিছু টাকা সরিয়ে রাখতো, যাতে তার বর টের না পায়। সে ঠিক করেছিলো, এভাবে বেশ কিছু টাকা জমিয়ে সে দূরে কোথাও চলে যাবে, তারপর অন্য কাজ খুঁজে নেবে। সে মনে প্রাণে চাইতো তার বরের সঙ্গে তার বিচ্ছেদ হয়ে যাক। আমি ওর কথা শুনে সেদিন একটা ছোট্ট ‘বেশ তো’ বলে ছেড়ে দিয়েছিলাম।
বেশ কয়েকদিন এইভাবে চললো। রোজই মেয়েটাকে দেখতাম ঐ একই জায়গায় বসে লিখছে। সেই দৃশ্যটা আমার স্মৃতিতে এখনও ছবির মত ভেসে ওঠে। তারপর একদিন হঠাৎ মেয়েটা এদিকে আসা বন্ধ করে দিলো। বেশ কয়েকদিন সে বেপাত্তা। তারপর প্রায় দিন পাঁচেক বাদে তাকে আবার দেখতে পেলাম। তার হাতে লেখার খাতা নেই, কলম নেই। সে শূন্য দৃষ্টিতে উদাস মনে বসে আছে। ঐ গভীর খাদের দিকে তাকিয়ে যেন সেই খাদের তল পরিমাপ করছে। সে আমাকে দেখতে পেয়েই বলতে লাগলো, ওর সব জমানো টাকা ওর বর কেড়ে নিয়েছে। ও আলাদা করে টাকা জমাতো বলে ওকে খুব মেরেছে সে। সেই কারণে অসুস্থ হয়ে সে বাড়িতে বিছানায় পড়েছিলো। মেয়েটা সেদিন আমাকে জড়িয়ে ধরে কি কান্নাটাই কাঁদছিলো। আমি ওকে সান্ত্বনা দিতে পারছিলাম না। ওকে কি বলবো সেটাই আমি বুঝতে পারছিলাম না। হঠাৎ ও বলে উঠলো, ‘আমি কিভাবে পালাবো বলুন, আমি কিভাবে পালাবো?’ এই বলতে বলতে ও আমার কিছুর বোঝার আগেই ঐ মরণখাদে ঝাঁপ দিলো।
এই পর্যন্ত বলে নাবিকজেঠুর কিছুক্ষণ থামলেন। তাঁর সামনে দণ্ডায়মান শোতৃমণ্ডলী সবাই নিশ্চুপ। নাবিকজেঠু ধীরে ধীরে বলতে লাগলেন, ‘মেয়েটাকে সেদিন বাঁচাতে পারিনি – এই আক্ষেপ আমার মন থেকে কোনোদিন মুছবে না। তখনও এই মরণখাদ সম্বন্ধে বিশেষ জানতাম না। ঐ ঘটনাটা কাগজে বেরিয়েছিলো। তখন থেকেই জানি, এখানে সারাবছরে অন্তত কুড়ি থেকে পঁচিশটা মতো আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে।
তখন থেকে ঠিক করলাম, যদি পারি, তো কিছু মানুষকে আমার যতদূর সম্ভব সাহায্য করবো। এরপর থেকে আমি নিজেকে সজাগ রাখতে শুরু করলাম। যদি কেউ এখানে এসে পড়ে। যদি কাউকে দেখে মনে হয় সে নিজেকে শেষ করে দেওয়ার চিন্তা করছে। তাহলে আমি বেশি কিছু নয়, শুধু তাকে এক কাপ কফি খেয়ে যাওয়ার অনুরোধ করতাম। এইভাবেই আমি আপনাদের সকলকে বাঁচিয়েছি। আরো অনেকে এখানে নেই যাদের আমি বাঁচিয়েছিলাম। অনেককে বাঁচাতে আমি পারিওনি। অনেকক্ষেত্রে আমাকে জীবনের ঝুঁকি নিতে হয়েছিলো। এই বুড়ো বয়সে একজনকে বাঁচাতে গিয়ে পায়ে চিড়ও ধরেছে আমার। তবু তাতে আমার কোন ক্ষোভ নেই। নাবিক হিসেবে একসময় সমুদ্রের জলে ভাসতে থাকাটাই আমার পেশা ছিলো। আর আজ যে আমি আপনাদের জীবনের সমুদ্রে ভাসতে শেখাতে পেরেছি, এতেই আমি খুশী।
আমার আয়ু ফুরিয়েছে। আপনারা হয়ত জানেন আমি ক্যান্সার আক্রান্ত। এই মারণ রোগ নিয়ে আমি হয়তো এই পৃথিবীতে আর বেশিদিন থাকবো না। কিন্তু আপনাদের মধ্যে থাকলে আমার খুব বেঁচে থাকতে ইচ্ছা করে। জানিনা, এখান থেকে চলে গেলে সেই ইচ্ছেটা কতখানি জীবিত থাকবে। তবে আপনাদের সকলের জীবন সার্থক হয়ে উঠুক, এই কামনা করি।
নাবিকজেঠুর কথা শেষ হতে একজন কৃশকায় লোক তাঁর কাছে এগিয়ে এলো। তারপর জেঠুর হাতদুটো ধরে বললো, ‘কাল এক বড়ো ভুল করছিলাম। আপনি শুধরে দিলেন। অজস্র ধন্যবাদ আপনাকে।’ লোকটাকে আমি চিনি। কালকের ঐ ব্যক্তি যাকে নাবিকজেঠু আর হরিকাকু ধরাধরি করে নিয়ে আসছিলেন। গতকাল সে রাগের সঙ্গে বেরিয়ে গেছিলো, আর আজ দেখলাম তার চোখে জল। অনেকের চোখেই আজ জল দেখেছিলাম। নাবিকজেঠু তার দিকে তাকিয়ে স্মিত হাসলেন। তারপর স্থির দৃষ্টিতে সমুদ্রের ঐ অসীমের পানে চেয়ে রইলেন। পড়ন্ত বিকেল তখন। সূর্যের কমনীয় রক্তিমাভ আলো তাঁর সমস্ত মুখমণ্ডলে ছড়িয়ে পড়ে উজ্জ্বল করে তুলছে। তবে তাঁর দৃষ্টিতে যেন লেগে রয়েছে একটা গভীর শূন্যতা। যেন অসীম কোনো খাদের সম্মুখে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি, এবার তাঁকে সেখানে ঝাঁপ দিতে হবে।
খাওয়া-দাওয়া, আনন্দ, নাচগান – সবই হলো। নাবিকজেঠু আজ একজন প্রাণচঞ্চল যুবকের মতো সমস্ত কিছুতেই অংশগ্রহণ করলেন। রাতে আমাদের সাথে চিকেন রোস্ট খেলেন। আগুনের ধারে আমাদের সাথে গোল হয়ে কিছুক্ষণ নাচলেন। কি একটা গান বেসুরোভাবে গাইলেন। এই গানটা নাকি তিনি জাহাজে চাকরি করাকালীন শিখেছিলেন। সবই তাঁকে করতে দেখলাম। তবু আমার মনে হলো, তিনি আজ বারবার অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছিলেন। সারাদিন হুল্লোড় চলেছে, থেমেছে রাত বারোটার পরে। তাও ওদের অধিকাংশেরই সারারাত আনন্দ করবার ইচ্ছা ছিলো। কিন্তু নাবিকজেঠুর শরীরের অবস্থা বিচার করেই ওরা সবাই একে একে বিদায় নিলো।
এখন রাত প্রায় আড়াইটে বাজে। আমার আর আজ রাতে হয়তো ঘুম হবে না। এখানে অনেক অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করলাম। কাল যখন বাড়ি ফিরবো, মনটা অনেক হাল্কা থাকবে। ইচ্ছা করে, মাঝে মাঝেই এখানে ফিরে আসি। হয়ত আবার আসবও। নাবিকজেঠু এখান থেকে চলে যাচ্ছেন ঠিকই। কিন্তু বাড়িটা তো আর যাচ্ছে না। আপাতত হরিকাকা এখানে থাকবে। আমিও মাঝে মাঝে না হয় এখানে এসে হরিকাকার সাথে কাটিয়ে যাব। আর যদি দেখি কেউ মরণখাদের কাছে গেছে, তাহলে একবার বলবো, ‘এক কাপ কফি খেয়ে যান।’
যাই হোক, এখন আসি। বিদায়।
:: সমাপ্ত::
(প্রথম পর্বের লিঙ্ক - Click This Link)