সত্যস্বর পত্রিকার একটি প্রতিবেদন
২৩শে অক্টোবর, ২০০৮
অমরগিরিতে যুবতীর মৃত্যু
নিজস্ব প্রতিবেদন – অমরগিরিতে সাগরের উপকণ্ঠে এক যুবতীর ক্ষতবিক্ষত দেহকে ঘিরে এলাকায় চাঞ্চল্য ছড়িয়েছে। শিখা দাস নামে ঐ যুবতী স্থানীয় একটি ধাবায় কাজ করতেন। গত বৃহস্পতিবার ধাবা থেকে বাড়ি ফেরবার পথে তিনি নিখোঁজ হয়ে যান। এদিন সকালে স্থানীয় মানুষজন মোহনা সাগরতীরে তার দেহ পড়ে থাকতে দেখে পুলিশে খবর দেয়। পুলিশের অনুমান এটা আত্মহত্যার ঘটনা। বেদে পাড়ার ঐ যুবতীর এক প্রতিবেশীর কথায়, ‘দিন কয়েক ধরে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঝামেলা চলছিলো।’ জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশ যুবতীর স্বামীকে থানায় নিয়ে যায়। দেহটি ময়নাতদন্তের জন্য পাঠানো হয়েছে।
তবে অমরগিরিতে আত্মহত্যার ঘটনা নতুন কিছু নয়। এলাকার বাসিন্দা সঞ্জীব চন্দর কথায়, ‘এখানকার সুপর্ণ সরণী নামে রাস্তাটা একটা খাড়াই পাহাড়ের ওপর এসে শেষ হয়ে গেছে। সেই পাহাড়ের কিনারা থেকেই বছরে প্রায় তিরিশ-চল্লিশ জন লোক আত্মহত্যা করে। স্থানীয় মানুষজনের মুখে খাদটার নামই হয়ে গেছে মরণখাদ। অত্যন্ত নির্জন এই অঞ্চলটাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করবার জন্য অনেকদিন ধরেই দাবী করছেন এলাকাবাসীরা। কিন্তু সেক্ষেত্রে এখানকার অধিবাসীদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে বলে প্রশাসন থেকেও কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এখন এই মৃত্যু আরো একবার প্রমাণ করে দিলো, এই এলাকাটা কতখানি ভয়ঙ্কর।
উত্তম মিত্রের ডায়রি
১২ই ডিসেম্বর, ২০১৮
বাবা আজ বললো, ‘তোকে নাবিকজেঠুর বাড়ি যেতে হবে। আমিই যাবো বলে ঠিক করেছিলাম, কিন্তু অফিসে কাজের খুব চাপ। তাই আমার পক্ষে এখন যাওয়া সম্ভব হবে না। তুই-ই যা। ওনাকে তো তুই ভালোমতোই চিনিস। আর উনিও তোকে চেনেন। কোনো অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।’
বাবার কথায় আমি একটু অস্বস্তিতে পড়লাম। নাবিকজেঠুকে যে চিনি না তা নয়। কিন্তু যে লোকটাকে আমি প্রায় সাত-আট বছর দেখিনি, তাকে আজ হঠাৎ দেখতে গেলে কেমন লাগবে সেই ভেবেই আমি কিছুটা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লাম। বাবা আমাকে হতবুদ্ধি দেখে আশ্বাস দিলো, জেঠুকে আগেভাগে ফোন করে সব কথা জানিয়েই আমাকে পাঠানো হবে। এই বলে বাবা তো আমাকে দিন তিন-চার পরে রওনা হতে বলে চলে গেলো। কিন্তু আমার কেমন কেমন লাগছে। একটা লোককে কতদিন দেখিনি। এ কথা ঠিক যে, যে জেঠু খুবই খোলামেলা মনের মানুষ। কিন্তু আজ এতগুলো বছর পর আবার তাঁর সাথে যখন দেখা হতে চলেছে, তখন কেমন লাগবে কে জানে? বাবার কথা তো ফেলতে পারি না।
নাবিকজেঠুর বাবার জেঠুর বড়োছেলে। পঁচিশ বছরের বড়ো এই দাদার সঙ্গে বাবার ভাব একেবারে অভিন্নহৃদয় বন্ধুর মতো। জেঠুর রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার কথা বাবার কাছে কত শুনেছি। দীর্ঘদেহী, স্বাস্থ্যবান মানুষটা ছোটবেলায় বেশ কয়েকবার এসেওছেন আমাদের বাড়িতে। কিন্তু বিশ বছর ভারতীয় নৌবাহিনীতে কাজ করে আর তারপরে প্রায় বাইশ বছর সরকারী চাকরি করার পর এখন তিনি আত্মীয়-স্বজন ছেড়ে সমুদ্রের ধারে ছোট্ট বাড়ি করে থাকেন। সঙ্গে হরি নামে এক চাকর থাকে সর্বক্ষণের জন্য। বাবা তো বলে, ‘বৌ ম’রে যাওয়ার পর ওর মাথাটাই গেছে। না হলে এই বয়সে কেউ আপনার জনকে ছেড়ে দূরে থাকে?’ জেঠুর দুই ছেলে। বড়ো ছেলে থাকে কলকাতায়। আর.বি.আইয়ে কাজ করে। আর ছোটো ছেলে ডি.আর.ডি.ওর সায়েন্টিস্ট। হায়দ্রাবাদে আছে। দুজনেরই বিয়ে থা হয়ে গেছে। ছেলেমেয়েও আছে। দুজনেই তাদের বাবাকে কাছে আনতে চায়। কিন্তু নাবিকজেঠুর এক জেদ। তিনি ঐ সমুদ্রের পাড় থেকে নড়বেন না। যদি বাবাকে চাও, তো তোমরা এখানে এসো।
এই তো হলো নাবিকজেঠুর কথা। এখন দু-তিনদিনের মধ্যে জোগাড়যন্ত্র করে বেরোতে হবে। কলেজের এখন ছুটি। আর এটাই বাবার আমাকে পাঠানোর মূল কারণ। যাই হোক, এখানে যা হাড়কাঁপানো ঠাণ্ডা পড়েছে, তাতে সমুদ্রের ধারে গেলে ভালোই লাগবে মনে হয়।
১৫ই ডিসেম্বর, ২০১৮
দুদিন লেখালিখি বন্ধ ছিলো। এর কারণটা অবশ্যই হলো যাওয়ার তোড়জোড়। নিজের জামাকাপড় গোছানো হয়ে গেছে। ট্রেনের টিকিট কেটে আগাম আসন সংরক্ষণ করে রেখেছি। আর হ্যাঁ, সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ খবর হলো, নাবিকজেঠুর সাথে কথা বলেছি। আমি, বাবা, মা তিনজনেই ভালোভাবে কথা বলেছি জেঠুর সাথে। কথা বলে মনে হলো, এখনও উনি আগের মতোই খোলামেলা স্বভাবের আছেন। আমার সাথে কথা শুরু হতেই তিনি বলে উঠলেন, ‘কি রে চ্যাঙ্গা বিশু। কেমন আছিস?’ উনি আমাকে ছোটবেলায় যে চ্যাঙ্গা বিশু বলে ডাকতেন, সেটা ওনার এখনও মনে আছে দেখে খুব ভালো লাগলো।
তবে আজ বাবার কাছে যেটা শুনলাম, সেটা যথেষ্ট চিন্তার বিষয়। বাবা জানালো, নাবিকজেঠুর ক্যান্সার হয়েছে। এই অবস্থায় ওনার পক্ষে অমন একটা অজ এলাকায় একা একা থাকাটা নিতান্তই অনুচিত। তাই মানিকদা, মানে জেঠুর বড়োছেলে চাইছে জেঠুকে কলকাতায় ফিরিয়ে নিয়ে যেতে। কিন্তু জেঠুকে রাজী করানোটাই মুশকিলের। যাই হোক, আমিও জেঠুকে বাড়ি যাওয়ার ব্যাপারে বলবো। জানি না, উনি আমার কথা কতদূর শুনবেন। তবে বাবাকে দেখে মনে হলো, এ ব্যাপারে বাবা খুবই উদ্বিগ্ন। আর নিজে এখন যেতে পারছে না বলে আমাকে পাঠাচ্ছে। এই ফাঁকে অবশ্য আমার একটু ঘুরে আসা হবে।
একা একা দূরপাল্লার ট্রেন ভ্রমণের অভিজ্ঞতা আমার আগে একবার হয়েছে। তবে কাল যে যাবো – এই নিয়ে একটা উত্তেজনাও মনে মনে কাজ করছে। না হলে, রাত এই সাড়ে বারোটার সময়েও আমার চোখে ঘুম থাকবে না কেন? কাল ভোর সাড়ে পাঁচটার সময় ট্রেন। মা বলেছিলো, সাড়ে ন’টার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়তে। সেই মতো ন’টার মধ্যে খাওয়াদাওয়াও শেষ করে নিয়েছিলাম। এখন আর ঘুমই আসছে না।
১৭ই ডিসেম্বর, ২০১৮
এইভাবে এতদূরে একা একা কারুর বাড়ি যাওয়া আমার জীবনে এই প্রথম। ট্রেনে ঘুমটা ভালোই হয়েছিলো। স্টেশন আসার একটু আগে ঘুমটা ভেঙেছিলো ভাগ্যিস! নইলে আর নামতে হতো না। যাই হোক, ট্রেন থেকে নেমে একটা অটো ভাড়া করে জায়গাটার নাম বলতেই একটা রাস্তার মোড়ে এসে অটোটা দাঁড় করালো। ভাড়া নিলো দশ টাকা। সামনে তাকিয়ে দেখি হরিকাকু রাস্তার মোড়েই দাঁড়িয়ে আছে। আগে ওনাকে অনেক জোয়ান দেখেছিলাম। এখন মাথার চুল সব সাদা হয়ে গেছে। মুখে খোঁচা খোঁচা কাঁচাপাকা দাড়ি। নাবিকজেঠুর সাথে উনিও আমাদের বাড়িতে অনেকবার এসেছেন। আমাকে আসতে দেখে হরিকাকু ঈষৎ হাসলেন। তারপর পরস্পর কুশল বিনিময় করতে করতে দুজনে এগোতে থাকলাম।
নাবিকজেঠুর বাড়িটা একটা অসাধারণ জায়গায়। সমুদ্রের ধারে একটা ছোট পাহাড়। আর তারই একপাশে জেঠুর একতলা ছোট একটা বাড়ি। বাড়ির সামনের যে রাস্তাটা, সেটা জেঠুর বাড়ি পর্যন্ত এসেই শেষ হয়ে গেছে। ওদিকটায় আরেকটু এগোলে বেশ বড়োসড়ো একটা খাদ। প্রায় চল্লিশ ফুটের ওপর গভীর এই খাদটার নিচে রয়েছে বালিয়াড়ি। আর তার থেকে কিছুটা এগিয়েই শুরু হয়েছে সমুদ্রতট। সামনে তাকালে দেখা যায় চিকচিক করছে সমুদ্রের জল। আমি বাড়িতে ঢোকার আগে ঐদিকে একটু যেতে গেছিলাম। হরিকাকু আমাকে হাত ধরে টেনে নিয়ে এলেন। আর চোখ পাকিয়ে বলে উঠলেন, ‘ওইদিকে যাবে না বাবু। ওইটা হইলো মরণখাদ।’ আমি হরিকাকুর কথা বিশেষ বুঝলাম না। ওকে কিছু জিগ্যেস করবার ইচ্ছেও হলো না। কারণ আমি তখন ঐ সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে রয়েছি। এখানে প্রতি মুহূর্তে ভেসে ভেসে আসছে সেই সমুদ্রের গর্জন। নাবিকজেঠুর বাড়ির সামনেই আছে একটা ছোট উঠোন। তাতে বিভিন্ন ধরনের ছোট ছোট ফুলের গাছ।
আমি যখন বাড়িতে পৌঁছোলাম তখন সাতটা বেজে গেছে। বাড়িতে ঢুকতেই দেখলাম নাবিকজেঠু বাড়ির সামনের উঠোনটায় উবু হয়ে বসে আগাছা পরিষ্কার করছেন। জেঠু আগের থেকে একটু রোগা হয়েছেন বলে মনে হলো। আর মুখে অনেক দাড়ি রেখেছেন। আমাকে দেখে উঠে এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরলেন। আমিও চট করে প্রণামটা সেরে ফেললাম। ‘কি রে কেমন আছিস?’ ইত্যাদি কুশলবিনিময় কিছুক্ষণ হলো। তারপর উনি আমাকে বারান্দাতে একটা চেয়ারে বসতে দিলেন আর হরিকাকুকে নিয়ে ভেতরের ঘরে গেলেন। আমি বসে বসে বাইরের দৃশ্য উপভোগ করছিলাম। সূর্য বেশ কিছুটা উঠেছে। সমুদ্রের জলে তার আলো পড়ে মনে হচ্ছে যেন শত শত মণি-মুক্তো ছড়ানো আছে সামনের ঐ অসীম বিস্তৃত জলরাশির ওপরে। খুব হাওয়া দিচ্ছিলো সকালবেলাতে। লোনা হাওয়া আর তার সাথে সমুদ্রের গর্জন। এর বেশ একটা নেশা ধরানো ক্ষমতা আছে, খানিকক্ষণ ধরে শুনতে থাকলে যেন মনে হয় বাস্তবের এই কোলাহলময় পৃথিবীটাকে কোথায় দূরে ফেলে এসেছি। যেহেতু এখানে বড়ো রাস্তা করার পরিসর নেই, আর এখানে লোকবসতিও বেশি একটা নয়, তাই কোলাহল এই জায়গাকে এখনও ছুঁতে পারেনি।
দৃশ্য দেখতে আমি এতোটাই বিমোহিত হয়ে গেছিলাম, যে বারান্দা থেকে বেরিয়ে আমি এগিয়ে যেতে লাগলাম। আর ঠিক তখনই নাবিকজেঠু ডাক দিলেন, ‘কি হে, চ্যাঙ্গা বিশু। ওদিকে কোথায় চললে? এসো, আগে বিশ্রাম করো। তারপর বিশ্রম্ভালাপ করা যাবে।’
নাবিকজেঠু আমাকে যে ঘরে নিয়ে গেলো সে ঘরটা বেশ ছোট। একটা ছোট চৌকি পাতা আছে ঘরের মাঝখানে। আর তার পাশেই একটা টেবিল। আমি নিজের ব্যাগ মেঝেতে রেখে খানিকক্ষণ বিশ্রাম করে, বাইরের পোশাক পাল্টে আবার সেই বারান্দার চেয়ারে এসে বসলাম। লুচি আর আলুর দম ছিলো সকালের টিফিনে বরাদ্দ। নাবিকজেঠুর সাথে সাধারণ কথাবার্তা সারলাম। উনি জানালেন, ওনার গত কয়েকদিন আগে পায়ে সামান্য চিড় ধরেছিলো, কিন্তু এখন দিব্যি আছেন। যদিও আমি দেখেছি, নাবিকজেঠু এখনও একটু খুঁড়িয়ে হাঁটেন। কিন্তু তিনি সেটাকে বিশেষ আমল দিলেন না। আমি জিগ্যেস করলাম, ‘কি করে অমন হলো তোমার?’ উনি খুব স্বাভাবিকভাবেই বললেন, ‘ঐ একটা লোককে টেনে তুলতে গিয়ে পা ফসকে পড়েছিলাম। ওতেই একটা চিড় ধরেছিলো।’ আমি বললাম, ‘তোমার কিন্তু এরকম একা একা থাকাটা একদম উচিত নয়। মানিকদা তোমাকে অত করে যেতে বলে, তবুও তুমি ওদের কথা শোনো না। তোমার কি ওদের জন্য একটুও মন কেমন করে না?’ আমার কথা শুনে মুচকি হেসে নাবিকজেঠু বললেন, ‘করে না, তা নয়। তবে এখানে যা আছে, তা কি আর ওখানে পাবো?’ আমি বললাম, ‘কী পাওয়ার আছে এখানে? এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তো? এটা হয়ত তুমি কলকাতায় পাবে না। কিন্তু তোমার নিজের জীবনটা তো আগে, তাই না? যখন ইচ্ছে করবে, মাঝে মাঝে চলে আসবে এখানে।’ নাবিকজেঠুর আমার কথার উত্তর না দিয়ে বললেন, ‘তুই যখন এখানে এসেছিস, তখন দুটো দিন থেকে যা। সামনের শুক্রবার আমার জন্মদিন। আমার ইচ্ছে, এবারের জন্মদিনটায় তুই আমার এখানে থাক।’
নাবিকজেঠুকে যত দেখছি, ততই বিস্মিত হচ্ছি। সারাদিনে ওনাকে যেমন কর্মঠ, আর প্রাণচঞ্চল দেখলাম, তাতে মনেই হয় না, লোকটা ক্যান্সার আক্রান্ত। আমার মনে হলো, ঐ মারণরোগের ভয়টাকে যেন উনি বেমালুম ভুলে আছেন। বাড়ি যাওয়ার প্রতি ওনার তীব্র আপত্তি। অবশ্য এই পরিবেশের সঙ্গে তিনি হয়ত নিজেকে এমনভাবে জড়িয়ে নিয়েছেন যে এখান থেকে যেতেই তাঁর মন চাইছে না। কিন্তু একথাও সত্যি, এখান থেকে ওনার রোগের চিকিৎসা করাও সম্ভব নয়। ওনার মতো বিচক্ষণ ব্যক্তির কি এই সহজ সত্যিটাকে বুঝতে পারছেন না? কে জানে?
আজ রাত অনেক হলো। এবার আমাকে ঘুমিয়ে পড়তে হবে।
১৮ই ডিসেম্বর, ২০১৮
আজ একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটলো। আমার মনে হচ্ছে, নাবিকজেঠু আর হরিকাকা দুজনেই আমার কাছ থেকে কিছু লুকোতে চাইছে। রাত বারোটা বাজে এখন। তবু লিখতে বসেছি। ঘটনাটা ঘটেছিলো সকালবেলায়।
ছ’টা থেকে সাড়ে ছ’টার মধ্যে ঘুম থেকে ওঠা আমার রোজকার অভ্যাস। আজও তাই উঠেছিলাম। আমার ঘরের জানালা দিয়ে সোজা তাকালে দেখা যায় সূর্য উঠছে। নিচে সমুদ্রের বেলাভূমি, সেখানে গুটিকয়েক লোক ছোট ছোট ডিঙি নৌকো নিয়ে মাছ ধরছে। দিনের কমনীয় আলোয় চকচক করছে সমুদ্রের জল। তার কিরণ ঠিকরে এসে পড়ছে আমার এই ঘরে। সিলিংয়ে একটা ঢেউ খেলানো আলো। উঠোনে তখন হরিকাকা কাজ করছিলেন। ফুলগাছের চারাগুলোতে জল দিচ্ছিলেন। আর নাবিকজেঠু বারান্দায় ইজিচেয়ারে বসে চা খাচ্ছিলেন। বোধহয় গভীর কোন চিন্তায় নিমগ্ন ছিলেন তিনি।
কতক্ষণ এমনটা চলছিলো বলতে পারি না। আমি বাইরে জানালা দিয়ে তাকিয়ে ছিলাম। হঠাৎ দেখি নাবিকজেঠু খুব দ্রুত চায়ের কাপটা টেবিলে রেখেই দৌড়ে গেলেন বাইরের দিকে। চায়ের কাপ থেকে চা কিছুটা চলকে পড়লো তার গায়ে, কিছুটা পড়লো টেবিলে। কিন্তু তিনি তাতে ভ্রূক্ষেপও করলেন না। হন্তদন্ত হয়ে ছুটে যেতে লাগলেন বাইরের দিকে। তার দিকে তাকিয়ে হাতের কাজ ফেলে রেখে হরিকাকাও ছুটলেন তার পেছন পেছন, ‘বাবু দৌড়োবেন না, বাবু দৌড়োবেন না’ বলতে বলতে। আমি আর থাকতে পারলাম না। আমিও দ্রুত দরজা খুলে সবেগে ওদের পেছন পেছন ছুটলাম। বাড়ির সীমানা পেরোতেই দেখলাম, মরণ খাদের ধারে এক ব্যক্তি প্রায় শুয়ে পড়েছে। আর তাকে সেখান থেকে তুলে নাবিকজেঠু আর হরিকাকা প্রাণপণে টেনে নিয়ে আসছেন এদিকে। আমি তো ওদের এইভাবে দেখে হতভম্ব হয়ে গেলাম। কী হয়েছে লোকটার?
বয়স প্রায় তিরিশ হবে। মাথায় ঘন চুল। মুখে দাড়ির জঙ্গল। গায়ের রং বেশ কালো। লোকটাকে বাড়িতে নিয়ে এসে নাবিকজেঠু বসালেন বারান্দার চেয়ারটাতে। নিজে বসলেন ইজিচেয়ারে। তার কিছুক্ষণের মধ্যেই এক কাপ গরম কফি নিয়ে এলেন হরিকাকা। তাকে সেই কফি দেওয়া হলো। লোকটা ইতিমধ্যে কিছুটা ধাতস্থ হয়ে নাবিকজেঠুর দিকে বিস্ময়াবহ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো খানিকক্ষণ। তারপর একটা আক্রোশ তার দৃষ্টির সমস্ত বিস্ময়কে ভস্মীভূত করে ফেলে অত্যন্ত কঠোর হয়ে উঠলো। লোকটা বেশ কর্কশভাবে নাবিকজেঠুকে বলে উঠলো, ‘আমাকে আপনারা এখানে নিয়ে এলেন কেন?’ নাবিকজেঠু খুব শান্তভাবে, মুখে ঈষৎ হাসি এনে বললেন, ‘আমার কফি খাওয়ার সঙ্গী জুটছিলো না। তাই আপনাকে নিয়ে এলাম। আপনি আমার সাথে কফি খান। তারপর যেখানে যাচ্ছিলেন, সেখানে যেতে পারেন। আমি আপনাকে আটকাবো না।’ লোকটা ঠিক আগের মতোই কর্কশ স্বরে বলতে লাগলো, ‘নিকুচি করেছে কফি।’
এই বলে সে পেয়ালার কফিটুকু অত্যন্ত দ্রুত কোনোরকমে গলাধঃকরণ করে সেখান থেকে উঠে চলে গেলো। যাওয়ার সময় সে অত্যন্ত দ্রুত হাঁটছিলো, দেখলাম তার পা কিছুটা টলছিলো। কিছুক্ষণ সমস্তটাই নিস্তব্ধ। একটা পাখি ট্যাঁ ট্যাঁ শব্দে খুব ভোর থেকেই ডেকে যাচ্ছিলো। তার আওয়াজটা এখনই হঠাৎ থেমে গেলো। আমরা এই নিস্তব্ধতার প্রতি হঠাৎ সচেতন হয়ে যেন ভাবরাজ্য থেকে বাস্তবে ফিরলাম। নাবিকজেঠু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে হরিকাকাকে বললেন, ‘কফির কাপ দুটো নিয়ে যা হরি।’ হরিকাকা চলে গেলে আমি নাবিকজেঠুকে জিগ্যেস করলাম, ‘কী হয়েছে জেঠু? ঐ লোকটা কে?’ নাবিকজেঠুর আমার দিকে তাকিয়ে স্মিতহাস্যে বলে উঠলেন, ‘কেউ না।’ এর বেশি কোন উত্তর না করে ধীর পায়ে ঘরের ভিতর চলে গেলেন তিনি।
হরিকাকাকে পরে এই লোকটার সম্বন্ধে জিগ্যেস করেছি। তাঁর ভাসা ভাসা উত্তরে এটুকু বুঝতে পেরেছিলাম, ঐ লোকটা মরণখাদে ঝাঁপ দিয়ে নিজেকে শেষ করে দিতে এসেছিলো। নাবিকজেঠু সেটাই আগেভাগে বুঝতে পেরে ছুটে যান। তারপর তাকে দুজনে মিলে ধরে নিয়ে আসেন।
এ তো খুব ভালো কথা। আমার শুনে খুব ভালো লাগলো। লোকটা আবার আত্মহত্যা করার চেষ্টা করবে কিনা জানি না। কিন্তু আপাতত যে তার প্রাণরক্ষা পেলো, সেটাই আমাকে খুব খুশী করলো। কিন্তু নাবিকজেঠু অমনভাবে কিছু না বলেই চলে গেলেন কেন? উনি চাইলে তো আমাকে খুলেই বলতে পারতেন। উনি কি কিছু লুকোতে চাইছেন? আরেকটা ব্যাপার! যদিও হরিকাকা আমাকে পুরো ঘটনাটাই বললেন। তবু আমার মনে হলো, উনিও যেন কিছু চেপে যাচ্ছেন। আমার এই অনুমানে ভুলও হতে পারে। তবে যদি এটা ঠিক হয়, তবে কি ধরে নেবো আমি বাইরের লোক বলেই ওনারা আমার কাছে সবটা খোলসা করে বলছেন না? ব্যাপারটা আমার ঠিক মাথায় ঢুকলো না।
আজ আর লিখবো না। হঠাৎ কারেন্ট চলে গেলো। একটা ব্যাটারির আলো আছে বটে। তবে তার ভরসায় আর বেশি রাত জাগাটা উচিত হবে না।
(প্রথম পর্ব সমাপ্ত)
(দ্বিতীয় পর্বের লিঙ্ক - Click This Link)
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই আগস্ট, ২০২০ দুপুর ১:২৮