somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গগন-চটি

১০ ই মার্চ, ২০২৩ বিকাল ৫:৫৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

কিছুতেই কোন কাজে মন বশাতে পারছি না। ব্লগ পড়ে কোন রকমে সময় কাটিয়ে দিচ্ছি।নিজে কোন কিছুই লিখতে পারছি না। তাই ভাবলাম বিভিন্ন সময়ে পড়ে ভাললাগা গল, প্রবন্ধ বা কবিতা গুলো ব্লগে শেয়ার করি।

আজ আপনাদের সাথে শেয়ার করছি পরশুরামের লেখা "গগন-চটি" পল্পটি। চারিদিকের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে আমাদের গগনেও গগন চটির আবির্ভাব একান্ত আবশ্যক।

** গল্পটি সংগ্রহ করেছি আন্তর্জাল থেকে



রাজশেখর বসু (মার্চ ১৬, ১৮৮০ - এপ্রিল ২৭, ১৯৬০) ছিলেন একজন বিশিষ্ট ভারতীয় বাঙালি সাহিত্যিক, অনুবাদক, রসায়নবিদ ও অভিধান প্রণেতা। তিনি পরশুরাম ছদ্মনামে তার ব্যঙ্গকৌতুক ও বিদ্রুপাত্মক কথাসাহিত্যের জন্য প্রসিদ্ধ।

***গগন-চটি***

হাতিবাগানের দরজী আবুবকর মিঞা আর তার বউ রমজানী বিবি সন্ধ্যার সময় পশ্চিম আকাশে ঈদের চাঁদ দেখছিল। হঠাৎ একটা অদ্ভুত জিনিস রমজানীর নজরে পড়ল। সে তার স্বামীকে জিজ্ঞাসা করল, ও মিঞা, আসমানের মধ্যিখানে ছোট্ট কাটারির মতন জ্বলজ্বল করছে ওটা কি গো? আবুবকর অনেকক্ষণ ঠাহর করে বলল, কাটারি নয় রে, ওটা পয়জার, দেখছিস না তালতলার চটির মতন গড়ন। বোধ হয় মল্লিকবাবুরা ফানুস উড়িয়েছে।
আবুবকরের অনুমান ঠিক নয়, কারণ পরদিন এবং তারপর রোজই সন্ধ্যার পর আকাশে দেখা গেল। এই অদ্ভুত বস্তু ফানুসের মতন এদিক ওদিক ভেসে বেড়ায় না, আকাশে স্থির হয়েও থাকে না, চাঁদ আর গ্রহ—নক্ষত্রর মতন এর উদয় অস্ত হয়। উদীয়মান জ্যোতিঃসম্রাট তারক সান্যালকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বললেন, ওটা রাহু, বলেই মনে হচ্ছে, মহাবিপদের পূর্বলক্ষণ। এই কথা শুনে প্রবীণ জ্যোতিঃসম্রাট শশধর আচার্য বললেন, তারকটা গোমূর্খ, রাহু হলে মুণ্ডুর মতন গড়ন হত না? ওটা কেতু, ল্যাজের মতন দেখাচ্ছে। অতি ভীষণ দুর্নিমিত্ত সূচনা করছে। তোমাদের উচিত গ্রহশান্তির জন্য যাগ করা আর অষ্টপ্রহরব্যাপী হরিসংকীর্তন।
একটা আতঙ্ক সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ল। খবরের কাগজে নানা রকম মন্তব্য প্রকাশিত হতে লাগল। একজন লিখলেন, বোধহয় উড়ন চাকতি, ধাক্কালেগে তুবড়ে গিয়ে চটিজুতোর মতন দেখাচ্ছে। আর একজন লিখলেন, নিশ্চয় ল্যাজকাটা ধূমকেতু, সূর্যের আর একটু কাছে এলেই নূতন ল্যাজ গজাবে, তার ঝাপটায় পৃথিবী চুরমার হতে পারে।
প্রবীণ হেডপণ্ডিত কুঞ্জবিহারী তলাপাত্র কাগজে লিখলেন, এই আকাশচারী ভয়ংকর পাদুকা কোন মহাপুরুষের? দেখিয়া মনে হয় বিদ্যাসাগর মহাশয়ের। মধ্য—শিক্ষাপর্ষদের খামখেয়াল দেখিয়া সেই স্বর্গস্থ তেজস্বী মহাত্মার ধৈর্যচ্যুতি হইয়াছে, তাই তাঁহার এক পাটি বিনামা গগনতলে নিক্ষেপ করিয়াছেন। এই উড়ুক্কু গগন—চটি শীঘ্রই শিক্ষাপর্ষদের মস্তকে নিপতিত হইবে।
সরকার—বিরোধী দলের অন্যতম মুখপাত্র বিরুপাক্ষ মণ্ডল লিখলেন, না, বিদ্যাসাগরের চটি নয়, তার শুঁড় এত বড় ছিল না। এই আসমানী পয়জার হচ্ছে স্বর্গস্থ মনীষী ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকারের। যত সব মেডিক্যাল কলেজ আর হাসপাতালের কেলেঙ্কারি দেখে তিনি খেপে উঠেছেন, হাতের কাছে অন্য হাতিয়ার না পেয়ে এক পাটি চটি ছেড়েছেন। কর্তারা হুঁশিয়ার।
ভক্তকবি হেমন্ত চট্টরাজ লিখলেন, এই গগন চটি মানুষের নয়, এ হচ্ছে মূর্তিমান ঐশ রোষ। চুরি ঘুষ ভেজাল মিথ্যাচার ব্যভিচার ভণ্ডামি ইত্যাদি পাপের বৃদ্ধি, রাজ্যসরকারের অকর্মণ্যতা, ধনীদের বিলাসবাহুল্য, ছেলেমেয়েদের সিনেমোন্মাদ, এই সব দেখে নটরাজ চঞ্চল হয়েছেন, প্রলয়নাচন নাচবার জন্য ডান পা বাড়িয়েছেন, তা থেকেই এই রুদ্র—চটি গগনতলে খসে পড়েছে। প্রলয়ংকর রুদ্রতাণ্ডব শুরু হতে আর দেরি নেই, জগতের ধ্বংস একেবারে আসন্ন। দেশের ধনী দরিদ্র উচ্চ নীচ আবালবৃদ্ধ স্ত্রীপুরুষ যদি শীঘ্র ধর্মপথে ফিরে না আসে তবে এই রুদ্ররোষ সকলকেই ব্যাপাদিত করবে।
কিন্তু আনাড়ী লোকদের এই সব জল্পনা শিক্ষিত জনের মনে লাগল না। বিশেষজ্ঞরা কি বলেন? বিশ্বম্ভর কটন মিল, বিশ্বম্ভর ব্যাংক, বিশ্বম্ভরী পত্রিকা ইত্যাদির মালিক শ্রীবিশ্বম্ভর চক্রবর্তী একজন সর্ববিদ্যাবিশারদ লোক, কোনও প্রশ্নের উত্তরে তিনি ‘জানি না’ বলেন না। কিন্তু গগন—চটির কথা জিজ্ঞাসা করলে তিনি শুধু গম্ভীরভাবে উপর নীচে ডাইনে বাঁয়ে ঘাড় নাড়লেন। কয়েকজন অধ্যাপককে জিজ্ঞাসা করায় তাঁরা বললেন, এখন কিছু বলা যায় না, তবে নক্ষত্র নয় তা নিশ্চিত, কারণ এর গতিপথ বিষুববৃত্তের ঠিক সমান্তরাল নয়। এই আগন্তুক জ্যোতিষ্কটি গ্রহের মতন বিপথগামী। পুচ্ছহীন ধূমকেতু হতে পারে। তা ভয়ের কারণ আছে বইকি। সাদা চোখে যতই ছোট দেখাক বস্তুটি নিশ্চয় প্রকাণ্ড। দেখা যাক, আমাদের কোদাইক্যানাল মানমন্দির আর গ্রীনিচ প্যালোমার ইত্যাদি থেকে কি রিপোর্ট আসে।
রিপোর্ট শীঘ্রই এল, দেশ—বিদেশের সমস্ত বিখ্যাত মানমন্দির থেকে একই সংবাদ প্রচারিত হল। দুর্বোধ্য বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব বাদ দিয়ে যা দাঁড়ায় তা এই। —সূর্যের নিকটতম গ্রহ হচ্ছে বুধ (মার্করি), তার পরে আছে শুক্র (ভিনস), তারপর আমাদের পৃথিবী, তার পর মঙ্গল (মার্স), তার পর বহু দূরে বৃহস্পতি (জুপিটার)। আরও দূরদূরান্তরে শনি (সাটার্ন), ইউরেনাস, নেপচুন আর প্লুটো। মঙ্গল আর বৃহস্পতির কক্ষের মাঝামাঝি পথে প্রকাণ্ড এক ঝাঁক অ্যাস্টারয়েড যা ছোট ছোট খণ্ডগ্রহ সূর্যকে পরিক্রমা করে। তারই একটা হঠাৎ কক্ষভ্রষ্ট হয়ে পৃথিবীর নিকটে এসে পড়েছে। এই খণ্ডগ্রহটি গোলাকার নয়। ভারতীয় জ্যোতিষীরা এর নাম দিয়েছেন গগন—চটি অর্থাৎ হেভেনলি স্লিপার। আপাতত আমরাও সেই নাম মেনে নিলাম। এই গগন—চটির কিঞ্চিৎ স্বকীয় দীপ্তি আছে, তার উপর সূর্যকিরণ পড়ায় আরও দীপ্তিমান হয়েছে। পৃথিবী থেকে এর বর্তমান দূরত্ব পৌনে দু কোটি মাইল, প্রায় দু বৎসরে সূর্যকে পরিক্রমণ করছে। এর আয়তন আর ওজন চন্দ্রের প্রায় দ্বিগুণ। এত বড় অ্যাস্টারয়েডের অস্তিত্ব জানা ছিল না। অনুমান হয়, গোটা কতক খণ্ডগ্রহের সংঘর্ষ আর মিলনের ফলে উৎপন্ন হয়ে এই গগন—চটি ছিটকে বেরিয়ে এসেছে। এর উত্তাপ আর স্বকীয় দীপ্তিও সংঘর্ষ—জনিত। এই বৃহৎ অ্যাস্টারয়েড নিকটে আসায় মঙ্গল গ্রহ আর চন্দ্রের কক্ষ একটু বেঁকে গেছে, আমাদের জোয়ার ভাটার সময়ও কিছু বদলেছে। পৃথিবী থেকে এর দূরত্ব এখন পর্যন্ত যা আছে তাতে বিশেষ ভয়ের কারণ নেই, তবে সন্দেহ হচ্ছে গগন—চটি ক্রমেই কাছে আসছে। যদি বেশী কাছে আসে তবে আমাদের এই পৃথিবীর পরিমাণ কি হবে তা ভাবতেও হৃৎকম্প হয়।
এই বিবৃতির ফলে অনেকে ভয়ে আঁতকে উঠল, কয়েকজন স্থূলকায় ধনী হার্টফেল হয়ে মারা গেল। অনেকে পেটের অসুখ, মাথা ঘোরা, বুক ধড়ফড়ানি আর হাঁপানিতে ভুগতে লাগল। হিন্দুধর্মের নেতৃস্থানীয় স্বামী—মহারাজগণ, মুসলমান মোল্লা—মাওলানাগণ এবং খ্রীষ্টীয় পাদরীগণ নিজের নিজের শাস্ত্র অনুসারে হিতোপদেশ দিতে লাগলেন। সাহিত্যিকরা উপন্যাস কবিতা রম্যরচনা প্রভৃতি বর্জন করে পরলোকের কথা লিখতে লাগলেন। কিন্তু বেশির ভাগ লোকের দুশ্চিন্তা দেখা গেল না, বরং গগন—চটির হুজুগে পাড়ায় পাড়ায় আড্ডা জমে উঠল। শেয়ারবাজারে বিশেষ কোনও তেজিমন্দি দেখা গেল না, সিনেমার ভিড়ও কমল না।
কিছুদিন পরেই দফায় দফায় যে জ্যোতিষিক সংবাদ আসতে লাগল তাতে লোকের পিলে চমকে উঠল, রক্ত জল হয়ে গেল। গগন—চটি নামক এই দুষ্টগ্রহ ক্রমশ পৃথিবীর নিকটবর্তী হচ্ছে এবং মহাকর্ষের নিয়ম অনুসারে পরস্পর টানাটানি চলছে। চন্দ্রসমেত পৃথিবী আর গগন—চটি যেন মিলে মিশে তালগোল পাকাবার চেষ্টায় আছে। হিসাব করে দেখা গেছে, পাঁচ মাসের মধ্যেই চন্দ্র আর গগন—চটির সংঘর্ষ হবে, তারপর দুটোই হুড়মুড় করে পৃথিবীর উপর পড়বে। তার ফল যা দাঁড়াবে তার তুলনায় লক্ষ হাইড্রোজেন বোমা তুচ্ছ। সংঘাতের কিছু পূর্বেই বায়ুমণ্ডল লুপ্ত হবে, সমুদ্র উৎক্ষিপ্ত হবে, সমস্ত প্রাণী রুদ্ধশ্বাস হয়ে মরবে। চরম ধ্বংসের জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া আমাদের কিছু করণীয় নেই।
বিভিন্ন খ্রীষ্টীয় সম্প্রদায়ের মুখপাত্রগণ একটি যুক্ত বিবৃতি প্রচার করলেন—আমাদের করণীয় অবশ্যই আছে। সেকালে বৃদ্ধরা একটি ছড়া বলতেন—If cold air reach you through a hole, Go make your will and mend your soul। কিন্তু এই আগন্তুক গগন—চটি ছিদ্রাগত শীতল বায়ু নয়, মানবজাতির পাপের জন্য ঈশ্বরপ্রেরিত মৃত্যুদণ্ড, আমাদের সকলকেই ধ্বংস করবে। উইল করা বৃথা, কিন্তু মৃত্যুর পূর্বে আমাদের আত্মার ত্রুটি অবশ্যই শোধন করতে হবে। অতএব সরল অতঃকরণে সমস্ত পাপ স্বীকার কর, নিরন্তর প্রার্থনা কর, ঈশ্বরের করুণা ভিক্ষা কর, সকল শত্রুকে ক্ষমা কর, যে কদিন বেঁচে আছ যথাসাধ্য অপরের দুঃখ দূর কর।
ইহুদী মুসলমান আর বৌদ্ধ ধর্মনেতারাও অনুরূপ উপদেশ দিতে লাগলেন। আদি—শংকরাচার্যের একমাত্র ভাগিনেয়ের বশংধর ১০০৮ শ্রী ব্যোমশংকর মহারাজ একটি হিন্দী পুস্তিকা ছাপিয়ে পঞ্চাশ লক্ষ কপি বিলি করলেন। তার সারমর্ম এই।—অয় মেরে বচ্চেচ, হে আমার বৎসগণ, মৃত্যুভয় ত্যাগ কর। আমার বয়স নব্বই পেরিয়েছে, আর তোমরা প্রায় সকলেই আমার চাইতে ছোট, কিন্তু তাতে কিছু ক্ষতিবৃদ্ধি নেই, কারণ ভবযন্ত্রণার ভোগ বালক—বৃদ্ধ সকলের পক্ষেই সমান। আমাদের আত্মা শীঘ্রই দেহপিঞ্জর থেকে মুক্তি পেয়ে পরামাত্মায় লীন হবে, এ তো পরম আনন্দের কথা, এতে ভয়ের কি আছে? কিন্তু অশুচি অবস্থায় দেহত্যাগ করা চলবে না, তাতে নরকগতি হবে। তোমরা হয়তো জান, কোনও বড় অপারেশনের আগে রোগীকে উপবাসী রাখা হয় এবং জোলাপ আর এনিমা দিয়ে তাঁর কোষ্ঠ সাফ করা হয়। যখন রোগীর পাকস্থলী শূন্য, মলভাণ্ড শূন্য, মূত্রাশয়ও শূন্য, সর্ব শরীর পরিষ্কৃত, তখনই ডাক্তার অস্ত্রপ্রয়োগ করেন। শুচিতার জন্য এত সতর্ককার কারণ—পাছে সেপটিক হয়। এখন ভেবে দেখ, অ্যাপেনডিক্স বা হার্নিয়া বা প্রস্টেট ছেদনের তুলনায় প্রাণ বিসর্জন কত গুরুতর ব্যাপার। মৃত্যুকালে যদি মনে কিছুমাত্র কালুষ্য বা কল্মষ বা কিল্বিষ থাকে তবে আত্মার সেপসিস অনিবার্য। পাপক্ষালন না করেই যদি তোমরা প্রাণত্যাগ কর তবে নিঃসন্দেহে সোজা নরকে যাবে। অতএব আর বিলম্ব না করে সরল মনে লজ্জা ভয় ত্যাগ করে সমস্ত পাপ স্বীকার কর, তাতেই তোমার শুচি হবে। চুপি চুপি বললে চলবে না, জনতার সমক্ষে উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা করতে হবে, কিংবা ছাপিয়ে প্রচার করতে হবে, যেমন আমি করছি। এই পুস্তিকায় শেষে তফসিল ক আর খ—এ মৎকৃত যাবতীয় দুষ্কর্মের তালিকা পাবে—কতগুলো ছারপোকা মেরেছি, কতবার লুকিয়ে মুরগি খেয়েছি, কতবার মিথ্যা বলেছি, কতজন ভক্তিমতী শিষ্যার প্রতি কুদৃষ্টিপাত করেছি—সবই খোলাস করে বলা হয়েছে। তোমরাও আর কালবিলম্ব না করে এখনই পাপক্ষালনে রত হও।
বিলাতে অক্সফোর্ড গ্রুপের উদ্যোগে দলে দলে নরনারী দুষ্কৃতি স্বীকার করতে লাগল, অন্যান্য পাশ্চাত্ত্য দেশেও অনুরূপ শুদ্ধির আয়োজন হল। ভারতবাসীর লজ্জা একটু বেশী, সেজন্য ব্যোমশংকরজীর উপদেশে প্রথম প্রথম বিশেষ ফল হল না। কিন্তু সম্প্রতি প্যালোমার মানমন্দির থেকে যে রিপোর্ট এসেছে তারপরে কেউ আর চুপ করে থাকতে পারে না। গগন—চটি আরও কাছে এসে পড়েছে, তার ফলে পৃথিবীর অভিকর্ষ বা গ্রাভিটি কমে গেছে, আমরা সকলেই একটু হালকা হয়ে পড়েছি। আর দেরি নেই, শেষের সেই ভয়ংকর দিনের জন্য প্রস্তুত হও।
মনুমেণ্টের নীচে আর শহরের সমস্ত পার্কে দলে দলে মেয়ে—পুরুষ চিৎকার করে পাপ স্বীকার করতে লাগল। বড়বাজার থেকে একটি বিরাট প্রসেশন ব্যাণ্ড বাজাতে বাজাতে বেরুল এবং নেতাজী সুভাষ রোড হয়ে শহর প্রদক্ষিণ করতে লাগল। বিস্তর মান্যগণ্য লোক তাতে যোগ দিয়ে বুক চাপড়াতে চাপড়াতে করুণ কণ্ঠে নিজের নিজের দুষ্কর্ম ঘোষণা করতে লাগলেন, কিন্তু ব্যাণ্ডের আওয়াজে তাঁদের কথা ঠিক বোঝা গেল না।
বিলাতী রেডিওতে নিরন্তর বাজতে লাগল—Nearer my God to Thee। দিল্লীর রেডিওতে ‘রঘুপতি রাঘব’ এবং লখনউ আর পাটনায় ‘রাম নাম সচ হৈ’ অহোরাত্র নিনাদিত হল। কলকাতায় ধ্বনিত হল—’সমুখে শান্তিপারাবার’। মস্কো রেডিও নীরব রইল, কারণ ভগবানের সঙ্গে কমিউনিস্টদের সদভাব নেই। অবশেষে সোভিএট রাষ্ট্রদূতের সনির্বন্ধ অনুরোধে আমাদের রাষ্ট্রপতি কমিউনিস্ট প্রজাবৃন্দের আত্মার সদগতির নিমিত্ত গয়াধামে অগ্রিম পিণ্ডদানের ব্যবস্থা করলেন।
বৃহৎ চতুঃশক্তি অর্থাৎ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন এবং ফ্রান্সের শাসকবর্গ গত পঞ্চাশ বৎসরে যত কুকর্ম করেছেন তার ফিরিস্তি দিয়ে White Book প্রকাশ করলেন এবং একযোগে ঘোষণা করলেন—সব মানুষ ভাই ভাই, কিছুমাত্র বিবাদ নাই। পাকিস্তানের কর্তারা বললেন, য়হ বাত তো ঠিক হৈ, হিন্দী পাকী ভাই ভাই, লেকিন আগে কাশ্মীর চাই।
জগদব্যাপী এই প্রচণ্ড বিক্ষোভের মধ্যে শুধু একজনের কোনও রকম চিত্তচাঞ্চল্য দেখা গেল না। ইনি হচ্ছেন হাঠখোলার ভুবনেশ্বরী দেবী। বয়স আশি পার হলেও ইনি বেশ সবলা, সম্প্রতি দ্বিতীয় বার কেদার—বদরী ঘুরে এসেছেন। প্রচুর সম্পত্তি, স্বামী পুত্র কন্যার ঝঞ্ঝাট নেই, শুধু একপাল আশ্রিত কুপোষ্য আছে, তাদের ইনি কড়া শাসনে রাখেন। ভুবনেশ্বরী খুব ভক্তিমতী মহিলা, গীতগোবিন্দ গীতা আর গীতাঞ্জলি কণ্ঠস্থ করেছেন। কিন্তু পাড়ার লোকে তাঁকে ঘোর নাস্তিক মনে করে, কারণ তিনি কোনও রকম হুজুগে মাতেন না। তাঁর ভয়ার্ত পোষ্যবর্গ ব্যাকুল হয়ে অনুরোধ করল, কর্তা—মা, গগন—চটি উদয় হয়েছেন, প্রলয়ের আর দেরি নাই। জগন্নাথ ঘাটে সভা হচ্ছে, সবাই পাপ কবুল করছে, আপনিও করে ফেলুন। মন খোলসা হলে শান্তিতে মরতে পারবেন।
ভুবনেশ্বরী ধমক দিয়ে বললেন, পাপ যা করেছি তা করেছি, ঢাক পিটিয়ে সবাইকে তা বলতে যাব কেন রে হতভাগারা? গগন—চটি না ঢে�কি, আকাশে লাখ লাখ তারা আছে, আর একটা না হয় এল, তাতে হয়েছে কি? তোরা বললেই প্রলয় হবে? মরতে এখন ঢের দেরি রে, এখনই হা—হুতোশ করছিস কেন? ভগবান আছেন কি করতে? ‘আমায় নইলে ত্রিভুবনেশ্বর তোমার প্রেম হ’ত যে মিছে’—রবি ঠাকুরের এই গান শুনিস নি? মানুষকেই যদি ঝাড়ে বংশ লোপাট করে ফেলেন তবে ভগবানের আর বেঁচে সুখ কি? লীলা খেলা করবেন কাকে নিয়ে? যা যা, নিশ্চিন্তি হয়ে ঘুমো গে।
কিসে কি হয় কিছুই বলা যায় না। হয়তো ভুবনেশ্বরীর কথায় ত্রিভুবনেশ্বরের একটু চক্ষুলজ্জা হল। হয়তো কার্যকারণ পরম্পরায় প্রাকৃতিক নিয়মেই যা ঘটবার তা ঘটল। হঠাৎ একদিন খবরের কাগজে তিন ইঞ্চি হরফে ছাপা হল—ভয় নেই, দুষ্ট গ্রহ দূর হচ্ছে। বড় বড় জ্যোতিষীরা একযোগে জানিয়েছেন, বৃহস্পতি শনি ইউরেনাস আর নেপচুন এই চারটে প্রকাণ্ড গ্রহের সঙ্গে এক রেখায় আসার ফলে গগন—চটির পিছনে টান পড়েছে, সে দ্রুতবেগে পুরাতন কক্ষে নিজের সঙ্গীদের মধ্যে ফিরে যাচ্ছে। অতি অল্পের জন্য আমাদের পৃথিবী বেঁচে গেল।
বিপদ কেটে যাওয়ায় জনসাধারণ হাঁফ ছেড়ে বাঁচল, কিন্তু যাঁরা অসাধারণ তাঁরা নিশ্চিন্ত হতে পারলেন না। দেশের হোমরাচোমরা মান্যগণ্যদের প্রতিনিধিস্থানীয় একটি দল দিল্লিতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে নিবেদন করলেন, হুজুর, আমরা যে বিস্তর কসুর কবুল করে ফেলেছি এখন সামলাব কি করে? প্রধানমন্ত্রী সুপ্রিম কোর্টের চীফ জস্টিসের মত চাইলেন। তিনি রায় দিলেন, পুলিসের পীড়নের ফলে কেউ যদি অপরাধ স্বীকার করে তবে তা আদালতে গ্রাহ্য হয় না। গগন—চটির আতঙ্কে লোকে যা বলে ফেলেছে তারও আইনসম্মত কোনও মূল্য নেই, বিশেষতঃ যেমন স্ট্যাম্প কাগজে কেউ অ্যাফিডাভিট করে নি।
বৃহৎ চতুঃশক্তি এবং ইউ—এন—ও গোষ্ঠীভুক্ত ছোট বড় সকল রাষ্ট্র একটি প্রোটোকলে স্বাক্ষর করে ঘোষণা করলেন, গগন—চটির আবির্ভাবে বিকারগ্রস্ত হয়ে আমরা যেসব প্রলাপোক্তি করেছিলাম তা এতদ্বারা প্রত্যাহৃত হল। এখন আবার পূর্বাবস্থা চলবে।
গগন—চটি সুদূর গগনে বিলীন হয়েছে কিন্তু যাবার আগে সকলকেই বিলক্ষণ ঘা কতক দিয়ে গেছে। আমাদের মান ইজ্জত ধূলিসাৎ হয়েছে মাথা উঁচু করে বুক ফুলিয়ে আর দাঁড়াবার জো নেই।


সর্বশেষ এডিট : ১০ ই মার্চ, ২০২৩ সন্ধ্যা ৬:০৩
১০টি মন্তব্য ১০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। গানডুদের গল্প

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:২৮




তীব্র দাবদাহের কারণে দুবছর আগে আকাশে ড্রোন পাঠিয়ে চীন কৃত্রিম বৃষ্টি নামিয়েছিলো। চীনের খরা কবলিত শিচুয়ান প্রদেশে এই বৃষ্টিপাত চলেছিলো টানা ৪ ঘন্টাব্যাপী। চীনে কৃত্রিম বৃষ্টি নামানোর প্রক্রিয়া সেবারই প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×