শীত আসে। প্রকৃতির রূপ ভিন্নরূপে আবিষ্কৃত হয়। পরিপূর্ণ রিক্ততা প্রকৃতির রহস্যের বোতাম খুলে দেয়। ভরাট কুয়াশা সবকিছুতে অন্তরঙ্গ সাড়া জাগায়। দূরের পাহাড়ের চূড়ায়, নুইয়ে থাকা নদীর বাঁকে, মালতী লতার শুভ্র গায়ে, পৃথিবীর রম্নপালি প্রাণে। তীব্র শীত শীত আমেজ মাটির বুকে টুকরো টুকরো কুয়াশা ছিটায়। তার মাঝে ঘাসের কুচিকুচি পাতায় শিশির অঙ্কন করে তার আল্পনা। যেন সিগ্ধতা মেশাতে চায় ঘাসের যৌবন শরীরে। দূরদিগন্তের খেজুর গাছের ঝুলন্ত হাঁড়িতে খেজুরের রস জমে। কুয়াশার এক পশলা ছোঁয়া শাক-সবজির ফ্যাকাশে সবুজ রঙে গাঢ় সবুজের রঙ এঁকে দেয়। উত্তর প্রান্তে শীতের ঠাণ্ডা হিম বয়।
টিনের চালে মিষ্টি আওয়াজে কুয়াশার মুক্তা ঝরে। সেই আওয়াজে ঘুম ভেঙে যায় অনেকেরই। যেমনটা আমার। তবু লেপ মুড়িয়ে থাকি। একটু অলসতার ঘোরে। আশ্চর্য শীত যেন আমার মাথার কাছে তার কোল বিছিয়ে দেয়। তাই পরম শান্তির ঘুম ভীষণ ভারী হয়ে ওঠে। এক সময় এলোমেলো কল্পনা মগজের কোষে ভিড় করতে থাকে। মনে হয় ভালোবাসার মানুষটি বিছানার ফাঁকা অংশটাতে তার উষ্ণ শরীর এলিয়ে দিয়েছে।
তার মায়াবী মুখ, উঁচু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা কপাল, তন্দ্রালু চোখের পাতা ছোঁয়ার তৃষ্ণা বাড়ে। মিথ্যে হলেও তার উল্ক চুলে ভাবনার হাত বাড়িয়ে দেই, বিলিয়ে দেই বিরামহীন ভালোবাসার অফুরন্ত আদর। ধীরে ধীরে হারাতে থাকি স্বপ্নে। অাঁকাবাঁকা পথ দূর দিগন্তের প্রান্তর ছোঁয়ে যায়। নগ্ন কুচি কুচি ঘাস চোখ তুলে তাকায় উপরের দিকে। তার মাঝে পা রাখি আমি। সঙ্গে প্রিয় মানুষটিও।
এবড়ো-থেবড়ো ভাবনা নির্ভেজাল আবেগের জ্বালা খুলে দেয়। মনের ভেতর স্বপ্ন দরিয়া হোলি খেলে। শরীর সিক্ত হয়। দু'খণ্ড স্বর্গের ছোঁয়া পায়। কোমল স্পর্শে হাত রাখে হাতে!
কদম থামে না। নির্ভাবনায় ভালোবাসার মহাপ্রলয়ে নির্বিকার হেঁটে চলে। হঠাৎ আচমকা শীতের ঝাপটা মিষ্টি স্বপ্নের হাল ছেড়ে দেয়। তখন বোধহয় খানিক আগের ভালোবাসার ভাববিনিময় স্বপ্নের ঠোঁটে ধরা দিয়েছিল। এমন ভাবতেই দু'ঠোঁটের মধ্যমণিতে একটু হাসি ফুটে ওঠে। চোখের সুশীল লজ্জা আমার পুরো মুখে মুখ রাঙ্গিয়ে দেয় রঙিন তুলিতে। এই ফাঁকে উঁকি দেয় শীতের নিষপ্রভ ও অলস সূর্য। রোদ ঝলমল করে। এলোমেলো আকারে তার উজ্জ্বলতা শাখা গজায়। পৃথিবী পায় নতুন আবরণ। জড়িয়ে নেয় সোনালি রোদের চাদর।
দূরন্ত কিশোর-কিশোরীরা তখন ঘুমের জাল ছিঁড়ে দেয়, অতঃপর রোদের সঙ্কেতে উল্কার মতো ছুটে আসে উঠোনে। সে সময় আমি নির্মল শীতে দাঁড়িয়ে থাকি জানালার পাশে। আড়মোড়া চোখে বাইরে তাকাই। দেখি কিশোর-কিশোরীরা ততক্ষনে আগুন জ্বালানোতে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। তখন চাপা পড়া শৈশব স্মৃতির নাড়া দেয়। চোখের সামনে ভেসে আসে হারানো দিনের প্রতিচ্ছবি। ভেতরের মনবালিকা স্মৃতির পীড়াপীড়িতে নিঃসঙ্গ বোধ করে। এক সময় বাইরে পা রাখি অজান্তে। পলকহীন চোখে তাকাই প্রকৃতির দিকে। খোলা আকাশের নিচে আলোর নিখিল ঝরে।
দক্ষিণ প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা বৃক্ষের সবুজ পাতা, পাশভর্তি পুকুরে ভেসে ওঠা কচুরিপানা, বাঁশ ঝাড়ের কঞ্চি দিয়ে তৈরি ঘাটের শরীর, তখনও কুয়াশা ছোঁয়া কান্নার জল তাদের মাঝে চুপসে থাকে। ডালে বসে থাকা পরিচিত পাখির পায়েও প্রকৃতির অশ্রম্ন স্যাঁতস্যাঁতে ভাব প্রকাশ করে। এমন দৃশ্য দেখতে কাল্পনিকভাবে অসংখ্যবার কর্ণের দেয়ালে ঠোকর খায়, মন কেমন জানি অদ্ভূত আনন্দ অনুভব করে!! প্রকৃতিও হাঁসতে থাকে...!!!
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে অক্টোবর, ২০১৬ সকাল ১১:৪৭