প্রিয় পাঠক কিংবা পাঠিকা নিশ্চিত করে বলতে পারি - আপনি খুবই নবীণ কিংবা খুবই প্রবীণ অথবা এ দুয়ের মাঝামাঝি যে কোনো বয়সের একজন ভাল মানুষ। আপনি ভাল মানুষ বলেই আপনাকে আমি এই গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসাবে দাঁড় করাচ্ছি। এটা কিন্তু আমার উপস্থাপন-কৌশল নয় কিংবা নয় কোনো ভণিতা।আসলেই আপনি আমার এই গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র।
আপনাকে আমি ভাল মানুষ কিভাবে বললাম? না-না আপনাকে তেল দেয়ার জন্য এটা বলিনি।সমীকরণটা খুবই সহজ - যেহেতু আপনি সাহিত্যরসিক, গল্প পাঠ করতে ভালবাসেন সেহেতু আপনি গড়পড়তা সাধারণ মানুষের চেয়ে সংবেদনশীল। আপনার সহানুভূতি আছে, মমতা আছে, পরোপকারের মানসিকতা আছে। সুতরাং নিঃসন্দেহে আপনি ভাল মানুষ। মমতামাখা সহানুভূতিশীল মানুষ।
আপনাকে নিয়ে আমি আরও একটি কথা নিশ্চিত করে বলতে পারি, সেটা হচ্ছে - এই পৃথিবীতে আপনি মোটেই একা নন। আপনার বাবা-মা, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, বৌ কিংবা বর, এবং সন্তানাদি রয়েছে। অন্তত একজন হলেও কেউ না কেউ আপনার ঠিকই রয়েছে। যে আপনার প্রতীক্ষায় থাকে। প্রতীক্ষমান কেউ আছে বলেই আপনি স্বপ্ন দেখেন, ঘরে ফেরেন, জীবনকে ভালবাসেন। আপনি জানেন, সুখের প্রথম শর্ত আপনার জন্য প্রতীক্ষমান কারও অস্তিত্ব।
মানুষমাত্রই মনের গহীনে প্রায়ই ডুব মারে। আপনিও মারেন। আজকে তেমনি এক ডুবের দিন আপনার। আপনি এখন আপনার মনের অতল গহ্বরে ধীরে-ধীরে তলিয়ে যাচ্ছেন। এবং তলিয়ে যেতে যেতে আপনি রূপান্তরিত হচ্ছেন নতুন এক মানুষে। মনের গভীরে আপনি সম্পূর্ণ আলাদা, নিঃসঙ্গ, একা একটি মানুষ। আপনার পরিচিত অনেকেই আছে কিন্তু কেউই আপনার বন্ধু নয়। এরকম ব্যাতিক্রমী মানুষ খুব কম হলেও আছে, যাদের পরিচিতি আছে, পরিচিত মানুষজন আছে কিন্তু কোনো বন্ধু নাই। আপনি সেরকমই একজন নির্বান্ধব মানুষ। ভাগ্যটা যেন কখনোই আপনার নয়। ভাগ্য আপনার নয় বলেই আপনার বাবা-মা, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, বৌ কিংবা বর, এবং সন্তানাদি ইত্যাদি সম্পর্কগুলোর কেউই নেই। আপনি পুরোপুরি একা একটি মানুষ। এই বিশাল পৃথিবীর বুকে আপনি পরিপূর্ণ নিঃসঙ্গ একটি মানুষ। আপনার কেউ না থাকার হাহাকার প্রতিনিয়ত বাতাসে মিলায় কিন্তু কাউকেই ছোঁয় না।
ছোঁয় না কারণ সবারই কেউ না কেউ আছে। পুরোপুরি নিঃসঙ্গ আপনার মতো কেউ নয়। তাই আপনার অনুভূতি কেউই উপলব্ধি করতে পারে না। পারবে কিকরে তারা তো এই অনুভূতির সাথে পরিচিত নয়। সুতরাং আপনার কোনো সহমর্মী, সমব্যথীও নেই। আপনি হচ্ছেন হাজার মাইল বিস্তৃত ধূ-ধূ ধূসর মরুভূমির মাঝে সম্পূর্ণ একা একটি বৃক্ষ। এক ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছেন হাজার বছর ধরে। আরও বহু হাজার বছর আপনাকে এভাবেই বাঁচতে হবে। আপনার কোনো স্বপ্ন নেই। স্বপ্ন দেখার ইচ্ছাটাও আপনার মরে গেছে। মাঝেমাঝে প্রবল বাতাসে যখন আপনার পাতায় পাতায়, শাখা-প্রশাখায় শনশন শব্দ ওঠে - সেটা আপনার অন্তরেরই তীব্র হাহাকার ধ্বনির মূর্ত রূপ। ট্রাজিডি এটাই আপনার এই হাহাকার ধ্বনি শোনারও কেউ নেই। কেউই নেই। একদম কেউ নেই। আপনার হাহাকার চিরকাল বাতাসেই মিলায়--- বাতাসেই মিলায়---
আপনার সুখ-স্মৃতি নেই বললেই চলে। তবুও যখন ভাবতে বসেন একটা স্মৃতি আপনার মনকে ভাললাগার অনুভূতি দিয়ে যায়। আপনি তখন বছর দশেকের হবেন। ক্ষুধার জ্বালায় একদিন সুরক্ষিত এক বাড়ির ভিতরে ঢুকে পড়েছিলেন। ঐ বয়সেই আপনি টের পেয়ে গিয়েছিলেন ইট-পাথরের অট্টালিকায় মমতাদের কেউ বাস করে না। তবু নিতান্তই নিরুপায় হয়ে আপনি সেদিন ইট-পাথরের কারাগারে ঢুকে পড়েছিলেন এবং ভয়ে-ভয়ে, চোরের মতো ইতিউতি তাকাচ্ছিলেন অসম্ভবের আশায়। আপনার দীন বেশ, রুক্ষ-শুষ্ক চেহারা আর ভীত চাউনিটাই কাল হয়ে দাঁড়াল। আপনি চোর হিসাবে গণ্য হলেন। তারপর আপনাকে পশুর মতোই পিটানো হলো। আশ্চর্য কেউ আপনার কথা বিশ্বাস করল না। আপনি চেষ্টা করেছিলেন বোঝাতে কিন্তু কেউ আপনাকে শুনতেই চাইল না। চোরের কথা কেউকি শুনতে চায়। তারপর তুমুল অভিমানে, বোবা-বিস্ময়ে আপনি ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকলেন। আরও আশ্চর্য আপনার চোখ থেকে এক ফোটা অশ্রুও বের হলো না। আপনি যেন পণ করেছিলেন মোটেই অরণ্যে রোদন করবেন না। অশ্রুকণা যেন আপনার মহামূল্যবান মুক্তোবিন্দু - অপচয় করার বিলাসিতাকে আপনি কিছুতেই প্রশ্রয় দিতে চাইলেন না। একটা প্রকাণ্ড জানোয়ারের থাবায় আপনার যখন ঠোঁট ফেটে লাল অশ্রু ঝরতে লাগল তখনও আপনার চোখে এক ফোটা জলরং অশ্রু কেউ আবিষ্কার করতে না পেরে আপনাকে ঘিরে উপভোগ করতে থাকা নারী-পুরুষগুলি আরও ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল। একেকজন একেকরকম শাস্তির তরিকা বাতলে দিতে লাগল। এবং সবচেয়ে আশ্চর্য, এমনি সময়ে ফুটফুটে চাঁদের মতো একটি দেবকুমারি বাচ্চামেয়ে এসে আপনাকে বাঁচিয়ে দিল। সেই দেবকুমারি ছুটে এসে আপনার দিকে কী মনে করে তার আধখাওয়া রুটির টুকরাটি বাড়িয়ে ধরলে আপনি প্রথমে হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন। অতঃপর নেকড়েদের ভিড়ে একটি হরিণশাবকের কোমল উপস্থিতি আপনাকে নরম, খুবই নরম করে দিয়েছিল। আপনি নীরব কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন।
এতক্ষণ আপনি আপনার কান্নাটাকে জিদ করে আটকে রেখেছিলেন। এই স্বার্থপর, অবিবেচক সমাজের কোনো আচরণে আপনি কাঁদবেন না, এই ছিল আপনার প্রতিজ্ঞা। আপনার বিদ্রোহ। আপনার ঘৃণা। কিন্তু সেই দেবকুমারি আপনার সবকিছু এলোমেলো করে দিয়েছিল। আপনি নীরবে কাঁদতে লাগলেন।
আপনার অশ্রুকে সমাজ তার বিজয় গণ্য করে আপনাকে গেটের বাইরে ধাক্কা মেরে বের করে দিয়েছিল। কিন্তু আপনি ফিরে এসেছিলেন সেই ভাললাগার অনুভূতি নিয়ে যা এখনও মাঝেমাঝেই আপনাকে আনমনা করে তোলে।
তারপর বহুদিন আপনি সেই সুরম্য অট্টালিকার সামনে গিয়েছেন, বহু অপেক্ষা করেছেন কিন্তু আর কোনোদিন সেই দেবকুমারিকে আপনি দেখতে পাননি।
আপনি আজও, সেই ঘটনার বহু বহু বছর পরেও সেই অট্টালিকার সামনে গিয়েছিলেন অসম্ভব এক আশা বুকে নিয়ে। অনেক পরিবর্তন আপনার চোখে পড়ল। অট্টালিকার রং সেদিনের মতো ঝকঝক করছে না। সামনের গাছগুলি বড় হয়ে গেছে। ব্যালকনি থেকে ঝুলিয়ে দেওয়া লতাগুলি এখন মাটি ছুঁতে চাইছে। আপনি নিজের বোকামি বুঝতে পারলেন। বুঝতে পারলেন যে এত বছরে সেই দেবকুমারি আর ছোটটি নেই; সেও এখন এই সমাজেরই একজন নির্মম নিষ্ঠুর নারী। আপনি ফিরে এলেন। বেঁচে থাকার শেষ ইচ্ছাটুকুও আপনার বিলুপ্ত হয়ে গেল। আপনি বুঝে গেলেন আপনার আর কোনো পিছুটান নেই। অতএব আপনি আপনার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন।
আপনি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন, যে পৃথিবীতে দেবুমারিরাও একদিন নিষ্ঠুর নারী হয়ে যায় সেই পৃথিবীতে আপনি আর থাকবেন না। এখানে কেউ আপনার জন্য অপেক্ষা করে নেই। আপনার ভালমন্দের খবরে কারও কোনো দরকার নেই। আপনি আজ যখন চিরদিনের জন্য নেই হয়ে যাবেন আপনার জন্য কেউ কোথাও কাঁদবে না। আশ্চর্য এত বড় দুনিয়ায় আপনার কেউ নেই। কেউ কোনোদিনই ছিল না। ছিল না বলতে আপন কাউকে আপনি কোনোদিন দেখেন নি; কাউকে জানেন না, চেনেন না। আপনাকে নাকি ডার্স্টবিনে কুড়িয়ে পাওয়া গিয়েছিল। আপনি কুড়িয়ে পাওয়া নবজাতক। বড় হয়েছেন এতিমখানায়।
এতিমখানার অনিয়ম থেকে, ভালবাসাহীনতা থেকে আপনি মুক্তির উদ্দেশ্যে মাঝেমাঝেই পলায়নকে আশ্রয় করতেন। এই পলায়নপরতা আপনার চরিত্রের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য। এটি আপনার প্রিয়। খুবই প্রিয়। যে কোনো পলায়নের সুযোগ আপনার মধ্যে নেশা ধরায়। আপনি ঘোরলাগা মানুষ হয়ে যান। যেমন আজ এই মুহূর্তে আপনি ঘোরের মধ্যে চলে গেছেন।
আপনি আজ পালাবেন --- আপনি আজ পালাবেন --- আপনি আজ পালাবেন --- পালানোর রোমান্টিক আনন্দ আপনি টের পাচ্ছেন।
কোনো কুলেই আপনার কেউ নেই এই অনুভূতি বরাবর আপনার মধ্যে বিশাল এক শূন্যতা তৈরি করে দিত। আজও দিল। এই সব মুহূর্তগুলোয় জীবনের প্রতি সকল আকর্ষণ উধাও হয়ে যায়। আজও গেল। পৃথিবীতে আপনি নেই এতে কারও কিছু আসে যায় না। এই বোধটাই আপনাকে প্রচণ্ড অভিমানী করে তুলতো। সবার প্রতি। সব কিছুর প্রতি। আজও তুললো।
সাতশো কোটি মানুষের ভিড়ে একজন মানুষ প্রকৃতই একা: বোধে এবং বাস্তবে। এটা বিপদজনক! এটা বিপর্যয়কর! এটা রেড সিগনাল! এর কোনো সান্ত্বনা নাই। সান্ত্বনা হয় না। নিঃসঙ্গ লোকটির শূন্যতার কাছে আর সবকিছুই মলিন। এই শূন্যতাবোধের হাহাকার সর্বগ্রাসী। বেঁচে থাকার রোমান্টিক চেতনাকে ভোঁতা করে দেয়। মানুষ একটা ঘোরলাগা মানুষ হয়ে যায়। কোনো কিছুই তাকে আর আটকাতে পারে না। মহাঘূর্ণিপাকের ফাঁদে পড়ে গিয়ে অবধারিত মহাপ্রস্থানের দিকে এগোতে থাকে।
ঐ তো ট্রেন আসতেছে--- আর একটু কাছে এলেই রেলিং থেকে একটা মাত্র লাফ---
##############
না-ভাই-না! না-ভাই-না! ভাই-ভাই-ভাই কি হইছে আপনের?ভাইগো।
চিৎকার করে শাবনূর শক্ত করে জামানকে জড়িয়ে ধরল। তার ছোট দুই হাতের সমস্ত শক্তি দিয়ে। এবং আরো জোরে চিৎকার করতে থাকল যাতে নিচের লোকেরা শুনতে পায়। তার চিৎকারে মিশে থাকল ভয়; জামানকে তার ছোট দুই হাতের আগল থেকে ছুটে না যেতে দেয়ার দৃঢ়তা; এবং দূরের লোকের সাহায্য প্রার্থনা।
ভাগ্য চিরদিনই জামানের সাথে বেইমানী করেছে। কোনোদিনই তার কোনো ইচ্ছা পূর্ণ করেনি। আজও করল না। যেমন আজ তার ইচ্ছার পথে পাহাড় হয়ে দাঁড়িয়ে গেল শাবনূরের ছোট্ট অথচ দৃঢ় দুটি হাত। এই মুহূর্তে পৃথিবীর সবচেয়ে দামী দুটি হাত।
জামান ওভারব্রীজের রেলিং থেকে নেমে দাঁড়াল। ট্রেন নিচ দিয়ে তখনও যাচ্ছিল। তার কানে আসছিল ট্রেনের ঝকর ঝকর শব্দ। এতক্ষণ এই শব্দটাই তার কানে আসেনি। মূলত কোনো শব্দই তার কানে এতক্ষণ পৌঁছয়নি। চেতনাজুড়ে ছিল শুধুই প্রস্থানের প্রস্তুতি। এখন সব শব্দ সে শুনতে পাচ্ছে। তাকে জড়িয়ে ধরা মেয়েটির চিৎকার, রেলিংয়ে বসে থাকা দুটি কাকের খুনসুটির মৃদু আওয়াজ, এমনকি মেয়েটির নিঃশ্বাসের শব্দও সে পাচ্ছে। সব শব্দ, সব দৃশ্য, সব রঙ, সব স্পর্শ তার ইন্দ্রিয়ে মাধুর্য ছড়িয়ে দিচ্ছে।
সে আস্তে করে শাবনূরের হাতের উপর হাত রেখে বলল, ছাড়ো। এই জামান ঘোরলাগা জামান নয়। সহজ-স্বাভাবিক সাধারণ জামান।
পিছন থেকে জামানকে জড়িয়ে ধরে রেখেছিল শাবনূর। তাই তাকে জামান দেখতে পাচ্ছিল না। কিন্তু বুঝতে পারছিল ছোট্ট একটা মেয়ে। কৃতজ্ঞতার সাথে পরম মমতায় সে শাবনূরের হাতের উপর হাত রেখে আর একটু জোরে বলল, ছাড়ো ছাড়ো।
শাবনূর ভয়ে ভয়ে ছাড়ল। পুরোটা নয়। জামার একটা অংশ খামচে ধরে থাকল। যেন ছেড়ে দিলেই জামান চির বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে।
ঘুরে দাঁড়াল জামান। শাবনূরকে দেখল ভাল করে। অপুষ্ট, রোগা চৌদ্দ/পনের বছরের একটা মেয়ে। ভীত, বড় বড় দুটি চোখ। সেই চোখে মায়ার বাড়াবাড়ি। ময়লা ফ্রক, ময়লা সালোয়ার। রুক্ষ লালচে চুল।
জামান তার ডান হাত শাবনূরের মাথার উপর রাখল। মাত্র মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে এসে জীবনের প্রতি সমস্ত তৃষ্ণা যেন তার গলায় ভর করল। আস্তে করে বলল , পানি খাব। একটু পানি খাওয়াতে পার?
হ, পারি। বলেই শাবনূর ছুটতে শুরু করে আবার ফিরে আসলো। এসে অসহায় দুটি চোখ মেলে জামানের দিকে তাকাল। জামান এই দৃষ্টির মানে বুঝতে পারল। অভয় দিয়ে বলল, ভয় নাই। কিন্তু শাবনূরের মন মানল না। সে জামানের হাত ধরে বলল, ভাই, আপনে আমার সাথে চলেন। পানির কল অনেক দূরে।
শাবনূরের অনাস্থা বুঝতে পেরে জামান অচেনা একটা ভাললাগা টের পেল। সেই ভাললাগার প্রস্ফুটনে তার দুঠোঁট প্রসারিত হল। আস্তে করে বলল, ঠিক আছে চল।
বেলা দুপুর। প্রচণ্ড গরম। কোথাও বাতাস নেই। লোকজনের আনাগোনাও কম। ওভারব্রীজের উপর সাধারণত কেউ আসে না। এরকম সময়ে শাবনূর ওভারব্রীজের উপর বসে বিশ্রাম নেয়। উপরে টিনের শেড থাকায় চমৎকার ছায়া। আজ তার যখন ঝিমুনির মতো এসেছিল ঠিক তখন কিভাবে যেন তার চোখ খুলে গেল। আর সাথে সাথে জামানের দিকে চোখ পড়েছিল তার। কোনো রকম ভাবনা চিন্তা ছাড়াই তার মনে হয়েছিল, বিপদ! তারপর কেমন করে মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে সে জামানের কাছে পৌঁছে গিয়েছিল তা সে জানে না। কিন্তু সে সঠিক সময়েই পৌঁছতে পেরেছিল।
শাবনূর মেয়েটির নিজের দেওয়া নাম। তার কোনো নাম ছিল না। সবাই তারে পিচ্চি, ছেমরি, ছেরি ইত্যাদি বলে ডাকত। অনেক দিন ভাবতে ভাবতে সে নিজের জন্য এই নামটিই ঠিক করেছিল। শাবনূর তার প্রিয় নায়িকা।
লম্বা প্লাটফর্মের এক প্রান্তে যেখানে লোকজন নেই সেখানে দুজন বসল। শাবনূরের মনে অনেক জিজ্ঞাসা। কৌতুহলে তার বুক ফেটে যাচ্ছিল। কিন্তু সে কি মনেকরে প্রথমেই জানতে চেয়েছিল - ভাই, খিদা লাগছে, কিছু খাইবেন?
জামানের আসলেই ক্ষুধা লেগেছিল। কিন্তু সে না সূচক মাথা নেড়েছিল।
ঃ ভাই, আপনে ঐ কামডা করতে গেছিলেন ক্যান?
জামান দূরে তাকিয়েছিল। নির্দিষ্ট কোনো কিছুর দিকে নয়। স্রেফ তাকিয়ে থাকা। একটা হতাশা, তীব্র বেদনা ফুটে ওঠে তার চোখে। তার চেহারায়।
- হাহ্, এইডা তুমি ঠিক বুজবা না। তারপরও তোমারে বলি। তুমি আমারে বাঁচাইছ। তোমার হক আছে শোনোনের।
শাবনূর আরেকটু কাছে এগিয়ে বসে যাতে শুনতে পায় ভাল করে।
- শোন, আমি মানুষ হইছি এতিমখানায়। লোকে আমারে কুড়াইয়া পাইছিল পথের ধারে। আমি হইছি একটা হতভাগা পোলা। দুনিয়ায় যার কেউ নাই। তাই আমার কোনো দামও নাই। আইজকা মইরা গেলে আমি বেওয়ারিশ লাশ।
তারপর সে শাবনূরের দিকে তাকিয়ে বলেছিল, বোজলা যার কেউ নাই জীবনে বাঁইচা থাকার কোনো আনন্দও তার নাই। তাইলে তুমি কিসের লইগা বাঁচবা, কও?
ঃ ভাই, আপনের মতো আমারও কেউ নাই। জ্ঞান হওয়ার পর থেইকা নিজেরে রাস্তাতেই পাইছি। রাস্তাতেই বড় হইছি। আপনের মাথার উপ্রে তাও একটা ছাদ আছিল। আমার উপ্রে আছিল ঐ পুরা আসমানডা। আমিতো মরার কতা কুনোদিন ভাবি নাই। আমিতো আরও মাইয়া মানুষ। তাইলে?
জামান চুপ করে থাকে। সে এই প্রশ্নের জবাব কিকরে দেবে। সে তার যন্ত্রণার কথা কিভাবে বুঝাবে এই কিশোরীকে। একই ঘটনার মধ্য দিয়ে গেলে সবাইকি একই অভিজ্ঞতা লাভ করে? সুতরাং সে চুপ করেই থাকে।
শাবনূর জামানের নীরবতা দেখে বলেছিল, ভাই, আমি ঐ বিরাট আসমান থেইকা বাঁচার সাহস পাইছি কিন্তুক আপনের ছাদ আপনেরে কিছুই দেয় নাই।
তারপর দুজনেই চুপচাপ। অনেকক্ষণ পরে শাবনূর জামানের হাতের উপর হাত রেখে তার জীবনের সবচেয়ে আকুল অনুরোধটি করেছিল।
ঃ ভাই গো, আপনে আমারে একটা সুযোগ দেবেন?
- কী?
ঃ আমি আপনের আত্মীয়-স্বজন, বন্দু-বান্দব সব হমু। খালি আমারে একটা সুযোগ দেন।
বহু বছর আগে এক টুকরা আধ-খাওয়া রুটি তাকে যেই সুখ দিয়েছিল, যেই ভরসা দিয়েছিল সেই অনুভূতি আবার জামান টের পেল। সেদিনের পর আর কোনোদিনই তার চোখে পানি আসে নাই। আজ আবার এলো।
মাঝেমাঝেই কান্না বড় সংক্রামক। ফোঁপাতে ফোঁপাতেই শাবনূর জিজ্ঞেস করে- ভাই কান্দেন ক্যান? কান্দেন ক্যান?
তারপর দুজনেই কাঁদতে থাকে। একজন নীরবে আরেকজন ফুঁপিয়ে।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই আগস্ট, ২০১৩ রাত ১১:২০