somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

শ্যামদেশে কয়দিনঃ পর্ব একঃ অবতরণ

১১ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ সকাল ১০:৩৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



“সায়াম” বা “শ্যামদেশ” অধুনা “থাইল্যান্ড”এর সুবর্ণভূমি বিমানবন্দরে আমাদের বহনকারী ব্যাংকক এয়ারওয়েজের বিমানটি যখন অবতরণ করল তখন রাত্রি ত্রিপ্রহরের মাঝামাঝি। গতিজাড়িত ধীর চলমান বিমানের জানালা দিয়ে বাইরে তাকালে বন্দরের সব কিছু কিঞ্চিত ঘোলাটে লাগে। বাসযোগে অবতরণ টার্মিনালে ঢোকার সাথে সাথেই প্রচণ্ড ঝকঝকে আলোতে চোখ সইয়ে নিতে বেশ কয়েক মুহূর্ত সময় নেয়, যেন কয়েক ঘণ্টা বিরক্তিকর লোডশেডিং এর পরে হঠাৎ যেন বিদ্যুতের আগমন। চারপাশে লোকজনের কলকাকলি ও ব্যস্তসমেত চলাফেরায় কিছুক্ষন আগের ঝিমুনি ভাবটা কেটে যায়। দিক নির্দেশনা দেখে ডোমেস্টিক ট্রান্সফার কাউন্টারের দিকে ঢিমাতেতালে হাটতে থাকলাম, আমাদের সংযুক্ত ফ্লাইট পরদিন সকাল সাড়ে সাতটায় তাই তেমন কোন তারা বোধ করি না। স্ত্রী আর সাত বছরের পুত্র সহ সপ্তাহ খানেক দুই-চার জায়গায় ঘুরাঘুরি করার ব্যাপক খায়েশ নিয়ে এই শ্যামভুমিতে আগমন। শিশু পুত্র ঘুম ভাঙ্গা চোখে কৌতুহলী হয়ে এদিক-ওদিক তাকাতে তাকাতে হাঁটতে থাকে। কিছুক্ষনের মধ্যেই চলন্ত পথ (Floor Escalator) তার কাছে মজার খেলনা হিসাবে ধরা দেয়। সে কিছুক্ষণ হেঁটে হেঁটে আবার কিছুক্ষণ চলন্ত পথের উপর দিয়ে এই ভাবে আমাদের সঙ্গে যেতে থাকে।
মিনিট পনের হাঁটার পরে আমরা ‘ট্রান্সফার ও ইমিগ্রেশন কাউন্টারের’ সামনে পৌঁছে ত্রিসীমানার মধ্যে কাউকে দেখতে না পেয়ে যারপরনাই অবাক হই। স্ত্রী-পুত্র আমার দিকে সন্দেহের দৃষ্টি তে তাকায় যে আমরা ঠিক জায়গাতে এসেছি কি-না? শ্যামদেশে আমাদের প্রথম গন্তব্য দক্ষিনে অবস্থিত ফুকেট দ্বীপ আর ইমিগ্রেশনের প্রক্রিয়া এখান থেকেই সম্পন্ন করে যেতে হবে, বিমানবন্দরের ওয়েব সাইটে এই রকমই নির্দেশনা দেখেছিলাম এছাড়া টিকিট কেনার সময়ও ট্রাভেল এজেন্টও এই রকমই বলে দিয়েছে যে, নেমেই ইমিগ্রেশন সম্পন্ন করে “ব্যাংকক এয়ার” এর লাউঞ্ছে গিয়ে চা-নাস্তা সহযোগে পরবর্তী ফ্লাইটের পূর্ব পর্যন্ত আরাম-আয়েশের সঙ্গে অপেক্ষা করা যাবে! সাহায্যের আশায় ইতিউতি তাকাতে থাকি। একটু দূরেই এক শ্বেতাঙ্গ ভদ্রমহিলা বাক্স-পোটরা নিয়ে দুটা বেঞ্চ একসাথে করে শোয়ার ইন্তেজাম করছে দেখে কিছুটা স্বচ্ছন্দ বোধ করি এই ভেবে যে আমরা অন্ততঃ ভূল যায়গাতে আসি নাই হয়তো কাউন্টার গুলো বন্ধ হয়ে গেছে।


সুনসান নিরব ট্রান্সফার এরিয়া
পাশের একটা ‘শুল্ক-ছাড়’ দোকানে পরিচ্ছন্ন কাজে নিয়জিত এক মহিলা কর্মীকে জিজ্ঞাসা করে তেমন কোন উত্তর পাইনা, সে শুধু স্মিত হাসে, শেষমেষে এক নিরাপত্তা কর্মীকে পেয়ে তাকে বেশ কসরত করে বোঝাতে সক্ষম হই যে ট্রান্সফার ও ইমিগ্রেশন কাউন্টার কখন খুলবে, সে বেশী বাতচিতের ধারে কাছে না গিয়ে “এক কথায় প্রকাশ” ধরনের উত্তর দেয় “ফাইভ, মর্নিং”, থাই ইংরেজি সম্পর্কে পূর্ব অভিজ্ঞতা থাকাতে আমি বুঝে নেই ভোর পাঁচ টাতে খুলবে। ইতিমধ্যে আশেপাশে আরো কয়েকজন আমাদের মত বদলী যাত্রী দেখতে পাই।
কি আর করা ইমিগ্রেশন শেষ করে ব্যাংকক এয়ারওয়েজের লাউঞ্জে চা-নাস্তা খেয়ে বাকি রাতটুকু আয়েশ করে গড়াগড়ির ইচ্ছা বাধ্য হয়েই বাদ দিতে হয়, শ্বেতাঙ্গ ভদ্রমহিলার মত আমরাও খালি ব্রেঞ্চের দিকে অগ্রসর হই। পুত্রের জন্য একটাতে সাময়িক বিছানার ব্যবস্থা করি, কিন্তু পুত্রকে ধারে কাছে দেখি না সে কিঞ্চিত দূরে যথারীতি “চলন্ত পথে” খেলায় ব্যস্ত। চলন্ত পথ গুলো স্পর্শকাতর পদ্ধতির হওয়ার কারণে সামনে গেলেই চলতে শুরু করে, তার কাছে হয়তো এগুলো পার্কের রাইড গুলির মতই মজার মনে হচ্ছে। পুত্রকে ধরে এনে তার জন্য তৈরি সাময়িক বিছানাতে শোয়াই আর আমরাও দুটা চেয়ারে আরাম করে বসি। টুক-টাক কথা বলতে বলতে স্ত্রীও ঝিমানো শুরু করলে আমি ট্যাবে মনোনিবেশ করে সময় কাটানোর চেস্টা করি, সহজেই ওয়াই-ফাই এর সংযোগ পাওয়া যায় আর ‘এয়ারপোর্ট অথারিটি অব থাইল্যান্ডের’ বিনা মূল্যের প্রদানকৃত বেশ উচ্চ গতির লাইনের সুবিধা পেয়ে অন্তঃজালের সাথে সংযুক্ত হই।


সময় কাজে লাগানোর বিকল্প ব্যবস্থা
গান শুনতে শুনতে একটু ঝিমিয়ে পড়েছিলাম হয়ত, সম্বিৎ ফিরে পেলাম অনেক লোকজনের কথা বলার আওয়াজ আর চলন্ত পথ গুলো সচল হওয়ার শব্দে, বড়সড় কোন বিমান অবতরণ করেছে কাছের কোন গেটে যাত্রীরা আমাদের সামনে দিয়ে যাচ্ছে। বেশ কয়েকশো মানুষ হবে, প্রায় সবাই মোঙ্গলয়েড চেহারার আর চকচকে বেশভূষা দেখে মনে হচ্ছে সূর্য উদয়ের দেশ থেকে আগমন। আমি এদেরকে দেখতে থাকি, দেশের একটা ছোট শহরের বাস-টারমিনালের সন্নিকটে আমার ছেলেবেলা কেটেছে আর বাসার সামনে বসে বসে বাসযাত্রী দের দেখে দেখে আমার অনেক সময় কাটত সেই সুবাদে এখনও আমার বাস-টারমিনাল, রেল স্টেশন, লঞ্চ-ঘাটে, বিমানবন্দরে আমার অপেক্ষা করতে খারাপ লাগে না, নানা রঙের নানা জাতির মানুষ জন এদের কর্মকাণ্ড, ব্যস্ততা দেখতে দেখতে সময় পাড় করা যায়। যাত্রীদের সামনের দিকে কিঞ্চিৎ জটলা করতে দেখতে পাই, কৌতূহলী হয়ে এগিয়ে যাই ধূমপান কক্ষের সামনে জটলা চলছে। ভিতরে ভরপুর থাকাতে এরা তাদের বেড়িয়ে আসার অপেক্ষা করছে। অনেক লম্বা উড়াল সময়ের কারণে এরা এই স্বাদ থেকে বঞ্চিত ছিল বলে সামনে ধূমপান কক্ষ দেখে প্রথম সুযোগেই তার ব্যবহার করছে। তাদের দেখে আমার মাথায়ও ইচ্ছাটি চাড়া দেয় এবং যথারীতি আমিও এই কক্ষে ঢুকে পরি।
অবতরণকারী জাপানিরা ধীরে ধীরে চলে যায় আর জায়গাটি সেই আগের মতই সুনশান নিরব হয়ে যায়। তবে বেশীক্ষন নীরব থাকে না, আর একটি বড়সড় বিমান অবতরণ করলে যায়গাটা আবারও কোলাহলপূর্ণ হয়ে যায়। এবারের যাত্রীদের চেহারা-সুরত, বাতচিত আর বেশভূষায় ভারতীয় বলে মনে হয়। ইতিমধ্যে পাঁচটা বাজতে চলল, ইমিগ্রেশন কাউন্টারে দুই একজন উর্দি পড়া কর্মকর্তা দের দেখা যাচ্ছে বলে আমরা উঠে পড়ি। প্রথমে ‘ব্যাংকক এয়ার’ এর কাউন্টারে যাই, ঢাকা থেকেই বোর্ডিং পাশ নিয়ে আসার জন্য আমাদের মাল-সামানা সরাসরি ফুকেট চলে যাবে। কাউন্টারের মেয়েটি আমদের বোর্ডিং পাশ গুলো চেক করে নির্গমন গেটের নম্বর দিয়ে দেয় আর ছোট্ট একটা লাগেজ স্টিকার গায়ের সাথে লাগানোর জন্য দেয়। আমি কিছুটা ভ্যাবাচেকা খেয়ে যাই, শেষ পর্যন্ত আমাকে আবার মাল-সামানার লাইনে পাঠায় কি-না কে জানে? স্টিকার টার কথা জিজ্ঞাসা করলে মেয়েটি ছোট-খাটো একটা বৃক্তিতা দেয় যার বেশির ভাগ অংশই আমার বোধগম্য হয় না। অনেক কষ্টে যেটুকু বুঝতে পারি তা হল স্টিকার দেখে এয়ারলাইন্সের লোকজন আমাকে মাল-সামানা প্রদান করবে। প্রকৃতপক্ষে আমরা বদলী যাত্রী হওয়াতে আর আমদের মাল-সামানা সরাসরি ট্রান্সফার হয়ে গেছে তাই আমাদের ফুকেট এয়ারপোর্টের লাগেজ ক্লেইম এর বিশেষ কোন যায়গা থেকে সংগ্রহ করতে হবে। তবে যাই হোক, বুকে-গায়ে স্টিকার ব্যবহার মাত্র শুরু, পর্যটকদের স্টিকার দিয়ে সনাক্ত করা, তাদের স্টিকার অনুযায়ী সেবা প্রদান করার অভিনব পদ্ধতির সাথে পরে ব্যাপক পরিচয় হয়। গায়ে ট্যাগ লাগিয়ে আমরা ইমিগ্রেশন কাউন্টারে যাই। কাউন্টার গুলোর সামনে এখনো তেমন কোন লাইন দেখিনা, আমরা একটা কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে ইমিগ্রেশন কর্মকর্তার কাছে পাসপোর্ট গুলো বাড়িয়ে দিলে তিনি স্মিত হেসে পাসপোর্ট গুলো গ্রহণ করে তেমন কোন বাগাড়ম্বর ছাড়াই মিনিট পাঁচেকের মধ্যে সিল-ছাপ্পর মেরে সকল আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে পাসপোর্ট ফেরত দিয়ে “শ্যামদেশে” সুস্বাগত জানায়।

এরপরে আমরা ডোমেস্টিক বহির্গমন টারমিনালের মধ্যে ব্যাংকক এয়ারের লাউঞ্জের খোঁজে হাটতে থাকি, টার্মিনাল ভবনের কাঁচের দেয়ালের বাইরে কিঞ্চিৎ মেঘালা আকাশে সকালের আলো ফুটতে দেখা যায়। লাউঞ্জে ঢুকতে আমাদের বোর্ডিং কার্ড দেখাতে হয়, তারা আমাদের লাউঞ্জের ওয়াই-ফাই ব্যবহারের পাসওয়ার্ড দেয়। ভিতরে এসে আমরা এক বহুজাতিক পরিমণ্ডলে উপনীত হই, আশেপাশে কালো, শাদা, নাক খাড়া, নাক বোঁচা, আমাদের মত হালকা কালো সব জাতির প্রতিনিধিদের দেখতে পাই। বসার ব্যবস্থাও খারাপ না, চেয়ার-টেবিল, বার টেবিল, আধা শোয়া ইজি চেয়ার, সোফা সবই রয়েছে। আমরা একটু ফ্রেশ হয়ে একটা টেবিলে বসি, পুত্রকে ঘুমানোর জন্য একটা সোফাতে শোয়াতে গেলে সে কিছুতেই রাজি হয় না। চার দিকে চোখ বুলিয়ে দেখতে পাই, কেউ কেউ সোফাতে আরাম করে শুয়ে অথবা বসে ঘুমাচ্ছে আর বাকি যারা জেগে আছে তাদের সবার চোখ যার যার ল্যাপটপ, ট্যাব অথবা মুঠোফোনে। স্ত্রী আমাকে মানুষজনের এতো যন্ত্র নির্ভরতার বিষয়টা দেখায়, সেই সাথে সে কিঞ্চিৎ বিরক্তও হয় কেও কারও সাথে কথা বলছে না দেখে। পর্যাপ্ত জল-খাবারের সাথে চা, কফি ও ফলের রস বুফে আকারে সাজানো রয়েছে আমরা এখানেই প্রাতঃরাশ সম্পন্ন করি।


বহির্গমন গেট থেকে তোলা
আমাদের বিমান উড়াল দেয়ার সময় হলে আমরা নির্ধারিত নির্গমন গেটে যাই পরে আবারও এয়ারলাইন্সের বাস যোগে টারমারকে অপেক্ষামান বিমানে উঠি। এয়ারবাস কোম্পানির নির্মিত এ৩১৯ বিমান, উঠার সময় বিমানের নাম লক্ষ্য করে দেখি “লুয়াং-প্রবাং ”, লুয়াং প্রবাং হচ্ছে পাশের দেশ লাওসের এক বিখ্যাত শহরের নাম এই শহর ইউনেস্কো ওয়ার্ড হেরিটেজের অন্তর্গত। গতরাতে ঢাকা থেকে যে বিমানটাতে এসেছি ঐটার নাম ছিল “নম-পেন ”, নম-পেন থাইল্যান্ডের আরেক পাশের দেশ কম্বোডিয়ার রাজধানী ও প্রধান শহর। ব্যাংকক এয়ার এর সব বিমান মনে হচ্ছে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার শহরের নাম দিয়ে। বোর্ডিং শেষ হলে যখন আমাদের পাইলট মশাই শুভসকাল জানিয়ে মাত্র ঘোষণা শুরু করল তখন এক যাত্রীর খবর হল যে সে তার ট্যাব চার্জরত অবস্থায় নির্গমন গেটে ফেলে এসেছে। বিমানবালারা ব্যস্ত সমেত ভাবে নির্গমন গেটে যোগাযোগ করে দেখল হ্যাঁ সে ঠিকই ফেলে এসেছে :D কি আর করা অবশেষে ২০ মিনিট দেরি, কারন নির্গমন গেট ঐখান থেকে বেশ দূরে বাসে আমাদেরই আসতেই প্রায় ১০ মিনিটের মত লেগেছে। তবে একটা বিষয় আমার কাছে ভালো লাগল যে কেউ তেমন কোন বিরক্ত হল না। বিমানবালারা একবার ও বলল না যে কেন এমনটি হল আবার কোন যাত্রী ও তেমন কোন বিরক্তি প্রকাশ করলো না এই দেরীর জন্য। আমার কাছে উভয় পক্ষের এই ভদ্রতা খুবই খুবই অবাক (!) লাগল। অবশেষে ভদ্রলোকের ট্যাবটা তার হাতে আসলে আমরা ফুকেটের উদ্দেশ্যে উড়াল দিলাম।
ব্যাংকক থেকে ফুকেটের উড়াল সময় প্রায় ১.৩০ ঘণ্টা। আমরা ব্যাংকক থেকে সরাসরি থাই উপ-সাগরের উপর দিয়ে সুরতথানি প্রদেশের উপর উড়ে আসলাম। যখন অবতরণের জন্য পাইলট মহাশয়ের সিটবেল্ট বাঁধা ঘোষণা শুনলাম তখন আমরা সুরতথানির ভূখন্ড পার করে আন্দামান সাগরের উপরে। ইতিমধ্যে উচ্চতাও অনেক কমে গেছে আর জানালা দিয়ে আন্দামান সাগরের সবুজাভ জলে ভাসমান পাহাড়গুলো দেখা যাচ্ছে, অপূর্ব দৃশ্য! আশেপাশে সীট ফাঁকা থাকায় আমি আমার নির্ধারিত সীট থেকে উঠে গিয়ে জানালার পাশের একটা সীটে বসলাম নিচের কিছু ছবি তোলার আশায়। উচ্চতা যতই দ্রুত কমছে ততই পানির কাছাকাছি আসছি, একটু ভয় ভয় করতে লাগলো বিমান কি বন্দরে নামবে না পানিতেই সাঁতরাবে? কয়েকটা ছবি তুলতে তুলতেই বিমানের চাকা রানওয়ে ছুঁইল।


পাখির চোখে দেখা ফুকেট দ্বীপের একাংশ
আমরা ফূকেট বিমানবন্দরে নামলাম, ফুকেট বিমানবন্দর থাইল্যান্ডের একটি আন্তর্জাতিক ও বেশ ব্যস্ত বিমানবন্দর আর গেট সংখ্যা দেখে মনে হল মোটামুটি বড়সড়ই সেইসংগে আরও বড় করার জন্য নির্মাণ কাজ চলমান। বিমান অবতরণ ব্রীজের সঙ্গে সংযুক্ত হওয়ার আগেই যাত্রীরা যথারীতি ব্যস্ত হয়ে গেল, মাথার উপর থেকে মাল-সামা্না নামিয়ে বিমান থেকে নামার জন্য তৈরি। আমাদের যেহেতু তেমন কোন তাড়া নাই আর বন্দরের বাইরেও আমাদের জন্য কেউ বা কোন গাড়ী অপেক্ষামান নাই তাই আমারা ঢিমে-তেতালে বিমান থেকে নামি এবং “ব্যাগেজ ক্লেইমে” সন্ধানে এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে ধীরে ধীরে টার্মিনাল ভবনে অগ্রসর হতে থাকি। এক পর্যায়ে এয়ারলাইন্সের উর্দি পড়া এক ললনা আমাদের থামিয়ে বদলি যাত্রীদের মাল-সামানার সংগ্রহের জন্য মেঝেতে অংকিত দিক চিহ্নে বরাবর যেতে বলে, আমি মেঝেতে অংকিত রৈখিক চিহ্নটিকে সাপের এঁকে-বেঁকে বেশ দূরের দিকে চলে গেছে দেখতে পাই এবং সেইসঙ্গে আমরা সুবর্ণভূমি বিমানবন্দর থেকে গায়ে লাগানোর জন্য দেয়া “লাগেজ ট্যাগের” মাহত্ব বুঝতে পারি। ফুকেট আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হওয়ায় এখানে অভ্যন্তরীণ, আন্তর্জাতিক, ব্যাংককে আন্তর্জাতিক থেকে আভ্যন্তরীণ বদলী এই তিন ধরণের যাত্রীই অবতরণ করে। আবার ব্যাংকক থেকে আগত বিমানে অভ্যন্তরীণ ও বদলী যাত্রী একসাথে থাকে যেহেতু বদলী যাত্রীদের মালপত্র ব্যাংককে চেকিং হয় না মালপত্র চেকিং এই জন্য এই ব্যবস্থা। দিক নির্দেশিত রেখা অনুসরণ করে আমরা মাল-সামানা সংগ্রহের স্থানে যাই এবং এয়ারলাইন্সের এক কর্মী অত্যন্ত যত্নের সাথে মালপত্র কাস্টমস থেকে চেক করিয়ে ট্যাগ মিলিয়ে আমাদের হাতে তুলে দেয় আমরা বিমানবন্দরের বাইরে বেরিয়ে হয়ে আসি। সব মিলিয়ে ব্যাংকক এয়ারওয়েজের সার্ভিস আমার কাছে বেশ ভালো মনে হয়।
ফুকেটে আমাদের গ্যন্তব্য পাতং শহর, বিমানবন্দর থেকে প্রায় একঘণ্টার পথ। প্রথমেই দেশীয় মুদ্রার সংস্থান করতে হবে, বহির্গমন টার্মিনাল থেকে বের হওয়ার গেটে মুদ্রা বিনিময় অনেকগুলো বুথ সেই সাথেই ট্যুর অপারেটর, ট্যাক্সি সার্ভিসের বুথ। আমি কিছু ডলার বিনিময় করে শ্যামদেশীয় মুদ্রা ‘বাথ’ নেই তবে পূর্বঅভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি বিমানবন্দরের চেয়ে শহরে ডলারের বিনিময় মূল্য বেশী থাকে তাই অল্প কিছু ডলার বিনিময় করি। ট্যাক্সি বুথে গিয়ে চাহিদার কথা বললে তার পা-তং পর্যন্ত ৮০০ বাথে যেতে রাজী হয় আমি দরদাম করার ইচ্ছায় ৫০০ বাথ বললে তারা আমদেরকে বাস যোগে যাওয়ার পরামর্শ প্রদান করে। আমার কাছে পরামর্শটা ভালোই মনে হল, আমাদের জন্য ১৮০ বাথ করে তিনটা টিকেট কিনে বাইরে আসলাম। ওদের একজন বাস দাঁড়ানোর নির্ধারিত স্থান দেখিয়ে দিল।
প্রকৃতপক্ষে এগুলো বড়সড় মাইক্রোবাস থাইল্যান্ডে এগুলো “ভ্যান” নামে পরিচিত, ১০/১২ জন বেশ আরামদায়ক ভাবে বসা যায়। ড্রাইভার আমাদের টিকেট নিয়ে হোটেলের নাম জেনে নেয় আর মাইক্রোবাসের পিছনে সবার মাল-সামানা উঠিয়ে নেয়। সর্বমোট আমরা ১২ জন যাত্রী উঠি, আমরা তিন জন ছাড়া এক রাশিয়ান দম্পতি, এক জাপানী দম্পতি, তিন অস্ট্রেলীয়, একজন ফুকেটের স্থানীয় থাই মহিলা, আর একজন আমেরিকান পর্যটক তার বেশভূষা দেখে মনে হয় অনেক ঘাটের পানি খেতে খেতে আসছেন। ড্রাইভার পা-তং এর উদ্দেশ্যে গাড়ী ছেড়ে দেয়। ফুকেট বিমানবন্দর থেকে পাতং যেতে প্রায় ১ ঘণ্টার মত সময় নিবে। মিনিট দশেক চলার পরে ড্রাইভার একটা ফিলিং স্টেশন কাম টুরিস্ট অফিস এ গাড়ী দাড় করায় গ্যাস নেওয়ার জন্য এবং আমাদের কে নেমে ১০ মিনিটের জন্য অফিসে বসতে বলে। সংলগ্ন টুরিস্ট অফিসে ঢোকার মুখেই আমরা সাদর অভ্যর্থনা পাই, তার আমাদেরকে বিভিন্ন ধরণের হোটেলের আর ডে-ট্রিপের অফার দেয়। আমাদের সবার হোটেলই পূর্ব থেকে ঠিক থাকাতে আমাদের সাথে তাদের কোন ব্যবসা হয় না। থাই দের পর্যটন ব্যবসা এতো গোছানো যে এরা সব যায়গাতেই এদের পর্যটন বুথ রেখেছে।
কিছুক্ষনের মধ্যেই ড্রাইভার আবার গাড়ী চালু করে আমরা পাতং এর উদ্দেশ্যে রয়না দেই। সুন্দর হাইওয়ে আর রাস্তার দুইপাশে ঘন সবুজ গাছপালা দেখতে খুবই সুন্দর লাগে। আমেরিকান পর্যটক সামনে ড্রাইভারের পাশে বসেছে সে ভাঙ্গা ভাঙ্গা থাই ভাষায় ড্রাইভারের সাথে কথা বলছে আর দুই জনে হো হো করে হাসছে, ড্রাইভার মনে হয় তার ভুলভাল থাই কথায় খুব মজা পাচ্ছে। বেশ কিছুক্ষন পরে আমারা পা-তং এর কাছাকাছি পৌঁছে যাই। পা-তং শহরে ঢোকার পূর্বে বড় একটা পাহাড় ডিঙ্গাতে হয়, পাহাড়ের উপর থেকে আমরা পা-তং শহরটা সাগরের একাংশ সহ দেখতে পাই, ছবি তোলার জন্য ক্যামেরা বের করতে না করতেই আমারা নিচের দিকে নামতে থাকি আর ৫/৭ মিনিটের মধ্যে আমরা পা-তং শহরে পৌঁছে যাই। ড্রাইভার একে একে সহ যাত্রীদের তাদের হোটেলে হোটেলে নামাতে থাকে। আমার কাছে এই বাস সার্ভিস খুবই খুবই কার্যকরী মনে হয়।
অবশেষে আমাদের পালা আসে আমাদের হোটেল মনে হয় বেশ পরিচিত, চালক আমাদের কে ‘রাতু থিত সংগরই পি’ রোডের মাঝামাঝি অবস্থিত আমাদের হোটেলের গেটে এসে নামিয়ে দেয়। অন্তঃজালের মাধ্যমে হোটেল বুক করাতে হোটেল নিয়ে হালকা দুশ্চিন্তায় ছিলাম, কেমন হবে, আসলে লোকেশনটা আমাদের জন্য ঠিক হয় কি না? বিচ থেকে বেশি দূরে কি-না? ইত্যাদি ইত্যাদি। হোটেলের সুইমিং পুল ও বহিঃদর্শন দেখে আমাদের খুব পছন্দ হয়ে গেল আর পুল দেখে তো পুত্র রীতিমত উত্তেজিত, এক মিনিটের মধ্যেই সে আবিস্কার করে ফেলল এখানে বড় পুলের পাশে বাচ্চাদের জন্যও ছোট পুল রয়েছে।


হোটেলের পুল
নিয়মানুযায়ী হোটেলের চেক-ইন এর সময় দুপুর দুইটাতে কিন্তু আমাদের পৌঁছানোর সময় ১১টা হওয়াতে আমি পূর্বেই অগ্রিম চেক-ইনের জন্য ই-মেইলে অনুরোধ করেছিলাম। হোটেল লবিতে কর্মীরা আমাদের উষ্ণ অভ্যর্থনা জানায় আর স্ট্রবেরীর জুস দিয়ে আমাদের কে আপ্যায়িত করে আর অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে আমাদেরকে ছয় তলায় বরাদ্দকৃত কক্ষে পৌঁছে দেয়। কক্ষে ঢুকে দীর্ঘ যাত্রার পরে আমরা বেশ স্বস্তি বোধ করি আর বিশ্রাম নেয়ার ইন্তেজাম শুরু করি।

==========================================
পরের পর্বঃ শ্যামদেশে কয়দিনঃ পর্ব দুই
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে মার্চ, ২০১৫ সকাল ১১:৪২
১৪টি মন্তব্য ১২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

পরিণতি - ৩য় পর্ব (একটি মনস্তাত্ত্বিক রহস্য উপন্যাস)

লিখেছেন সাখাওয়াত হোসেন বাবন, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১২:২৮



( পরিণতি ৬১ পর্বে'র একটি মনস্তাত্ত্বিক রহস্য উপন্যাস ।)

তিন


আচানক ঘুম ভেঙ্গে গেলো ।

চোখ খুলে প্রথমে বুঝতে পারলাম না কোথায় আছি । আবছা আলোয় মশারির বাহিরে চারপাশটা অপরিচিত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইফতার পার্টি মানে খাবারের বিপুল অপচয়

লিখেছেন রাজীব নুর, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৩:৫৩



গতকাল সরকারি ছুটির দিন ছিলো।
সারাদিন রাস্তাঘাট মোটামুটি ফাকাই ছিলো। ভাবলাম, আজ আরাম করে মেট্রোরেলে যাতায়াত করা যাবে। হায় কপাল! মেট্রো স্টেশনে গিয়ে দেখি গজব ভীড়! এত ভিড়... ...বাকিটুকু পড়ুন

গণতন্ত্র আর বাক-স্বাধীনতার আলাপসালাপ

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৪:২৩


একাত্তর সালে আওয়ামী লীগের লোকজন আর হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা ছিল পাকবাহিনীর প্রধান টার্গেট। যদিও সর্বস্তরের মানুষের ওপর নিপীড়ন অব্যাহত ছিল। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধা আর তাদের পরিবারের... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধাদের মুমিনী চেহারা ও পোশাক দেখে শান্তি পেলাম

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৯:৫৮



স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে স্টেজে উঠেছেন বত্রিশ মুক্তিযোদ্ধা তাঁদের চব্বিশ জনের দাঁড়ি, টুপি ও পাজামা-পাঞ্জাবী ছিলো। এমন দৃশ্য দেখে আত্মায় খুব শান্তি পেলাম। মনে হলো আমাদের মুক্তিযোদ্ধা আমাদের মুমিনদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×