somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

শ্যামদেশে কয়দিনঃ পর্ব দুইঃ ফুকেটের পকেটে... পকেটে.....

২৩ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ বিকাল ৪:১৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

জংসেইলন শপিং মলের সুন্দর স্থাপত্য

প্রথম পর্বের লিংকঃ শ্যামদেশে কয়দিনঃ পর্ব একঃ অবতরণ

পাতং শহরটা ছোট হলেও এর কলেবর খারাপ না, সর্বদা হরেক রকম পর্যটকে চারদিকে গিজগিজ করছে। আশে-পাশের লোকজেনের চেহারা-সুরত আর বেশভূষা দেখে মাঝে মাঝেই ভ্রম হয় যে, আমরা থাইল্যান্ড নাকি অন্য কোথাও আছি। ফুকেটে অনেকগুলো সৈকত শহর থাকলেও পাতং এর আকর্ষণ মনে হয় সবচেয়ে বেশী, তাই পাতং এ পর্যটকদের এতো আনাগোনা।


মানচিত্রে ফুকেটঃ বিভিন্ন সৈকতের অবস্থান (সংগ্রহঃ Click This Link)

এই বিলম্ব দুপুরেও রাস্তাতে আমরা প্রচুর পর্যটকের দেখা পাই বেশীরভাগই শ্বেতাঙ্গ, এছাড়া কৃষ্ণাঙ্গ, জাপানী, ভারতীয় এমন কি অনেক আরব দেশীয় পর্যটক দেখতে পাই। এদের বেশভূষা, চলন-বলনে বেশ আয়েশী আর আমোদিয় ভাব :), দেখেই মনে হচ্ছে ছুটি কাটাতে এসেছে আর ছুটিটা যত মজার সাথে কাটানো যায় সেই চেষ্টাতেই তারা সব ব্যস্ত।

জংসেইলন শপিংমলের মধ্যে জীবন্ত ক্যারিকেচার

হোটেলের ব্যালকনি থেকে পাতং এর পাহাড়

আশেপাশে রংবেরং এর দোকানপাটে বাহারি পণ্য বেশীরভাগই জামাকাপড়, সৈকতের সূর্যস্নান আর জলক্রিয়া সম্পর্কিত, গা-গতর মালিশকারীদের খোলামেলা আহবান আর সেই সাথে খাবারের দোকানও অনেক দেখা যায়। সিয়ামিজ, চীনদেশীয়, ইতালীয়, ফরাসী, মেক্সিকান, ভারতীয় আর সেই সাথে ফাস্টফুডের নামী অনেক দোকানের শাখা আমরা রাস্তার দুই পাশে দেখতে পাই। সকালের প্রাতঃরাশ আর বিমানে হালকা খাওয়া-দাওয়া পরে আমাদের এখনো কিছু খাওয়া হয়নি, হোটেলে উঠে ইতিমধ্যে আমরা দুই ঘণ্টার ঘুমিয়েছি তাই খুব ক্ষুধার্ত বোধ করি। কিন্তু চারদিকে খাবারের এত এত ব্যবস্থা দেখে আমরা বেশ সীদ্ধান্তহীনতায় ভুগতে থাকি! অবশেষে জংসেইলন শপিং মলের পাশের ম্যাকডোনাল্ডে এসে ঢুকি।

অতঃপর বাঘের খাঁচায়......
শেষ দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পরে বিকেলটা কি কাজে লাগানো যায় এই নিয়ে আমরা বাদানুবাদ করতে করতে জংসেইলন শপিং মল থেকে বাইরে আসি শেষমেশ আমরা বিকালটা ফুকটেরে আশপোশে ঘুরাঘুরি করে সময়টা উপভোগ করার সিদ্ধান্ত নেই। শপিং মলের সামনে আসতইে অনেক টুক-টুক চালক আমাদের নিয়ে ঘুরাঘুরি করার প্রস্তাব দেয়। তারা আমাদের বিভিন্ন জায়গার ছবি সম্বলতি ক্যাটালগ প্রর্দশন করে, তাদের প্রদর্শিত ক্যাটালগে নানা রকম আর্কষণীয় জায়গার বড়সড় তালিকা দেখতে পাই সেখানে বন-বাদারে টারজান খেলা থেকে শুরু করে সাপের খেলা, পুতুল নাচ, বান্দর নাচ, হস্তী দর্শন, ব্যাঘ্র দর্শন, গা-গতর মালিশ, সৌনা স্নান ইত্যাদি সব কিছুর প্রস্তাবই দেখতে পাই। এতো কিছুর সুবিধা দেখতে পেয়ে আমরা আবারো দোটানায় পড়ে যাই, আর এই অল্প সময়ে কোনটা আমাদরে জন্য সঠিক হবে তা ঠাওর করতে পারি না। ছেলে বাঘ দেখতে আগ্রহ প্রকাশ করে, ড্রাইভার জানালো বাঘ দেখতে গেলে পাশের শহর কাটু তে যেতে হবে যা মাত্র ২০ মিনিটের দূরত্ব, সময় আর ছেলের আগ্রহের কথা চিন্তা করে আমরা ব্যাঘ্র দর্শনেই যাত্রা করি। ব্যাঘ্র দর্শনে গিয়ে যে পাকেচেক্রে পড়ে বাঘের খাঁচায় ঢুকতে হবে এইটা জানলে আমি কখনো ব্যাঘ্র দর্শনে মোটেই রাজি হতাম না :)। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই ভাড়া করা টুক-টুকটি আমাদরেকে কাটু শহররের 'টাইগার কিংডম' এ নিয়ে আসে।

টাইগার কিংডমের মধ্যে খাঁচায় বাঘ

টাইগার কিংডম এ অভ্যর্থনার পাশের ক্যাফেতে বসেই আমরা খাঁচায় থাকা বাঘ দেখতে পাচ্ছিলাম এবং সেই সংগে ফাও হিসাবে ভয় ধরানো বাঘের গর্জনও পাচ্ছিলাম /:)। ওখানকার এক কর্মী আমাদেরকে তাদের বাঘ দর্শনের কি কি সুবিধা আছে তার ব্যাপক ফিরিস্তি দেয়। আমরা শুনে অবাক হই এখানে বাঘ শুধু দেখা না বাঘের সাথে মোলাকাতেরও ব্যবস্থা আছে! বাঘের গায়ে হাত দেয়া যায়, বাঘের সাথে ছবি তোলা যায়। খাইছে আমারে!!! :)। বাচ্চাদের জন্য বাঘের বাচ্চা দেখানোর ব্যবস্থা আছে, আমরা বেশ চড়া মূল্যে সেই টিকিট কিনি, বাচ্চাকে একা ছাড়ার নিয়ম নাই, বাচ্চার সাথে তার মা বা বাবার যেতে হবে। ওর মা ওর সাথে যাবে বলে ঠিক করে। এবার আমি আমার নিজের জন্য টিকেট কিনতে গিয়ে দেখি যত ছোট বাঘ টিকেটের দাম তত বেশী। তাই বুদ্ধিমানের (!) মত তুলনামূলক কমদামে বেশ বড় সাইজের বাঘ দেখার টিকেট কিনে সস্তায় পাওয়া গেছে বলে ব্যাপক খুশী হই (!)
যথারীতি আবারো গাঁয়ের সাথে ট্যাগ লাগিয়ে দেয়, মা আর ছেলের সবুজ আর আমারটা হলুদ, আমারা গাইডের সাথে বাঘের কাছাকাছি যাওয়ার জন্য মুল কমপাউন্ডে ঢুকি। আশে-পাশের খাঁচায় অনেক বাঘ দেখতে পাই, সবই আমাদের বিখ্যাত ‘রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার’ তবে বাঘগুলো বেশ স্বাস্থ্যবান। আমি যেতে যেতে এই বাঘ যে আমাদের ‘জাতীয় পশু’ আর আমাদের সুন্দরবনে এদের অবাধ বিচরণ এই বিষয়ে গাইডকে ব্যাপক জ্ঞান দিতে থাকি, সে শুধু মুচকি মুচকি হাসতে থাকে। ছেলে আর তার মাকে ওরা বাচ্চা বাঘের খাঁচার ভিতরে ঢুকতে দেয়, ঢোকার আগে হাত ভালোকরে জীবানুমুক্ত করে ওদের দেয়া স্যান্ডেল পড়তে হয়। মা ও ছেলে শুরুতে কিছুটা আড়ষ্ট থাকলেও ছেলে কিছুক্ষনের মধ্যেই সহজ হয়ে বাচ্চা বাঘের সাথে হুটোপুটি করতে থাকে।

বাচ্চা বাঘের সঙ্গে ছেলের হুটোপুটি

কিছুক্ষন পরে আমার পালা আসে, আমাকে গাইড এবার আর একটা খাঁচার দিকে নিয়ে যায়, খাঁচার সামনে এসে তো আমার নিজের আত্মারাম খাঁচা ছাড়া হওয়ার জোগাড় হয়, ভিতরে দেখি তিনটা বড়সড় বাঘ, একটা তো আমাদের দিকে জুলুজুলু করে তাকিয়ে আছে আর দুইটা নিজেদের মধ্যে মারামারি (মনে হয় মজা করে খেলা) করছে আর একটু পরে পরে পানির চৌবাচ্চায় লাফিয়ে পড়ছে। আমি গাইডের দিকে তাকাই, এবার তার মুচকি হাসি আরও প্রকট হয়, ভাবটা এমন যে ব্যাটা বাঘ নিয়ে তো অনেক ‘লেকচার’ ঝাড়ছিস এখন দেখি বাঘের খাঁচায় ঢোক :) । এই ব্যাটার হাসি দেখে আমার মোটামুটি গা-জ্বলে যায়, ব্যাটা বজ্জাত কি বুঝতে পারলো নাকি যে আমি ভয় পেয়েছি।

এই খাঁচাতেই আমি ঢুকেছিলাম

সে আমাকে ডাকে ‘কাম জেন্তলম্যান কাম’ আমি মহা ফান্দে পড়ে যাই, পুরাপুরি ‘ইজ্জত কা সাওয়াল’ :((, এ-যাবত কালে যত দোয়া-কালাম শিখেছি সেগুলো পড়তে পড়তে ব্যাপক সাহসী সাহসী ভাব নিয়ে খাঁচার ভিতরে ঢুকি B-)। আমার সাথে গাইড সহ আরও দুই জন ঢোকে তারা বাঘের ট্রেইনার মুলতঃ এরাই বাঘ গুলোকে সামলাবে। গাইড একের পর এক বর্ণনা দিতে থাকে বাঘ গুলো র বয়স কত, কবে জন্ম, কি খায়... আমার মাথায় এগুলো কিছুই ঢোকে না, আমার ধান্ধা একটাই কখন এখান থেকে বের হব। বাঘের সরাসরি সামনে যাওয়া বারণ, আমি একটার পেছনে যেতে না যেতেই আরেকটা আবার আমার পেছনে এসে দাঁড়ায়। একটা বাঘ বসলে গাইড বলে এবার বাঘের গায়ে হাত দিতে পার, আমি ভয়ে ভয়ে এর গায়ে হাত দেই। গাইড ছবি তুলতে যায়, আমাকে বলে ‘লুক জেন্তলম্যান লুক... স্মাইল...স্মাইল’ আমি কোনমতে কাষ্ঠ হাসি দেই আর মনে মনে বলি ভাই বহুত হইছে এইবার তুমি আমাকে এই খাঁচা থেকে বের কর!! :((

রঙে রঙ্গিন বেলাভূমিঃ
ফুকেটের প্রথম দিন আমাদের ভ্রমণজনিতঃ অবসাদ আর বাঘের খাঁচায় নাকাল হতে হতে কেটে যায়। টাইগার কিংডম থেকে বেড়িয়ে আমরা পাতং সৈকত এ আসতে আসতেই সন্ধ্যা হয়ে যায় বলে আমাদের আর সৈকতে যাওয়া হয় না।

পাতং বেলাভূমির একাংশ

দ্বিতীয় দিন সকাল বেলা ধীরে সুস্থে ঘুম থেকে উঠে আমরা আয়েশ করে প্রাতঃরাশ করি আর সেই সাথে সীদ্ধান্ত নেই যে আমরা আর এলোমেলো কোথাও যাবনা, ফুকেটে এসেছি সুনীল আন্দামান সাগর দেখতে এখন এই দিকেই মনোনিবেশ করব। আমরা দিনটা পাতং সৈকতে কাটাবো বলে মনঃস্থির করি।

বিনোদন তো সবারই দরকার :)

সৈকতে ব্যাপক জলক্রীড়ার ব্যবস্থা

পড়ন্ত বিকেলে বেলাভূমিতে প্যারাসেইলিং

হোটেল থেকে সৈকত হাঁটা পথ, ৮/১০ মিনিটের মধ্যেই আমরা পাতং সৈকতে চলে আসি। পাতং সৈকত দেখেতো আমি ভারী ধরণের টাসকি খেলাম :-*, আমার ধারনা শুধু আমি না, যে কোন বাংলাদেশীই এই টাসকি খাবে! আমাদের কক্সবাজার সৈকত যে দেখেছে তার কাছে পাতং সৈকত তেমন কিছুই মনে হবে না:)। দৈর্ঘ্যে খুবই ছোট একটা সৈকত ! অর্ধচন্দ্রাকৃতি আকার, এক মাথা থেকে অন্য মাথা পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে, আর বেলাভূমিও খুব ছোট। তবে হ্যাঁ, পানির রং আসলেই অন্যরকম, নীলাভ সবুজ! আর এই কারণে শুধুই তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছা করে! আর ঢেঊ গুলোও মনে হল অনেক বড় বড়। পানির রং, সাদা বালুকাবেলা আর উঁচু উঁচু ঢেঊ এই সব বিশেষণের জন্যই মনে হয় পাতং সৈকত অনন্য।

নীলাভ সৈকত

প্যারাসেইলিং এর প্রস্তুতি

নীল আকাশে প্যারাসেইলিং

বেলাভূমিতে অনেক পর্যটককে সূর্যস্নানরত অবস্থায় দেখতে পাই, নভেম্বর মাসের শুরু হলেও সূর্য এখনও যথেষ্ঠ তাপ বিকিরন করছে এর মধ্যেই উনারা ব্যাপক বিক্রমে সূর্য স্নান করে যাচ্ছে! কেউ কেউ আবার সাগরে নেমে সাঁতরাচ্ছে, জলক্রিড়ার ব্যবাস্থাও মন্দ না! অনেক সীস্কুটার, ছোট ছোট স্পীডবোট আর তার পেছনে লাগানো রাবারের ভেলা, বেশ মজার বাহন, স্পীডবোট দ্রুতগতিতে চলতে শুরু করলে কিছুক্ষন পরে সবাই উল্টে পরে যাচ্ছে, ব্যাপক মজা!!! এছাড়াও প্যারাসেইলিং এর ব্যবস্থাও আছে, অনেকে সাগরের উপর দিয়ে প্যারাসুট নিয়ে ভেসে বেড়াচ্ছে। সবমিলিয়ে ব্যাপক বিনোদনের ব্যবস্থা!! পর্যটকদের এতও আমোদ-প্রমোদ করতে দেখে আমরাও যথেষ্ঠ আমোদিত হতে থাকি!

মাছের মালিশঃ
পাতং সৈকতে আমাদের সারা দিন থাকার পরিকল্পনা থাকলেও দুপুরেই আমাদের বাধ্য হয়ে উঠতে হয়। পুত্র পুরো সময়টা জলহস্তীর মত পানিতে বসে থাকলে তার মাতা তার আশু সর্দী-জ্বরের আশংকায় ভীত হয়ে যায়। পরিশেষে অনিচ্ছা সত্বেও আমরা হোটেলের দিকে ফিরতে থাকি। হোটেলের কাছাকাছি আসতেই রাস্তার পাশে ভিন্ন ধরণের মালিশের সাইন চোখে পরে, ‘ফিস স্পা এন্ড ফুট ম্যাসাজ’ তবে গতানুগতিক মালিশের দোকানগুলোর মত চটকদার না। আমাদের এই মালিশ নেয়ার অদ্ভুত খেয়াল চাপে:)
মালিশকেন্দ্রের ভেতরে প্রবেশ করেই সুন্দর করে সাজানো একটা ছোট উঠোন আর এই উঠোন ঘিরেই বড় বড় বেশ কয়েকটি এক্যুরিয়াম রাখা। এক্যুরিয়ামগুলোতে স্ফটিক স্বচ্ছ পানিতে অনেক মাছ কিলবিল করছে। বেশ কয়েকজন উৎসাহী পর্যটক এর মধ্যে পা ডুবিয়ে বসে আছে আর মজাসে চিৎকার করছে। এদের চিৎকার দেখে মাত্র উৎসাহী ছেলে এই মালিশ নিতে অস্বীকৃতি জানায় তার ধারনা মাছগুলো তার পা খেয়ে ফেলবে :)

মাছের মালিশ :) :) :)

মালিশওয়ালার সাথে দরদাম করে জনপ্রতি ১০০ বাথে আমরা ১৫ মিনিট করে এই সেবা নেয়ার টিকেট কিনি। পা জীবানু মুক্ত করার জন্যে তরল সাবান দিয়ে প্রথমে পরিষ্কার করা হয় এর পরে আমারা এক্যুরিয়ামে পা ডুবিয়ে বসি। ইঞ্চি খানেক লম্বা লম্বা আমাদের দেশী ‘চ্যালা’ মাছের মত মাছ, এক সেকেন্ডের মধ্যে আমাদের পায়ে ঝাপিয়ে পড়ে। এই ছোট ছোট মাছের ঠোকর পায়ে এক ধরণের ঝিম-ঝিম অনুভূতি দেয় সেই সংগে সুড়সুড়িও :)। আমাদের পা আস্ত আছে দেখতে পেয়ে ছেলে তার ভয় ভেংগে আমাদের সাথে যোগ দেয় :)

ঐরাবতের পিঠে সওয়ারঃ
দুপুরের মধ্যেই সৈকত থেকে চলে আসাতে যথারীতি বিকেলের জন্য আমরা মোটামুটি বেকার হয়ে যাই। সৈকত থেকে ফেরার পথেই এক ট্যুর অপারেটরের অফিসে ঢু মারি, সেখানে অর্ধেক দিনের জন্য কি কি বেড়ানোর সুযোগ আছে জিজ্ঞাসা করাতে তারা টুক-টুক ড্রাইভারের মত লম্বা তালিকা আর নানা রকম রংগিন ব্রোশিয়ার দেখায়। তাদের ব্রোশিয়ার দেখে মা ও ছেলে হাতীর পিঠে চড়ে জংগলে ট্রাকিং এর প্যাকেজ পছন্দ করে, কিন্তু অর্ধেক দিনের জন্য তাদের প্যাকেজ মূল্য আমাদের কাছে বেশ চড়া মনে হয়, দরাদরি করতে গেলে তারা খুব একটা আগ্রহ দেখায় না। আসলে আমার মনে হয় ইংরেজীতে তারা খুব একটা স্বচ্ছন্দ বোধ করে না বলে তারা আর আগায় না।

হস্তীর পিঠে যাত্রা শুরু

মাছের মালিশ শেষ করে আমরা মালিশকেন্দ্রের বিপরীত দিকে আর একটা ট্যুর অপারেটরের এর কাছে যাই। হাসি মুখে এক তরুণী আমাদের কে সাদর অভ্যর্থনা জানায় তার নাম ‘কিয়া’ বলে আমাদের সাথে পরিচিত হয়। তাকে আমরা হাতীর পিঠে চড়ে জংগলে ট্র্যাকিং এর প্যাকেজের কথা জিজ্ঞাসা করি। সে হিসাব-কিতাব করে আগের অপারেটরের চেয়ে কম মূল্য বলে, সুযোগ পেয়ে আমরা তার সাথে হাস্য-রসের সাথে দরদাম শুরু করি অবশেষে বেশ সস্তায় তিন জনের জন্য ১৩০০ বাথ দিয়ে আমরা এই প্যাকেজ ক্রয় করি। প্যাকেজে আমাদের হোটেল থেকে যথাস্থানে নিয়ে যাওয়া এবং ৩০ মিনিট হাতির পিঠে জংগল ট্রাকিং, ৩০ মিনিট হাতির বাচ্চার শো, চা-নাস্তা এবং সব শেষ করে হোটেলে পৌঁছে দেয়া অন্তর্ভুক্ত।
আমরা দুপুরের খাবার খেয়ে হোটেলের লবিতে অপেক্ষা করি, দুপুর আড়াইটায় যথাসময়ে ‘ফুকেট প্যারাডাইস’ থেকে আমাদের নিতে গাড়ী আসে। গাড়ীতে উঠে পরিচয় হয় দুইজন অবসরপ্রাপ্ত আমেরিকান সেনা, এক রাশিয়ান মা ও ছেলে এবং এক সৌদি দম্পতি। আমাদেরকে পাতং থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরে ‘রোয়াই’ শহরে যেতে হবে। আমাদের জন্য ফুকেট দ্বীপের বেশ কিছু অংশ দর্শনের সু্যোগ হয়। পাহাড়ী চড়াই-উৎরাই মধ্যে দিয়ে সুন্দর রাস্তা এবং পাহাড়ী সবুজ জংগলের মধ্যে দিয়ে মাঝে মাঝে নীলাভ সাগর দেখা যাচ্ছে। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা ‘ক্যারন’ শহরে চলে এলাম, ক্যারন পার হয়ে একটু এগোলেই আমরা সুন্দর একটা ভিউ পয়েন্টে আসি, ঐখান থেকে ক্যারন সৈকত সহ আন্দামান সাগরে অনেক অংশ একসাথে দেখা যায়।

আমাদের হাতির সদা হাস্যময় মাহুত

মিনিট চল্লিশের মাথায় আমরা ‘রোয়াই’ শহরের কাছা-কাছি ‘ফুকেট পারাডাইস’ এ পৌঁছাই। এখানে শুধু্ হাতীতে জংগল ট্রাকিং না, সেই সাথে সাপের বিভিন্ন ধরনের শো, বাঁদরের খেলা এবং সবচেয়ে আকর্ষণীয় এটিভি (ATV- All-terrain Vehicle) চালানোর জন্য বিখ্যাত। গাড়ী থেকে নামতেই আমাদের আবারও গায়ের সাথে দুই রঙের স্টিকার লাগিয়ে দেয়। গাইড আমাদের আবারও গাড়ীতে চড়িয়ে পাহাড়ের উপরে হাতীর পীঠে চড়ার জায়গায় নিয়ে যায়। হাতীর পিঠে উঠার জন্য বেশ উঁচু প্লাটফর্ম তৈরী করা রয়েছে, আমরা হাতীর পিঠে চড়ি আর বসার ব্যবস্থাও খারাপ না। লোহার রড দিয়ে তৈরী সুন্দর আসন, কিন্তু সমস্যা হয় হাতী হাঁটতে শুরু করলে, অনেক জোরে দুলনি হয় আর যখন পাহাড়ে ঢাল বেয়ে উপড়ের দিকে বা নিচের দিকে নামে তখন বসে থাকাই কষ্টকর হয়ে যায়। ভেবে ভয় হচ্ছিল হাতি যদি পাহাড়ের ঢাল বেয়ে জোড়ে দৌড়ে নামতে থাকে তখন আমাদের কি অবস্থা হবে। আমাদের হাতীর মাহুত খুবই রসিক সে ‘ম্যা’ ‘ম্যা’ করে তার হাতীকে সামাচ্ছিল আর আমাদের সাথে বিভিন্ন কথায় মজা করছিল। ছেলে মাহুতের মত করে ‘ম্যা’ ‘ম্যা’ করে হাতীর সাথে কথা বলতে গেলে আমরা তাকে থামাই, তার কথায় হাতী আবার উল্টোটা মনে করে দৌড় শুরু না করে :-*। তেমন বড় কোন ঝামেলা ছাড়াই আমারা ৩০ মিনিটের এই উত্তেজনাপূর্ণ আরোহণ শেষ করি।

হাতির পিঠে করে জংগলে ট্রাকিং

হস্তী আরোহণ শেষ হলে আমাদের কে গাইড ছোট একটা হল রুমে এনে বসায় এখানেই হাতীর বাচ্চার শো হবে। সর্বসাকুল্যে দর্শক মাত্র সাত জন, আমরা ছাড়া চার জন রাশিয়ান বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী। অল্পক্ষণের মধ্যে হারমনিকা বাজাতে বাজাতে ট্রেইনারের সাথে ছোট একটা হাতীর বাচ্চা প্রবেশ করে, বাজনা থামিয়ে সে তার শুড় তুলে সবাই কে ‘সোয়াদিকা’ (থাই ভাষায় হ্যালো) জানায়।ট্রেইনার আমাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয় হাতীর বাচ্চার নাম ‘এঞ্জেলিনা’ তার বয়স আড়াই বছর, মেমরি খুবই কড়া আর প্রতি সন্ধ্যায় বাংলা রোডে গিয়ে নেচে আসে :) । ট্রেইনারের নির্দেশ মত সে দুই পা তুলে, শুয়ে, নেচে সুনিপুন ভাবে বিভিন্ন কসরত দেখায়। একে একে শুর দিয়ে পেঁচিয়ে সবার সাথে কোলাকুলি করে।

দুষ্ট এঞ্জেলিনা:)

এরপর ট্রেইনার জানায় ‘এঞ্জেলিনা’ সবাই কে গা-গতর মালিশ করে দেবে :)। সবাই খুবই উৎসুক হয়। প্রথমে এক রাশিয়ান ছাত্রী যায় হাতী তার পিঠে শুর দিয়ে মালিশ দিতে থাকে এটা দেখে আমারা সবাই খুবই মজা পেতে থাকি। একে একে সবাইকে ‘এঞ্জেলিনা’ এই মালিশ দেয় এবং শেষে আমার পালা আসে। আমি পিঠ দিয়ে দাঁড়ালে সে কিছুই করে না দেখে অবাক হই, ট্রেইনার বলে সামনের দিকে দাঁড়াতে। সামনের দিকে দাঁড়ালে সে আমার বুকে শুড় দিয়ে বেশ জোড়ে জোড়েই বাড়ি দিতে থাকে  । দুই চারটা বাড়ি খেয়েই আমার হাতীর মালিশের স্বাদ মিটে যায়, ট্রেইনার আবার বলে ‘হ্যাপি এন্ডিং’ তখন এই বদ হাতীর বাচ্চা যেদিকে তার শুড় বাড়ায় তাতে আমি মোটামুটি আতংকিত হয়ে হল রুমের বাইরের দিকে দৌড় দেই। এদিকে দর্শক গ্যালারীতে ব্যাপক হাস্যরসের আর হাততালির উদ্রেক ঘটে/:) । আমার মনে হয়ে কুফা লেগেছে, বেড়াতে এসে যে কোন বিপদেই পড়লাম, গতকাল হলাম বাঘের খাঁচায় নাকাল আজকে আবার হই হাতীর হাতে নাকাল। শেষ পর্যন্ত মান-সন্মান নিয়ে দেশে ফিরতে পাড়ব কি-না এই দুশ্চিন্তাই মাথায় ভর করে :((

এঞ্জেলিনার মালিশ :) :) :)

অবশেষে এই শো শেষ হলে আমরা আবার পাতং এর দিকে রওনা দেই। পথে যেতে যেতে আমি ঘোষণা দেই জীব-জন্তুর কোন শো-টোতে আমি আর নাই, বহুত হইছে! আর কোন শো-টো বাদ দিয়ে আগামিকাল আমরা আন্দামান সাগরের দ্বীপ গুলি দেখার জন্য মনস্থির করি। পাতং নেমে দ্বীপে ঘোরাঘুরির প্যাকেজের টিকিট কিনতে আবারো শ্রীমতি কিয়ার শরণাপন্ন হই।
=========================================
দুঃখিত............... অনেক বড় লেখা হয়ে গেছে .......!!!! এর পর থেকে ছোট করে লিখব :) :) :)
তৃতীয় পর্বের লিংকঃশ্যামদেশে কয়দিনঃ পর্ব তিনঃ আন্দামান সাগরে দ্বীপ যাত্রা
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই এপ্রিল, ২০১৫ রাত ৮:৪৪
১৫টি মন্তব্য ১৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় রাজাকাররা বাংলাদেশর উৎসব গুলোকে সনাতানাইজেশনের চেষ্টা করছে কেন?

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সম্প্রতি প্রতিবছর ঈদ, ১লা বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শহীদ দিবস এলে জঙ্গি রাজাকাররা হাউকাউ করে কেন? শিরোনামে মোহাম্মদ গোফরানের একটি লেখা চোখে পড়েছে, যে পোস্টে তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি করাটা প্রফেসরদেরই ভালো মানায়

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৩


অত্র অঞ্চলে প্রতিটা সিভিতে আপনারা একটা কথা লেখা দেখবেন, যে আবেদনকারী ব্যক্তির বিশেষ গুণ হলো “সততা ও কঠোর পরিশ্রম”। এর মানে তারা বুঝাতে চায় যে তারা টাকা পয়সা চুরি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঘুষের ধর্ম নাই

লিখেছেন প্রামানিক, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫৫


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

মুসলমানে শুকর খায় না
হিন্দু খায় না গাই
সবাই মিলেই সুদ, ঘুষ খায়
সেথায় বিভেদ নাই।

হিন্দু বলে জয় শ্র্রীরাম
মুসলিম আল্লাহ রসুল
হারাম খেয়েই ধর্ম করে
অন্যের ধরে ভুল।

পানি বললে জাত থাকে না
ঘুষ... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরান-ইজরায়েল দ্বৈরথঃ পানি কতোদূর গড়াবে??

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:২৬



সারা বিশ্বের খবরাখবর যারা রাখে, তাদের সবাই মোটামুটি জানে যে গত পহেলা এপ্রিল ইজরায়েল ইরানকে ''এপ্রিল ফুল'' দিবসের উপহার দেয়ার নিমিত্তে সিরিয়ায় অবস্থিত ইরানের কনস্যুলেট ভবনে বিমান হামলা চালায়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×