somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ইন্দিরা গান্ধীর চোখে মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক: ওরিয়ানা ফলাচির সাক্ষাৎকার থেকে

১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:৫৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইতালীয় সাংবাদিক ওরিয়ানা ফলাচি ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাক্ষাৎকার নেন। এই সাক্ষাৎকারে মুক্তিযুদ্ধ, শরনার্থী সমস্যা, ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক, আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদী পররাষ্ট্রনীতি এবং পাকিস্তানে তাদের সামরিক শাসনের সমর্থনের বিষয়গুলো উল্লেখ আছে।

ওরিয়ানা ফলাচি: আমি সবচেয়ে কঠিন প্রশ্ন দিয়েই শুরু করছি। আপনি একটি যুদ্ধ জিতেছেন; শুধু জেতেননি, বিশালভাবে জিতেছেন। কিন্তু অনেকের মতে, এই বিজয় বিপজ্জনক। আপনি কি সত্যিই মনে করেন বাংলাদেশ আপনার প্রত্যাশিত মিত্র হবে? আপনার কি ভয় হয় না যে এটি শেষ পর্যন্ত এক অস্বস্তিকর বোঝা হয়ে দাঁড়াতে পারে?

ইন্দিরা গান্ধী: দেখুন, জীবন সবসময়ই ঝুঁকিপূর্ণ। আমি মনে করি না ঝুঁকি এড়িয়ে চলা উচিত। যা সঠিক মনে হয়, সেটাই করা উচিত। আর যদি সঠিক কাজে ঝুঁকি থাকে, তাহলে ঝুঁকি নিতে হবে। এটাই আমার জীবনদর্শন। আমি কখনো প্রয়োজনীয় কোনো কাজের সম্ভাব্য পরিণতি আগে ভেবে বসে থাকি না। নতুন পরিস্থিতি এলে তখন তার পরিণতি বিবেচনা করি এবং সেই পরিস্থিতির মুখোমুখি হই।

আপনি বলছেন এই বিজয় বিপজ্জনক। আজকের দিনে কেউ নিশ্চিতভাবে বলতে পারে না এটি বিপজ্জনক। এখন আমি আপনার উল্লেখ করা ঝুঁকি দেখছি না। তবে ভবিষ্যতে যদি সেগুলো বাস্তব হয়, আমি তখন সেই নতুন বাস্তবতার আলোকে কাজ করব। আমি মনে করি, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বন্ধুত্ব থাকবে। অবশ্যই একতরফা বন্ধুত্ব নয়। কেউ কিছুই বিনা কারণে করে না; প্রত্যেকেরই দেওয়ার আছে, নেওয়ার আছে। আমরা যদি বাংলাদেশকে কিছু দিই, তাহলে বাংলাদেশও আমাদের কিছু দিচ্ছে, এটা স্বাভাবিক।

আর বাংলাদেশ কেন তার প্রতিশ্রুতি রাখতে পারবে না? অর্থনৈতিকভাবে দেশটি সম্পদে ভরপুর এবং নিজের পায়ে দাঁড়াতে সক্ষম। রাজনৈতিকভাবে আমার মনে হয় দেশটির নেতৃত্বে প্রশিক্ষিত মানুষ আছেন। যে শরণার্থীরা এখানে আশ্রয় নিয়েছিল, তারা ফিরে যাচ্ছে।

ওরিয়ানা ফলাচি: তারা কি সত্যিই ফিরে যাচ্ছে?

ইন্দিরা গান্ধী: হ্যাঁ। ইতিমধ্যে বিশ লক্ষ মানুষ ফিরে গেছে।

ওরিয়ানা ফলাচি: এক কোটির মধ্যে মাত্র বিশ লক্ষ, এটা তো খুব বেশি নয়।

ইন্দিরা গান্ধী: না, তবে সময় দিন। তারা দ্রুতই ফিরছে, যথেষ্ট দ্রুত। আমি সন্তুষ্ট। আমার প্রত্যাশার চেয়েও বেশি।

ওরিয়ানা ফলাচি: মিসেস গান্ধী, বিজয়ের বিপদের কথা বলতে গিয়ে আমি শুধু বাংলাদেশকেই বোঝাইনি। আমি পশ্চিমবঙ্গের কথাও বলছিলাম, যা ভারতের অংশ, এবং যেখানে এখন স্বাধীনতার দাবিও শোনা যাচ্ছে। আমি কলকাতায় নকশালপন্থীদের কথা শুনেছি… আর লেনিনের একটি উক্তি আছে, “বিশ্ব বিপ্লব সাংহাই ও কলকাতা হয়ে অগ্রসর হবে।”

ইন্দিরা গান্ধী: না, সেটা সম্ভব নয়। কেন জানেন? কারণ ভারতে ইতিমধ্যেই একটি বিপ্লব ঘটছে। এখানে পরিবর্তন আসছে - শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিকভাবে। কমিউনিজমের কোনো বিপদ নেই। বরং আমাদের সরকার না থেকে যদি ডানপন্থী সরকার থাকত, তখন সেই বিপদ দেখা দিত।

আসলে ভারতে কমিউনিস্টরা শক্তিশালী হয়েছিল তখনই, যখন মানুষ মনে করেছিল আমাদের দল ডানদিকে সরে যাচ্ছে, এবং তারা ভুল ভাবেনি। তখন তাদের সামনে একমাত্র পথ ছিল চরম বামদিকে ঝুঁকে পড়া। কিন্তু এখন মানুষ আমাদের প্রচেষ্টা দেখছে, সমস্যার সমাধান দেখছে, ফলে কমিউনিস্টদের প্রভাব কমছে। পশ্চিমবঙ্গের নকশালপন্থীরা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আছে। বাংলাদেশেও যারা আছে, তারাও নিয়ন্ত্রণে আসবে। না, আমি কোনো অশান্তির আশঙ্কা করছি না।

ওরিয়ানা ফলাচি: কিন্তু বাংলাদেশে তো তারা ইতিমধ্যেই কিছু সমস্যা তৈরি করেছে। মুক্তির পর ঢাকায় আমি ভয়াবহ আইন বহির্ভূত হত্যা দেখেছি।

ইন্দিরা গান্ধী: সেগুলো হয়েছিল প্রথম পাঁচ দিনের মধ্যে, এবং অন্যদের করা গণহত্যার তুলনায় তা খুবই সীমিত ছিল। যারা লক্ষ লক্ষ মানুষ হত্যা করেছিল, তাদের তুলনায়। কিছু দুঃখজনক ঘটনা ঘটেছিল, সত্যি, এবং আমরা সেগুলো ঠেকানোর চেষ্টা করেছি। আপনি যদি জানতেন, আমরা কত মানুষকে বাঁচিয়েছি! কিন্তু আমরা সর্বত্র থাকতে পারিনি, সবকিছু দেখতে পারিনি। কিছু ঘটনা আমাদের চোখ এড়িয়ে যেতেই পারে, এটা অনিবার্য। সব সমাজেই কিছু গোষ্ঠী থাকে যারা জঘন্য আচরণ করে। তবে তাদের অবস্থাও বুঝতে হবে। তারা ক্ষোভে উন্মত্ত ছিল, প্রতিশোধের আগুনে অন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ন্যায়বিচার করতে গেলে, কয়েক দিনের মধ্যে আপনি যা দেখেছেন তার চেয়ে বহু মাস ধরে তারা যা দেখেছে ও সহ্য করেছে, সেটাও বিবেচনায় নিতে হবে।

ওরিয়ানা ফলাচি: মিসেস গান্ধী, আপনি জানেন, এই অভিযোগ রয়েছে যে ভারতই যুদ্ধ উসকে দিয়েছিল এবং প্রথম আক্রমণ করেছিল। এ ব্যাপারে আপনি কী বলবেন?

ইন্দিরা গান্ধী: যদি একেবারে শুরুতে যাই, তাহলে আমরা মুক্তিবাহিনীকে সাহায্য করেছি। সুতরাং যদি সেখান থেকেই সবকিছুর সূচনা ধরা হয়, তাহলে হ্যাঁ, আমরাই শুরু করেছি। কিন্তু আমাদের অন্য কোনো পথ ছিল না। আমরা আমাদের মাটিতে দশ মিলিয়ন শরণার্থী ধরে রাখতে পারতাম না; এত দীর্ঘ সময় ধরে এমন অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সহ্য করা অসম্ভব ছিল। এই স্রোত থামত না, বরং আরও বাড়ত, যতক্ষণ না এক ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটত। নিজেদের স্বার্থেই আমাদের এটি থামাতে হয়েছিল। যুদ্ধ ঠেকানোর চেষ্টা করতে গিয়ে আমি নিক্সনসহ যেসব নেতার সঙ্গে দেখা করেছি, সবাইকে এই কথাই বলেছিলাম।

কিন্তু প্রকৃত যুদ্ধের শুরুটা দেখলে স্পষ্ট বোঝা যায়, আক্রমণটা পাকিস্তানই করেছিল। সেদিন বিকেল পাঁচটায় তাদের বিমান আমাদের ওপর হামলা চালায়, আগ্রায় প্রথম বোমা পড়ে। আমরা যে তখন সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত ছিলাম, সেটাই এর প্রমাণ।

সাপ্তাহিক ছুটির সময়েই একমাত্র সময়, যখন সরকারী লোকেরা দিল্লি ছাড়তে পারে। তখন প্রায় কেউই দিল্লিতে ছিল না। আমি কলকাতায় ছিলাম। প্রতিরক্ষামন্ত্রী গিয়েছিলেন পাটনায়, সেখান থেকে বেঙ্গালুরু যাওয়ার কথা ছিল। অর্থমন্ত্রী বম্বেতে ছিলেন, পুনে যাওয়ার প্রস্তুতিতে। সেনাপ্রধান ছিলেন অন্য কোথাও, আমি মনে করতে পারছি না। সবাইকে হুড়োহুড়ি করে দিল্লি ফিরতে হয়। এ কারণেই আমাদের পাল্টা আক্রমণ শুরু হয় পরের দিন, কয়েক ঘণ্টার মধ্যে নয়।

স্বাভাবিকভাবেই আমরা প্রস্তুত ছিলাম; আমরা জানতাম কিছু একটা ঘটবে। কিন্তু বাস্তবে আমরা কেবল আকাশপথের হামলার জন্যই প্রস্তুত ছিলাম। সেটা না থাকলে, তারা আমাদের নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারত।

ওরিয়ানা ফলাচি: মিসেস গান্ধী, সংঘাত এড়াতে আপনি যে ইউরোপ ও আমেরিকা সফর করেছিলেন, তার কথা আপনি উল্লেখ করেছিলেন। আজ কি আপনি সত্যটা বলতে পারেন, আসলে কী হয়েছিল? নিক্সনের সঙ্গে বিষয়গুলো কীভাবে এগিয়েছিল?

ইন্দিরা গান্ধী: আমি সেই সফরে গিয়েছিলাম এটা জেনে যে, বড় বাঁধের সামনে দাড়ানো আমি এক শিশুর মত যে আঙুল দিয়ে বাঁধের ছিদ্র বন্ধ করার চেষ্টা করছে।। আর এমন কিছু বিষয় আছে যেগুলো… জানি না… বলা যায় না… আচ্ছা, বলাই যাক! সত্যটা হলো—আমি নিক্সনের সঙ্গে খুব স্পষ্টভাবে কথা বলেছিলাম। আমি তাকে ঠিক সেটাই বলেছিলাম, যা আগে হিথ, পম্পিদু এবং ব্রান্টকেও বলেছিলাম। কোনো রাখঢাক না করে আমি তাকে জানিয়েছিলাম, দশ মিলিয়ন শরণার্থীকে কাঁধে নিয়ে আমরা আর এগোতে পারছি না; এমন এক বিস্ফোরক পরিস্থিতি আর সহ্য করা সম্ভব নয়। হিথ, পম্পিদু এবং ব্রান্ট বিষয়টি ভালোভাবেই বুঝেছিলেন। কিন্তু নিক্সন বোঝেননি। ঘটনা হলো, অন্যরা যেখানে একটি বিষয় একভাবে বোঝেন, নিক্সন সেখানে আরেকটি বোঝেন। আমার সন্দেহ হয়েছিল যে তিনি খুবই পাকিস্তানপন্থী। আসলে সন্দেহ নয়, আমি জানতাম, আমেরিকা সবসময়ই পাকিস্তানের পক্ষে ছিল। পাকিস্তানকে ভালোবেসে নয়, বরং ভারতকে অপছন্দ করে। তবে সম্প্রতি আমার মনে হয়েছিল, তাদের অবস্থান বদলাচ্ছে। পাকিস্তানপন্থী কম হচ্ছে বলে নয়, বরং ভারতবিরোধী মনোভাব কমেছে বলে। আমি ভুল করেছিলাম। যুদ্ধ ঠেকানো তো দূরের কথা, বরং নিক্সনের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ যুদ্ধকে আরও অনিবার্য করে তুলেছিল। এই অভিজ্ঞতা কাজে লেগেছিল শুধু আমার নিজের জন্য। সেই অভিজ্ঞতা আমাকে শিখিয়েছে, মানুষ যখন আপনার বিরুদ্ধে কিছু করে, শেষ পর্যন্ত সেটা আপনার পক্ষেই যায়।

এটা জীবনের এক ধরনের নিয়ম। খোঁজ নিলে দেখবেন, সব পরিস্থিতিতেই এটা সত্য। জানেন আমি শেষ নির্বাচনে কেন জিতেছিলাম? মানুষ আমাকে পছন্দ করেছিল। হ্যাঁ; আমি কঠোর পরিশ্রম করেছিলাম। হ্যাঁ; কিন্তু একই সঙ্গে বিরোধীরা আমার সঙ্গে খুব খারাপ আচরণ করেছিল বলেও। আর জানেন আমি এই যুদ্ধ কেন জিতেছি? আমার সেনাবাহিনী সক্ষম ছিল, হ্যাঁ; কিন্তু একই সঙ্গে আমেরিকানরা পাকিস্তানের পক্ষে ছিল বলেও।

ওরিয়ানা ফলাচি: আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।

ইন্দিরা গান্ধী: আমেরিকা সবসময় ভেবেছে তারা পাকিস্তানকে সাহায্য করছে। কিন্তু তারা যদি পাকিস্তানকে সাহায্য না করত, পাকিস্তান হয়তো আরও শক্তিশালী দেশ হতো। গণতন্ত্রের সামান্য চিহ্নও অস্বীকার করে এমন একটি সামরিক শাসনব্যবস্থাকে সমর্থন করে কোনো দেশকে সাহায্য করা যায় না। পাকিস্তানকে যে বিষয়টি পরাজিত করেছে, সেটাই ছিল তাদের সামরিক শাসন। যে শাসনকে আমেরিকানরাই সমর্থন দিয়েছিল। কখনো কখনো বন্ধু খুবই বিপজ্জনক হয়। বন্ধুরা যে সাহায্য করে, সে বিষয়ে আমাদের খুব সতর্ক থাকা উচিত।

ওরিয়ানা ফলাচি: আর চীন? চীনও তো পাকিস্তানের পক্ষে ছিল। আর আমি যদি ভুল না করি, চীনই ভারতের সবচেয়ে বড় সম্ভাব্য শত্রু।

ইন্দিরা গান্ধী: না। আমি দেখি না কেন আমরা চীনের শত্রু হব। আমরা তাদের শত্রু হতে চাই না। তারা যদি সেটা চায়, আমাদের কিছু করার নেই, কিন্তু আমি মনে করি না তারা সত্যিই তা চায়। কারণ সেটি তাদের কোনো উপকারে আসবে না।

এই যুদ্ধে তাদের অবস্থানের কথা যদি বলেন, আমার মনে হয় তারা আমেরিকানদের চেয়ে বেশি দক্ষ ছিল। তারা অনেক বেশি সূক্ষ্মভাবে কাজ করেছে। চাইলে তারা পাকিস্তানের জন্য আরও অনেক কিছু করতে পারত, তাই না? কিন্তু সপ্তম নৌবহরকে বঙ্গোপসাগরে পাঠিয়েছে আমেরিকানরাই, চীনারা নয়। সব ধরনের ঝুঁকি এড়ানোর জন্য আমি চীনা সীমান্ত থেকে আমাদের সেনা সরাইনি, কিন্তু আমি কখনো বিশ্বাস করিনি যে চীন কোনো ভুল পদক্ষেপ নিয়ে হস্তক্ষেপ করবে। অর্থাৎ, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আশঙ্কায় আমি কখনোই বিশ্বাস করিনি। অবশ্যই, যদি আমেরিকানরা একটি গুলিও ছুড়ত, যদি সপ্তম নৌবহর বঙ্গোপসাগরে বসে থাকা ছাড়া অন্য কিছু করত, তাহলে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বেঁধে যেত। কিন্তু সত্যি বলতে কী, সেই ভয়ও আমার মনে আসেনি।

ওরিয়ানা ফলাচি: অহিংসার আদর্শে বড় হওয়া একজন মানুষের সঙ্গে যুদ্ধ নিয়ে কথা বলতে খুবই অদ্ভুত লাগে, মিসেস গান্ধী। এই সংঘাতের দিনগুলোতে আপনি কী অনুভব করেছেন, তা জানতে ইচ্ছে করে।

ইন্দিরা গান্ধী: মনে রাখতে হবে, এটা আমার প্রথম যুদ্ধ নয়; আমাকে আগেও যুদ্ধের মুখোমুখি হতে হয়েছে। তাছাড়া অহিংসা নিয়ে আপনাকে একটি ছোট গল্প বলি। ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হওয়ার পরপরই পাকিস্তান কাশ্মীরে আক্রমণ করে। তখন কাশ্মীর শাসন করতেন একজন মহারাজা। তিনি পালিয়ে যান, আর শেখ আবদুল্লাহর নেতৃত্বে কাশ্মীরের মানুষ ভারতের কাছে সাহায্য চায়। তখনকার গভর্নর-জেনারেল লর্ড মাউন্টব্যাটেন বলেন, পাকিস্তান আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধ ঘোষণা না করলে তিনি কাশ্মীরকে সাহায্য করতে পারবেন না, এবং পাকিস্তানিরা যে সাধারণ মানুষকে হত্যা করছিল, তাতে তার বিশেষ কোনো উদ্বেগ ছিল না। তাই আমাদের নেতারা একটি দলিলে স্বাক্ষর করার সিদ্ধান্ত নেন, যার মাধ্যমে তারা পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধে যাওয়ার অঙ্গীকার করেন। আর অহিংসার প্রবক্তা মহাত্মা গান্ধীও সেই দলিলে স্বাক্ষর করেছিলেন। হ্যাঁ, তিনি যুদ্ধ বেছে নিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, আর কোনো পথ নেই। কাউকে রক্ষা করতে হলে, বা নিজেকে রক্ষা করতে হলে, যুদ্ধ অনিবার্য।

ওরিয়ানা ফলাচি: আমার কথা হলো, আমি এই যুদ্ধকে এখনো ভাইয়ে-ভাইয়ে যুদ্ধ হিসেবেই দেখি। আমি এমনকি জেনারেল অরোরা ও জেনারেল নিয়াজীকেও এ কথা বলেছিলাম, আর দুজনেই উত্তর দিয়েছিলেন, “মূলত আমরা ভাই।”

ইন্দিরা গান্ধী: মূলত নয় পুরোপুরি। ভারতীয় ও পাকিস্তানিরা আক্ষরিক অর্থেই ভাই। ঢাকা পতনের পর পাকিস্তানি ও ভারতীয় অফিসারদের করমর্দন দেখে আপনি বিস্মিত হয়েছিলেন, আমি জানি। কিন্তু জানেন কি, ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত আমাদের সেনাবাহিনী ও পাকিস্তানি সেনাবাহিনীতে এমন জেনারেল পাওয়া যেত, যারা রক্তের সম্পর্কের ভাই - একই বাবা-মায়ের সন্তান?

এক পাশে চাচা, অন্য পাশে ভাতিজা; এখানে এক চাচাতো ভাই, ওখানে আরেক চাচাতো ভাই, এমন ঘটনাও ছিল। আজও তা পুরোপুরি শেষ হয়ে যায়নি। আরও একটি কথা বলি, এক সময় সুইজারল্যান্ডে নিযুক্ত ভারত ও পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত দুজনই ছিলেন রক্তের ভাই।

ব্রিটিশরা আমাদের ওপর যে দেশভাগ চাপিয়ে দিয়েছিল, তা ছিল সম্পূর্ণ অস্বাভাবিক। এর একমাত্র ফল ছিল পরিবার ভেঙে দেওয়া, মানুষকে ছিন্নভিন্ন করা। আমি হৃদয়বিদারক দৃশ্য দেখেছি, কেউ দেশ ছাড়ছে, কেউ ছাড়তে চাইছে না। অনেক মুসলমান ভারত ছাড়তে চাননি, কিন্তু প্রচারণায় ভালো সুযোগের আশ্বাস পেয়ে পাকিস্তানে চলে যান। আবার অনেক হিন্দু পাকিস্তান ছাড়তে চাননি, কিন্তু সেখানকার সম্পর্ক বা সম্পত্তির টানে থেকে যান।

একে অপরের শত্রু হওয়া, কী ভয়ংকর এক অযৌক্তিকতা। একেবারে পাগলামি, যখন ভাবেন মুসলমান ও হিন্দুরা একসঙ্গে স্বাধীনতার লড়াই করেছিল। হ্যাঁ, ব্রিটিশ আমলেও সংঘর্ষ হয়েছিল, কিন্তু পরে জানা গেছে, দেশভাগের প্রাক্কালে যারা আমাদের একসঙ্গে থাকতে চায়নি, তারাই সেগুলো উসকে দিয়েছিল। দেশভাগের পরও বিদেশিরা আমাদের বিভক্ত রাখার নীতি অনুসরণ করেছে। ভারত ও পাকিস্তান যদি একসঙ্গে থাকত, কনফেডারেশন হিসেবে নয়, বরং ইতালি ও ফ্রান্সের মতো প্রতিবেশী ও বন্ধুত্বপূর্ণ দেশ হিসেবে, আমরা দু’পক্ষই অনেক দূর এগোতে পারতাম।

কিন্তু কারও স্বার্থে ছিল না যে আমরা এগোই। কারও স্বার্থে ছিল আমরা যেন পরস্পরের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত থাকি, একে অপরকে ছিঁড়ে ফেলি। হ্যাঁ, আমি পাকিস্তানিদের অনেকটাই দায়মুক্ত করতে চাই। তারা কী-ই বা করত? কেউ তাদের আমাদের ওপর হামলা করতে উৎসাহ দিয়েছে, কেউ অস্ত্র দিয়েছে আর তারা হামলা করেছে।

ওরিয়ানা ফলাচি: ভুট্টো বলেছেন, তিনি ভারতের সঙ্গে একটি কনফেডারেশন গঠনে প্রস্তুত। এ বিষয়ে আপনার মত কী, মিসেস গান্ধী?

ইন্দিরা গান্ধী: দেখুন… ভুট্টো খুব ভারসাম্যপূর্ণ মানুষ নন। তিনি কথা বললে বোঝা যায় না, তিনি আসলে কী বলতে চান। এবার তিনি কী বোঝাতে চান? তিনি কি আমাদের বন্ধু হতে চান? আমরা তো অনেক দিন ধরেই তার সঙ্গে বন্ধুত্ব চাইছি; আমিও সবসময় সেটাই চেয়েছি। একটি বিষয় পাশ্চাত্যরা জানে না। পাশ্চাত্য সংবাদমাধ্যম সবসময় বলেছে ভারত পাকিস্তানের শত্রু, পাকিস্তান ভারতের শত্রু; হিন্দু মুসলমানের শত্রু। কিন্তু তারা কখনো বলেনি, আমাদের দেশ দুই ভাগ হওয়ার পর থেকেই আমার দল এই ধারণার বিরুদ্ধে লড়াই করে আসছে। আমরা সবসময় বলে এসেছি, ধর্মীয় বিদ্বেষ ভুল ও হাস্যকর; কোনো দেশ থেকে সংখ্যালঘুদের মুছে ফেলা যায় না; ভিন্ন ধর্মের মানুষকে একসঙ্গে বাস করতেই হবে। আধুনিক দুনিয়ায় কীভাবে মানুষ ধর্মের নামে একে অপরকে হত্যা করতে পারে? আজকের আসল সমস্যাগুলো অন্য - দারিদ্র্য, অধিকার, প্রযুক্তির পরিবর্তনে সৃষ্ট চ্যালেঞ্জ। এগুলো সার্বজনীন সমস্যা। পাকিস্তানেরও, আমাদেরও।

যখন কেউ চিৎকার করে বলে ধর্ম বিপন্ন, আমি সেটা গুরুত্ব দিই না। দুর্ভাগ্যজনকভাবে ভারতেও এমন মানুষ আছে। তারাই বলে, পাকিস্তানকে কখনো মেনে নেওয়া উচিত হয়নি। এখন যেহেতু আছে, ধ্বংস করে দেওয়া উচিত। কিন্তু এরা হাতে গোনা কয়েকজন উন্মাদ, যাদের জনসমর্থন নেই।

ভারতে পাকিস্তানবিরোধী প্রচারণা নেই। যুদ্ধের সময় কিছুটা ছিল, স্বাভাবিকভাবেই, কিন্তু তখনও আমরা সেটাকে নিয়ন্ত্রণে রেখেছিলাম। পাকিস্তানিরা এতে বিস্মিত হয়েছিল। ক্যাম্প হাসপাতালের বন্দিরা বলেছিল, কি! আপনি হিন্দু ডাক্তার, আর আমাকে চিকিৎসা দিতে চান?

ভুট্টোকে আমি শুধু এটুকুই বলতে পারি, তিনি যদি বুঝে বলে থাকেন, তবে এটাই বলার একমাত্র কথা। আর যদি না বলে থাকেন, তবে তার ভবিষ্যৎই বা কী? শুনেছি ভুট্টো উচ্চাকাঙ্ক্ষী। আমি আশা করি, তিনি খুবই উচ্চাকাঙ্ক্ষী হবেন, উচ্চাকাঙ্ক্ষা তাকে বাস্তবতা বুঝতে সাহায্য করতে পারে।

(সাক্ষাৎকারটি ফলাচির "Interview with History" বই থেকে নেওয়া একটি খণ্ডাংশ মাত্র, যেখানে মুক্তিযুদ্ধ এবং ভারত-পাকিস্তান বিষয়গুলির উল্লেখ আছে। ইংরেজি বইটি ইন্টারনেটে পাওয়া যায়। এর একটি বাংলা অনুবাদও রয়েছে বলে শুনেছি। আমি ইংরেজি মূল অনুবাদটি চ্যাটজিপিটি এবং গুগল ট্রান্সলেটর দিয়ে করেছি, পরে কিছু ভাষাগত পরিবর্তন করেছি পড়ার সুবিধার জন্য।)
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১০
১০টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বন্ডাইর মত হত্যাকাণ্ড বন্ধে নেতানিয়াহুদের থামানো জরুরি...

লিখেছেন নতুন নকিব, ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:২৫

বন্ডাইর মত হত্যাকাণ্ড বন্ধে নেতানিয়াহুদের থামানো জরুরি...

বন্ডাই সৈকতের হামলাস্থল। ছবি: রয়টার্স

অস্ট্রেলিয়ার সিডনির বন্ডাই সৈকত এলাকায় ইহুদিদের একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানে সমবেত মানুষের ওপর দুই অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী অতর্কিতে গুলি চালিয়েছে। এতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আল্লাহ সর্বত্র বিরাজমাণ নন বলা কুফুরী

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১৪



সূরাঃ ২ বাকারা, ২৫৫ নং আয়াতের অনুবাদ-
২৫৫। আল্লাহ, তিনি ব্যতীত কোন ইলাহ নেই।তিনি চিরঞ্জীব চির বিদ্যমাণ।তাঁকে তন্দ্রা অথবা নিদ্রা স্পর্শ করে না।আকাশ ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে সমস্তই... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিজয়ের আগে রাজাকারের গুলিতে নিহত আফজাল

লিখেছেন প্রামানিক, ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:১৩


ঘটনা স্থল গাইবান্ধা জেলার ফুলছড়ি থানার উড়িয়া ইউনিয়নের গুণভরি ওয়াপদা বাঁধ।

১৯৭১সালের ১৬ই ডিসেম্বরের কয়েক দিন আগের ঘটনা। আফজাল নামের ভদ্রলোক এসেছিলেন শ্বশুর বাড়ি বেড়াতে। আমাদের পাশের গ্রামেই তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

৫৫ বছর আগে কি ঘটেছে, উহা কি ইডিয়টদের মনে থাকে?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:৫৮




ব্লগের অনেক প্রশ্নফাঁস ( Gen-F ) ১ দিন আগে পড়া নিউটনের ২য় সুত্রের প্রমাণ মনে করতে পারে না বলেই ফাঁসকরা প্রশ্নপত্র কিনে, বইয়ের পাতা কেটে পরীক্ষার হলে নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

১৯৭১ সালে পাক ভারত যুদ্ধে ভারত বিজয়ী!

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯


দীর্ঘ ২৫ বছরের নানা লাঞ্ছনা গঞ্জনা বঞ্চনা সহ্য করে যখন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বীর বাঙালী অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে বীরবিক্রমে যুদ্ধ করে দেশ প্রায় স্বাধীন করে ফেলবে এমন সময় বাংলাদেশী ভারতীয়... ...বাকিটুকু পড়ুন

×