somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ভাষার গল্পঃ কৃষ্ণচূড়ার ডালে ডালে...

০৪ ঠা এপ্রিল, ২০১৪ বিকাল ৩:২২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



ছেলেটা যেন কেমন ছিল। কেমন যেন। যা ভাষায় প্রকাশ করা সত্যই দুঃসাধ্য। উপরন্তু আমাদের সামনে সে যা করে দেখালো তাও ভাষায় বর্ণনা করা কঠিন।

সে ছিল আমার রুমমেট। হালকা-পাতলা দোহারা গঠন। চুল ছিল বাবরি। চোখে কাল ফ্রেমে মোটা চশমা। একই সাথে থেকেছি , শুয়েছি, পড়েছি, তিনটি বছর। এক, দুই, তিন, তিনটি বছর। কিন্তু তাকে চিনতে পারি নাই। অন্তত সে ঘটনার পূর্ব পর্যন্ত সে ছিল আমার কাছে, নাহ, আমাদের কাছে নিতান্ত শান্ত, নিশ্চুপ এক গোবেচারা। সে ছিল ভীষণ রকমের লাজুক। যেন লাজুকের স্বর্ণলতা। বিনা ভারেই নুইয়ে পরে।

সে পথ চলত মাথা নিচু করে,দৃষ্টি পথে, বুকে থুতনি ঠেকিয়ে। আমার যতদুর মনে পড়ে সে কখনো তার মাথার উপরের আকাশটাকে দেখেনি। যা কখনও বিতৃষ্ণা জাগায় না।

সে ক্লাস করত মাথা নিচু করে, লেকচার শুনত মাথা নিচু করে। তার যাবার স্থান ছিল শুধু একটা। আর তা হল লাইব্রেরি। এছাড়া সে রুম টু ক্লাস, ক্লাস টু রুম। এমন ছেলে যে এমন কাজ করবে তা কে জানতো?

সে ছিল সিরিয়াস রকমের অল্পভাষী। সে ঘটনার পূর্ব পর্যন্ত আমরা জানতাম, সে কেবল দুটি শব্দ জানে; হ্যাঁ এবং না। তার কাছে থেকে কিছু জানবার থাকলে তাকে প্রশ্ন করতে হত ইংরেজি “ট্যাগ কোয়েশ্চেন” এর মত করে। অনেকটা এরকম, এই যেমন যদি জানবার থাকে,সে কামালের নোট খাতা নিয়েছে কিনা, তবে তাকে বলতে হবে, “তুই কি কামালের নোট খাতা নিয়েছিস, নেস নি?”

সে তখন উত্তরে, হ্যাঁ অথবা না বলত। এমন অল্পভাষী আমি বাপের জন্মেও দেখিনি। যে কারণে আমরা তাকে ডাকতাম, “ট্যাগিং বয়” বলে। বাংলায়, “ঝুলন্ত বালক”, সংক্ষেপে “ঝুবা”।

যে রুমটাতে আমি থাকতাম, সে রুমটার জানালা দিয়ে রাস্তা দেখা যেত। রাস্তার পাশে একটা কৃষ্ণচূড়ার গাছ। ফাল্গুনে, কাল পিচের রাস্তাটা রাঙা কৃষ্ণচূড়ায় ভরে যায়। সে তন্ময় হয়ে তা অবলোকন করতো, আর কি যেন লিখত। কেউ উঁকি দিয়ে দেখতে গেলে লুকিয়ে ফেলত। সে কি প্রেমে পড়েছিল? একজনের নাম তো পরে জানতে পেরেছিলাম। কিন্তু আরেকজন কে ছিল?

১৯৪৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর সাংস্কৃতিক সংস্থা “তমদ্দুন মজলিস” প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞানের অধ্যাপক আবুল কাসেম, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, জনাব শামসুল আলম প্রমুখের উদ্যোগে । ১৯৪৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বরে যখন “ পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু” শীর্ষক পুস্তিকা প্রকাশ হল তখন থেকে দেশটা উত্তেজিত। এখন চলছে ১৯৫২ সাল। খবরের কাগজে একটা প্রবন্ধ পড়লাম। ভাষা আর সংস্কৃতি নিয়ে। অসাধারণ শব্দচয়ন,নিখুঁত যুক্তি, সাবলীল লেখা, পড়তে গিয়ে হোঁচট খেতে হয় না, কিন্তু কথার ভাব কোনভাবেই হালকা হয় না।সেখানে লেখা আছে, “পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কি হবে সে সম্বন্ধে কোন সিদ্ধান্ত হওয়ার আগেই উচ্চ পদস্থ উর্দুভাষী আমলাদের বিশাল প্রভাবের কারণে গোপনে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার চেষ্টা করা হচ্ছে এবং নতুন রাষ্ট্রের পোস্টকার্ড, খাম, মানি অর্ডার ফরমে ইংরেজীর পাশাপাশি শুধু উর্দু ভাষা ব্যবহার শুরু করা হচ্ছে। অথচ পাকিস্তানের জনংখ্যার শতকরা ৫৬ জনই বাংলা ভাষী।আর কত শোষিত হব?” বড় আশা করে তার কাছে প্রবন্ধটা নিয়ে গেলাম, যে সে পড়বে। সে তো পড়লই না, উপরন্তু প্রবন্ধটা দেখে মুখখানায় এমন এক অরুচিকর বিশ্রীভাব আনল যে ওর মুখ দেখেই আমার পিত্তি জ্বলে গেল। রাগে গর গর করতে করতে ফিরে এলাম। এমনও মানুষ কি হয়?

১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারী পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ নামে একটা ছাত্রসংস্থা গঠিত হয়েছিল, সেই সংগঠনটা শুরু থেকেই আন্দোলনে করছিল। দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক শামসুল আলম ভাইয়ের সাথে কথা হল । যিনি তমদ্দুন মজলিস ও পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের যুগপৎ সদস্য ছিলেন। দেশে নাকি গোলযোগ শুরু হয়ে গিয়েছে। যে খাজা নাজিমুদ্দিন ১৯৪৮ সালের ১৫ মার্চ রাষ্ট্রভাষা বাংলার সব দাবী দাওয়া মেনে নিয়েছিল সেই খাজা আবার বলে কিনা উর্দুই হবে রাষ্ট্রভাষা!পুরোই মীরজাফর! আমাদের ঢাবিতে একটা সংগঠনও গঠন করা হয়ে গিয়েছে। সিপাহী বিদ্রোহ জাতীয় কিছু একটা হবেই।এত গোলযোগের মাঝেও ছেলেটা কত শান্ত। কোন উত্তেজনা নেই।এমন ছেলেকে দিয়ে কি কখনো কিছু হয়?

এরই মাঝে রক্ত গরম করা আরও দুইটা প্রবন্ধ পড়লাম। সেই একই লেখকের। আমার মনে সরকারের বিরুদ্ধে তেমন একটা বিরোধী মনোভাব ছিল না। কিন্তু প্রবন্ধগুলো পড়ে আমার চোখ খুলে গেল। আমাদের উপর যে কি পরিমাণ অবিচার হচ্ছে তা জানতে পারলাম। তাই প্রতিজ্ঞা নিলাম যে, সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়বই। একটু খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম, আমার মত অনেকেই সেইসব প্রবন্ধের অনলে জ্বলে উথেছে, উঠছে। কিন্তু আমার রুমের সেই “ঝুলন্ত বালক” সেই আগের মতই নিরীহ, শান্ত, গোবেচারা আর বইপোকা রয়ে গেল। সামান্যতম পরিবর্তন নেই! এসব ছেলের কারনেই দেশের চাকা স্থির হয়ে আছে।

সভায় আমরা সর্বসম্মতিক্রমে গোটা অঞ্চলে সাধারণ ধর্মঘটের একটি দিন ঠিক করলাম। “আমাদের দাবী না মানলে ধর্মঘট চালিয়ে যাব”-এরকম একটা সংকল্প করলাম। কিন্তু শয়তানগুলো ধর্মঘটের আগের দিন থেকে একমাসের কারফিউ জারি করে মিটিং-মিছিল করা বন্ধ করে দিল। আমরা ঢাবির ছাত্ররা বিভিন্ন হলে সভা করে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত নিলাম। ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে ৯৪ নবাবপুর রোডস্থ আওয়ামী মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আবুল হাশিমের সভাপতিত্বে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মী পরিষদের সভা অনুষ্ঠিত হল। পরিষদের কিছু সদস্য নিষেধাজ্ঞা অমান্য করার পক্ষে থাকলেও, সবশেষে ১১-৩ ভোটে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। আমি তো ভয় পেয়ে গেলাম। আন্দোলন কি তাহলে থেমে যাবে?

২০ ফেব্রুয়ারি রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলে একই বিষয় নিয়ে পৃথক পৃথক সভা অনুষ্ঠিত হল। সন্ধ্যায় সলিমুল্লাহ হলে ফকির শাহাবুদ্দীনের সভাপতিত্বে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত নেয়া হল। আমি এটা শুনে তো খুশি হয়ে গেলাম। এবার আমাদের রুখবে কে? সেদিনই সবার মত নিয়ে কারফিউ ভাঙ্গার জন্য তৈরি হলাম।



১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি (৮ ফাল্গুন ১৩৫৮)। সকাল সকাল সবাই সমবেত হলাম। ছেলেটাকে জোর করে পড়ার টেবিল থেকে উঠিয়ে এনেছি। সে এমন পরিস্থিতিতে পুরোদমে লেখাপড়া করছিল... !

সকাল ১০টায় আর বেলা ১২ টার দিকে আমাদের আর পুলিশের মাঝে ইট-পাটকেল বিনিময় হয়। ছেলেটা যেন কোথায় হারিয়ে গেল। আশে-পাশে তার দেখা পেলাম না। আমার হাত জখম হওয়াতে আমি রুমে এলাম হাতে কাপড় বাঁধতে। রুমে এসে তো আমি অবাক। এ কেমন ছেলে রে! যেখানে গোটা দেশ উত্তেজিত সেখানে এই ছেলে পড়াশুনায় ব্যস্ত!প্রচণ্ডবেগে কি যেন লিখছে!যেন হাতে সময় খুব কম। উঁকি দিয়ে দেখি, চিঠি লিখছে, মায়ের কাছে! মেজাজ এমনিতেই তেঁতে আছে, তার উপর ছেলেটার এহেন কাণ্ড দেখে আমার অনুভূতি লোপ পেল। তার ফতুয়ার কলার ধরে তাকে টেনে উঠাতে গেলাম। সে আমাকে বাঁধা দিয়ে বলল, “শান্ত হোন। এই উঠছি। যাচ্ছি। আমার কাজ শেষ। কেবল...” বলে বেশ কিছু কাগজ একটা বড়সর খামে ঢুকিয়ে পকেটে ভরাতে ভরাতে আমার সাথে চলতে লাগলো। তার শীতল গম্ভীর কণ্ঠ আমাকে অবাক করেছিল। খানিকক্ষণ মনে হয়েছিল, এই কি আমাদের সেই “ট্যাগিং বয়”।

বেলা তিনটার দিকে আমরা আইন পরিষদের দিকে যাচ্ছিলাম। এ সময় উচ্চপদস্থ পুলিশ আর সরকারী আমলারা আমাদের নিষেধ করলে আমরা সিদ্ধান্তহীনতায় পড়ে একরকম পিছিয়ে যাচ্ছিলাম। এমনি সময় কোথা থেকে যেন সেই ছেলেটা মিছিলের ভীড় ঠেলে বেরিয়ে এসে হন হন করে যেতে লাগলো পরিষদের দিকে। আমি তাকে টেনে ধরতে গেলে সে আমাকে সরিয়ে চলতে লাগলো।

সে বলতে লাগলো, “ আমার মায়ের ভাষা কেড়ে নিতে চাস!আমার মায়ের! যে মা আমাকে আলো, বাতাস, প্রকৃতির সৌন্দর্য দিয়েছে সেই মায়ের? মায়ের মুখে গল্প শুনতে দিবি না। মাকে অসম্মান করিস! মায়ের মুখের ভাষা বদলে দিতে চাস! কেড়ে নিতে চাস? মায়ের বুকে লাথি দিতে চাস? এই দেখ, তার ছেলে এখনও বেঁচে আছে। সেই সন্তান বুক বাড়িয়ে দিয়েছে। নে মার। মার গুলি”।

বলেই সে বীরদর্পে এগিয়ে যেতে থাকে। পুলিশ থামতে বললেও যখন সে থামে নি তখনই গুলি করল। তার বুকে লাগলো। তারপরও সে এগিয়ে যেতে থাকে। আরেকটা গুলি। এবার সে আরেকটু এগিয়ে গিয়েই পড়ে গেল। প্রথমে হাঁটুগেড়ে বসল, কিছুক্ষন সেভাবেই স্থির থেকে এককাত হয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল। কিন্তু তার চোখ তখনও চেয়ে, ঘৃণাভরে। ততক্ষণে এদিকে গোলযোগ বেড়ে গিয়েছে। কেননা, ছেলেটার পিছু পিছু আমরাও এগিয়ে গিয়েছিলাম। একজন নেতার পিছনে সবাই যেভাবে যায়। সে আমাদের কয়েক মুহূর্তের নেতা হয়ে কয়েক যুগের জন্য এসেছিল।

আমাদের উপরও গুলি করায় আমরা দিগ্বিদিক ছোটাছুটি করছিলাম। আব্দুল জব্বার এবং রফিক উদ্দিন আহমেদকে পড়ে যেতে দেখেছি। হয়তোগুলি লেগেছে। আমি ছোটাছুটি করতে করতে কিভাবে যেন ছেলেটার কাছেই চলে গেলাম। ছেলেটা তখনও জীবিত। কি অবাক ব্যাপার! আমি তার মাথা কোলে নিলাম। সে রক্তমাখা হাতে আমাকে কিছু একটা ধরিয়ে দিল। আমি দেখলাম সেই খামটা। সে কিছু বলছিল। গোলাগুলি আর ছোটাছুটির শব্দের কারণে কেবল “মাকে”, “গ্রামে”, “বোনটাকে” আরও কিছু শব্দ বুঝতে পারলাম। আরও কিছু বলতে চাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই নিঃস্পন্দন হয়ে গেল। আমি সেখান থেকে সোজা ট্রেন স্টেশনে গিয়ে ট্রেনে চড়ে গ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। ট্রেনে বসে খামটা খুললাম।

কি অবাক ব্যাপার? এও কি সম্ভব? অবশ্যই অসম্ভব। দিবাস্বপ্ন দেখছি না তো? চিমটি কেটে দেখলাম। নাহ জেগেই আছি। কিন্তু তারপরও যে বিশ্বাস হচ্ছে না। সেই ট্যাগিং বয়, অল্পভাষী, লাজুকের স্বর্ণলতা কিনা লিখেছিল আত্মচেতনায় জ্বলে ওঠার মতো, জনহীন মরুতে আশা জাগবার মতো,বড় বড় যুক্তিবাদীদের মুখ থুবড়ে দেওয়ার মতো প্রবন্ধগুলো? নাহ, কিছুতেই যে বিশ্বাস হচ্ছে না।

চলন্ত ট্রেনের জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল্ম। সবুজ ক্ষেতের পর সবুজ ক্ষেত, গ্রামের পর গ্রাম, গঞ্জের পর গঞ্জ পেরিয়ে যাচ্ছি । সেই সাথে হচ্ছে ট্রেনের ছন্দময় দুলুনি। কোথাও এতটুকু অমিল নেই। শুধু অমিল রয়েছে অতীত আর এই বর্তমানে। ছেলেটা এভাবে আমাদের হারিয়ে দিয়ে চলে গেল? নাহ, সে কি করে চলে যাবে? সে তো থাকবেই, থাকবেই এই অন্তরে, ঠিক মাঝখানে, অনেক গভীরে।



তার মাকে কোনমতে কাঁপা কাঁপা হাতে তার শেষ চিঠিটা দিয়েছিলাম। নোলক পড়া, পানের রঙে লাল হওয়া দাঁতে, সোনালী পাড়ের সবুজ জমিনের শাড়ি পড়ে তার মা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে বলেছিল, “আমার বাজান কেমুন আছে? ভালা আছে তো?”
একটা শব্দও মুখ থেকে বের করতে পারি নাই। তিনি আবারো আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “বাজান, আমি তো মুখ্যু-স্যুখ্যু মানুষ, যদি পইরা দেতেন, খুব খুশি হইতাম।
আমি যে রকম কাঁপা কাঁপা হাতে চিঠিটা দিয়েছিলাম, সেরকমই কাঁপা কাঁপা হাতে নিয়ে তার মায়ের এগিয়ে দেওয়া মোড়ায় বসে কান্নায় ভেঙ্গে আসা গলায় পড়তে শুরু করেছিলাম। তার মা বারান্দার খুঁটিতে হেলান দিয়ে আকাশে নিস্পলক আঁখি পেতে শুনতে লাগলেন ।
শ্রদ্ধেয় আম্মাজান,
আমার ছালাম নিবেন।আমি খোদার অশেষ রহমতে ভালোই রয়েছি।

এই বাক্য দুটা শোনার পর পূর্বের মতোই নিস্পলক আঁখি পেতে বললেন, সুবহানাল্লাহ। খোদা মোর ছোয়াক ভালা রাখুক। পড়েন বাজান, পড়েন।

“পর সমাচার এই যে এখানকার অবস্থা ভালো যাচ্ছে না। গোলযোগ শুরু হয়ে গিয়েছে”।
তার মা অজানা আশঙ্কায় দোয়া পড়ে বুকে কয়েকবার ফুঁ দিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, অবস্থা কি খুব খারাপ?
আমি জবাব না দিয়ে আবার পড়তে শুরু করেছিলাম, “ঐ পশ্চিম পাকিস্তানিরা বাংলা ভাষাকে মেরে ফেলতে চায় মা। আমার মায়ের ভাষা কেড়ে নিতে চায়!আমার মায়ের! যে মা আমাকে আলো, বাতাস, প্রকৃতির সৌন্দর্য দিয়েছে সেই মায়ের! মায়ের মুখে গল্প শুনতে দেবে না। মাকে অসম্মান করে! মায়ের মুখের ভাষা বদলে দিতে চায়? কেড়ে নিতে চায়? মায়ের বুকে লাথি দিতে চায়?কিন্তু মা তোমার ছেলে তো এখনো বেঁচে আছে। প্রয়োজনে সেই ছেলে বুক বাড়িয়ে দেবে। তবুও মায়ের অসম্মান হতে দেবে না। ঐ পশুদের আমি তা করতে দেব না।

কিছু টাকা পাঠালাম। মিলিকে স্কুলে ভর্তি করে দিও। টাকার প্রয়োজন হলে পত্র দিও। মিলিকে আমার স্নেহ দিও।
ইতি,
তোমার স্নেহের,
লাল।


“লাল”- এ আবার কেমন নাম? জিজ্ঞেস করতে তার মা লাজুক হাসি হেসে বলেছিলেন, বাজান, আমার বাবজানের নাম দুলাল। কিন্তুক আদুর কইরা লাল ডাকি।
এসময় একটা কচি মুখ তার মায়ের পিছন থেকে বলেছিল, ভাইজান কবে আইব?

আমি আর এক মুহূর্তও সেখানে বসে থাকতে পারি নাই। বিদ্যুৎবেগে উঠে দাঁড়িয়ে মুখ ঘুরিয়ে শীতল কণ্ঠে বলেছিলাম, আসবে, আসবে।


এরপর বাসায় চলে এসেছিলাম। পরিবেশ ঠাণ্ডা হলে বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে শুনি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ছাত্ররা ২৩ ফেব্রুয়ারি রাতে শহীদ মিনার তৈরির কাজ শুরু করে যেটা তৈরি শেষ হয়েছিল ২৪ তারিখ ভোরে। তাতে একটি হাতে লেখা কাগজ গেঁথে দেয়া হয়েছিল, যাতে লেখা ছিল “শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ”। সেদিনই শহীদ মিনার তৈরির খবর দৈনিক সংবাদপত্রগুলোতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল । দৈনিক আজাদ পত্রিকায় সংবাদটা ছাপা হয়, শিরোনাম ছিল “শহীদ বীরের স্মৃতিতে”। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র হোস্টেলের (ব্যারাক) বার নম্বর শেডের পূর্ব প্রান্তে,কোণাকুণিভাবে হোস্টেলের মধ্যবর্তী রাস্তার গা-ঘেষে মিনারটি তৈরি করা হয়েছিল। বাইরের রাস্তা থেকে যাতে সহজেই দেখা যায় সেই উদ্দেশ্য ছিল এবং যেকোনো ছাউনি থেকে বেরিয়ে এসে ভেতরের লম্বা টানা রাস্তাতে দাঁড়ালেই যেন চোখে পড়ে। শহীদ মিনারটি ছিল ১০ ফুট উচু আর ৬ ফুট চওড়া। মিনার তৈরির তদারকিতে ছিলেন জিএস শরফুদ্দিন (ইঞ্জিনিয়ার শরফুদ্দিন নামে পরিচিত), নকশা অঙ্কন করেছিলেন বদিউল আলম। তাঁদের সাথে ছিলেন সাঈদ হায়দার। শহীদ মিনার নির্মাণে সহযোগিতা করেন দুইজন রাজমিস্ত্রী। মেডিক্যাল কলেজের সম্প্রসারণের জন্য জমিয়ে রাখা ইট, বালু এবং পুরনো ঢাকার পিয়ারু সর্দারের গুদাম থেকে সিমেন্ট আনা হয়ছিল। ভোর হবার পর একটি কাপড় দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছিল মিনারটি।ঐ দিনই অর্থাৎ ২৪ ফেব্রুয়ারি সকালে, ২২ ফেব্রুয়ারির শহীদ শফিউরের পিতা অনানুষ্ঠানিকভাবে শহীদ মিনারের উদ্বোধন করেন।২৬ ফেব্রুয়ারি সকালে দশটার দিকে শহীদ মিনার উদ্বোধন করেন দৈনিক আজাদ সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দীন।উদ্বোধনের দিন অর্থাৎ ২৬ ফেব্রুয়ারি পুলিশ ও পাকিস্তান সেনাবাহিনী মেডিক্যালের ছাত্রদের আবাসিক হোস্টেল ঘিরে ফেলে এবং প্রথম শহীদ মিনার ভেঙে ফেলে।এরপর ঢাকা কলেজেও একটি শহীদ মিনার তৈরি করা হয় এটিও একসময় সরকারের নির্দেশে ভেঙে ফেলা হয়।



২২ ফেব্রুয়ারি অহিউল্লাহ নামের এক ৭-৯ বছরের বাচ্চাকে ওরা গুলি করে। ছেলেটার বাবা ছিল কাঠ মিস্ত্রি। ছেলেটার নাকি আঁকাআঁকির খুব শখ ছিল। রাস্তায় কুড়িয়ে পাওয়া রঙ-বেরঙের কাগজে গাছ-মানুষের ছবি আঁকত।সে আগে মিলিটারি দেখে নাই। তাই মিলিটারি দেখে রাস্তার এক পাশে দাঁড়িয়ে আঁকছিল। ঠিক তখনি তাকে গুলি করে গুম করে ফেলা হয়। যার কথা অনেকেই জানে না। একজন কিশোর ভাষাযোদ্ধা...

দুলালের একটা প্রেম ছিল ভাষা। অন্য কোন মানবী কি ছিল? জানা নেই। তার শেষ প্রবন্ধটা অনেকদিন ট্র্যাঙ্কে বন্দি হয়েছিল।
১৯৫৪ সালের ৭ মে মুসলিম লীগের সমর্থনে বাংলাকে রাষ্ট্রীয় ভাষার মর্যাদা দেয়া হয়। বাংলাকে পাকিস্তানের দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দিয়ে সংবিধানে পরিবর্তন আনা হয় ১৯৫৬ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি। সংবিধানের ২১৪(১) অধ্যায়ে রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে লেখা হয়:
“214.(1) The state language of Pakistan shall be Urdu and Bengali.
[২১৪. (১) উর্দু এবং বাংলা হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা।]”



এটা জানার পর তার প্রবন্ধটা ছাপতে দিয়েছিলাম। কারণ প্রবন্ধটা ছিল বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করার পর সেটার উদযাপন নিয়ে। সে কি করে অত আগেই নিশ্চিত হয়েছিল?এতটা আত্মবিশ্বাস তাকে কে দিয়েছিল? সত্যি, ভালবাসা মানুষকে অন্ধ যেমন করে তেমন চক্ষুষ্মানও করে ।
আজও সেই কালো পিচের রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাই। যে রাস্তা প্রতি ফাল্গুনে কৃষ্ণচূড়ার লাল লাল ফুলে ছেয়ে যায়। সেই লালে আমি সেই “লাল” ছেলেকে খুঁজে পাই। তাকে খুঁজে পাই আমার চারপাশে আপন ভাষায়, তার মায়ের ভাষায় কথা বলা মানুষদের মাঝে। সে যে ভুলবার নয়।

কৃষ্ণচূড়ার ডালে ডালে,
ভরে গিয়েছে যে রক্তলালে,
তাতে তুমি আছো মিশে।
ভুলব না, ভুলব না আমরা তোমাকে।

সত্যই তুমি ভুলবার নয়। তুমি অমর আমাদের অন্তরের গভীরে।



[বিঃদ্রঃ আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায় এবং শহীদ মিনার সম্পর্কিত তথ্যগুলো সত্য]

৩টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

পথ হারিয়ে-খুঁজে ফিরি

লিখেছেন সামিউল ইসলাম বাবু, ১৩ ই মে, ২০২৪ রাত ১:৩৩


মনটা ভালো নেই। কার সাথে কথা বলবো বুঝে পাচ্ছি না। বন্ধু সার্কেল কেও বিদেশে আবার কেও বা চাকুরির সুবাদে অনেক দুরে। ছাত্র থাকা কালে মন খারাপ বা সমস্যায় পড়লে... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রজাতির শেষ জীবিত প্রাণ !

লিখেছেন অপু তানভীর, ১৩ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৫১



বিবিসির একটা খবর চোখে এল সেদিন । উত্তরাঞ্চলীয় সাদা গন্ডার প্রজাতির শেষ পুরুষ গন্ডারটি মারা গেছে । তার নাম ছিল সুদান । মৃত্যুর সময় তার বয়স ৪৫। বিবিসির সংবাদটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশে সবচেয়ে ক্রিয়েটিভ এবং পরিমার্জিত কনটেন্ট ক্রিয়েটর মধ্যে সে একজন ।।

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ১৩ ই মে, ২০২৪ সকাল ১১:৩৯



আপনারা কতজন Umma Kulsum Popi চেনেন, আমি ঠিক জানি না। আমার পর্যবেক্ষণ মতে, বাংলাদেশে সবচেয়ে ক্রিয়েটিভ এবং পরিমার্জিত কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের একজন হলেন উনি। যদি বলি দেশের সেরা পাঁচজন কনটেন্ট... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদিস অস্বীকার করে রাসূলের (সা.) আনুগত্য সম্ভব

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৩ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সূরাঃ ৪ নিসা, ৫৯ নং আয়াতের অনুবাদ-
৫৯। হে মুমিনগণ! যদি তোমরা আল্লাহ ও আখিরাতে বিশ্বাস কর তবে তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহর, আর আনুগত্য কর রাসুলের, আর যারা তোমাদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

=কবিতাগুলো যেনো এক একটি মধুমঞ্জুরী ফুল=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ১৩ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:২০



©কাজী ফাতেমা ছবি
মনের মাধুরী মিশিয়ে যে কবিতা লিখি
কবিতাগুলো যেনো আমার এক একটি মঞ্জুরী লতা ফুল,
মনের ডালে ডালে রঙবাহারী রূপ নিয়ে
ঝুলে থাকে কবিতা দিবানিশি
যে কবিতার সাথে নিত্য বাস,
তাদের আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×