সিনাইয়ের সমতল উপত্যকা জুড়ে যদি মিনারটাকে শায়িত করা যেত তবে কমসে কম দুইদিন লেগে যেত মিনারের একপ্রান্ত হতে আরেকপ্রান্ত অব্ধি হেঁটে যেতে। আর এই আকাশচুম্বী মিনার যখন কিনা দাঁড়িয়ে আছে, তখন এর পাদদেশ হতে চূড়া পর্যন্ত আরোহণ করতে পুরো দেড় মাস লাগে তাও যদি কোন বোঝা ছাড়া কেউ উঠতে থাকে তবেই। কিন্তু, খুব স্বল্পসংখ্যক মানুষই আছে যারা কিনা এই মিনারে খালি হাতে আরোহণ করে। যে টানাগাড়ি দিয়ে ইট তোলা হয় মিনার নির্মাণের জন্য তার ভারেই স্বাভাবিক আরোহণের গতি ব্যহত হয়ে থাকে। একটা ইট প্রথম টানাগাড়িতে তোলার পর মিনার নির্মাণের কাজে লাগানোর জন্য যখন নামানো হয় এর মাঝে পুরো চার চারটি মাস কেটে যায়।
............
হিলালুম-এর সারাজীবন এলাম-এ কেটেছে। ব্যবিলনের সাথে যতটুকু তার পরিচয় তাও এলাম-এর খনিজ তামা-র প্রধানতম বিক্রেতা হিসেবে। বিক্রির জন্যে তামার বড় ধাতব পিণ্ডগুলো নৌকায় করে কারুন নদী থেকে ভাটি হয়ে ইউফ্রেটিস অভিমুখে যায়। হিলালুম আর অন্যান্য খনকরা অবশ্য স্থলভাগ দিয়ে যাতায়াতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে, সওদাগরদের খচ্চরে টানা কারাভানের সাথে। মালভূমির ধুলোমাখা পথ থেকে হাঁটতে হাঁটতে তারা একসময় সমতল উপত্যকায় নেমে আসে, যেখানে সবুজ ঘাসে ছাওয়া প্রান্তরে খাল আর খাড়িগুলো এলোমেলো চলে গিয়েছে।
তাদের মধ্যে কেউ এর আগে মিনারটা নিজ চোখে দেখে নি। যখন কি না তারা ব্যবিলন থেকে অনেক লীগ দূরে, তখন থেকেই মিনারটা দেখা যাচ্ছিল। কাদামাটির এ পৃথিবী থেকে ধেয়ে চলেছে আকাশের বিশালতার মাঝে সূক্ষ্ম শণের তৈরি সূতার মতন, গরম হাওয়ায় যেন দুলছে বলে ভ্রম জাগে। সামনে এগোতে এগোতে একসময় দৃশ্যমান হয় ব্যবিলনে শহরের প্রাচীর কিন্তু সকলের চাউনি তখনও মিনারেই আবদ্ধ। যখন মিনার থেকে সমতলে চোখ নামানোর ফুরসত মিলল, দেখা গেল শহরের বাইরেও কিভাবে এই মিনার নিজের উপস্থিতির জানান দিয়ে যাচ্ছে। ইউফ্রেটিস এর কূল আর তলদেশ থেকে ইট বানানোর জন্য বছরের পর বছর ধরে পলি তুলে আনার ফলে মনে হচ্ছে এক প্রশস্ত-সুগভীর খাঁদের মধ্য দিয়ে এখন নদীটি বয়ে চলছে। শহরের দক্ষিণে সারির পর সারি দাঁড়িয়ে আছে চুল্লীগুলো যেগুলোর শতাব্দী প্রাচীন আগুন আর জ্বলছে না।
শহরে প্রবেশদ্বারের দিকে যেতে যেতে হিলালুম-এর কল্পনার চাইতেও সুবিশাল হয়ে ধরা দিল এই মিনার। একটা বৃহৎ মন্দিরের মতন চওড়া অথচ মেঘ পাড়ি দিয়ে আকাশ ফুঁড়ে কোন উচ্চতায় উঠে ছোট হতে হতে মিলিয়ে গিয়েছে যে অতদূর দৃষ্টিও পৌঁছায় না। সূর্যের আলো থেকে চোখ বাঁচিয়ে সেই অনন্ত উচ্চতার দিকে তাকিয়ে সবাই হাঁটছিল।
হিলালুম এর বন্ধু নান্নি কনুইয়ের গুঁতো দিয়ে বিস্ময়াভিভূত কণ্ঠে বলল, “এই মিনারে উঠতে হবে আমাদের? সেই চূড়া পর্যন্ত?”
“আসলেই ভাবা যায় না, খননের জন্য কি না মাটি থেকে পাড়ি জমাতে হবে আকাশে।”
খনকদের দলটা যখন শহরের পশ্চিম দেয়ালের প্রধান দরজায় এসে দাঁড়ালো, শহর থেকে একটা কারাভান মাত্রই ছেড়ে যাচ্ছিল। দেয়ালের ছায়া যতটুকু পড়েছে সেই সরু জায়গাটায় সবাই এসে ভিড় করলো সূর্যের আঁচ বাঁচিয়ে। আর তাদের সর্দার বেলি প্রাচীরের উপর দাঁড়িয়ে থাকা প্রহরীদের দিকে তাকিয়ে হাঁক ছেঁড়ে বলল, “ সেই সুদূর এলাম থেকে এসেছি আমরা, খননকাজের জন্য ডাকা হয়েছে আমাদের।”
প্রহরীদের মধ্যে একটা খুশীর গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়লো। একজন দ্বাররক্ষী জানতে চাইলো, “তোমরাই তো স্বর্গের খিলান খননের জন্যে এসেছ?”
“হ্যাঁ, আমরাই।”
............
সমস্ত শহরটা উৎসবে মাতোয়ারা ছিল। আট দিন আগে শুরু হয়েছিল এই আনন্দ-যজ্ঞ যখন কিনা শেষ ইটটাকে পাঠানো হয়েছিল মিনারের শীর্ষে। আরও দুই দিন চলবে এই উৎসব। সকাল থেকে রাত, রাত থেকে ভোর – সমস্ত শহর উল্লাস করছিল। পেট পুড়ে খাওয়া আর সাথে নাচ গানের ছড়াছড়ি।
রাজমিস্ত্রিরা ছাড়াও মিনারে কাজ করতো টানাগাড়ির চালকেরা। মিনারের ওঠা-নামা করতে করতে যাদের পায়ের পেশীগুলো এখন দড়ির মতন পাকানো আর সুদৃঢ় হয়ে গিয়েছে। প্রতিদিন সকালে একদল টানাগাড়ি চালকেরা নিজেদের আরোহণ শুরু করতো গাড়িভর্তি ইট নিয়ে। চারদিন পর নিজেদের ইটগুলো তুলে দিত পরবর্তী দলের চালকদের কাছে আর পঞ্চম দিন নাগাদ ফিরে আসতো শহরে নিজেদের খালি গাড়ি নিয়ে। এরকম অসংখ্য দল ছড়িয়ে ছিল মিনারের ভিতর সেই শীর্ষ পর্যন্ত একটা অবিচ্ছিন্ন শিকলের মতন, কিন্তু শুধুমাত্র একেবারে নীচের দলটাই শহরের অন্যান্য সকলের সাথে মিলে আনন্দ-উল্লাস করছিল। রইলো বাকি অন্য টানাগাড়ি-চালকদের কথা যারা মিনারের ভেতরেই বসবাস করে। তাদের জন্যে আগে থেকেই পর্যাপ্ত পরিমাণে মদ-মাংস পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল যাতে মিনারের কাজে নিয়োজিত কেউ এই উৎসব থেকে বাদ না যায়।
বিকেলের দিকে হিলালুম আর অন্যান্য এলামিট খনকেরা মাটির চৌকিতে করে বসেছিল শহরের কেন্দ্রে। তাদের সামনে নানারকম খাবার আর পানীয়ে পরিপূর্ণ লম্বা একখানা টেবিল, এরকম অসংখ্য টেবিল ছড়িয়ে আছে আশে পাশে। খনকদের সাথে টানাগাড়ি চালকদের কথা হচ্ছিল, তাদের সকল জিজ্ঞাসা ঐ মিনার নিয়ে।
নান্নি বলল, “আচ্ছা, আমি শুনেছি একেবারে উপরে যেসকল রাজমিস্ত্রিরা কাজ করে তারা নাকি চিৎকার করতে করতে নিজেদের মাথার চুল টেনে ছিঁড়ে ফেলে যদি ভুলেও হাত ফসকে একখানা ইট নীচে পড়ে যায় কারণ আরেকটা ইট এসে পৌঁছাতে চার মাস সময় লাগবে; কিন্তু একজন আস্ত মানুষ যদি পড়ে যায় তবে সেদিকে দ্বিতীয়বার ফিরেও তাকায় না। কথাটা কি সত্যি নাকি?”
“আরে নাহ, ওসব শুধু মুখ চলতি গাল-গপ্পো।“ লুগাটুম নামের এক বাঁচাল চালক মাথা নাড়তে নাড়তে জবাব দিল। “সর্বক্ষণই ইট নিয়ে টানাগাড়ি চলছে মিনারের চূড়া অবধি, প্রতিদিন হাজারো ইট গিয়ে পৌঁছায় রাজমিস্ত্রিদের হাতে। এর মধ্যে একখানা ইট হাত ফসকে পড়লে কি আর এমন আসে যায়।”
লুগাটুম নান্নির দিকে একটু ঝুঁকে এসে গম্ভীর গলায় বলল, “তবে একটা জিনিস আছে যার দাম আসলেই মানুষের জীবনের চাইতেও বেশি রাজমিস্ত্রিদের কাছে: কর্ণিক।”
“কর্ণিক! কিন্তু কেন?”
“একজন রাজমিস্ত্রি যদি নিজের কর্ণিক ফেলে দেয়, তাহলে পরের দুই-তিন মাস পর্যন্ত তাকে অলস বসে থাকতে হয় যতক্ষণ পর্যন্ত না আরেকটা কর্ণিক এসে পৌঁছচ্ছে। আর এই সময়টায় সে কোন বেতনও পায় না, তার হাতের টাকাকড়ি সব ফুরিয়ে যায়; ঋণে ঋণে সে জর্জরিত হয়ে পরে। কাজেই কর্ণিক হারালে রাজমিস্ত্রিদের কান্নায় চারপাশ ভারী হয়ে ওঠে। সেখানে একজন মানুষ পা হড়কে নীচে পড়ে গেলে সবাই মনে মনে একটু নিশ্চিন্ত হয় যে মানুষটা মারা গেলেও তার কর্ণিকটা তো রইলো। এর পর কারও কর্ণিক হারালে আর ঐ দুই তিন মাস অপেক্ষা করা লাগবে না। এই বাড়তি কর্ণিক দিয়ে সে তার কাজ চালিয়ে নিতে পারবে। ব্যস, সমস্যার সমাধান হয়ে গেলো।”
হিলালুম একমুহূর্তের জন্য একেবারে হতবাক হয়ে গেল। কিন্তু তারপরই সে মনে মনে ভাবল, ঠিক কতখানা বাড়তি শাবল তারা সাথে করে এনেছে কাজের সুবিধার্থে। “ওইসব চাপাবাজি ছাড় তো। এত হাজার হাজার ইট প্রতিদিন বয়ে নিয়ে যাচ্ছ মিনারের চূড়ায়, আর কিছু বাড়তি কর্ণিক নিয়ে যেতে পারবে না। কি আর এমন ওজন ওগুলোর? আর সেখানে একজন দক্ষ রাজমিস্ত্রি হারালে যে ক্ষতি হয় সেটা কি অত সহজে পূরণ করা যায়। নিশ্চয়ই যেই সেই লোক কাজ করছে না মিনার গড়ার জন্য। এরকম একজন বাড়তি রাজমিস্ত্রি যদি আগে হতেই না থেকে থাকে মিনারের চূড়ায়, তাহলে সেরকম দক্ষ কেউ চূড়ায় উঠার আগ পর্যন্ত চুপচাপ অপেক্ষা করা ছাড়া গতি নেই।”
সব চালকেরা হাসিতে ফেটে পড়লো। “নাহ, আসলেই তোমাকে আর বোকা বানানো গেল না।“ লুগাটুম মজা করে বলল। “তা মিনারে উঠছ কবে থেকে? উৎসব শেষ হওয়া মাত্র নিশ্চয়ই?” হিলালুমকে উদ্দেশ্য করে সে জিজ্ঞেস করলো।
হিলালুম বিয়ারের বাটিতে চুমুক দিতে দিতে বলল, “হ্যাঁ, তাই তো জানি। শুনলাম আমাদের সাথে নাকি সেই সুদূর পশ্চিম থেকে আসা আরও কিছু খননকারীরাও যাবে? আমার সাথে এখন পর্যন্ত দেখা হয় নি। চেন নাকি ওদের?”
“হ্যাঁ। মিশর বলে এক দেশ থেকে আসছে তারা। তোমাদের মতন খননকারী নয় ওরা। ওদের যত দক্ষতা সব পাথর নিয়ে।”
“আমাদের এলাম-এও কিন্তু পাথরের খনি আছে।“ মুখ ভর্তি মাংস চিবাতে চিবাতে নান্নি বলল।
“আরে, সেই পাথর নয়। ওরা গ্রানাইট খনন করতে পারে।“
“গ্রানাইট?” চুনাপাথর আর শ্বেতপাথরের খনি আছে এলাম-এ যেখান থেকে নিয়মিত খনন করা হয়, কিন্তু গ্রানাইট নেই। “ঠিক ঠিক জেনে বলছ তো?”
“যেসকল ব্যবসীয়ারা মিশরে গিয়েছে আগে ওরাই এসে বলেছিল যে ঐ দেশে নাকি চুনাপাথর আর গ্রানাইট কেটে মন্দির আর স্তম্ভ বানানো হয়। বিশাল বিশাল চাক থেকে কেটে কেটে বানায়। এমনকি গ্রানাইট খুঁদে বিশাল বিশাল সব মূর্তিও বানায় ওরা।”
“কিন্তু গ্রানাইট নিয়ে কাজ করা তো আসলেই অনেক কঠিন।”
লুগাটুম কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, “ওদের জন্য এসব কোন ব্যাপারই না। রাজকীয় স্থপতিরা অনেক ভেবে চিনতে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তাদের মতে যখন তোমরা স্বর্গের খিলান খনন করবে তখন ওদের সাহায্য তোমাদের প্রয়োজন হতে পারে।”
হিলালুম সম্মতি জানালো মাথা নেড়ে। আসলেই তো। কত রকমের সাহায্য তাদের প্রয়োজন হতে পারে তার কি কোন ঠিক আছে? “ওদের সাথে তোমার দেখা হয় নি?”
“না, এখনও এসে পৌঁছায়নি। আশা করছি আর দুয়েকদিনের মধ্যে এসে পরবে। অবশ্য উৎসব শেষ হওয়ার আগে আসার সম্ভাবনা খুব কম। তেমন হলে, তোমরা এলামিট খনকরা আগেভাগেই আরোহণ শুরু করে দেবে।”
“তুমি চলছ তো আমাদের সাথে, তাই না?”
“হ্যাঁ, কিন্তু সে শুধু প্রথম চার দিনের জন্য। তারপর আমাদের ফিরে আসতেই হবে, আর তোমরা ভাগ্যবানেরা উঠতে থাকবে অন্য দলের সাথে।”
“আমাদের অত ভাগ্যবান মনে হওয়ার কারণটা কি?”
“আমার খুব ইচ্ছা ছিল জানো তো, একেবারে চূড়া পর্যন্ত যাওয়ার। একবার আরেকটা উঁচুতলার দলের সাথে গিয়েছিলাম কিছুদূর, প্রায় বারো দিনের উচ্চতায়। কিন্তু, সেটুকুই ছিল আমার সর্বোচ্চ আরোহণ। আর তোমরা কতটা উপরে উঠবে ভেবে দেখেছো?”
লুগাটুম বিষণ্ণ হাসি দিল। “তোমাদের দেখে ঈর্ষা হচ্ছে। তোমরাই প্রথম স্বর্গের খিলান ছুঁতে যাচ্ছ।“
শুধু ছুঁতে যাচ্ছি না। স্বর্গের খিলান খুঁড়তেও যাচ্ছি, শাবলের আঘাতে আঘাতে। হিলালুম অস্বস্তিভরে নড়েচড়ে বসলো ব্যাপারটা ভাবতে গিয়ে।
“ঈর্ষার কিছু নেই......” সে শুরু করলো।
“হ্যাঁ, সেটাই। ঈর্ষার কিছু নেই। আমাদের কাজ শেষ হলে পরে সকলেই স্বর্গে প্রবেশ করতে পারবে।” মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে বলে উঠলো নান্নি।
দ্বিতীয় পর্ব চলে এসেছে। পড়ে নিন একবারেই!
তারপর ভালো লাগলে তৃতীয় পর্বটাও পড়ে নিতে পারেন।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই এপ্রিল, ২০১৯ সন্ধ্যা ৭:৩৫