somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

স্বর্গসন্ধানী ০২ (Tower of Babylon - Ted Chiang)

০৪ ঠা এপ্রিল, ২০১৯ রাত ১১:২৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

প্রথম পর্ব আগে পড়ে নিন এইখানে গিয়ে! ধন্যবাদ।

পরদিন সকালে হিলালুম মিনারটা কাছ থেকে দেখতে গেল। মিনারটাকে চারদিক থেকে পরিবেষ্টন করে রাখা বিশাল আঙ্গিনায় দাঁড়িয়ে সে চোখ বুলালো আশেপাশে। মিনারটার প্রায় গাঁ ঘেঁষেই একটা মন্দির, অন্য যেকোনো জায়গায় যেটা নিজেই একটা দর্শনীয় বস্তু হয়ে থাকতো। কিন্তু, এখন এই মিনারের পাশে মন্দিরটাকে মনে হচ্ছে আর দুই দশটা সাধারণ বাড়ির মতন।

যে অটল দৃঢ়তা নিয়ে এই মিনার দাঁড়িয়ে আছে, এখানে এসে তার অনুভূতি হিলালুমকে জেঁকে ধরল। প্রচলিত কাহিনী অনুসারে, এই মিনার বানানোর সময় এমন পন্থা অবলম্বন করা হয়েছে যাতে এর ভিত্তি ও দেহ এমনকি মেসোপটেমিয়ার সুবিখ্যাত জিগুরাতগুলোর চাইতেও সুদৃঢ় হয়। একেবারে গোঁড়া থেকে চূড়া পর্যন্ত পোড়া ইটের তৈরি এই মিনার। কোন সাধারণ মন্দির বানাতে পোড়া ইট দেয়া হত শুধু বাইরের দিকে, সৌন্দর্য বর্ধনের জন্যে। আর ভেতরের স্তরে থাকতো সূর্যের তাপে শুকিয়ে আনা মাটির ইট। কিন্তু, এই মিনারের ক্ষেত্রে সবক্ষেত্রেই পোড়া ইটের ব্যবহার তার এই মজবুত আকৃতি প্রদানে সাহায্য করেছে। শুধু তাই নয়। ইটগুলোকে জোড়া লাগাতে ব্যবহার করা হয়েছে আলকাতরার লেই, যেগুলো শুকিয়ে গেলে পরে ইটের মতনই মজবুত হয়ে ওঠে।

মিনারের গোঁড়াটা সাধারণ আর যে কোন মন্দিরের ভিত্তির প্রথম দুই ধাপের মতনই। বিশাল বড় বর্গাকৃতির ভিত যার একেক পাশ প্রায় দুইশ কিউবিট চওড়া আর উচ্চতায় চল্লিশ কিউবিট, দক্ষিণ দিকে তিনটে সিঁড়ি সহ। প্রথম ভিতের উপর বসে আছে অপেক্ষাকৃত ছোট দ্বিতীয় ভিত যেখানে যাওয়ার জন্যে মধ্যবর্তী সিঁড়ি দিয়ে উঠতে হয়। আর এই দ্বিতীয় ভিতের উপর থেকেই শুরু মিনারের মূল কাঠামোর।

একেক পাশে ষাট কিউবিট করে চওড়া এই মিনার ঋজুভাবে সটান উঠেছে এমন বর্গাকার আকৃতিতে যাতে স্বর্গের সমস্ত ওজন নিজের ঘাড়ে নিতে পারে। এক ফালি চামড়া যেভাবে চাবুকের হাতলে প্যাঁচানো থাকে ঠিক সেইভাবে মিনারের চারপাশ দিয়ে ঘুরে ঘুরে সর্পাকৃতিতে উঠে গিয়েছে মসৃণ সোপান। না, দ্বিতীয় বার ভালো করে তাকানোতে হিলালুম বুঝতে পারলো। সোপান একটা নয়, বরং দুইটি। পাশাপাশি জড়িয়ে আছে দেখেই চোখে পড়ে না প্রথম দেখায়। প্রতিটা সোপানের বাহিরের প্রান্তে প্রশস্ত কিন্তু সরু স্তম্ভ একই সাথে সোপানের বুনিয়াদ মজবুত করছে, সেই সাথে ছায়াও দিচ্ছে টানাগাড়ি-চালকদের। মিনারের গা বেয়ে হিলালুমের দৃষ্টি উপরের দিকে উঠতে লাগলো যতদূর দেখা যায়। সোপান-ইট-সোপান-ইট এইভাবে উঠতে উঠতে এক পর্যায়ে আর তাদের আলাদা করা যাচ্ছে না চোখের দৃষ্টি দিয়ে। চোখের সীমানার বাইরে কোন অসীমে গিয়ে এই মিনার মিশেছে, অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলে মাথা ঝিমঝিম করে। হিলালুম চোখমুখ কুঁচকে, পিটপিট করে কয়েকবার দেখল। নিজের অজান্তেই হোঁচট খেয়ে এক দুই পা পিছাল আর তারপর ফিরে তাকাল। তার শরীর তখন মৃদুভাবে কাঁপছে।

হিলালুম ভাবতে থাকলো সেইসব গল্পের কথা যা সে শুনেছিল নিজের শৈশবকালে। মহাপ্লাবনের পরের কাহিনী যখন ধীরে ধীরে মানুষ আবারো ছড়িয়ে পড়েছিল পৃথিবীর প্রতিটি কোনায়, আনাচে কানাচে। পৃথিবীর শেষ প্রান্ত পর্যন্ত পাল তুলে গিয়েছে, নিজ চোখে দেখে এসেছে কিভাবে সাত সমুদ্রের পানি ঝরনার মতন ঝড়ে পড়ছে পাতালের অতল গভীরে বয়ে চলা নদীর কালো স্রোতে। এভাবেই মানুষের মনে ধারনা জন্মাল পৃথিবীর আকার সম্পর্কে। তার মনে হতে লাগলো এই পৃথিবী তার প্রয়োজনের তুলনায় কতই না ক্ষুদ্র। তার অনুসন্ধিৎসু মন চাইলো এই পৃথিবীর সীমানার বাইরে কি আছে তা জানতে, জানতে চাইলো ইয়াহওয়ে-র সৃষ্টির আদ্যোপান্ত। কিভাবে তার নজর গেলো আকাশপানে, সেই যেখানে ইয়াহওয়ে নিজে থাকেন; স্বর্গের মহা-জলাধার, যা পার হয়ে যেতে হয় স্বর্গোদ্যানে। আর সেই লক্ষ্যে অনেক শতাব্দী পূর্বে মানুষ এই মিনারের ভিত্তিস্থাপন করলো। স্বর্গসন্ধানী মানুষ চাইলো এমন এক সোপান নির্মাণ করতে যা যোগসূত্র হয়ে উঠবে এই মাটির পৃথিবী আর অপরূপ স্বর্গের মধ্যে। যেই পথ দিয়ে হেটে মানুষ স্বর্গে প্রবেশের পথ খুঁজে নিবে আবার ইয়াহওয়ে যেই পথে নেমে এসে দেখে নিতে পারবেন তার সৃষ্টি করা মানুষ আর তাদের বাসস্থল এই পৃথিবীকে।

হাজারো মানুষ এক ও অভিন্ন উদ্দেশ্য অবিশ্রান্ত ভাবে পরিশ্রম করে যাচ্ছে যাতে তারা ইয়াহওয়ের নিকট পৌঁছাতে পারে তার সৃষ্টিকে আরও ভালো করে জানতে পারে – এই ভাবনাটাই তাকে সবসময় আন্দোলিত করেছে। যখন ব্যাবিলনীয়রা এলাম=এ সুদক্ষ খননকারী খুঁজতে এলো, সে অধীর আগ্রহে এগিয়ে গিয়েছিল। অথচ, এখন এই মিনারের পাদদেশে দাঁড়িয়ে তার সকল অনুভূতি একসাথে বিদ্রোহ ঘোষণা করলো যেন। না, কোনকিছুরই বাড়াবাড়ি ভালো নয়। এভাবে স্বর্গ ছুঁতে চাওয়ার ধৃষ্টতা দেখানোটা কি মানুষের ঠিক হচ্ছে – যেই মিনারের দিকে তাকালেই মনে হচ্ছে পৃথিবীর-মানবজাতির ক্ষমতার সীমার বাইরে সে চলে এসেছে;

সেই মিনারে আরোহণ করাটা কি আদৌ উচিৎ হবে?

.........

মিনারে ওঠা শুরু করার দিন সকালবেলা, দ্বিতীয় ভিতের উপরে সাড়ি সাড়ি দুই চাকার শক্তপোক্ত টানাগাড়িগুলো দাঁড়িয়ে ছিল। পুরো ভিতের উপরে কোথাও তিল ধারণেরও জায়গা নেই। অধিকাংশ গাড়িই ভর্তি ছিল নানাপদের খাদ্যদ্রব্য দিয়ে। বস্তার পর বস্তা যব, গম, মসুরের ডাল, পেঁয়াজ, খেজুর, শসা, আস্ত পাউরুটির টুকরো, শুকনো মাছ। আরও তোলা হচ্ছিল মাটির মশক যা ভরা ছিল পানি, খেজুরের মদ, বিয়ার, ছাগ-দুগ্ধ, পাম তেল দিয়ে। আর যেসব টানাগাড়িতে খাবার ছিল না, সেগুলোতে এমন সব মূল্যবান দ্রব্য নেয়া হচ্ছিল যা বাজারে বিক্রি করা যাবে যেমন – তাম্রপাত্র, বেতের ঝুড়ি, রেশমি কাপড়, কাঠের টুল আর টেবিল। এমনকি একদল যাজক একটা মোটাতাজা ষাঁড় আর একটা ছাগলও নিচ্ছিলেন একপাশ আচ্ছাদিত টানাগাড়িতে করে যাতে মিনারে ওঠার সময় কিনারের দিকে তাকিয়ে তারা আতঙ্কিত না হয়ে পরে। মিনারের চূড়ায় পশুদুটিকে বলি দেয়া হবে।

এছাড়াও কয়েকটা টানাগাড়িতে খননকারীদের জন্য প্রয়োজনীয় গাঁইতি, শাবল আর হাতুড়ি বোঝাই করা হয়েছিল। আরও নেয়া হয়েছিল একটা ছোট কামারশালা বানানোর প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র যা চূড়ায় স্থাপন করা হবে। সর্দারের নির্দেশে একাধিক টানাগাড়ি ডাঁই করে তোলা হয়েছিল কাঠ আর বেত।

লুগাটুম সেরকমই একটা টানাগাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। শক্ত করে বেঁধে নিচ্ছিল উঁচু হয়ে থাকা কাঠের স্তূপটাকে। হিলালুম তার কাছাকাছি এসে প্রশ্ন করলো, “এই এত এত কাঠ আসে কোত্থেকে বলো তো? এলাম থেকে ব্যবিলন আসার পথে তো কোন বন চোখে এলো না?”
“ওদিকে নেই, কিন্তু শহর থেকে সোজা উত্তর দিকে বেশ খানিকটা এগোলেই দেখতে হাজারো গাছে ভরা বন। সেই যখন এই মিনার বানানো শুরু হয়েছিল, তখনই ঐ বনের অধিকাংশ গাছ রোপণ করা হয়েছিল। ওখানের গাছ থেকেই কাঠগুলো আসে, কাটা শেষে ভেলায় করে ইউফ্রেটিস নদী দিয়ে আনা হয়।”
“একটা পুরো বন রোপণ করা হয়েছিল?”
“তবে আর কি বলছি। কাজ শুরু করার সময়ই স্থপতিরা জানতো এই পুরো সিনাই উপত্যকায় যত কাঠ আছে তার সব কাজে লাগালেও কম পড়ে যাবে চুল্লী জ্বালাতে। তাই এই বনায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। একদল কর্মী আছে যাদের কাজই হচ্ছে গাছগুলোতে নিয়ম করে পানি দেয়া আর কোন গাছ কাটা হলে তার বদলে আরেকটি গাছ রোপণ করা।”
হিলালুম বিস্ময়াভিভূত হয়ে উঠেছিল। “আর সেখান থেকেই তাহলে সব কাঠের যোগান হয়েছে?”
“মোটামুটি। আরও দূর উত্তরেও কিছু বন ছিল যেখান থেকে গাছ কেটে আনা হয়েছে। একইভাবে নদীপথে, ভেলায় করে।” টানাগাড়িটার চাকাগুলো শ্যেনদৃষ্টিতে পরখ করতে করতে বলে চলল লুগাটুম। নিজের কাছে থাকা একটা চামড়ার বোতল খুলে দুয়েক ফোঁটা তেল ঢেলে দিল চাকা আর অক্ষদণ্ডের মাঝে।
নান্নি হাঁটতে হাঁটতে ওদের কাছাকাছি চলে এসেছিল। সামনে বিস্তৃত ব্যবিলনের রাস্তা-বাড়ি-প্রাচীর দেখতে দেখতে সে মন্তব্য করলো, “এর আগে কখনো এত উঁচুতেই ওঠা হয় নি যেখান থেকে কি না পুরো একখানা শহর দেখা যায়।”
“আমিও উঠি নি।“ হিলালুমও স্বীকার করে নিলো। লুগাটুম শুধু মুচকি হাসল।
“চলো চলো। সব টানাগাড়ি প্রস্তুত হয়ে গিয়েছে।“

দ্রুতই প্রতিটা টানাগাড়ির দায়িত্ব জোড়ায় জোড়ায় বুঝিয়ে দেয়া হল। প্রতিটি গাড়ি থেকে দুইটি করে দণ্ড সামনের দিকে বের হয়ে ছিল যার সাথে আবার শক্ত করে দড়ি বাঁধা ছিল ধরে টানার জন্য। এই দুইটি দণ্ডের মাঝখানে প্রত্যেক জোড়া টানাগাড়ি চালক দাঁড়িয়েছিল। যেসকল টানাগাড়িগুলো খনকদের টানতে হবে সেগুলো নিয়মিত চালকদের গাড়িগুলোর মাঝখানে মাঝখানে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছিল যাতে করে মিনারে ওঠার গতিটা যথোপযুক্ত থাকে। লুগাটুম আর একজন চালক ঠিক হিলালুম আর নান্নির পেছনের টানাগাড়িটাতেই দাঁড়িয়েছিল।
“মনে রেখো,” লুগাটুম গলা উঁচু করে বলল, “সামনের টানা গাড়ি থেকে আনুমানিক দশ কিউবিট দূরত্ব বজায় রাখবে। কোনার বাঁকগুলো ঘোরার সময় ডানদিকে যে থাকবে সেই শুধু টানবে আর প্রতি একঘণ্টা অন্তর অন্তর নিজেদের মধ্যে জায়গা বদল করবে।”
সামনের টানাগাড়িগুলো আস্তে আস্তে সোপান ধরে চলতে শুরু করেছিল। হিলালুম আর নান্নি ঝুঁকে টানাগাড়ির দড়িগুলো নিজেদের কাঁধে তুলে নিলো। দুজনে একসাথে উঠে দাঁড়ালো আর সেই সাথে টানাগাড়ির সামনের প্রান্তটাও মেঝে থেকে উপরে উঠলো।
“টান দাও।“ পিছন থেকে লুগাটুম আওয়াজ দিল।
দুজনেই সামনের দিকে ঝুঁকে পড়লো দড়ির বিপরীতে আর টানাগাড়িটাও আস্তে আস্তে চলতে শুরু করলো। একবার চাকা গড়িয়ে যাওয়ার পর, গাড়িটা টানা বেশ সহজই লাগছিল। ভিতটা ঘোরা শেষে তারা সোপানের গোঁড়ায় এসে পৌঁছল। আবারও তাদের সামনের দিকে ঝুঁকে পরতে হল সোপান বেয়ে ওঠার সময়।
“এটাকে যদি হালকা বলা হয় তবে ভারী কাকে বলে জানতেও চাই না।” হিলালুম বিড়বিড় করে বলল।

সোপানটা যথেষ্ট চওড়া ছিল, একজন মানুষ চাইলেই টানাগাড়িগুলোকে পাশ কাটিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে পারতো। মেঝেটা পোড়ামাটির ইট দিয়েই তৈরি করা হয়েছিল যেখানে দুটো গভীর খাঁজ শত শত বছর ধরে এই পথ দিয়ে টানাগাড়ি চলাচলের প্রমাণ দিচ্ছিল। বর্গাকৃতির পাথরগুলো একটার উপর আরেকটা রেখে সারিবদ্ধ করা হয়েছিল যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা মাথার উপর ধনুকের মতন বাঁকানো আকৃতি নিয়ে ঠিক মধ্যখানে মিলিত হয়। ডানদিকের স্তম্ভগুলো অনেকখানি প্রশস্ত ছিল, মাঝে মাঝে এমনকি ঢালটাকে সুড়ঙ্গ বলেই মনে হচ্ছিল। কেউ যদি কৌতূহলী হয়ে পাশে উঁকি না দিত, তবে আসলে যে একটা মিনারে ওঠা হচ্ছে তা বুঝার খুব একটা অবকাশ ছিল না।
“খনিতে কাজ করার সময় গান-টান গাও না তোমরা?” লুগাটুম প্রশ্ন করলো।
“পাথর যদি নরম থাকে তবেই গাই,” নান্নি বলল।
“তা, সেরকম একটা গান ধরেই ফেল তাহলে।”
অন্যান্য খনকেরাও একই রকম অনুরোধ পাচ্ছিল আর কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখা গেল সকলেই গলা ছেড়ে গান গাইতে গাইতে সামনে আগাচ্ছে।

.........

যতই তারা উপরে উঠছিল, ছায়া ছোট থেকে ছোট হয়ে আসছিল। সূর্যের আলো থেকে আড়ালে এই উচ্চতায় তাদের ঘিরে রাখছিল বিশুদ্ধ, স্বচ্ছ বাতাস। ব্যবিলনের সরু গলিতে যেখানে মধ্যাহ্নের তাপমাত্রা গায়ের চামড়া পুড়িয়ে দেয়, সেখানের সাথে তুলনা করলে এই উচ্চতায় তাপমাত্রা হাজারো গুণে ঠাণ্ডা ছিল। পাশে তাকালেই খনকেরা দেখতে পাচ্ছিল নীচে মহানদী ইউফ্রেটিস তার কালো জল বয়ে নিয়ে চলছে, লীগের পর লীগ বিস্তৃত হয়ে আছে সবুজ মাঠ। আর সেই উপত্যকায় ছড়িয়ে থাকা খালগুলো রূপালী দড়ির মতন ঝিকমিক করে উঠছে। এই উচ্চতা থেকে ব্যবিলন শহরকে লাগছিল কাগজে আঁকা এক জটিল নকশার মতন, সেখানে জিপসামের চুনকাম সূর্যের আলোতে জ্বলজ্বল করছিল। যতই উপরে উঠা হচ্ছিল, শহরটা ততই ঝাপসা হয়ে আসছিল। একটা সময় সেটাকে মিনারের গোঁড়ায় থাকা একটা বৃত্ত মনে হচ্ছিল।

হিলালুম ডানদিকের দড়িটা টানছিল কিনারার পাশ ঘেঁষে চলতে চলতে যখন ঠিক নীচতলার ঢাল থেকে চিৎকার ভেসে আসলো। একবার সে ভাবল দাঁড়িয়ে উকি মেরে দেখবে কি না কিন্তু তাতে সবার সামনে আগানোর গতিতে একটা বিঘ্ন ঘটবে দেখে সে আর থামল না। এমনিতেও এভাবে পাশ দিয়ে উঁকি মেরে নীচতলার সোপানের কিছুই তেমন একটা স্পষ্ট করে দেখা যায় না। “নীচে আবার কি হল?” পেছনে থাকা লুগাটুমকে ডাক দিয়ে বলল সে।
“তোমারই এক সহকর্মীর উচ্চতা-ভীতি ছিল যা বোঝা যাচ্ছে। মাঝে মাঝে এমন এক দুজনকে পাই আমরা যারা প্রথমবার উঠতে গিয়ে কাবু হয়ে পড়ে। দেখা যায় সে মেঝেতে শুয়ে পড়ে, আর সামনে এগুতে চায় না। অবশ্য খুব কমসংখ্যক মানুষই এত অল্প উচ্চতাতে ভয় পায়।”
হিলালুম বুঝতে পারছিল। “আমাদের মতন খননকারীদের ক্ষেত্রেও এমন একধরনের ভয় কাজ করে, জানো তো। অনেকেই আছে যারা খনিতে কাজ করতে ঢুকতে পারে না যদি কখনো তাদের জ্যান্ত কবর হয়ে যায় মাটি ধ্বসে – এই ভয়ে।”
“আসলেই?” লুগাটুম বলল, “এমনটা আগে শুনি নি। তা তোমার আবার উচ্চতা নিয়ে কোন ভয়টয় নেই তো?”
“কি যে বলো না!” এক মুহূর্তের জন্য তার চোখাচোখি হল নান্নির সাথে। তারা দুজনেই সত্যিটা খুব ভালো করে জানতো।
“ভয়ে তোমার হাত ঘেমে উঠছে, তাই না?” নান্নি ফিসফিসিয়ে বলল।
হিলালুম দড়ির শক্ত আশে নিজের হাত মুছে নিতে নিতে মাথা ঝাঁকাল।
“আমারও বুক ধুকপুক করছিল যখন কিনারা দিয়ে হাঁটছিলাম।”
“আমাদেরও মনে হয় গরু-ছাগল দুটোর মতন একটা ঢাকা দেয়া টানাগাড়ির প্রয়োজন ছিল,” হিলালুম মজা করে বলল।
“তোমার কি মনে হয় আরও উপরে ওঠার পর আমাদেরও এরকম উচ্চতা-ভীতি জন্মাতে পারে?”
হিলালুম ভেবে দেখল। তাদের মধ্যে একজন খনিক উচ্চতার ভয়ে কাবু হয়ে পড়েছে ব্যাপারটা ঠিক ভালো লাগছে না। সে মাথা থেকে অস্বস্তিটা ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করল। হাজারো মানুষ প্রতিনিয়ত এই পথ দিয়ে মিনারে উঠে চলছে, সেখানে একজনের ভয় সবার মধ্যে ছড়িয়ে পড়লে তো সেটা নিজেদেরই বোকামি হবে। “আসলে এই মিনারে আরোহণ করার সাথে কেউই তেমন পরিচিত নই। অনেকটা সময় পাচ্ছি আমরা এই পুরো প্রক্রিয়ার সাথে, উচ্চতার সাথে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে। যখন কি না আমরা এই মিনারের চূড়ায় পৌঁছবো, দেখা যাবে আমরা আফসোস করছি যে মিনারটা কেন আরেকটু উঁচু হল না।”
“একদমই না,” নান্নি বলল। “মনে হয় না এই বোঝা আমি এক কিউবিটও বেশি টেনে নিয়ে যেতে চাইবো।” দুজনেই হেসে উঠল।

তৃতীয় পর্বটাও পড়ে নিন ঝটপট।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই এপ্রিল, ২০১৯ সন্ধ্যা ৭:৩৬
৫টি মন্তব্য ৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

লুঙ্গিসুট

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:২৪



ছোটবেলায় হরেক রঙের খেলা খেলেছি। লাটিম,চেঙ্গু পান্টি, ঘুড়ি,মার্বেল,আরো কত কি। আমার মতো আপনারাও খেলেছেন এগুলো।রোদ ঝড় বৃষ্টি কোনো বাধাই মানতাম না। আগে খেলা তারপর সব কিছু।
ছোটবেলায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখার মত মুফতি তাকি উসমানী সাহেবের কিছু কথা

লিখেছেন নতুন নকিব, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:২৫

স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখার মত মুফতি তাকি উসমানী সাহেবের কিছু কথা

ছবি কৃতজ্ঞতা: অন্তর্জাল।

একবার শাইখুল হাদিস মুফতি তাকি উসমানী দামাত বারাকাতুহুম সাহেবকে জিজ্ঞেস করা হল, জীবনের সারকথা কী? উত্তরে তিনি এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

=মৃত্যু কাছে, অথবা দূরেও নয়=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:০৭



©কাজী ফাতেমা ছবি
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দিয়ে বলি, আমারও সময় হবে যাবার
কি করে চলে যায় মানুষ হুটহাট, না বলে কয়ে,
মৃত্যু কী খুব কাছে নয়, অথবা খুব দূরে!
দূরে তবু ধরে নেই... ...বাকিটুকু পড়ুন

সবুজ চোখের মানুষের ধাঁধা

লিখেছেন করুণাধারা, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:২৯



এই ধাঁধার নাম সবুজ চোখের মানুষের ধাঁধা; নিচের লিংকে এটার ভিডিও আছে।

স্বৈরশাসকের বন্দী

এই ধাঁধাটি আমার ভালো লেগেছিল, তাই অনেক আগে আমার একটা পোস্টে এই ধাঁধাটি দিয়েছিলাম। কিন্তু সেই পোস্টে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইসলামের চার খলিফার ধারাবাহিকতা কে নির্ধারণ করেছেন?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:৩৭




সূরাঃ ৩ আলে-ইমরান, ২৬ নং আয়াতের অনুবাদ-
২৬। বল হে সার্বভৈৗম শক্তির (রাজত্বের) মালিক আল্লাহ! তুমি যাকে ইচ্ছা ক্ষমতা (রাজত্ব) প্রদান কর এবং যার থেকে ইচ্ছা ক্ষমতা (রাজত্ব)... ...বাকিটুকু পড়ুন

×