somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সায়েন্স ফিকশনঃ দ্বিতীয় জীবন

৩০ শে জুলাই, ২০১৯ রাত ১১:২৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ভালো করে গ্লাস ক্লিনার স্প্রে করে নিলাম ডাইনিং টেবিলটার ওপর। অনেক দিন হল ঠিকঠাক পরিষ্কার করা হয় না। ন্যাকড়াটা দিয়ে ভালো করে ঘষে দাগগুলো তুলে একেবারে ঝকঝকে করে তুললাম। রিফাত দেখলে খুব খুশি হতো। ওর মতন পরিষ্কার তো আমি কখনোই ছিলাম না। এসব ধোয়া-মোছা, পরিষ্কার করা এগুলো ওরই দায়িত্ব ছিল। সারাদিন কাজ শেষে বাসায় এসে সময় না পেলেও, দেখা যেত সকালে অফিসে যাওয়ার আগে টেবিল, চেয়ার, টিভি, সোফা সব ডলে ডলে ঝাঁ চকচকে করে তুলছে। আমি মাঝে মাঝে বিরক্ত হয়ে বলতাম, শুচিবাই। এখন নিজেই সেসব করছি। সারা বাসা ঈদের আগে যেভাবে কোনা কোনা খুঁজে সবাই পরিষ্কার করে ঠিক সেভাবে। জানালা মুছে তাতে টাঙ্গিয়ে দিয়েছি ধুয়ে ইস্ত্রি করা পর্দা। ঘর আর বাথরুম পরিষ্কার করেছি টাইলস ক্লিনার দিয়ে। রান্নাঘরের সব বাসন-হাড়ি-পাতিল, ধুয়ে সাজিয়ে রেখেছি ঠিক যেভাবে রাখলে রিফাত খুশি হতো। কার্পেট ভালো করে ব্রাশ দিয়ে পরিষ্কার করেছি, এমনকি ফ্রিজের জমে থাকা বরফও। প্রস্তুতিতে কোন কমতি রাখতে চাই না আমি।

কাজ শেষে বাথরুম থেকে গোসল করে বেড়িয়ে আসলাম। মাথায় টাওয়েল প্যাঁচানো, গায়েও জড়িয়ে রেখেছি একটা। আজকের জন্যে বিশেষ ড্রেসটা বের করে রাখা ছিল আগেই। গত বছর রিফাত নিয়ে এসেছিল কলকাতা থেকে। ওর খুব পছন্দের ড্রেস ছিল। নীলের মধ্যে সোনালী জরির কাজ করা। ড্রেসটা পড়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ভালো করে তাকালাম নিজের দিকে। মাথায় একটা টিপ দিতে হবে আর ঠোটে লিপস্টিক। ঠিক যেমনটা রিফাতের পছন্দ ছিল। চুলটা খোলাই রাখবো। ওড়নাটা আটকে নিলাম সেফটিপিন দিয়ে। রান্নাঘর থেকে খাবারের প্যাকেট খুলে প্লেটে ঢেলে নিলাম। রিফাতের প্রিয় রেস্টুরেন্ট থেকে অনলাইন অর্ডার করে নিয়ে আসা নুডলস। মাইক্রোওয়েভে গরম করতে দিয়ে ময়লার ঝুড়িটা দরজার বাইরে রেখে আসলাম, তা না হলে পরে দুর্গন্ধ ছড়াবে। কালকে তো আর বের করতে আমি এখানে থাকবো না। মাইক্রোওয়েভের শব্দে সম্বিত ফিরল। টেবিলের ওপর ম্যাট বিছিয়ে নিলাম। নুডলসের সাথে ফ্রিজ থেকে বের করে নিলাম পানির বোতল আর কোল্ড ড্রিংক। যেমনটা রিফাত চাইতো, সেভাবেই নীচে ম্যাট দিয়ে রাখলাম যাতে ডাইনিং টেবিল ভিজে না যায়। উফ, সসের বোতল ভুলে গিয়েছিলাম। নুডলসে সস কম হলে রিফাত খেতেই চাইতো না। পুরো লাল করে ফেলত সস দিয়ে।

সসে ভেজা লাল চ্যাটচেটে নুডলস কাঁটা চামচ দিয়ে তুলে মুখে দিলাম। এভাবে খেতে পারিনা আমি। রিফাত পারতো, অনায়াসে। আমি সমসময় চায়ের চামচ দিয়েই কাজ চালাতাম। কিন্তু, আজকের কথা ভিন্ন। কোল্ড ড্রিংক খেলাম এক চুমুক। অন্যান্য দিন এরকম সময় রাতের খাবার শেষে একগাদা ওষুধ গিলতে হয় আমাকে, কিন্তু আজকে আর তার প্রয়োজন নেই। ডাক্তারের সাধ্য নেই এই রোগ দূর করার। মুচকি হাসলাম আমি। হাসিটা ধীরে ধীরে অদ্ভুতভাবে বেঁকে গেলো মুখ ভেংচিতে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই দেখলাম বাধ ভাঙ্গা কান্নায় নুয়ে পড়ছি আমি। কিন্তু, না না না। কাঁদা যাবে না কোনমতেই। রিফাত আমার চোখে পানি দেখলে খুব কষ্ট পেতো নিশ্চয়ই। একদম কাঁদা যাবে না। চোখের কথায় মনে আসলো, ভালো করে কাজল দিয়ে নিতে হবে। কি করে ভুলে গেলাম এটা আমি। টিস্যু দিয়ে চোখটা মুছে আরেক চামচ নুডলস মুখে দিলাম।

বাসা থেকে বের হওয়ার আগে ভালো করে দেখে নিলাম সব লাইট-ফ্যান নেভানো হয়েছে কি না। দরজাটা আর লক করলাম না। তাহলে পরে যারাই আসুক না কেন, ভাংতে হবে। কি দরকার। নীচে এসে রিকশা নিলাম একটা, গাবতলি মাজার রোড পর্যন্ত যাওয়া যাবে। সেখান থেকে হাঁটবো ভাবছি বাকি পথটুকু। সিএনজি বা উবার নিলে ভালো হত, কিন্তু শেষবারের মতন রিকশায় উঠতে চাচ্ছিলাম আমি। আমার আর রিফাতের খুব শখ ছিল লং ড্রাইভে যাওয়ার কিন্তু গাড়ি কেনা হয়ে ওঠেনি কখনও। তাই দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাতে প্রতি শুক্রবার রাতে রিকশা ভাড়া করে ঘন্টাদুয়েক ঘুরে বেড়াতাম। ধানমন্ডি, লালমাটিয়া, আসাদ গেট, মিরপুর রোড, মোহাম্মদপুর। রিকশা থেমেছে। আমি নেমে রিকশা ভাড়া মিটিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম। বেশ বাতাস আজকে রাতে। তবে এ জায়গাটায় ভিড় প্রচুর। গাবতলি বাস স্ট্যান্ডের প্রচণ্ড ভিড়-হট্টগোল পার হয়ে গাবতলি ব্রিজের উপর এসে দাঁড়ালাম। যাক, অবশেষে আমার গন্তব্যে এসে পৌঁছাতে পেরেছি আম।।

নীচে তাকিয়ে দেখলাম। খুব একটা নাকি পানি নেই, কিন্তু হাঁটু পানি থাকলেই হবে। সাতার তো আর জানা নেই আমার। কাজেই সেটাই যথেষ্ট। ডানে বামে ভালো করে তাকালাম আমি। অনেকেই হাঁটছে আশেপাশে, তবে তারা কেউ বুঝে ওঠার আগেই আমি ঝাঁপ দিয়ে দিলাম রেলিং এর ওপর থেকে। পিছনের কোলাহল-আর্তনাদ কিছুই আর কানে আসছে না আমার। শুধু কানের পাশ দিয়ে বাতাস যাচ্ছে অবিরত। নীচের কালো পানি এগিয়ে আসছে ঝড়ের বেগে। চোখের সামনে নাকি অতীতের সব স্মৃতি ভেসে ওঠার কথা কিন্তু তার আগেই হঠাৎ যেন সব থমকে দাঁড়ালো। মনে হল ঠিক আমার নীচে একটা হাজারো খণ্ডে চূর্ণ বিচূর্ণ হওয়া আয়না। আয়নার ওপাশে কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু ভালো করে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। এত হাজার হাজার টুকরো থেকে একটা সম্পূর্ণ ছবি পাওয়া যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে একটা অস্পষ্ট অবয়ব। যেন আমাকে কিছু বলতে চাচ্ছে। আয়নার কাঁচগুলো সাদাটে কিংবা হয়তো আয়নাটার পেছনে কুয়াশার মতন সাদাটে ধোঁয়া। এর মাঝখান থেকে কেউ একজন যেন হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে আমার দিকে। তার কথা শুনতে পাচ্ছি না আমি। তার চোখ আমি দেখতে পাচ্ছি না। কিন্তু এক অদ্ভুত মমতা ভরা গলায় সে আমাকে ডাকছে। এক মায়াভরা আকুতি তার চোখে। আমি অনুভব করতে পারছি। না চাইতেও আমার অজান্তেই আমার হাত এগিয়ে গিয়ে স্পর্শ করলো এক টুকরো কাঁচকে। আর তারপর সব অন্ধকার...

----------------------------

ডুবে যাচ্ছি আমি। গভীর থেকে আরও গভীরে। পানি নয়। থকথকে জেলির মতন আঠালো, ঘন তরলের মধ্যে ডুবে যাচ্ছি ক্রমাগত। শ্বাস নিতে চাইলাম কিন্তু পারছি না। খাবি খাওয়া মাছের মতন মুখ খুলছে আর বন্ধ হচ্ছে আমার। এটাই কি তবে মৃত্যু? প্রচণ্ড জোরে চিৎকার করে উঠলাম আমি কিংবা চিৎকার করতে চাইলাম। অথচ টু শব্দটাও বের হল না। এক অন্য ভুবনের নিঃশব্দতায় ঘেরা এখন আমি। এরপর তীব্র আলোর ঝলকানিতে চোখ বন্ধ করে ফেলতে বাধ্য হলাম আমি। বুকের ওপর থেকে ভারটা কমছে একটু একটু করে। বুক ভরে শ্বাস টেনে মিটিমিটি চোখে তাকালাম। রংধনুর সাত রং চারপাশে যেন নাচের ছন্দে ছুটে চলছে। কর্কশ সেই আলো, কোনভাবেই তাকানো যায় না। কিন্তু তাও তাকিয়ে দেখতে ইচ্ছে করে বারবার এমনই এক মসৃণ সৌন্দর্য।

আর তারপর মনে হল একটা চলন্ত বাস এসে নাক বরাবর ধাক্কা দিল আমাকে। আমার সকল অনুভূতি বদলে গেলো কখনো অনুভব না করা ব্যথায়। দেহের প্রতিটি হাড় যেন গুড়ো গুড়ো হয়ে যাচ্ছে। প্রতিটি লোমকূপে যেন কেউ সযত্নে ঢুকচ্ছে সুতীক্ষ্ণ সুঁই। কেউ যেন সারা গায়ে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে আমার কিংবা বুল-ডোজারের নীচে পিষে দলা দলা রক্ত-মাংসে পালটে দিচ্ছে আমাকে। ব্যথার গভীরতা আমাকে গত দেড় মাস ধরে না ভুলতে পারা রিফাতের কথাও ভুলিয়ে দিল। আর তারপর প্রচণ্ড কাঁপতে থাকা আমাকে আমি আবিষ্কার করলাম গাবতলি ব্রিজের উপরে।

একরাশ ভয়ংকর অনুভূতি থেকে কেউ যেন অনুভূতি শূন্য অবস্থায় ঠেলে দিল আমাকে। কানের মাঝে ঝিঁ ঝিঁ করছে। মনে হচ্ছে যেন গোসল করেছি এতটাই ঘেমে আছি, এই অবস্থায় চারপাশে তাকালাম আমি। ঠিক সেখানেই দাঁড়িয়ে আছি যেখান থেকে ঝাপ দিতে চেয়েছিলাম নীচে। আশেপাশে মানুষজন হাঁটছে, দূরপাল্লার বাসগুলো আয়েশি ভঙ্গীতে পার হচ্ছে ব্রিজ, ঐ যে রাস্তার ওইপাশে পুলিশের গাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে, নীচে একটা ট্রলার যাচ্ছে বালি বোঝাই হয়ে। সবই ঠিক সেই ঝাঁপ দেয়ার আগের সময়ের মতন। আস্তে করে নিঃশ্বাস ফেললাম আমি। যেভাবে ভেবেছিলাম সেভাবে কিছুই হল না। হয়তো ঝাপই দেই নি আমি। তার আগেই আমার মনের ভেতরের লুকিয়ে থাকা ভয় এসে আমাকে গ্রাস করে নিয়েছে। থরথর কাপতে থাকা হাত উপরে তুলে একটা সিএনজি ডাক দিলাম। আজ হল না। তবে কাল নিশ্চয়ই হবে। রিফাতকে আরেকটা দিন অপেক্ষা করতে হবে শুধু, এই যা।

সিএনজি বাসার সামনে দাঁড় করিয়ে রেখে উপরে গেলাম আমি। বাড়তি টাকা নেই নি সাথে। বাসা থেকে এনে দিতে হবে। লিফটটা ধীরে ধীরে উঠলো তিন তলায়। বের হয়ে এসে বাসার দরজার হাতল ধরে ঘুরালাম আমি। এ কি? দরজা বন্ধ! সর্বনাশ! ভুলে কি দরজা বন্ধ করেই বের হয়েছি আমি? এই রাতের বেলায় কিভাবে চাবিওয়ালা পাবো, দরজা ভাঙবো কি করে? সিএনজিওয়ালাকে ভাড়াও দিতে হবে। রাগের মাথায় দুম দুম করে দুই ঘা বসিয়ে দিলাম দরজার গায়ে।

"আসছি বাবা। কলিং বেলটা কি আবার নষ্ট হয়ে গিয়েছে নাকি?" দরজার ওইপাশ থেকে অস্পষ্ট ভেসে আসা কথাগুলো যেন জায়গায় জমিয়ে দিল আমাকে। পা দুটো শরীরের ভার আর রাখতে পারছে না, বন বন করে ঘুরছে মাথা। পাশের দেয়াল ধরে সামলালাম নিজেকে। পায়ের শব্দ এগিয়ে আসছে ধীরে ধীরে। তারপর দরজার ছিটকিনি খোলার শব্দ আর লকটা আস্তে আস্তে ঘুরে পুরোপুরি খুলে গেলো দরজা। আমি অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলাম দরজা ধরে দাঁড়িয়ে থাকা রিফাতের দিকে। গায়ে সবুজ রঙের গেঞ্জি, থ্রি কোয়ার্টার পড়ে দাঁড়িয়ে আছে রিফাত। হাতে আধখোলা বই। চুল উসকোখুসকো, দেখে বোঝা যাচ্ছে একটু আগে গোসল করেছে অফিস থেকে ফিরেই। কিন্তু চিরুনি আর লাগায় নি চুলে। ঠিক যেভাবে গত আড়াই বছর ধরে কতশত অসংখ্য বার আমি রিফাতকে দেখেছি, সেভাবেই আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে সে।

"কি হল? ভেতরে আসার জন্য কি..." কথা শেষ করতে পারলো না রিফাত। তার আগেই উড়ে গিয়ে ওর বুকে মাথা গুঁজে গত দেড় মাস ধরে জমিয়ে রাখা কান্নার ঝাঁপি খুলে দিলাম আমি।

"কি হয়েছে? কি হয়েছে অনু?" আমাকে জড়িয়ে ধরে উদ্বিগ্ন স্বরে রিফাত প্রশ্ন করে চলছে। ওর সান্ত্বনার স্পর্শ আমার পিঠে। এই একটু ছোঁয়ার জন্য কতটা তৃষিত ছিলাম আমি। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেই চললাম আমি। বাস্তব-অবাস্তব, সম্ভব-অসম্ভব এর সীমারেখা পার করে আমার রিফাত আমার কাছে ফিরে এসেছে। এতটুকুই চাই আমি। আর কিছু না। টুং করে শব্দের সাথে সাথে লিফটের দরজাটা খুলে গেলো। টের পেলাম আমাকে জড়িয়ে ধরে রাখা রিফাতের হাতগুলো শক্ত হয়ে গেল। ওর শরীরের মৃদু কম্পন টের পেয়ে ওর দিকে মুখ তুলে তাকালাম আমি। আর তারপর ওর চোখের দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকালাম আমার পেছনে। আমি দাঁড়িয়ে আছি আমার দিকে অবাক দৃষ্টি দিয়ে।

"রিফাত! এই মেয়েটা কে?" নিজের গলাটাকেই ভীষণ অচেনা লাগলো আমার কাছে যখন কিনা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছে আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা আরেক আমি।

----------------------------

রাত প্রায় বারোটা বাজে। ড্রইং রুমের বড় ঘড়িটা টিকটিক করে চলছে। আমার নিজের বাসার একটা ঘরও যে আমার কাছে অচেনা ঠেকতে পারে এমনটা কখনো ভাবি নি। ডিভানে আধশোয়া হয়ে ভাবছিলাম গত দুই ঘণ্টার কথা। বন্ধ বেডরুমের দরজার ওইপাশ থেকে ভেসে আসছে আবছা আবছা তোমাদের কথা। এবং সেই কথার মধ্যে টের পাচ্ছি তোমার গলার স্বরে আমার জন্য ভালোবাসা। এটাই তো তুমি। প্রমাণ করার মতন কিছু ছিল না আমার কাছে। মোবাইল নেই নি সাথে, পার্সও না। কিন্তু, আমার হাতের অনামিকায় ঠিকই জ্বলজ্বল করছিল আমাদের বিয়ের আংটি। গলায় ফিরাযাত্রায় পড়িয়ে দেয়া মা-র নিজের গলার চেইন আর লকেট। এগুলোই যথেষ্ট ছিল তোমার জন্য আমাকে চিনে নিতে। বিশ্বাস করেছ আমার কথা সেজন্য আমি কৃতজ্ঞ।

তুমি জানো আমার আর কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। তুমি জানো, আমিই অন্তরা। তোমার স্ত্রী। অথচ এখন আরেকটা আমির সাথে ঝগড়া করছ আমাকে নিয়ে। অদ্ভুত লাগছে এই কথাটা ভাবতে। আর ঐ অন্তরা, সে তো আমিই। আর আমি নিজেই জানি আমার মনে এখন কি কথা চলতে পারে। আমি অনেক বেশি ঈর্ষা কাতর। তোমাকে নিয়ে। আমি জানি আমাদের দুইজনের মধ্যে আদতে কোন পার্থক্য নেই। চেহারায়, গড়নে, চলনে, মননে। আজ থেকে এক সপ্তাহ, এক মাস পর তুমি কি আমাদের মধ্যে কোন পার্থক্য করতে পারবে? হয়তো না। হয়তো, এই আমি ঐ আমিকে সরিয়ে তোমার ওপর আমার একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করতে চাইবে। সেটাই স্বাভাবিক। নারী তো আমি।

কিন্তু, সত্যি কথা বলতে কি; সেরকম কোন ইচ্ছাই আমার নেই। আমি জানি, ঐ অন্তরাকে তোমার জীবন থেকে সরিয়ে দিতে চাইলে ওকে খুন করা ছাড়া আমার আর কোন উপায় নেই। অথচ, আমার মনে হয় না সেটা আমার দ্বারা আদৌ সম্ভব হবে। নিজের চোখের দিকে তাকিয়ে নিজেকে খুন করা কি কারো পক্ষে সম্ভব? হলেও হতে পারে। কিন্তু, আমি পারবো না। আমার জন্য এটাই অনেক পাওয়া। তোমাকে আরেকবার দেখতে পাওয়া, আরেকবার তোমার স্পর্শ পাওয়া, আমার নামটা তোমার মুখ থেকে আরেকবার শুনতে পাওয়া। সামনে কি হবে, ভবিষ্যৎ কি সাজিয়ে রেখেছে আমার জন্য তা নিয়ে একদমই ভাবছি না আমি। চোখ বন্ধ করে মৃদু হাসলাম আমি। তোমার কাছে চিরকালের জন্য চলে যেতে চেয়েছিলাম, তোমাকে পেয়েছি।

হঠাৎ করেই আশেপাশের সব শব্দ যেন হারিয়ে গেল। চমকে উঠে চোখ মেলে তাকাতেই দেখলাম আমার চারপাশের দেয়ালগুলো কিরকম আয়নার মতন ভেঙ্গে যাচ্ছে। আর সেই ভাঙ্গা আয়নার মধ্য দিয়ে একে একে হেঁটে প্রবেশ করলো চারজন মানুষ। মানুষ কি? অন্তত দুই হাত পা, মাথা আছে। আপাদমস্তক সাদা স্পেস স্যুটের মতন একটা ড্রেস পড়া। ড্রেসের ঠিক মধ্যখানে একটা সবুজ গোলক আকা। সেখান থেকে অসংখ্য রেখে বের হয়ে ছড়িয়ে গিয়েছে। হাতে অদ্ভুত ধরনের গ্লাভস, চোখের যায়গায় বড় বড় কাঁচ বসানো গগলস। ওইপাশে কি চোখ আছে, নাকি অন্য কিছু? মানুষ নাকি মানুষ অবয়বের অদ্ভুত কোন জিনিস বা প্রাণী। আমার ভুল ভেঙ্গে দিতে একজন সামনে এগিয়ে এসে ধীর গলায় বলে উঠলো, "আমরা দুঃখিত। এরকমটা হওয়ার কোন কথা ছিল না। আপনি প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়ম লঙ্ঘন করছেন। এই পৃথিবীতে আপনার থাকার কথা নয়। আপনাকে ফিরে যেতে হবে।"

দীর্ঘশ্বাস ফেললাম আমি। গত দুই ঘণ্টায় অনেক কিছুই ভেবেছি আমি। এরকমটা ভাবি নি। সত্যিই ভাবি নি। কিংবা এই তিতকুটে সত্যটা নিয়ে ভাবতে চাই নি। "আমি কোথায় আছি? আমি কি অতীতে ফিরে এসেছি? সময় পরিভ্রমণ বা এরকম কিছু? আর আপনার কারা?"

"কাছাকাছি। আপনি স্থান ও সময়ের মধ্যবর্তী একটি সুরঙ্গ দিয়ে অন্য এক সময়ে চলে এসেছেন। এ এমন এক পৃথিবী যেখানে আপনি বর্তমান আছেন। এবং আপনার স্বামীও জীবিত আছেন। আপনি একটি সমান্তরাল পৃথিবীতে আছেন বলতে পারেন। আর আমরা তারা, যারা এই স্থান-কালের অসংগতি নিয়ন্ত্রণে কাজ করি। আমরা বর্তমান, আমরা অতীত আবার আমরাই ভবিষ্যৎ। আমরা আছি আবার নেই। কিন্তু, নিয়ম তার যথাস্থানে থাকতে বাধ্য।"

প্রচুর মুভি দেখি আমি। বইও পড়ি। কাজেই ঠিক কি বলতে চাইছে আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটি তা কিছুটা হলেও বুঝতে পারলাম। দুইপাশ থেকে অন্য দুইজন এগিয়ে এসে আমার হাতে দুইটা ধাতব ব্রেসলেট পড়িয়ে দিল। ব্রেসলেট গুলো থেকে অনেকগুলো তার বেরিয়ে এসে যুক্ত হয়েছে আরেকটা যন্ত্রে। সেটা চাপিয়ে দেয়া হল আমার পিঠে। ধীরে ধীরে কাঁপছে যন্ত্রটা। "একটু স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবেন। অল্প কিছু সময়ের মধ্যেই আমরা আপনাকে প্রত্যর্পণ করবো আপনার নিজস্ব সময় ও পৃথিবীতে।"

তার এই কথা যেন আমাকে এক ঝাঁকিতে বাস্তবে ফিরিয়ে আনল। আর আমি সত্যিকার অর্থেই বুঝতে পারলাম কি ঘটতে চলেছে। "না না না। থামুন প্লিজ। থামুন। আমি এখান থেকে চলে যাবো। এই শহর থেকে চলে যাবো। অন্য কোন শহরে, অন্য কোন দেশে। আর কখনো রিফাতের আশেপাশেও আসবো না। কিন্তু আমাকে যেতে দিন প্লিজ। ওরা এই সময়টুকুর কথা ঠিক ভুলে যাবে। ভাববে কোন দুঃস্বপ্ন বা হ্যালুসিনেশন। কিন্তু আমাকে এই পৃথিবীতে থাকতে দিন প্লিজ। এখানে, যেখানে রিফাত আছে। আমার জন্য সেটাই যথেষ্ট। বিশ্বাস করুন। প্লিজ, প্লিজ।" ঝটকা দিয়ে ছুটে যেতে চাইলাম আমি কিন্তু আমার হাতের আর পিঠের যন্ত্রগুলো কি এক অদ্ভুত শক্তিতে আমাকে যেন একটা স্থানেই ধরে রাখল।

লোকটা এগিয়ে আসলো আমার দিকে। "আমি আসলেই দুঃখিত। কিন্তু, প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মের ব্যতিক্রম করা সম্ভব নয়। তাহলে সবকিছু ধ্বংস হয়ে যাবে। আমাদের মধ্যেই কোন একজন এই নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে আপনাকে এই পৃথিবীতে নিয়ে এসেছে। তাকে তার উপযুক্ত শাস্তি প্রদান করা হবে। কিন্তু আপনার এটা প্রাপ্য ছিল না। আমাদের ক্ষমা করবেন।"

আমার কপালে একটা ছোট্ট চারকোনা যন্ত্র চেপে ধরল একজন। সেটা থেকে হলুদ একটা আলোর রশ্নি বের হয়ে আস্তে আস্তে আমার সারা শরীর ঘিরে ফেলছে। বুঝতে পারছি আমার সময় শেষ হয়ে আসছে, তাই বলে উঠলাম আমি, "এক মুহূর্তের জন্য হলেও, আমাকে এই পৃথিবীতে আনার জন্য ধন্যবাদ। যিনি আমাকে এই সময়টুকু দিয়েছেন তাকে এই কথাটা বলে দেবেন।"

লোকটা ধীর গলায় বলে উঠলো, "আমি আপনার এই কথা তার কাছে পোঁছে দেব। বিদায়।"

তারপর হঠাৎ নিজেকে আবিষ্কার করলাম আমার ড্রয়িংরুমে। অন্ধকারের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছি। অঝোরে কাঁদছি।

----------------------------

এক বছর পরের কথা।

বারান্দায় বসে আছি আমি। হাতে একগাদা সস দিয়ে ভেজানো নুডলস, পাশেই কোল্ড ড্রিংক। গতকাল জ্যোৎস্না ছিল। তবে আজকেও অনেক চাঁদের আলো আছে। রাত একটা বাজে। আশেপাশের সব বাতি নেভানো। শহরটা ঘুমিয়ে গিয়েছে। আমি শুধু তোমার কথা ভাবছি। ভাবছি, এক বছর আগের কথা। সেই অদ্ভুত দিনের কথা। যাকে কোনভাবেই ব্যাখ্যা করা যায় না। অনেক বই পড়েছি, অনেক জানার-বুঝার চেষ্টা করেছি এই এক বছরে। এবং সত্যি বলতে একটা কথাই বুঝতে পেরেছি। বাস্তবতাটা কল্পনার চাইতেও গভীর ও চমকপ্রদ। এই পৃথিবী একা নয়। সে ছবি হলে, তার হাজারো প্রতিচ্ছবি আছে। হাজারো সম্ভাবনা, হাজারো বাস্তবতা, হাজারো তুমি। আর তার মধ্যে অনেক তুমি এখনো জীবিত। অনেক পৃথিবীতে হয়তো আমিই মৃত। আর তুমি একা। বারান্দায় বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে আমার কথা ভাবছ। ঠিক যেমন আমি ভাবছি তোমার কথা।

আমি ঠিক আছি। মেনে নিতে সময় নিয়েছি। কিন্তু মেনে নিয়েছি আমার নিজস্ব বাস্তবতাটুকু। আর বেঁচে আছি এই দ্বিতীয় জীবনে তোমার স্মৃতি সাথে নিয়ে। স্মৃতি বলা ঠিক হবে না। আমি বেঁচে আছি এই ভেবে যে অন্য কোথাও, অন্য কোন এক পৃথিবীতে তুমি ভালো আছো, সুখে আছো আমার সাথে। ব্যস, এটুকুই তো চাওয়া আমার।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে জুলাই, ২০১৯ রাত ১১:২৮
৮টি মন্তব্য ৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ব্লগটা তো ছ্যাড়াব্যাড়া হয়ে গেলো :(

লিখেছেন সাখাওয়াত হোসেন বাবন, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:৫৭



আমি আমার ব্লগিং শুরু করি প্রথম আলো ব্লগে লেখালেখির মাধ্যমে। ব্লগটির প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। কারণ প্রথম আলো ব্লগ আমায় লেখালেখিতে মনোযোগী হতে শিখিয়েছে । সে এক যুগ আগের কথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

লুঙ্গিসুট

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:২৪



ছোটবেলায় হরেক রঙের খেলা খেলেছি। লাটিম,চেঙ্গু পান্টি, ঘুড়ি,মার্বেল,আরো কত কি। আমার মতো আপনারাও খেলেছেন এগুলো।রোদ ঝড় বৃষ্টি কোনো বাধাই মানতাম না। আগে খেলা তারপর সব কিছু।
ছোটবেলায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখার মত মুফতি তাকি উসমানী সাহেবের কিছু কথা

লিখেছেন নতুন নকিব, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:২৫

স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখার মত মুফতি তাকি উসমানী সাহেবের কিছু কথা

ছবি কৃতজ্ঞতা: অন্তর্জাল।

একবার শাইখুল হাদিস মুফতি তাকি উসমানী দামাত বারাকাতুহুম সাহেবকে জিজ্ঞেস করা হল, জীবনের সারকথা কী? উত্তরে তিনি এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

=মৃত্যু কাছে, অথবা দূরেও নয়=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:০৭



©কাজী ফাতেমা ছবি
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দিয়ে বলি, আমারও সময় হবে যাবার
কি করে চলে যায় মানুষ হুটহাট, না বলে কয়ে,
মৃত্যু কী খুব কাছে নয়, অথবা খুব দূরে!
দূরে তবু ধরে নেই... ...বাকিটুকু পড়ুন

সবুজ চোখের মানুষের ধাঁধা

লিখেছেন করুণাধারা, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:২৯



এই ধাঁধার নাম সবুজ চোখের মানুষের ধাঁধা; নিচের লিংকে এটার ভিডিও আছে।

স্বৈরশাসকের বন্দী

এই ধাঁধাটি আমার ভালো লেগেছিল, তাই অনেক আগে আমার একটা পোস্টে এই ধাঁধাটি দিয়েছিলাম। কিন্তু সেই পোস্টে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×