প্রথম অংশটুকু পড়ে আসতে ক্লিক করুন এই লিংকে
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার কাহিনীটা বলতে শুরু করলো রীচার। আমিও চুপি চুপি একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। জেরা শুরু করার আগেই যা যা জানার ছিল রীচার বলে দিচ্ছে। কিংবা হয়তো এই এতগুলো পেইন-কিলারের প্রভাবে হঠাৎ মুখে খই ফুটছে ওর। বারে ভীষণ ভিড় ছিল কিন্তু সে একটা কোনা খুঁজে দেয়ালে পিঠ দিয়ে বসে ছিল। ফলে পুরো বারটাই এক নজরে দেখতে পাচ্ছিল এমনকি আসা-যাওয়ার জন্য যে দুটো দরজা আছে সেটাও ছিল দৃষ্টির সীমানার মধ্যেই। এসবই আসলে পুরনো অভ্যাস। সেনাবাহিনীর তদন্ত কাজের একটা লম্বা সময় তাকে বার-এ বসে সন্দেহভাজনদের ওপর নজর রাখতে হয়েছে। এই ফাঁকে একজন ওয়েট্রেস এসে তার অর্ডারটাও নিয়ে গিয়েছে। প্রথমে এক কাপ কফি আর তারপর বিয়ার, ব্যস। এক বোতল রোলিং রক। এমনিতে এ বিষয়ে রীচারের কোন বিশেষ পছন্দ নেই। যেখানে যা পাওয়া যায়, তাই সই।
আর তারপরই রীচারের চোখ গেলো বারে বসে থাকা ঐ বিশেষ লোকটার দিকে। একটু লম্বা, মোটাসোটা মতন দেখতে। গায়ের রংটা কালো তবে খুব ভারিক্কি একটা ভাব আছে লোকটার মধ্যে। বারে এমন আয়েশি ভাবে বসে ছিল যেন জানে তার আদেশ মানতে সবাই সদা প্রস্তুত থাকে। লোকটাকে দেখামাত্র রীচার তার বসার ধরনে পরিবর্তন আনল। এটাও স্বভাবজাত। এ হচ্ছে, ‘ভালো কিছু হলেও হতে পারে তবে খারাপটার জন্যই প্রস্তুত থাকো’- ভঙ্গী। অবশ্য এধরনের গুণ্ডাদের নিয়ে কখনোই খুব একটা ঝামেলা পোহাতে হয় নি রীচার-কে। এদের আচার-আচরণ এক রকম ছকে বাঁধা থাকে। লোকটা যে টুলে বসে আছে সেখান থেকে রীচারের কাছে পৌঁছাতে গেলে মাঝখানে বেশ খানিকটা জায়গা খালি আছে। ঝামেলা বাঁধলে ওই জায়গাটাতেই হবে। ঐ পর্যন্ত এসে লোকটা দাঁড়িয়ে যাবে আর তারপর চলবে হম্বি তম্বি, ফাঁকা আওয়াজ। খালি কলসি সবসময়ই বেশি বাজে। আসলে কি, এ ধরনের গুণ্ডাদের বদনামটাই হল আসল পুঁজি। আর যার কুখ্যাতি যত বেশি সে কাজের বেলায় ততটা ঠনঠন হয়ে থাকে। একসময় দেখা যায় তার নাম শুনেই লোকজন পালানোর পথ খুঁজতে থাকে আর সেটাই হয়ে দাঁড়ায় তাদের কাল। যে দক্ষতার কারণে এতটা নাম কামালো সেই দক্ষতায় মরচে পড়ে যায়। এক পর্যায়ে কোন কাজই আর ঠিকঠাক করতে পারে না এই ধরনের লোকগুলো, মারামারি তো নয়ই। একটা আস্তে করে ঠুকে দেয়া সিগারেট পাঞ্চই এইসব সমস্যার সবচাইতে সহজ ও দ্রুত সমাধান। সিগারেট পাঞ্চ আসলে আদ্যিকালের একটা জিনিস তবে কাজের। সেই যখন মানুষজন সিগারেট ফুঁকতে মাত্র শিখেছে। একটা সিগারেট টানা শেষে আরেকটা সিগারেট ধরিয়ে মুখে নেবে এখনই, মুখটা অর্ধেক খোলা, ঠিক ওই সময়টায় – একটা ফুটফুটে হাসি ছুঁড়ে দিয়ে হিসেব কষে ঠিকঠাক দড়াম করে মারা একটা বাঁ-হাতি আপারকাট, থুতনিটার একদম নীচ বরাবর। সময়টা মিলে গেলে দেখা যাবে দুই-তিনটা দাঁত এদিক সেদিক উড়ে গেল, হাঁ-হয়ে থাকা মুখটা ফট করে বন্ধ হয়ে গেল আর কপাল ভালো হলে দুই দাঁতের ফাঁকে আটকে কাঁটা পড়ে টুপ করে খসে গেলো জিহ্বার আগাটা। খেল খতম, পয়সা হজম। তাতে না পোষালে ঘাড়ের ঠিক ডান দিকে হাতের আঙুলের গাঁটগুলোকে শক্ত করে গদার মতন একটা বাড়িই যথেষ্ট হবে। কাজেই এসব ঝামেলা নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামায় না রীচার। কিছু ছোটখাটো সমস্যা অবশ্য আছে। যেমন এখনকার দিনে কেউ অন্তত এয়ারকন্ডিশন্ড করা বদ্ধ বারে বসে সিগারেট খায় না। অতএব ঘুষিটা মারতে হবে হারামিটা কথা বলতে থাকবে যখন, তখন। এভরিওয়ান টকস। আর এইসব গুণ্ডা-পাণ্ডাদের মুখ তো বন্ধই হতে চায় না। সারাক্ষণ মুখে খই ফুটছে হুমকি ধমকির, বিশেষ করে বিশ-পঁচিশ বার বলবে - ‘তুই চিনিস আমি কে?"
যাক, এত চিন্তার কিছু নেই। আশা করা যায় সময়টা আয়েসেই কেটে যাবে। কোন ঝামেলাই হবে না।
নিজের বিয়ারের লম্বা বোতলটা হালকা ঝাঁকিয়ে উপরের ফেনা যুক্ত অংশটায় চুমুক দিলো রীচার। অলস সময় কাটাতে এসেছে আর সেটাই করছে এখন। কিছুক্ষণ পর ওয়েট্রেস এসে তাকে জিজ্ঞাসা করল আর কিছু লাগবে কি না। বুঝাই যাচ্ছিল, এ আর কিছু না। খুচরো আলাপ শুরু করার আগে ভদ্রতা করে জানতে চাইছে আর কি। ওয়েট্রেসটা দেখতে শুনতে বেশ ভালোই। হয়তো, সেও একই কথা ভাবছিল রীচারকে নিয়ে। বয়সটা চল্লিশের কোঠায় কিন্তু দেখেই বুঝা যাচ্ছে ওয়েট্রেস হিসেবে একেবারে প্রথম শ্রেণীর এবং এটাই তার পেশা। ঐ কলেজ পড়ুয়া, পকেট খরচ যোগানোর চিন্তায় কাজে যোগ দেয়া তরুণীদের মতন নয় যারা আজ বাদে কাল অন্য কোথাও ভালো চাকরি পেলেই ফুড়ুৎ হয়ে যাবে। সে-ও ঐ লোকটার আশেপাশে যাচ্ছিল না, বরং এড়িয়েই চলছিল। লোকটাকে বারে দাঁড়ানো বারটেণ্ডার নিজেই সার্ভ করছে। অবশ্য এই ব্যবস্থায় যে সে বেশ খুশী সেটাও খুব স্পষ্টভাবে বুঝা যাচ্ছিল।
“ঐ লোকটা কে?” রীচার প্রশ্ন করলো।
“তোমার মতই আরেকজন কাস্টোমার।” স্বাভাবিকভাবেই উত্তর দিল ওয়েট্রেস।
“ওর নামটা জানো নাকি?”
“না। মানে ঐভাবে জানা নেই। আসলে সব কাস্টমারকে কি আর নাম-ধাম জিজ্ঞেস করা হয় নাকি?”
কথাটা বিশ্বাস করার কোন কারণই নেই। এইসব লোকদের নাম সব্বাই জানে। এবং সেটা এইসব লোকেরাই নিশ্চিত করে। নামটাই ওদের মূলধন।
“এখানে নিয়মিত আসে নাকি?” রীচার আবারো প্রশ্ন করলো।
“প্রতি সপ্তাহেই আসে। একবার করে।”
খুবই নিখুঁত ভাবে মেনে চলা নিয়ম। আর নিজের অভিজ্ঞতা থেকে রীচার জানে এরকম নিয়ম থাকা মানেই সেখানে কোন না কোন ঘাপলা আছে। কিন্তু, ওয়েট্রেস এ ব্যাপারে আর টুঁ শব্দটিও করতে রাজি ছিল না। তার বদলে সব সাদামাটা প্রশ্ন করতে শুরু করলো সে। শহরে নতুন আসলে নাকি? কোথা থেকে আসছ? কি করো? আর এইসব সাদামাটা প্রশ্নই রীচারের কাছে সবচাইতে ঝামেলার মনে হয়। উত্তর দিতে গিয়ে সবসময়ই কথা হাতরে বেড়ায় সে। সব শহরেই সে নতুন, সদ্য আসা আগন্তুক। কাজেই কোন নির্দিষ্ট শহর থেকে সে আসছে তা বলা যায় না, বড়জোর ঠিক আগের শহরটার নাম বলতে পারে সে। তবে সেটা কখনোই করে না রীচার। আর কাজ-কর্ম। তেমন কিছুই করে না রীচার। সারাজীবন সেনাবাহিনীতে ছিল সে। তার বাবা ছিলেন সেনাবাহিনীর একজন কর্মকর্তা, তারপর একসময় সে নিজেও সেনাবাহিনীর কাজে যোগ দেয়। তার বেড়ে ওঠা, শৈশব-কৈশোর কেটেছে পৃথিবীর নানা প্রান্তের সেনা ঘাঁটিতে। নিজের কর্মজীবনেও এক সেনা ঘাঁটি থেকে আরেকটায়, এভাবে সারা পৃথিবীতে চরকি কেটেছে সে। তারপর হঠাৎ করেই বেসামরিক জীবনে প্রবেশ করলো রীচার। এবং বুঝতে পারলো আর দশজন যেভাবে জীবন কাটায় সেভাবে জীবন কাটাতে গেলে স্রেফ পাগল হয়ে যাবে সে। কাজেই ঘুরে বেরাতে শুরু করলো রীচার। এক শহর থেকে আরেক শহরে, উদ্দেশহীন ভাবে। যেসব জায়গার আগে কখনোই যায় নি সে, পৌঁছে গেল সেসব নাম না জানা, অখ্যাত শহরে। এক দুই রাত হয়তো এক জায়গায় কাটায় তারপর আবার ছুটে চলে। বাড়তি কোন ব্যাগের ঝামেলায় যায় না, কোন নিয়মের ধার ধারে না, কোথাও পৌঁছানোর তাড়া নেই তার, গন্তব্য নেই। গুলতি থেকে ছুটে বের হওয়া গুলির মতন একমুখী জীবনযাপন। যেন এক যাযাবর। প্রথম প্রথম ভেবেছিল একসময় কোথাও থিতু হবে, এসব পাগলামি আর কয়দিন। বহু আগেই সে চিন্তা মাথা থেকে উধাও হয়ে গিয়েছে। এই জীবনটাই তার অস্তিত্বের পুরোটা জুড়ে আছে এখন।
সে পালটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল এইবার, “তা, ব্যবসাপাতি কেমন চলছে?”
ওয়েট্রেস কাঁধ ঝাঁকিয়ে হেলায় ফেলায় বলল চলছে ভালোই। তার মুখের ভঙ্গিমা আর কথার ধরনই বলে দিচ্ছিল যা সে বলছে তা সত্যি নয়। কারণ ওদের কাছেই সবসময় আসল খবরটা পাওয়া যায়। একাউন্টেন্ট কিংবা অডিটরদের খাতায় উঁকি মেরে যেই কথাটা জানা যায় না তা ওদের এক কথাতেই বুঝে ফেলা যায়। প্রতি সপ্তাহে মালিক যখন ওদের হাতে বেতন তুলে দেয় তখন মালিকের চিন্তাগ্রস্ত চেহারা দেখেই ওরা জেনে যায় ব্যবসার হালচাল আসলে খুব একটা ভালো নয়।
আর একথাতেই দ্বিতীয় ঘাপলাটা খুঁজে পেল রীচার। বাসস্ট্যান্ডের এতটা কাছে, একমাত্র বার হিসেবে দারুণ ব্যবসা করার কথা এদের। ব্যবসার ক্ষেত্রে জায়গাটাই প্রথম ও শেষ কথা। সেদিক দিয়ে এই বার একদম সেরা একটা জায়গায় অবস্থিত। আর স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে পুরোটা বার জুড়ে কাস্টমারের ছড়াছড়ি। সব টেবিলই বুকড। এমনকি বার কাউন্টারের সামনের টুলগুলোতেও কাঁধে কাঁধ লাগিয়ে মানুষজন বসে আছে, হাসছে, খাচ্ছে, পান করছে, আড্ডা দিচ্ছে। ঐ লোকটার দুই পাশের নিষিদ্ধ ঘোষিত তিন-চারটা টুল বাদে আর কি! চারপাশ থেকে ভেসে আসছে বোতল আর গ্লাসের টিং টিং শব্দ, কাঁচের প্লেটে কাঁটাচামচ আর ছুড়ির ঘষা খাওয়ার আওয়াজ। বার থেকে ঝড়ের গতিতে বোতল পোঁছে যাচ্ছে হাতে হাতে। আর পাঁচ-দশ-বিশ ডলারের নোটগুলোও ওইরকম দ্রুততায় ঝটপট পৌঁছে যাচ্ছে ক্যাশিয়ারের কাছে।
কাজেই রীচার একটু সময় নিয়ে চারপাশের পরিস্থিতি লক্ষ্য করতে থাকলো। একটা বিয়ারের বোতল শেষ হল, দ্বিতীয়টাও খতম হওয়ার পথে। ধীরে ধীরে চুমুক দিচ্ছিল সে, সময় নিয়ে। এক পর্যায়ে দরজা ঠেলে দ্বিতীয় একটা লোককে বারে প্রবেশ করতে দেখল সে। সাথে সাথেই বারের পরিবেশটা যেন একটু পালটে গেল। যেন সবাই জানে এখন কি ঘটবে কিন্তু কেউ সেটা নিয়ে কোন কথা বলতে রাজী না। মনে হচ্ছিল যেন আর কিছুক্ষণের মধ্যেই পর্দা উঠবে আর মঞ্চস্থ হবে সেই নাটকটি যার জন্য সবাই সারাটা বিকেল ধরে অপেক্ষা করছিল। বারে থাকা আর যেকোনো লোকের চাইতে এই সদ্য আগত ব্যক্তির পোশাক-আসাক অনেক বেশী ফিটফাট, ধোপদুরস্ত। দরজা খুলে ঢোকামাত্রই রীচার বুঝতে পেরেছিল সেই এই বারের মালিক। হাটতে হাটতে পরিচিত দুয়েকজন কাস্টমারের সাথে কুশল বিনিময় করলো সে, মুখে ধরে রাখা ভদ্রতাসূচক হাসি। কিন্তু, বুঝাই যাচ্ছে কোন একটা বিষয় নিয়ে চিন্তায় আছে সে, কিছুটা আনমনা। হাটতে হাটতে বারের পিছনে গেলো সে আর একটা ছোট্ট দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকল। খুব সম্ভবত মালিকের নিজস্ব অফিস সেটা।
দুই মিনিটের মধ্যেই আবার বাইরে বের হয়ে আসলো সে। হাতটাকে হালকা নীচে নামিয়ে নিজের শরীর দিয়ে আড়াল করে রেখেছে। কিছু একটা ধরে রেখেছে হাতে। বারটাও তাকে প্রয়োজনীয় আড়াল দিচ্ছে। বারটেন্ডারকে পাশ কাটিয়ে ঐ বিশাল-বপু লোকটার টুলের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো সে। একজন আরেকজনের দিকে তাকাল একমুহূর্তের জন্য, শুধু মেহগনি কাঠের নকশাকরা বারটা বাঁধা হয়ে রয়েছে দুইজনের মাঝে। সবাই অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। রীচার ব্যতীত।
কাজেই একমাত্র সেই দেখল ব্যাপারটা ঘটতে। নিজের হাতে থাকা জিনিসটা ঐ বিশেষ লোকটার হাতে তুলে দিল বারের মালিক। পুরো ব্যাপারটাই চটজলদি ও খুব স্বাভাবিকভাবে ঘটলো। তুখোড় কোন জাদুকরের হাতসাফাই দেখল যেন রীচার। টুলে বসে থাকা লোকটা জিনিসটা নিয়ে সোজা পকেটে চালান করে দিল। এই হাতে ছিল, এই নেই।
কিন্তু, এসব ম্যাজিক আগেও হাজারো বার দেখা আছে রীচারের।
একটা সাদা পেটমোটা খাম।
ভেতরে কি আছে কেউ না বললেও বুঝতে অসুবিধা হল না রীচারের। টাকা। এইমাত্র একটা চাঁদাবাজির ঘটনা প্রত্যক্ষ করলো সে।
লোকটা অবশ্য নড়ল না। নিজের সামনে থাকা মদের গ্লাসটয় আস্তে ধীরে চুমুক দিচ্ছে। যেন স্বাদটা মুখে লাগিয়ে রাখতে চাইছে সারারাতের জন্য। তার ক্ষমতা আছে। এইমাত্র সেটার প্রমাণও পাওয়া হয়ে গেছে তার। নিজেকে বিশাল একটা কিছু মনে করছিল নিশ্চয়ই। আসলে কিছুই নয় সে, বড়জোর একটা চামচা। এসব লোকদের কাজই হচ্ছে কথা পরে বলে আগে বরং গায়ের জোরে কাজ উদ্ধার করা। রীচারের এসব ব্যাপারে আর দশজনের চাইতে ভালো জানা আছে। এরকম ঘটনাতো আর এই প্রথম দেখছে না সে, এধরনের লোকদের সাথেও এটা তার প্রথম মোলাকাত নয়। এই পেটমোটা খামটা সোজা পৌঁছে যাবে হাত থেকে হাত হয়ে একেবারে রাঘব-বোয়ালের কাছে। আর ঐ চুনোপুঁটি তার বদলে টাকাগুলো থেকে একটা ছোট্ট অংশ পাবে, বেতন হিসেবে।
ওয়েট্রেস এসে জিজ্ঞেস করলো তিন নাম্বার রোলিং রকের বোতলটা খুলে নিয়ে আসবে নাকি রীচারের জন্য। রীচার মাথা নেড়ে নিষেধ করলো আর সেই সাথে জিজ্ঞেস করলো, “কি ঘটছে ঐখানে খুলে বল তো?”
“কোথায় কি ঘটছে?”
“তুমি ঠিকই বুঝেছ আমি কি জানতে চাইছি।”
ওয়েট্রেসের মুখে লজ্জা আর ক্ষোভের চিহ্ন ফুটে উঠল, যেন তার কোন ভীষণ গোপন কথা জেনে ফেলেছে রীচার। “আরও এক সপ্তাহ নির্ঝঞ্ঝাটে, শান্তিমত ব্যবসা করতে পারবো আমরা। কেউ এসে বারে ভাংচুর চালাবে না, কিংবা রাতের অন্ধকারে পুড়ে ছাই হয়ে যাবে না বারটা।“
“কতদিন ধরে চলছে এই ঘটনা?”
“বছর খানেক ধরে।“
“আর সবাই এটা মুখ বুজে সহ্য করে যাচ্ছে। কেউ কিছু করছে না কেন?”
“কি করবে? আমার মতন সবারই প্রাণের ভয় আছে তাই না।“
“সে আমারও আছে।“ রীচার বলল।
মৃদু হাসি ছুঁড়ে দিল ওয়েট্রেস রীচারের দিকে।
“বারের মালিক চাইলে কিছু করতে পারতো। দেশে আইন কানুন আছে বলেই জানি।” রীচার বলল।
“নাহ। মালিকেরও হাত-পা বাঁধা। পুলিশের কাছে যেতে হলে কিছু হলেও ঘটতে হবে। ধর, কেউ বেদম মার খেল। কিংবা প্রাণটাই খুইয়ে বসলো। কিংবা বারে আগুন লাগলো। এসব কিছু না ঘটলে আইন এদিকে ফিরেও তাকাবে না।"
“লোকটার নামটা কি?”
“সেটা জেনে তোমার কি কাজ?”
“কার জন্য কাজ করে লোকটা?”
নিজের হাতের দুই আঙ্গুল একসাথে করে মুখের সামনে নিয়ে ডান থেকে বামে টেনে চেন বন্ধ করার ভঙ্গী করলো ওয়েট্রেস। “আমার প্রাণের ভয় আছে। আর তার চাইতেও বড় কথা আমার একটা পরিবার আছে।“
রীচারের সামনে থেকে খালি বোতলটা নিয়ে বারের দিকে চলে গেল সে। এদিকে সামনে থাকা গ্লাসটা খালি হয়ে গিয়েছে কাজেই আস্তে ধীরে উঠে দাঁড়াল লোকটা। মদের দাম পরিশোধ করার কোন ইচ্ছেই দেখা গেল না তার মধ্যে, বারটেণ্ডার বা ক্যাশিয়ারও সেই টাকা চাওয়ার মতন গাধামি করলো না। দরজার দিকে হাঁটতে শুরু করলো সে। লোকজন দুইপাশে সরে গিয়ে জায়গা করে দিচ্ছে তাকে।
চেয়ারটা সরিয়ে রীচারও উঠে দাঁড়াল। দরজা খুলে বের হয়ে পিছু নিলো সে। লোকটার থেকে পনেরো হাতের মতন দূরত্ব বজায় রেখে হাঁটছে রীচার। দাঁড়ানো অবস্থায় এক নজরে লোকটাকে যাচাই করে নিলো রীচার। ছয় ফুট দুই ইঞ্চি লম্বা হবে। ওজন হবে দুইশ দশ পাউন্ডের মত। আর দশজনের চাইতে বেশ বিশাল দেখতে। তবে, রীচারের চাইতে না। বয়স অবশ্য রীচারের চাইতে কম, কিন্তু ঘটে যে তার মত অতটা বুদ্ধি ধরে না বুঝা যাচ্ছে। রীচারের মতন দক্ষ না, অতটা অভিজ্ঞতাও নেই। এমন কাউকে এখন পর্যন্ত খুঁজে পায় নি রীচার যে এসব দিক দিয়ে তার চাইতে সেরা। দুটো ব্লক পার হয়ে একটা নির্জন গলিতে ঢুকল লোকটা। রাস্তাটা বেশ অন্ধকার। হলুদ আলো আসছে দূরে থাকা একটা ল্যাম্পপোস্ট থেকে। এটাই সুযোগ।
গলা চড়িয়ে ডাক দিল সে, “এই যে।“
চট করে থেমে গেল লোকটা, ঘুরে দাঁড়াল। এতটা দূর থেকেও তার চোখের বিস্মিত দৃষ্টি পড়তে পারছে রীচার।
হেঁটে তার সামনে গিয়ে দাঁড়াল রীচার। “তোমার পকেটে যে খামটা আছে ওটার মালিক আসলে তুমি না। আমার মনে হয় ভুলে তোমার পকেটে চলে গিয়েছে খামটা। কাজেই আমি তোমাকে একটা সুযোগ দিচ্ছি ভুলটা ঠিক করার।“
লোকটা রীচারকে আগাগোড়া দেখে নিলো যেন আন্দাজ করতে চাইছে কে সেই লোক যে মাঝরাস্তায় থামিয়ে তাকে একথা বলতে পারে। “আমি বরং তোমাকে একটা সুযোগ দিচ্ছি। অন্যের ব্যাপারে নাক গলানো বন্ধ কর আর ভাগো এখান থেকে।“ কথাগুলো বলল ঠিকই লোকটা তবে গলায় কোন জোর নেই। বারের ভেতর সেই ছিল রাজা। কিন্তু এইখানে, রাস্তায়, রীচারের সামনে আর দশটা লোকের সাথে তার কোন তফাৎ নেই। জঙ্গলে রাজা একজনই থাকে আর এখানে সেটা রীচার।
শেষ পর্ব আছে এখানে!
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই আগস্ট, ২০১৯ রাত ৯:৩৬