নিয়ম দুই রকমের হতে পারে। লিখিত আর অলিখিত। আর চাকরির প্রথম দিনেই সেই নিয়মের ফাঁদে আটকা পড়ে গেলাম। কোন বইয়ে লেখা না থাকলেও সবাই জানে যে নতুন নতুন কাজে যোগ দেয়া গোয়েন্দার মতন দুর্ভাগা আর কেউ নেই। আর আমার ভাগ্য দেখা গেল আরও খারাপ। কারণ নিয়মে স্পষ্ট বলা আছে, বন্দুক যুদ্ধে আহত রোগীদের তথ্য পুলিশকে জানাতে হাসপাতালগুলো বাধ্য। আর আমরাও বাধ্য সেই ঘটনাগুলোর তদন্ত করতে। বিরক্তিকর কাজ। আর এসব কাজে কোন লাভও হয় না। তাও নিয়ম রক্ষার্থে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে গেলাম।
গাড়ীটাও পেয়েছি একেবারে মার্কামারা। কোন জিপিএস নেই, এমনকি একটা ম্যাপও খুঁজে পেলাম না গ্লাভ বক্সে। তবে তাতে হাসপাতাল খুঁজে পেতে কোন সমস্যা হল না। শহরের ঠিক বাইরে, দক্ষিণপশ্চিম কোনায় একটা হালকা খয়েরি রঙা বিল্ডিং। আমি আমার চকচকা আইডি কার্ড দেখিয়ে পৌঁছে গেলাম পাঁচ তালায়। আইসিইউ না তবে একই রকম বিশেষ সেবা দেয়া হয় এই তালায়। এমনকি ফোনটাও বন্ধ করতে হল, আবারও নিয়ম মানতে বাধ্য হলাম আর কি।
একজন নার্স এসে আমাকে দায়িত্বপ্রাপ্ত ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেল। কাঁচাপাকা চুল, বুদ্ধিদীপ্ত চোখ। নিশ্চয়ই একগাদা টাকা-পয়সা কামায় মানে দেখে সেরকমই লাগলো আর কি! প্রথমেই আমাকে একগাদা জ্ঞান দেয়া হল যে অযথা সময় নষ্ট করে নাকি হাসপাতালে এসেছি। রোগী ঘুমিয়ে আছে আর খুব তাড়াতাড়ি যে উঠবে তার কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। একগাদা পেইন কিলার আর ঘুমের ওষুধ দিয়ে রাখা হয়েছে রোগীকে। কিন্তু, নতুন চাকরি আর নিয়ম – এই দুইয়ের প্যাঁচে পরে আমাকে রিপোর্ট লিখে জমা দিতেই হবে কাজেই আমি তার মতামত চাইলাম পুরো ব্যাপারটা নিয়ে।
“বাম পাঁজরে গুলিটা লেগেছে। পাঁজরের একটা হাড় ভেঙেছে, কিছু মাংস ছিঁড়েখুঁড়ে বের হয়ে গিয়েছে গুলিটা।“ ছোট বাচ্চাদের ক্লাস নেয়ার মত করে বুঝাতে থাকল ডাক্তার। “জঘন্য ব্যাপার। একারণেই এত পেইন কিলার দিতে হয়েছে।“
“কত ক্যালিবারের গুলি? বলতে পারবেন?” আমি জিজ্ঞাসা করলাম।
“সে ব্যাপারে আমি কিছু বলতে পারবো না। তবে ছোটখাটো কোন বন্দুক বা এয়ার গান নয় সেটা নিশ্চিত।“
আমি রোগীকে দেখতে চাইলাম। “ঘুমন্ত একটা মানুষকে দেখে আপনার লাভটা কি হবে?”
“একটা রিপোর্ট লিখে জমা দিতে পারবো, সেটাই লাভ।“
জীবাণু সংক্রমণ হতে পারে তাই একটা কাঁচের জানালা দিয়েই আপাতত রোগীকে দেখতে হল। খাটে অঘোরে ঘুমিয়ে আছে। এক নজরে মনে ছাপ ফেলে যাওয়ার মতন দেখতে লোকটা। ছোট করে ছাঁটা এলোমেলো চুল। সাদামাটা চেহারা। কোমর পর্যন্ত কম্বল টেনে দেয়া। গায়ের উপরের অংশ খালি। শরীরের বাম দিকে বাহুমূলের ঠিক নীচেই ব্যান্ডেজ বাঁধা। হাতের মধ্যে কিছু ছোট ছোট টিউব এসে ঢুকেছে। আঙুলে একটা ক্লিপ লাগানো। পাশে রাখা মনিটরে জোরালো বিপ বিপ শব্দ আর রেখার উঁচুনিচু গতি তার জীবিত থাকার প্রমাণ দিচ্ছে। বিশাল দেহ। মনে হচ্ছে খাটের চাইতেও বুঝি বেশি লম্বা। কমপক্ষে ছয়ফুঁট পাঁচ ইঞ্চি, ওজন আনুমানিক ২৫০ পাউন্ড। দানবীয়। হাতের মুঠিটা বক্সারদের হাতের মতন সুদৃঢ়। পুরুষ হলে এরকমই হওয়া উচিত। সারা দেহে মাসল যেন একেবারে চেপে চেপে বসিয়ে দেয়া। বয়স্ক নয় আবার একেবারে তরুণও বলা যাবে না। দেখেই মনে হচ্ছে জীবনের সাথে প্রতিদিন যুদ্ধ করে লোকটা। সারা দেহে ক্ষতচিহ্ন। পেটে অনেক পুরাতন ক্ষত একটা তারার মতন আকৃতি নিয়ে আছে। মোটা, রুক্ষ ভাবে করা সেলাইয়ের দাগ। এমনকি বুকেও পুরাতন গুলির ক্ষত আছে। দেখেই বুঝা যাচ্ছে, .৩৮ ক্যালিবারের বুলেট। আটপৌরে জীবন কাটায় না লোকটা সেটা নিশ্চিত। ঐ যে বলে না, তুমি যদি মরে না যাও তবে সেই অভিজ্ঞতা তোমাকে আরও মজবুত করে তোলে।
কি আরাম করেই না ঘুমাচ্ছে! “ঘটনা কি ঘটে থাকতে পারে কিছু কি জানা আছে আপনার?” জিজ্ঞাসা করলাম।
“নিজে যে নিজেকে গুলি করে নি এটুকু বলতে পারি।“ ডাক্তার কিছুটা মজার সুরে বললেন। “অবশ্য মাথায় সমস্যা থাকলে ভিন্ন কথা।“
“না, মানে। কিছু বলে নি ঘুমিয়ে পড়ার আগে?”
“না। জ্ঞান ছিল পুরোটা সময় কিন্তু একটা কথাও বলে নি।“
“সাথে আইডি কিছু ছিল কি?” জরুরী প্রশ্নটা করে ফেললাম।
“রোগীর সব জিনিসই একটা ব্যাগে করে জমা রাখা আছে।“ ডাক্তার নিশ্চিত করলেন। “নার্সদের কাছে গেলেই পাবেন।“
একদম ছোটখাটো একটা ব্যাগ। স্বচ্ছ প্লাস্টিকের, জিপারসহ। ঐযে বাচ্চাকাচ্চারা পরীক্ষার হলে নিয়ে যায় সেরকম। কিছু খুচরা পয়সা। অনেকখানি টাকা একসাথে ভাজ করে রাবার ব্যান্ড দিয়ে পেঁচিয়ে রাখা। হাজার-দশেক বা তারও বেশি হবে। গুনলে বুঝা যাবে। একটা এটিএম কার্ড। আর একটা বহু পুরাতন পাসপোর্ট। একটা ভাঁজ করা যায় এমন টুথব্রাশ। মাথাটা আলগা করে আলাদা প্লাস্টিক টিউবে রাখা।
“ব্যস। এইকটা জিনিস?” আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম।
“আপনার কি মনে হয় আমরা রুগীদের জিনিস মেরে দেই?”
“আমি খুলে দেখলে সমস্যা নেই আশা করি?” বললাম।
“আপনি যেহেতু পুলিশ, সমস্যা একদমই নেই।“ ডাক্তার বলল।
এটিএম কার্ডটা কোন এক জে. রীচার-এর নামে করা। আরও বছর খানেক মেয়াদ আছে। পাসপোর্টের মেয়াদ অবশ্য আরও তিন বছর আগেই শেষ। নামটা জ্যাক রীচার। আমি ভেবেছিলাম জন হবে। নিশ্চয়ই এই নামেই জন্ম-সনদ করা হয়েছিল। কোন মিডল নেম নেই। আমেরিকায় এটা একটা বিরল ব্যতিক্রম বলা যায়। ছবির সাথে বিছানায় শুয়ে থাকা লোকটার চেহারার মিল সুস্পষ্ট। অবশ্য কমপক্ষে বারো-তের বছর আগেকার ছবি। ছবি দেখে মনে হচ্ছে শান্ত আর বিরক্ত হওয়ার একটা মাঝামাঝি অবস্থায় আছে লোকটা। মনে হচ্ছে ছবি তুলতে যতক্ষণ লাগবে ঠিক ততটুকু সময় শান্ত হয়ে বসে থাকতে পারবে, এর বেশি একটুও না।
কোন ড্রাইভার লাইসেন্স নেই, কোন ক্রেডিট কার্ড নেই, কোন মোবাইল ফোনও নেই।
“কি পড়া ছিল গায়ে?”
“ফুটপাথ থেকে কেনা সস্তার কাপড়।“” ডাক্তার নাক সিটকে জবাব দিল। “পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে।“
“কেন?”
“ভয়ংকর বাজে অবস্থা ছিল কাপড়গুলোর। যা গন্ধ ছড়াচ্ছিল না। রাস্তার ফকিররাও এর চাইতে ভালো কাপড় পড়ে।”
“ভবঘুরে নাকি?”
“বললামই তো, একটা কথাও বলে নি। ভবঘুরেও হতে পারে আবার ছদ্মবেশে থাকা কোটিপতিও হতে পারে। বলা মুশকিল।“
“এমনি দেখে তো বেশ সুস্থ-সবলই মনে হচ্ছে।“
“মানে, এভাবে গুলি খেয়ে ব্যান্ডেজ বেঁধে হাসপাতালে শুয়ে থাকা বাদে?”
“হ্যাঁ, সেটাই বলতে চাচ্ছিলাম।“
“হুম, একেবারে ঘোড়ার মতন শক্তিশালী, সুস্থ।“
“ঠিক কখন ঘুম থেকে উঠতে পারে?”
“আজ রাতে। আশা করা যায়। আমি ঘোড়ার মত করেই ঘুমের ওষুধ দিয়েছি।“
আমার শিফট শেষ হওয়ার ঠিক আগে আগে আবার হাসপাতালে গেলাম। এতটাও বেতন দেয় না আমাদের তবে চাকরিটা যেহেতু নতুন তাই একটু কাজ দেখানোর চেষ্টা আর কি। এমনিতে কোথাও কোন গোলাগুলির খবর পাওয়া যায় নি। অলিগলিতেও কোন কানকথা শোনা যায় নি। ৯১১ এ কোন ফোন আসে নি, কেউ কিছু দেখে নি, কেউ নিহত বা আহতও হয় নি। এসব অবশ্য স্বাভাবিক ব্যাপার এই শহরে। শহরটার একটা আলাদা সত্তা আছে যেন। অনেকটা ভেগাসের মতন। যা ভেগাসে ঘটে, তা ভেগাসেই থেকে যায়।
এছাড়া সব ডাটাবেজেও খোঁজ করেছি। রীচার নামটা অতটা প্রচলিত নয়। আর জ্যাক রীচার যে একেবারে অনন্য একটা নাম হবে সেটা ঠিক বুঝতে পেরেছিলাম। কিন্তু, কোন তথ্যই যেন খুঁজে পেলাম না। তথ্য না পেলেও যা পেলাম সেটাকে তথ্যের অভাব বলা যায়। কোন ফোন নেই, কোন গাড়ি বা নৌকা নেই, কোন ট্রেলার হোম নেই, কোন ঋণ, ঘরের ঠিকানা, ইনস্যুরেন্স পলিসি – একেবারে কিচ্ছুই নেই। কিছু সেনাবাহিনীর তথ্য অবশ্য ছিল। বহু পুরাতন। সেনাবাহিনীতে কাজ করতো এককালে। অভ্যন্তরীণ অপরাধ তদন্ত বিভাগে কর্মকর্তা হিসেবে, বেশ কয়েকবার পদকও পেয়েছে। প্রথমে দেখে একই ধরনের পেশায় থাকায় একটা আপন আপন ভাব আসছিল আর তারপর চিন্তায় পড়ে গেলাম। তের বছর ধরে সেনাবাহিনীর গৌরবময় অংশ ছিল লোকটা। আর এখন একজন ভবঘুরে, পাঁজরে গুলি খেয়ে হাসপাতালে শয্যাশায়ী। আর যাই হোক, কোন নতুন কাজে যোগ দেয়া গোয়েন্দা নিজের প্রথম দিনের প্রথম কাজে এমন চরিত্রের মুখোমুখি হতে চাইবে না তা নিশ্চিত।
হাসপাতালে পোঁছাতে পৌছাতে রাত হয়ে গিয়েছিল। পাঁচ তালায় গিয়ে অবশ্য দেখলাম বিছানায় সজাগ বসে আছে রীচার। আমি নাম জানতাম, তাই আমার পরিচয়টাই আগেভাগে দিলাম। সেই সাথে বিনয়ের সাথে বললাম যে এমন ঘটনায় একটা রিপোর্ট লিখে জমা দিতে হয় যেটা এক্ষেত্রে আমার দায়িত্ব আর তাই তাকে বলতে হবে যে ঠিক কি ঘটেছিল তার সাথে।
নির্লিপ্ত ভাবে সে জবাব দিল, “আমার কিছুই মনে নেই।“
এটা স্বাভাবিক। অনেকসময় এরকম ঘটনায় পাওয়া আঘাত থেকে সাময়িকভাবে স্মৃতিভ্রষ্ট হয়ে যায় মানুষ। কিন্তু, ওর কথা আমার বিশ্বাস হল না। বুঝাই যাচ্ছিল বানোয়াট কথা বলছে। একারণেই ওর ব্যাপারে কোথাও কিছু পাওয়া যায় নি। এরকম ধরাছোঁয়ার বাইরে কেউ থাকতে চাইলে সে ভীষণ সতর্ক হবে কথাবার্তায়। তবে আমিও কম কিছু নই। এমনি এমনি এই চাকরিটা পাই নি আমি। তুখোড় জেরাকারী হিসেবে আমার সুখ্যাতিই আমাকে এখানে পৌঁছে দিয়েছে। এধরনের চ্যালেঞ্জ আমার ভালোই লাগে। আর তাতে আমিই জিতি সবসময়। আমার এক প্রাক্তন একবার আমাকে বলেছিল আমার ভিজিটিং কার্ডে নাকি লিখে রাখা উচিত, “এভরিওয়ান টকস!”
কাজেই আমি বললাম, “আমাকে একটু সাহায্য করতে হবে যাতে কিছু হলেও লিখতে পারি রিপোর্টে।“
রীচার তার স্বচ্ছ নীল চোখে আমার দিকে তাকাল। ঘোড়ার মতন পেইন কিলার দেওয়ার পরও তার চিন্তাশক্তি এখনো পরিষ্কার সেটা বুঝা যাচ্ছিল। ওর চোখের বন্ধু-ভাবাপন্ন দৃষ্টিতে কোন শঙ্কা নেই। একই সাথে ঠাণ্ডা ও বিপদজনক দৃষ্টি। অনেক কিছুই জানে সে, পুরাতন ধ্যানধারণার একজন মানুষ - বুঝা যায়। আবার এক উষ্ণ আবেগ আছে তার চোখে, যেন শিকারের জন্য ওত পেতে আছে। মনে হচ্ছে একশোটা উপায় জানে সে আমাকে সাহায্য করার আর একশো একটা উপায় জানে আমাকে খুন করার।
আমি সাফাই গাইলাম। “আমি এই কাজে নতুন। আজই যোগ দিলাম। আর আজকেই যদি কাজে ভজকট ঘটাই তবে লাথি মেরে আমাকে বের করে দেবে।“
সে মৃদু হাস্যে বলল, “তোমার মতন সুন্দরীকে লাথি মেরে বের করার সাহস হবে নাকি আদৌ কারও?”
চাকরিতে থাকলে এরকম কথায় সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্টের কেস খেয়ে যেত রীচার সন্দেহ নেই। কিন্তু হাসপাতালের এই বিছানায় আহত আর অসহায় শুয়ে থাকা হ্যান্ড-সাম রীচারের মুখ থেকে বের হওয়া কথাগুলো শুনতে খারাপ লাগলো না খুব একটা।
“তুমিও গোয়েন্দা ছিলে, সেনাবাহিনীতে। তোমার ফাইলে দেখলাম। নিশ্চয়ই অন্য অনেক গোয়েন্দার সাথে কাজ করেছ। অনেককে ঝামেলার হাত থেকে বাঁচিয়েছ। ঠিক কিনা?’
“আমার কাজের একটা অংশ ছিল সেটা।“
“তাহলে এবার আমাকেও এই ঝামেলা থেকে বাঁচাও।“
চুপ করে থাকলো রীচার।
“গণ্ডগোলটা শুরু হল কি করে সেটা আগে বল।“
“রাত কটা বাজে দেখেছো? বাসায় যাওয়ার তাড়া নেই নাকি তোমার?” রীচার বলল।
“সে তো তোমারও নেই।“
আবারও চুপ।
“কিভাবে গুলি খেলে, বল তো।“ আমি আবারও প্রশ্ন করলাম।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রীচার কথা বলতে শুরু করলো। অন্যদের মতন সেই একই বুলি যে সে কোন ঝামেলায় জড়াতে চায় না। কিংবা ঝামেলাটা অন্তত সে শুরু করে নি। যেসব জায়গায় সে সাধারণত যায় সেসব জায়গা নিরিবিলি দেখেই যায়। আর সেখানে কিছুই ঘটে না বলার মতন। অন্তত বেশিরভাগ ক্ষেত্রে।
আমি তাকে আরেকটু বিস্তারিত বলতে অনুরোধ করলাম।
সে বলল মফস্বল হোক কিংবা বড় শহরে, সে নিজের মত চলাফেরা করে কারো সাত-পাঁচে না থেকে। নিজের মতন খায়, ঘুমায়। গোসল করে, নতুন কাপড় পড়ে আবার নতুন গন্তব্যে ছুটে চলে। দেখে সবই কিন্তু কিছুতে নাক গলায় না যেচে পড়ে। কখনও কখনও কারো কারো সাথে এক দুই ঘণ্টা কথা-বার্তা চলে। অনেকের সাথে হয়তো এক-দুই রাতের জন্য সময় কাটায়। কিন্তু এছাড়া আর কিছু নয়। একদম নিস্তরঙ্গ জীবন তার। দিন-সপ্তাহ-মাস কিভাবে কেটে যায় তার কোন হিসেব রাখার প্রয়োজনই নেই তার কারণ সবই সেই একই রকম, ঘটনা বিহীন।
এক দুইবার ঝামেলা যা হয়েছে, অন্য লোকের কারণেই শুরু হয়েছে। আর এমন লোক খুঁজে পাওয়া যায় বার কিংবা ডাইনার কিংবা রেস্তোরায়। যেখানে খাবার আর পানীয়ের জন্যে যেতেই হয়। আর সেখানে খাবার চিবাতে চিবাতে আর মদের গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে কারো চোখে না পড়েও চুপচাপ শুধু মুখ বুজে খাওয়া যায়।
কারণ সবসময় কথায় সবকিছু বুঝানো যায় না। চোখের ভাষাটাই আসল। মানুষের চোখে তাকিয়ে বুঝতে হয়। আরও সোজা ভাষায় বলতে গেলে, দেখা যায় অনেকেই চোখ তুলে তাকাচ্ছে না। কোন একজন নির্দিষ্ট মানুষের দিকে কেউ চোখ তুলে দেখছে না। হয়তো মানুষটা একা বারে বা টেবিলে বসে আছে আর লোকজন তাকে এড়িয়ে চলছে। কারণ একটাই, তাকে ভয় পাচ্ছে সবাই। কোন ধরনের গুণ্ডা। সবাই তাকে অপছন্দ করে আর সে নিজেও সেটা জানে। সে জানে তার আশেপাশে আসলে মানুষের মুখের বুলি বন্ধ হয়ে যায়, অন্যদিকে তাকিয়ে তার চাউনি এড়াতে চায় আর সেটা সে পছন্দ করে, ভালোবাসে। ক্ষমতার স্বাদ মদের মতন অনেকটা, নেশা ধরায়।
“তার মানে গতকাল এমনটাই ঘটেছিল?” আমি প্রশ্ন করলাম।
রীচার মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো। বারে ঠিক এরকমই একটা লোক ছিল। রীচার এর আগে এই বারে কোনকালে যায় নি, বারের কাউকে চেনার প্রশ্নই ওঠে না। এমনকি এই শহরেও আগে আসা হয় নি রীচারের। সারাদিন আন্তঃনগর বাসে বসে দিনশেষে এই শহরে এসে নেমেছিল। আর বাস স্ট্যান্ড থেকে দুই ব্লক দূরে অবস্থিত বার-টাকে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎই খুঁজে পেয়েছিল। অবশ্য জানা কথা যেকোনো শহরের বাসস্ট্যান্ডের কাছে ধারে এরকম বার থাকবেই। সে ভেতরে গিয়ে একটা কোনায় জায়গা খুঁজে বসেছিল। ওয়েটারের জন্য অপেক্ষা করছিল। বারে গিয়ে বসলেই বারম্যানের সাথে খুচরা কথাবার্তা বলতে হয় আর সেটার একদম ইচ্ছে করছিল না ঐ মুহূর্তে।
আমি থামিয়ে দিলাম, “দাঁড়াও দাঁড়াও। তুমি আন্তঃনগর বাসে করে এসেছিলে?”
রীচার আবারও মাথা নাড়ল। আমাকে অবশ্য আগেই সেটা বলেছে। তার চোখ দেখে ওর সেই পুরাতন পাসপোর্টের ছবিটার কথা মনে পড়লো আমার। যেন একটা সময় পর্যন্ত ধৈর্য ধরতে রাজি। আর চাইছে সারা পৃথিবী তার সাথে তাল মিলিয়ে চলবে।
আমি প্রশ্ন করলাম, "তা কোথা থেকে বাসে উঠা হয়েছিল?”
“সেটা জানার কি আদৌ কোন দরকার আছে?”
“কোন শহর থেকে আসছ তুমি?”
“এই শহরের মতই অন্য কোন এক শহর থেকে। কোথাও না কোথাও তো রাতটা কাটাতে হয় আমার।“
“এই শহরেই কেন?”
“ভেবেছিলাম এক দুইদিন থাকা যাবে শান্তি মতন। কিংবা এক দুই ঘণ্টা।“
“তোমার ফাইল বলছে তোমার কোন স্থায়ী ঠিকানা নেই।“
“একদম ঠিকই বলছে। আর সেটা তো খারাপ কিছু নয়। তাই না? অন্তত আমার কথার সাথে মিলে যাচ্ছে ফাইলের রেকর্ড।“
“ঠিক আছে। আগে বল গতকাল বারে এরপর কি হয়েছিল।“
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার পুরো কাহিনীটা বলতে শুরু করলো রীচার।
পরের অংশটুকু পড়তে ক্লিক করুন এইখানে
(অনুবাদকের কথাঃ অনুবাদ শুনেছি দুই রকমের হয়। আক্ষরিক অনুবাদ আর ভাবানুবাদ। আর এছাড়া হয় এডাপ্টেশন। আক্ষরিক অনুবাদ মানে অক্ষর ধরে ধরে অনুবাদ। তাতে ভাষান্তর করায় শুধুমাত্র দুই ভাষার ফারাকের কারণে লেখার আসল মজাটা পাওয়া যায় না। আর ভাবানুবাদে অনেক বেশি এদিক-সেদিক হয়ে যাওয়ায় দেখা যায় লেখার আসল মজাটা পাওয়া যায় না। আর এডাপ্টেশনের সমস্যা হল সব গল্প তো আর দেশের প্রেক্ষিতে চেনা শহরের কাঠামোয় লেখা যায় না। তাই দেখা যায় খামতি। আমি তাই সম্পূর্ণ নতুন পথ খুঁজে নিলাম। ছায়া-অনুবাদ। অক্ষরে অক্ষরে না হলেও মূল ভাব অবিকৃত রেখে, মূল কাহিনী অনুসরণ করে, কোন জায়গায় দুই লাইন বেশী লিখে, কোন জায়গায় কম – আসল স্বাদটুকু তুলে আনতে। দেখা যাক, কতদূর কি হয়।)
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই আগস্ট, ২০১৯ সন্ধ্যা ৬:৪৭