দেশ স্বাধীনের ৪১ বছর হয়ে গেলেও মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল সামাদের মুক্তি সংগ্রাম এখনো থেমে নেই। সহায় সম্বল হারিয়ে এখন তিনি ঘুরছেন পথে পথে। পৈত্রিক সম্পত্তি ফিরে পেতে তাঁর বেদনাদায়ক আর্ত-চিৎকার যেন শোনার কেউ নেই। দৃষ্টি ও কর্নপাতবিহীন সমাজের মাঝে তবুও তিনি হার মানতে রাজি নন। ‘জীবন বাজি রেখে যখন দেশকে শত্র“মুক্ত করতে পেরেছেন, তবে কেন নিজ ভুমিকে দখলমুক্ত করতে পারবেন না’- এই আশায় দখলদারদের কাছ থেকে পৈত্রিক সম্পত্তি মুক্ত করে আনতে অকুতোভয় সৈনিক আব্দুল সামাদের মুক্তি সংগ্রাম প্রতিনিয়তই চলছে অবিরাম। এ যেন তাঁর ‘কুড়েঘরে থেকে মুক্তির লড়াই’।
মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলার সিন্দুরখান ইউনিয়ন। শ্রীমঙ্গল শহর থেকে ৭ কিলোমিটার দূরবর্তী ৪নং সিন্দুরখান ইউনিয়নের ৮নং ওয়ার্ড জানাউড়া গ্রামের ভেতর দিয়ে প্রায় দেড় কিলেমিটার কাঁচা রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে সহসাই চোখে পড়ে একটি কুড়েঘর। কুড়েঘরের সামনে এক কোণে একটি চিকন বাঁশের ডগায় বাধা একটি ছোট্ট জাতীয় পতাকা উড়তে দেখে চলার গতিতে থেমে যায় পা। শীতের সকালে ঠান্ডা হিমেল বাতাসে ভাসা মৃদু কুয়াশার আড়ালে কুড়েঘরের ভেতর থেকে মানবকণ্ঠে কাশির শব্দ শোনা যাচ্ছিল। এ দৃশ্যপট দেখে সহজেই বুঝে নেওয়া যায় যে, এটিই মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল সামাদের কুড়েঘর। লোকমুখে শোনা কথা আর বাস্তবতাকে মিলিয়ে নিতে তাই হুট করেই ঢুকে গেলাম কুড়েঘরের ভিতরে। কথা হয় মুক্তিযোদ্ধা সামাদের সাথে।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন মো. আব্দুল সামাদ ৪নং সেক্টর কমান্ডার সি.আর. দত্তের নেতৃত্বে ও কোম্পানী কমান্ডার ইনামুল হকের তত্ত্বাবধানে যুদ্ধ করেন। মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট কর্তৃক প্রদত্ত তাঁর মুক্তি কার্ড নং ২৩২৩। তিনি পাকিস্তান মুজাহিদ রেজি. নং- ১২৮২৭৭ এর বদৌলতে মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং ইনস্ট্রাক্টর হিসেবে মুক্তিসেনাদের প্রশিক্ষণ প্রদান করেন।
মুক্তিযোদ্ধা সামাদ ছিলেন তৎসময়ের এক সম্ভ্রান্ত ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান। তাঁর পিতা মৃত আঞ্জু মোল্লার বিশাল ভূ-সম্পত্তি মুক্তিযুদ্ধের পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানী দুসর ও রাজাকার বাহিনীর সদস্যসহকারে অন্যান্য লুটেরা লুট করে নিয়েছে। এলাকার দুঃখী মানুষের কল্যাণে আঞ্জু মোল্লার এই বিশাল ভূ-সম্পত্তির একটা অংশ তিনি নিজেই দান করে গেছেন। অনেকটা আবার বিক্রি করে ফেলেছেন উত্তরসূরীরা। সর্বশেষ উপজেলার জুলেখানগর চা-বাগান সংলগ্ন লাইংরাছড়া মৌজার জেএল নং ৯৯ তে ১০৭ দাগের ১০নং খতিয়ানের ৬ একর ৪২ শতক পাহাড়ী জমি সরকারি খাসজমিতে রুপান্তর দেখিয়ে লীজ দিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করলেন মুক্তিযোদ্ধা সামাদ।
বর্তমানে সহায় সম্বল হারিয়ে একেবারে নিস্বঃ জীবন যাপন করছেন অবহেলিত মুক্তিযোদ্ধা সামাদ। গ্রামের মাধ্যভাগ দিয়ে বয়ে যাওয়া রাস্তার পাশে ছোট্ট একটি কুড়েঘরে বাস করেন আর ভিক্ষাবৃত্তিতেই জীপন পালেন তিনি। যুদ্ধ পরবর্তী সম্পত্তির অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে অনেকটা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলায় স্ত্রী-সন্তান, আত্মীয়-স্বজন এমনকি প্রশাসন পর্যন্ত তাঁকে তেমন গুরুত্ব দিচ্ছেন না। তবুও দখলদারদের উচ্ছেদ করে পৈত্রিক সম্পত্তিতে অধিকার প্রতিষ্ঠার চেষ্টায় তাঁর নেই বিন্দুমাত্র ত্র“টি।
জানাউড়া গ্রামের বাসিন্দা হাজী মো. জাফর উল্ল্যার ছেলে মো. মফিজ মিয়া (৫৫), মৃত আব্দুল নূরের ছেলে মো. হারিছ মিয়া (৪০), মৃত. জিরাই মিয়ার ছেলে মো. জালাল মিয়া (৪৫), মৃত হাজী আশ্বাদ উল্ল্যার ছেলে হাজী মো. জাফর উল্ল্যা (৯০), মৃত রহিম উল্ল্যার ছেলে সাবেক ওয়ার্ড সদস্য মো. মহিব উল্ল্যা (৮০) প্রমুখ ব্যক্তিরা এই প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল সামাদের জীবনের করুণ কাহিনীর বর্ণনা দিলেও সিন্দুরখান ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল হেলাল নিতান্তই হাস্যজ্জ্বল মুখে তাঁর মানবেতর জীবন যাপনের কথা স্বীকার করে কেবল সরকারি সহযোগিতা কামনা করলেন।
মুক্তিযোদ্ধা সামাদ কুড়েঘরে থেকে করে মুক্তির লড়াই
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
বিজয়ের আগে রাজাকারের গুলিতে নিহত আফজাল

ঘটনা স্থল গাইবান্ধা জেলার ফুলছড়ি থানার উড়িয়া ইউনিয়নের গুণভরি ওয়াপদা বাঁধ।
১৯৭১সালের ১৬ই ডিসেম্বরের কয়েক দিন আগের ঘটনা। আফজাল নামের ভদ্রলোক এসেছিলেন শ্বশুর বাড়ি বেড়াতে। আমাদের পাশের গ্রামেই তার... ...বাকিটুকু পড়ুন
৫৫ বছর আগে কি ঘটেছে, উহা কি ইডিয়টদের মনে থাকে?

ব্লগের অনেক প্রশ্নফাঁস ( Gen-F ) ১ দিন আগে পড়া নিউটনের ২য় সুত্রের প্রমাণ মনে করতে পারে না বলেই ফাঁসকরা প্রশ্নপত্র কিনে, বইয়ের পাতা কেটে পরীক্ষার হলে নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন
নিজামী, মুজাহিদ, বেগম জিয়াও বিজয় দিবস পালন করেছিলো!!

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বেগম জিয়ার মুরগী মগজে এই যুদ্ধ সম্পর্কে কোন ধারণা ছিলো না; বেগম জিয়া বিশ্বাস করতো না যে, বাংগালীরা পাকীদের মতো শক্তিশালী সেনাবাহিনীকে পরাজিত করতে পারে;... ...বাকিটুকু পড়ুন
১৯৭১ সালে পাক ভারত যুদ্ধে ভারত বিজয়ী!

দীর্ঘ ২৫ বছরের নানা লাঞ্ছনা গঞ্জনা বঞ্চনা সহ্য করে যখন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বীর বাঙালী অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে বীরবিক্রমে যুদ্ধ করে দেশ প্রায় স্বাধীন করে ফেলবে এমন সময় বাংলাদেশী ভারতীয়... ...বাকিটুকু পড়ুন
ইন্দিরা গান্ধীর চোখে মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক: ওরিয়ানা ফলাচির সাক্ষাৎকার থেকে

১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইতালীয় সাংবাদিক ওরিয়ানা ফলাচি ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাক্ষাৎকার নেন। এই সাক্ষাৎকারে মুক্তিযুদ্ধ, শরনার্থী সমস্যা, ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক, আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদী পররাষ্ট্রনীতি এবং পাকিস্তানে তাদের সামরিক... ...বাকিটুকু পড়ুন

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।