প্রথম দর্শনে ওটাকে নরক বলে চিনতে পারিনি । বোনটা যখন বিছানায় পড়ল, তড়িঘড়ি করে অ্যাডমিট করলাম, গিয়ে দেখি পূর্বের অভিজ্ঞতার তুলনায় এ তো প্রায় স্বর্গ ! পাঁচতলায় অবস্থিত ওয়ার্ডটায় জানালার পাশে সবচে খোলামেলা পরিচ্ছন্ন বিছানাটা । এর কদিন আগে দেখেছিলাম কলেরা হাসপাতাল (আমি অ্যাডমিট হইনাই)। সেই বিভৎস স্মৃতি মনে করে শিউরে উঠলাম । বাথরুমটাও পরিচ্ছন্ন । হাই-কমোড । বাহ !
জীবনে কোনদিন হাসপাতালে ভর্তি হইনাই । আমার অসুখ-বিসুখ খুব কমই হয় । কত পঁচা-বাঁসি-রাস্তার খাবার খেলুম । অন্যরা যা খেয়ে সঁটকে গেল , আমি তাই খেয়ে অট্যহাস্য করেছি । রাস্তার চটপটি ফুচকা গোগ্রাসে গিলেছি , রিক্সাওয়ালা মামাদের সাথে চায়ের দোকানে চা খেয়েছি ।
একবার হলো কি, খুব সকালে পরীক্ষা দিতে যাচ্ছি । সারাদিন পরীক্ষা চলবে । আম্মু নাশতা বানায় দেয়ার সময় পায়নাই । বললো আমি যেনো দোকান থেকে পরোটা-টরোটা কিছু কিনে নিয়ে যাই । আমি গিয়ে দেখি রাস্তার দুই পাশে দুই পরোটার দোকান । প্রচন্ড গতিতে পরোটা বানানো চলছে । একজন ক্রমাগত ঘাম মুছছে আর পরোটা বানাচ্ছে । অন্যজন একটু পরপর নাক পরিস্কার করছে আর পরোটা বানাচ্ছে । আমি খুব চিন্তায় পড়ে গেলাম । কোন দোকান থেকে পরোটা কেনা উচিৎ !!!? অনেক ভেবে শেষ পর্যন্ত যে ব্যাটা ঘাম মুছছে তার কাছ থেকে পরোটা কিনলাম ।
তো বুঝতেই পারছেন আমার মন কত লৌহকঠিন
এ হেন আমি কি না সামান্য জ্বরে চিৎপটাং ? তা হবেনা । জ্বর ব্যাটাকে আমি থোড়াই কেয়ার করি । প্রথম ২ দিন মোটামুটি জ্বর নিয়ে অফিস করলাম ( কেউ টেরও পায়নাই ) । তারপর দিন প্রবল জ্বর নিয়ে সামুতে একখানা পোস্ট দিলাম । সেই পোস্টের পরিণতি কি হইলো বুঝার আগেই আমি কাইত । পরে ডাক্তারগণ আবিস্কার করছিলো আমার হইছে হাম ! থুক্কু , ডেঙ্গু, ....... থুক্কু , হাম....থুক্কু .....কি যে হইছে তা কেউ জানেনা !!!! শেষ দিনটা পর্যন্ত প্রায় ১০ জন ডাক্তার এই হাম থুক্কু ডেঙ্গুর খেলা খেললো অবশেষে এক বৃদ্ধ বদ্যিবাবা আসিয়া কহিলেন , বসন্তরা সাত বোন । তাহাদের ৪ জনকে চিনা গিয়াছে বাকি ৩জন অদ্যাবধি অনাবিস্কৃত !! আমারে যে ধরিয়াছে সে এই ৩ বোনের কোন একজন , হামের হামসকল (লুক-অ্যালাইক) ।
অবশ্য আমার আব্বা দাবী করিল যে , কিছুদিন আগে হামহাম ঝর্ণা পরিদর্শনে যাওয়ার ফলেই নাকি আমার এই দুর্গতি !
হাসপাতালে ভর্তি হবার আগের দিন। সারা গায়ে বিচ্ছিরি রকম হাম গজিয়ে উঠল । সে যে কি ভয়ংকর অনুভূতি বাপু , তোমার না হলে তা বুঝবে না । নিজের চেহারা দেখে আতংকে পরদিন সকালে ভিরমী খেলাম । টের পাচ্ছিলাম আমার শরীরে বিন্দুমাত্র শক্তি আর অবশিষ্ট নেই । কারন আগের ৩ দিন শুধু পানি ছাড়া আর কিছুই খাওয়া হয়নি । আমার বোনেরও এই অবস্থা হয়েছিলো । ওকে স্যালাইন দিয়ে রাখা হয় । আমি মিনমিন করে আব্বুকে বল্লাম , আমাকেও স্যালাইন দাও । আমি মুখে কিছু খেতে পারবো না ।
আমি ভেবেছি স্যালাইন দিলে বুঝি আর কিছু খেতে লাগেনা । মনে হয় ক্ষুধাও লাগেনা । ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে অসুখের সময়টা পার করে দেয়া যাবে ।
তারপরে তো আমাকে হাসপাতালে ভর্তি করলো । সেই একই ওয়ার্ড, একই বেড । শুধু ১০ দিনের মাথায় রোগী বদলে গেছে । বোনের জায়গায় আমি ।
বললে বিশ্বাস করবা না । গোটা দশেক ডাক্তার মিলে ৭দিন ধরে আমার বোনের রোগনির্নয় করতে পারলেনা । তার আগেই ও ভাল হয়ে বাড়ীতে চলে এল । এইবার আমার পালা । আমি কিছুটা শঙ্কিত । "আসছে আষাঢ় মাস....কি জানি কি হয়..." । তারপরেও মনে আশা , ডেঙ্গু অথবা হাম এ দুটোর মধ্যেই সিলেবাস থাকবে । আমার বোনের ওপর এই দুটারই চিকিৎসা চালানো হয় । ও যেহেতু ভাল হয়েছে , কাজেই.....।
হাসপাতালটা দারুন তো ! ঈদের ছুটির আগে আগে এত্ত ডাক্তার বারবার এসে দেখে যাচ্ছে । প্রথমে ২-৩জন একসাথে এসে গম্ভীরভাবে আমাকে আধঘন্টা ধরে পরীক্ষা করল । চোখ উল্টান । জিভ দেখান । বদ ডাক্তারটাকে জিব বের করে ভেংচি কেটে মনে একটু শান্তি পেলাম । সে ব্যাটা আমার প্রেসারও মাপলো । বলে কিনা , এহে অনেক লো প্রেসার । আরে ফাজিল তুই কি ভাবছিস আমি ৩দিন ধরে কাচ্চি বিরিয়ানি খাইতেছি যে হাই প্রেসার উঠবে ?
তারপর আমাকে ওষুধ দিল । দেখি আমার বোনকে দেয়া ওষুধের সাথে তার কোনো মিল নাই । আমাকে প্রায় ৩ গুন বেশী ওষুধ দেয়া হইছে । স্যালাইন তো আছেই । আমি ক্ষীন স্বরে প্রতিবাদের চেষ্টা করে যাচ্ছি । এ কেমন কথা ! ও সবসময় আমার থেকে বেশী সুবিধা পাবে !! ট্যাবলেট খেতে ওর কোনো কষ্টই হয়না মুড়িমুড়কির মত খেয়ে ফেলে । এদিকে আমার সিভিট খেতেও কষ্ট হয় । তাছাড়া একই যাত্রায় পৃথক ফল , পৃথক ওষুধ একই ডাক্তার কি করে দেয় ? ডাক্তার আমাকে ঝাড়ি দিয়ে বলে , বাসায় বসে আপনার বোনের ওষুধগুলা খেয়ে নিলেই তো পারতেন , এখানে আসার কি দরকার ছিল ?
অপারগ হয়ে ট্যাবলেটগুলা গেলার চেষ্টা করলাম । ইয়াত্ত বড় সাইজের ভোম্বা ট্যাবলেট । আমার গলার ফুটো কক্ষনো ওর চে বড় নয় । তাও আবার একেকবারে ২টা করে খেতে হবে । সারাদিনে ৮টা । এ তো মাত্র একরকমের ওষুধ , ভাইরাসকে কাবু করার জন্য । এছাড়া জ্বর নামানোর জন্য খেতে হবে নাপা । সেও আরেক ভোম্বা । এটাও দুটো করে । আরো আছে ফুসকুড়ি কমানোর ওষুধ । পেটব্যাথার ওষুধ । সব দুটো দুটো করে । এরপরে দিল ঠান্ডার ওষুধ । সবশেষে দিলো গ্যসট্রিকের ওষুধ । এসব খেয়ে পেটে যেন গ্যাস না হয় তাই । আমি চিঁ চিঁ করে বললাম , ডাক্তারবাবু , এত ওষুধ খেলে আমার বমি আসে । আর যায় কোথায় ! অমনি ডাক্তারবাবু প্রেসক্রিপশন নিয়ে তাতে বমির জন্য আরও এক রকমের ওষুধ লিখে দিলেন । আমি টুঁ শব্দটি করবার সাহস হারিয়ে ফেললাম । যদি তার জন্যও নতুন ওষুধ লেখা হয় ।
যাবার আগে ডাক্তার বললো , এত ওষুধ খালি পেটে খাওয়া যাবেনা । ৪ বেলা পেট ভরে খেতে হবে ।
আরে বাবা ! আমি তো এখানে আসলামই এজন্য যে আমার মুখে খাবার শক্তি নাই । পানিও খেতে পারছিনা ট্যাবলেট দূরে থাক । হাতে একটা স্যালাইন ঢুকিয়ে পড়ে থাকব আর আপনাআপনি ভালো হয়ে যাব । এ ব্যাটা বলে কি ???
অবশেষে ডাক্তার চলে যেতেই নার্সের আগমন । এই নার্সটা সত্যিই ছিলো দরদী টাইপের । আমার হাত ফুটো করে স্যালাইন লাগিয়ে দিয়েছে ঠিকই কিন্তু ভাল ব্যবহার করেছে । এরপর ট্যাবলেট খেতে হবে । আমি হিসাব করলাম । মূল ট্যাবলেটটা খাওয়ার আধঘন্টা পর অন্য ট্যাবলেট । এর কিছুক্ষন পর নাপা । এসবের আগে আবার কিছু সলিড খাবার খেয়ে নিতে হবে । কিছু খেয়ে নেয়ার আধঘন্টা আগে আবার গ্যস্ট্রিক আর বমির ওষুধ । আর সাত কোর্সের এই ডিনারের শেষে ডেজার্ট হিসেবে কফ সিরাপ ( চুল ছিড়ার ইমো ) ।
এই চক্র শেষ হতে না হতে পরের চক্রের সময় হয়ে যায় ।
(চলবে.....)
( লেখাটা বেশী বড় হয়ে যাওয়াতে পর্ব করে দিলাম । অল্প কথায় নরকের আসল রূপ চিনানো যাবেনা । পরের পর্বে থাকছে ডাক্তারবাবুদের ডাঙ্গুলি খেলার বর্ণনা । )