রোডম্যাপটি প্রথমে পরিষ্কার হয় পাড়া-প্রতিবেশীদের কাছে। পরে আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবদের মাঝে কানাঘুষা শুরু হয়। আর সবার শেষে বুঝতে পারে বেচারা স্বামী। প্রবাসী বাঙালিদের মধ্যে কোনো কোনো দেশে ব্যাপারটি নাকি অনেকটা মহামারীর আকার ধারণ করেছে। এই সব ঘটনায় কার দোষ কতখানি বা কোন পক্ষ কতটুকু দায়ী তার বিশ্লেষণ আজকের লেখার মূল উদ্দেশ্য নয়। বিষয়টি এখানে এসেছে নেহায়েত তুলনা হয়ে। সংবাদ মাধ্যমের বিরুদ্ধে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও তার সরকারের প্রতিক্রিয়াটি অনেকটা শুভাকাঙ্ক্ষী বন্ধুবান্ধব আত্মীয়দের বিরুদ্ধে এসব স্বামীদের প্রথমদিকের প্রতিক্রিয়ার অনুরূপ। চোখ থাকা সত্ত্বেও যখন অনেক কিছু দেখেননি, কান থাকা সত্ত্বেও যখন অনেক কিছু শোনেননি। মন থাকা সত্ত্বেও যখন অনেক কিছু বোঝেননি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন,পত্র-পত্রিকা, টক-শোতে দেশের একচিত্র, আর গ্রামে অন্যচিত্র। তিনি আরো জানিয়েছেন, এই সরকারের বিরুদ্ধে কিছু না বললে অনেকের পেটের ভাত হজম হয় না।
ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার সাংবাদিক, কলামিস্ট, টক-শোর সঞ্চালক ও বক্তাগণ এই ‘ভাত হজম না হওয়ার’ মধ্যে সামিল হয়ে পড়েছেন। গোল টেবিল, চৌকো টেবিলসহ সব জ্যামিতিক গরানার টেবিলের বিরুদ্ধে কিছুদিন আগে প্রধানমন্ত্রী যে মনোভাবটি দেখিয়েছিলেন বা তার সরকারের সমালোচকদের মাথায় ফেরিওয়ালার ঝুড়ি তুলে দিয়েছিলেন, তা দেখে সেসব টেবিলের চারপাশে বসা অনেকেই থমকে গেছেন। তাদের অনেকের অভিজ্ঞতাই সুখকর বা প্রীতিকর হয়নি। রাষ্ট্রের স্পর্শকাতর প্রতিষ্ঠানগুলো বাকস্বাধীনতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পড়ে।
নামি-দামি মানুষদের অনেককেই আদালতে করজোড়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে কিংবা সংসদীয় দলের কাছে জবাবদিহির হুমকি গিলতে হয়েছে। কাজেই সমালোচকদের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী ও তার সরকারের এই অসহিষ্ণু মনোভাবের প্রতিফলন ঘটেছে সংসদে, প্রশাসনে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে। এমনকি স্বাধীন বিচারালয়কেও এর প্রভাব থেকে মুক্ত রাখা সম্ভব হয়নি। সাংবাদিকদের উপর সাম্প্রতিক নিপীড়ন ও অত্যাচারের মাত্রা বাড়ার পেছনেও সরকারপ্রধানের এই মনোভাবের একটা যোগসূত্র সহজেই খুঁজে পাওয়া যায়।
এভাবে দুএকজন ঝিকে মেরে সকল বৌদেরকে ইতিমধ্যে যা শেখানোর তা শিখিয়ে দেওয়া হয়েছে। তারপরও সব কূল ঠিক রাখা সম্ভব হচ্ছে না। একদিক স্তব্ধ করলে অন্যদিক থেকে কেউ না কেউ বেরিয়ে আসে। দেশের পত্রিকার মুখ বন্ধ করলে বিদেশি পত্রিকা সরব হয়ে ওঠে। বাঙালি ভাত না খেয়ে কয়েকদিন থাকতে পারবে কিন্তু কথা না বলে (পেট খালি না করে) কয়েক মুহূর্তও টিকে থাকতে পারবে না। কাজেই কোনো হালাকু খান কিংবা তার কোনো নাতি বা নাতনি চেষ্টা করে দেখতে পারেন- কিন্তু বাঙালির এই মুখটি কখনোই স্তব্ধ করা সম্ভব হবে না। অহেতুক শক্তি ক্ষয় হবে।
যারা সরকারের গোড়া সমর্থক তাদের পেটের ভাত সহজেই হজম হয়ে যাচ্ছে। মহাজোটের অংশীদার মেনন ও ইনুদের পেটের ভাত প্রায়ই ‘হাফ’ হজম অবস্থায় থাকে। তখন সরকারের মৃদু সমালোচনা করে পেটের ভাতগুলো পুরো হজম করে নেন। তবে শেখ হাসিনার ভাই বলে দাবিদার হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের পেটের ভাত হজমে বেশ সমস্যা হচ্ছে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। বিএনপি আগামী নির্বাচনে অংশ না নিলে তাঁকেই বিরোধী দলের নেতার আসনটি দিনকয়েকের জন্যে অলংকৃত করতে হতে পারে। এরশাদকে যারা জানেন তারা অবশ্য তার এই ভাত হজম না হওয়ার প্রকৃত রহস্যটি নিয়ে বেশ দ্বিধা-দ্বন্দ্বে পড়ে গেছেন। এরশাদ বলেছেন, ‘বর্তমান দেশের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো নেই। দেশে চলছে লুটপাট ও লুণ্ঠন।’ টকদই পরিবেশনের জন্য সামান্য গালমন্দের কথা আগে থেকে ঠিক হয়ে থাকলেও এই পাতানো ভাইটি কি পুরোদস্তুর চর বসিয়ে দিলেন? নাকি দেশের অবস্থাটি আসলেই ভয়াবহ?
গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডি আওয়ামী লীগের প্রতি অহেতুক বিদ্বেষ পোষণ করা শুরু করেছে কিংবা বিএনপি জোটকে অধিকতর পছন্দ করা শুরু করেছে- এমন ভাবার কোনো কারণ এখনও সৃষ্টি হয় নাই। সেই সিপিডিও এখন শেখ হাসিনা বর্ণিত এই ‘পেটের পীড়ায় ভুগছে। অর্থনীতির বিভিন্ন সূচক ও আলামত দেখে উৎকণ্ঠিত সিপিডি। প্রবৃদ্ধির শ্লথগতি, আয়-ব্যয়ের ব্যর্থতা, মুদ্রানীতিতে ঘোড়ার আগে গাড়ি, বৈদেশিক লেনদেনে ভারসাম্যহীনতা, বিদ্যুৎ খাতে অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতিতে দ্বিতীয় স্থানে উঠে আসা প্রভৃতি বিষয়গুলো তাদের পেটের ভাতগুলোকে হজম হতে দিচ্ছে না। জানি না অর্থমন্ত্রীর বিশেষ ভঙ্গিমায় ‘রাবিশ’ উচ্চারণটি তাদের জন্যে কতটুকু ‘হজমি বড়ি’ হিসেবে কাজ করবে।
তারপরেও প্রধানমন্ত্রীর উচ্চারিত কথাগুলির একটা বিশেষ ওজন রয়েছে। কারণ সরকারের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্টগুলো তিনি সরাসরি পেয়ে থাকেন। প্রটোকল ও নিরাপত্তার চাদরে বন্দি এদেশের প্রধানমন্ত্রীগণ অত্যন্ত উঁচুস্তরের চাটুকার দ্বারা পরিবেষ্টিত হওয়ার ঝুঁকিতে সবসময়েই থেকেছেন। তাই খলিফা ওমরের মতো বেরিয়ে সাধারণ জনগণের দুঃখ-কষ্ট দেখার সুযোগ তাদের খুব একটা হয় না। প্রধানমন্ত্রী যা দেখতে বা শুনতে পছন্দ করবেন আশপাশের সবাই তাই দেখাতে বা শোনাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। প্রধানমন্ত্রীর সাথে কার কার সাক্ষাৎ ঘটবে বা প্রধানমন্ত্রী কী কী দৃশ্য দেখবেন বা উপভোগ করবেন তাও অনেক আগে থেকেই সুনিপুণভাবে বিন্যস্ত করা থাকে। প্রাক্তন এক প্রেসিডেন্ট স্বপ্নে আদিষ্ট হয়ে এক মসজিদে গেলে সেই স্বপ্নের কথাও নাকি গোয়েন্দা সংস্থা দশ-বারো দিন আগেই জেনে ফেলেছিল ও সেই অনুযায়ী গোয়েন্দা প্রস্তুতি চালিয়েছিল। কাজেই প্রধানমন্ত্রী যা দেখেন বা যা শোনেন তা বাস্তবতা থেকে অনেক দূরে থাকে। তাই পত্র-পত্রিকার সাংবাদিকগণ যা দেখতে পারেন সেসব দেখার সৌভাগ্য প্রধানমন্ত্রীর কখনই হয় না।
তার এই বক্তব্য থেকে অনুমান করা সম্ভব যে প্রধানমন্ত্রী জনগণ থেকে কতটুকু বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন। একই অবস্থা সৃষ্টি হয়েছিল প্রথম আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে। এক শ্রেণীর চাটার দল সারা দেশের বাস্তব অবস্থা থেকে সরকারের কর্তাব্যক্তিদের বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছিল। জাতির দর্পণ হিসেবে যে সংবাদপত্র সরকারের ভুলত্র“টি ধরিয়ে দিয়ে চরম ক্ষতি থেকে রক্ষা করতে পারত সেই সংবাদপত্রের টুঁটিটিই চেপে ধরা হয়েছিল। নিজেদের গুণকীর্তনের জন্যে চারটি সংবাদপত্র রেখে বাকি সকল পত্র-পত্রিকা বন্ধ করে দেওয়া হয়। সরকারের গণবিচ্ছিন্নতা অনুমান করা যায় যখন জাতির বিরাট অংশ অনাহারে, অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছে তখন জাতির পিতার বায়োলজিক্যাল ছেলেকে সোনার মুকুট পরিয়ে বিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আমার মনে হয় প্রকৃত অবস্থাটি তখন তাঁকে জানতে দেওয়া হলে আজ আমাদের ইতিহাসটি হয়ত অন্যভাবে লেখা হত। ইতিহাসের নির্মম সত্যটি হল যে, এই ইতিহাস থেকে আমরা কখনোই শিক্ষা গ্রহণ করি না।
সেই সত্তরের দশক থেকে এখন অনেক কিছু বদলে গেছে। শুধু বদলাতে পারেনি সরকারের কর্তা ব্যক্তিদের মন ও মানসিকতা। মিডিয়া জগতে যে নীরব বিপ্লবটি সাধিত হয়ে গেছে সেই সম্পর্কে অনেকেই বেখেয়াল রয়ে গেছেন। ইন্টারনেট, মোবাইল ফোন, ফেইসবুক, টুইটারসহ সামাজিক নেটওয়ার্কগুলো সংবাদ জানানোর বা সত্যাসত্য যাচাই করার বিকল্প অনেকগুলি রাস্তা বের করে দিয়েছে। সত্যকে ঢেকে রাখা আজ কঠিন হয়ে পড়েছে।
টেকনোলজিক্যাল উন্নতি মানুষের ভাবনার জগতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনে দিয়েছে। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলোর সামনে এখন একটা উপায়ই খোলা রয়েছে। আর তা হল- সব ধরনের গলাবাজি ও চাপাবাজি ছেড়ে এখন প্রকৃত অর্থেই ভালো হয়ে যেতে হবে। মন্দ লোকগুলো যতই দক্ষ ও চতুর হোক না কেন- এরা কখনোই রাজনৈতিক দলগুলোর জন্যে আর অ্যাসেট থাকবে না। এই কথাটি যে দলটি যত বেশি বুঝবে তারা ততটুকু জনগণের সচেতনতার এসিড টেস্টে তত এগিয়ে থাকবে। মন্দ কাজ করার পরেও মানুষের প্রশংসা পাওয়ার দিন মনে হয় শেষ হয়ে গেছে বা তা দ্রুত শেষ হয়ে যাচ্ছে। মিডিয়ার উপর শেষ মরণ কামড়টি বোধ হয় সে কারণেই পড়ছে।
সমাজের সার্বিক অবক্ষয়ের ছোয়া মিডিয়া জগতে কিছুটা লাগলেও জনগণের সচেতনতার জয়গানটি এখান থেকেই অনবরত গাওয়া হচ্ছে। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি ও অনিয়ম এবং রাজনীতিতে দুর্বৃত্তায়নের বর্তমান মাত্রা দেখে অনেকেই হতাশ হয়ে বলেন, সর্বাঙ্গে ব্যথা, ওষুধ লাগাবো কোথায়? আমার মনে হয় ওষুধ লাগানোর জায়গাটি এখন খুঁজে পাওয়া গেছে বা টেকনোলজি সেই সুযোগটি সৃষ্টি করে দিয়েছে।
কাজেই আমরা যেকোনো মতের বা পথের অনুসারী হই না কেন, সবার উচিত সমাজ ও রাজনীতির এই ক্রনিক রোগটি সারাতে এই সুযোগটিকে যথাযথভাবে কাজে লাগানো।
(রিপোস্ট)
(সংগৃহিত)