আশেপাশের কেউই টের পাইনি
খুন হয়ে বসে আছি সেই কবে ।
প্রথমবার যখন খুন হলাম
সেই কি কষ্ট!
সেই কষ্ট একবারের জন্যও ভুলতে পারিনি এখনো।
ছয় বছর বয়সে মহল্লায় চড়ুইভাতি খেলতে গিয়ে প্রায় দ্বিগুন বয়সের নিলা আপা আমাকে তার দলে নেয়নি,
বলেছিলো,
-ভাড়াটিয়াদের সাথে খেলতে তার বাবা নিষেধ করেছে!
সেইদিন জীবনে প্রথমবার খুন হলাম একটি দোতালা বাড়ির বিকেলের অহংকারী ছায়ায়।
তারপর থেকে শৈশবে প্রতি পদে পদে খুন হয়েছি অসংখ্যবার-
একটি নতুন ফুটবলের গন্ধের কাছে,
একটি পাইলট কলমের নীল কালির কাছে,
একটি পুরোনো সাইকেলের গতির কাছে,
একটি সাদাকালো টেলিভিশনের বাক্সের কাছে,
একটি হলুদ শার্টের স্বপ্নের কাছে,
দোকানে সাঁজানো থরে থরে রঙ্গিন চকলেটে আর ঘুড়ির বেহায়াপনার কাছে,
আর সব সময় শূন্য একটি বুক পকেটের বিশাল ওজনের কাছে।
বাবা মা'ও আমাকে খুন করেছে শৈশবেই,
কিছু চাইলেই বলতো,
“আমাদের এতো শখ মানায় না”!
কৈশোরে আরেকবার খুন করলো সেই নিলা আপাই
-অন্ধকারে সন্ধ্যায় সিঁড়ির ঘরে দাঁড়িয়ে জীবনের প্রথম অকস্মাৎ এক না বুঝা,
না চাওয়া চুম্বনে।
অপমানে, ভয়ে সেই ভাড়াটিয়া কিশোরের লাশ আমি অনেকদিন আমার ঘরেই লুকিয়ে রেখেছিলাম।
মনোলীনা,
বারবার খুন হতে হতে আমার মেরুদন্ড বাঁকা হয়ে গেছে কবেই।
এখন সোঁজা হয়ে দাঁড়াতে ভুলে গেছি।
তুমি কি জানো?
মধ্য রাতে বিষণ্ন কিছু ছায়া বিলাপ করতে বসে শহরের সমস্ত ল্যাম্পপোস্টের নিচে।
কোনটি যে আমার ছায়া!
তাও ভুলে যাই,
ভুলে যাই,
ভুলে যাই।
মনে হয় শহরের সব মানুষের বিষাদের ছায়ার মাঝেই আমার বসবাস।
মনোলীনা,
আজকাল আমি ভালো নেই তোমার খুনে।
তোমার বিলাসী অবহেলায় আমি ভালো নেই,
তাইতো এখন আর মাথার চুল আঁচড়াই না।
মুখের দাঁড়ি কাটিনা অনেকদিন ধরে কি এক প্রচন্ড আলসেমিতে
-আমি ভালো নেই।
আয়রন ছাড়া কাপড় পরি
- আমি ভালো নেই।
অযথাই রোদ বৃষ্টিতে ঘোরাঘুরি করি
- আমি ভালো নেই।
সারারাত বারান্দায় বসে বসে
আকাশে নিজেকে খুঁজি
- আমি ভালো নেই।
মনোলীনা,
তুমি শুধু একবার আমাকে বুঝতে চেষ্টা করো!
আমি কোন মহাপুরুষ নই।
অসংখ্যবার খুন হতে হতে আমি এখন একটা লাজ-লজ্জাহীন পুরুষ মানুষ
- আমি ভালো নেই।
আমার প্রচন্ড ভয়
এবার না আমি নিজেই খুনী হয়ে যাই
শুধু তোমার অবহেলায়?
-আমি ভালো নেই।
মনোলীনা,
আমার বুকের ভিতরে এখন এক না দেখা বিরহী ডাক,
বুঝিনা কিছুই!
আমি হয়তো কবি হয়ে যাবো একদিন।
তুমি জেনে রাখো,
কবির চেয়ে বড় খুনী এই জগতে কেউ নেই।
যদি কখনো আমি কবি হয়ে যাই
খুঁজলেও পাবেনা আমাকে
ডাকলেও আসবো না আর।
সেদিন তুমি কিন্তু সত্যি সত্যি খুন হয়ে যাবে।
ঈশ্বরকে সাক্ষী রেখেই বলছি,
তুমি খুন হয়ে যাবে প্রতিদিন
আমার কবিতার বিষাদের প্রতিটি ধারালো শব্দে।
তুমি খুন হলেই
আমার বিষণ্ন ছায়াকে শহরের ল্যাম্পপোস্টের নিচে রেখেই আমি আজীবনের জন্য ফেরারী হয়ে যাবো।
মনোলীনা,
বিশ্বাস করো
তোমার বিলাসী অবহেলায়
আমি ভালো নেই,
আমি সত্যিই ভালো নেই
আমি একটুও ভালো নেই।
------------
রশিদ হারুন
৩১/০৫/২০২১