somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আবদুল হামিদ এক না বলা বীরের গল্প

০৯ ই মার্চ, ২০১৫ ভোর ৬:৩১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

পাঞ্জাবী কমান্ডিং অফিসার ক্যপ্টেন আসিফ রিজবী চমকে উঠলেন।নিজের কান কে বিশ্বাস করাতে পারছে না,কারন সামনে বসে থাকা একটি যুবক বয়স বেশি গেলে ২২ কি ২৩ হবে যে কিনা এখন তাদের হাতে বন্ধী সেই ছেলে কি তেজী কণ্ঠে কথা বল উঠলো। আসিফ রিজভী তাঁর জামার পকেট তল্লসীর উদ্দেশ্যে হাত দিতে উদ্যত হলে ছেলেটি গর্জে উঠে ধমকের সুরে বলে উঠল



“Stop. Do not you know I am a citizen of Bangladesh? you must seek my permission before charge me”



এই ক্যাম্পে এর আগেও অনেক মানুষ আনা হয়েছে ক্যপ্টেন আসিফ রিজবী অনেকের সাথেই কথা বলেছে রিজবী তাদের নিজের ইচ্ছা মত শান্তি দিয়েছে কেউ মুখ ফুটে তার মুখের সামনে কথা বলার সাহস পায়নি আর এই ছেলেটি রীতিমত ধমক দিচ্ছে। সেই মানুষ গুলোকে দেখলেই মনে হতো এরা মৃত্যু ভয়ে ভিতরে ভিতরে মরে যাচ্ছে আর এই ছেলেটি কে দেখলে মনে হচ্ছে মৃত্যু নিয়ে সে মোটেও চিন্তিত নয়।



–তোমার নাম হামিদ ?
– শুধু হামিদ নয় আব্দুল হামিদ।
–তো বলো বেটা তোমার সাথে আর কে কে আছে যে হিন্দুস্তানের জন্য কাজ করে?
আমি বাঙালি,দেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে আমি একটি শব্দ উচ্চারণ করবো না। তোমাদের পদানত হতে আমার জন্ম হয়নি। আমি এখন তোমাদের বন্দী, যা খুশী তোমরা করতে পার। আমি কোন কথা বলবোনা,বলনো না।


তাঁর এ নির্ভীক বীরত্বপূর্ণ উচ্চারণ ও আচরণ দেখে রিজভীর মতো নরপশু ও নাকি মন্তব্য করেছিলেন,হামিদের মতো ছেলে যে দেশে জন্মায় দেশ স্বাধীন না হয়ে যায় না।তারপর অমানুষিক নির্যাতন করেও তার মুখ কোন তথ্য বের করতে পারেনি।নির্যাতনের এক পর্যায়ে টেকনাফের বধ্যভূমিতে নিয়ে গিয়ে অমানবিক নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করা হয় আবদুল হামিদকে। আবদুল হামিদের মুত্যু সম্পর্কে স্থানীয় আবদুল জলিল (যিনি তখন পাকবাহিনীর চত্বরে জুতা সেলাই করতেন) বলেন “পাকবাহিনী আবদুল হামিদকে বারবার নির্দেশ দিয়েছিল ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ বলতে উত্তরে তিনি ‘জয়বাংলা’ বলেছিলেন।”এতে ক্ষিপ্ত হয়ে পাকসেনারা তাঁর বুকে গুলি চালায়।



উপরের কথা গুলো সিনেমার কোন দৃশ্যের মত মনে হলো ও আসলেই বাস্তবে এমনটা ঘটেছিলো চট্টগ্রাম কমার্স কলেজর হিসাব বিজ্ঞান বিষয়ে অনার্স শ্রেনীর ছাত্র আবদুল হামিদের সাথে।জন্ম ৫ মার্চ ১৯৫০ সালে চকরিয়ার বিলছড়ি এলাকার বমু গ্রামে। শিক্ষক পিতা আবদুল ফাত্তাহ অনেক স্বপ্ন ছিল ছেলে আবদুল হামিদকে নিয়ে একসময় ছেলে জড়িয়ে পড়ে ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে। ১৯৬৮-৬৯ সালে চট্টগ্রাম কর্মাস কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন।উনসত্তরের গণঅভুত্থানে যারা চট্টগ্রাম থেকে গণজোয়ার সৃষ্টি করেছেন আবদুল হামিদ ছিলেন তারমধ্যে অন্যতম।


১৯৭১ সালের ৭ মার্চ এর ঐতিহাসিক ভাষণের নির্দেশ মাথায় ও হৃদয়ে ধারণ করে তিনি চকরিয়ায় এলেন মুক্তিকামী জনতাকে সংঘটিত করতে।এস. কে শামসুল হুদা ও ডা. শামসুদ্দিনের নেতৃত্বে গঠন করলেন সংগ্রাম কমিটি । ২৭ এপ্রিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ভারী অস্ত্র শস্ত্র নিয়ে চকরিয়ার সংগ্রামী জনতার প্রতিরোধ ভেদ করে অতর্কিত হামলা চালায়। হানাদার বাহিনী চকরিয়ায় প্রবেশ করার সাথে পাকি দোসরদের চেহারা সম্পূর্ণ পাল্টে যায়। প্রথমেই তারা লুট ও যুবতী নারীদের ধরে ধরে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীকে ভোগের সামগ্রী হিসেবে তুলে দিলো।



হাবিলদার আবুল কালামের প্রশিক্ষণে আবদুল হামিদ, মাহবুব, জহিরুল ইসলাম সিদ্দিকী, নজির আহমদ প্রমূখ অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধারা প্রথমে উদ্বুদ্ধ হয়ে সীমিত শক্তি নিয়ে তাদের প্রতিরোধ করেছিলেন কিন্তু পরে যখন বুঝলেন যে, অত্যাধুনিক অস্ত্রের সামনে টিকে থাকা সম্ভব নয়।আরো প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র প্রয়োজন তাই তারা ভারতে গিয়ে গেরিলা প্রশিক্ষণের সিদ্ধান্ত নেয়। ভারতের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমার আগেই বাড়ি থেকে বিদায় নেওয়ার মুহুর্তে অগ্রজ এজাহার হোসাইনকে বললেন,


“দাদা আমি তাহলে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ গ্রহণের জ্য ভারতের পথে পাড়ি দিলাম।এখানে কাপুরুষের মতো বসে থাকার অপরাধ কোন দিন ইতিহাস ক্ষমা করবে না যদি কোন দিন ফিরে আসি দেখা হবে,দোয়া করবেন।”



১৩জন মুক্তিযোদ্ধা ১৮ মে লামা হয়ে ভারতের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমায়। গভীর জঙ্গল অতিক্রম করে পাহাড়ের পর পাহাড় ডিঙ্গিয়ে গাছের ফলমূল কিংবা বুনো মুরগী শিকার করে মাংস আগুনে ঝলসে ক্ষুধা মিটিয়ে প্রায় ১০দিন পর ভারতের মিজারাম প্রদেশের দেমাগিরিতে পৌঁছেন।ভারতের মিজোরাম আবার বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে,পাকিস্তানি মদদ প্রাপ্ত,বাঙালিদের ভয়ানক শত্রুভাবাপন্ন ছিলো। বহু বাঙালি তাদের হাতে প্রাণ হারিয়েছে। আবদুল হামিদের দল এমনি দুবার বিপদে পড়ে গিয়েছিলো, ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বি এস এফ এর সদস্যরা তাদের রক্ষা করে লংলাইয়ের সামরিক ক্যাম্পে পৌঁছে দেয়। সেখান থেকে মাসাধিক ট্রেনিং নিয়ে আবদুল হামিদের এর নেতৃত্বে এক দু:সাহসিক যোদ্ধাদল বাংলাদেশের চকরিয়ায় ফিরে আসে। এ দলে সেকেন্ড কমান্ড ছিলেন নজির আহমদ।



প্রশিক্ষণ শেষে সবাইকে হাবিলদার আবুল কালাম (শহীদ)সহ কয়েকজন মিলে গেরিলা দলের নেতৃত্বে পার্বত্য চট্টগ্রামের লামা, আলীকদম ও চকরিয়ায় এলাকায় বিভিন্ন কৌশলে হানাদার বাহিনী এবং তাদের দোসর রাজাকারদের উৎখাত করে। এর মধ্যে লামা থানা অপারেশন ও থানার সকল অস্ত্রশস্ত্র হস্তগত করে মুক্তিযুদ্ধে বিরাট সাফল্য লাভ করেন হামিদ এবং আবুল কালামের নেতৃত্বাধিন গেরিলা দল।



পাগল হয়ে উঠে পাকিস্তানীর দল হামিদের সন্ধানে দেশীয় রাজাকারদের লেলিয়ে দেয়।হামিদের নেতৃত্বে একটি দল তখন চকরিয়ার বিষফোঁড়া গণদুষমণ মেজর জামানকে চরম শাস্তি দেবার ফন্ধি বের করছিলো।হামিদের নেতৃত্বে তারা যখন জামানের ঘাটি আক্রমণ করতে প্রস্তুতি নিচ্ছে সে সময় পাকিস্তানি দোসর লামার রাজাকার মুছা হানাদার বাহিনীকে গোপনে খবর দেয়।



৪ নভেম্বর পাকিস্তানি ও জামায়াতের নেতৃত্বে রাজাকার গফুরের দল মুছাসহ অতর্কিত হামিদের বুমার ঘাটি আক্রমণ করে। রাতের অন্ধকারে তাঁর ভাই ও ভগ্নিপতি আজমল হোসেনসহ পাকিস্তানীদের হাতে আক্রমণে আটকা পড়ে যায়।আবদুল হামিদকে প্রথমে লামা এবং পরে কক্সবাজারের সেনা ঘাটিতে নিয়ে যায় রাজাকার দল।হামিদকে রক্ষা করার জন্য স্থানীয় অন্য একটি দল প্রতিরোধ শুরু করে কিন্তু পাকিস্তানী দোসরের সহায়তায় মেজর জামান কক্সবাজারে পাকিস্তানি সেনা দপ্তরে ওয়ারলেস সংবাদ পাঠায়। পাকিস্তানীরা আকাশ বাতাস বিদীর্ণ করে চকরিয়ায় ঘরবাড়ী ঝালিয়ে ধোয়ার কুন্ডলী সৃষ্টি করে মাতামুহুরী তীরের প্রতিরোধ শেষ করে দেয় নিমিষেই।



আবদুল হামিদের লাশ অর্ধ-কংকাল অবস্থায় টেকনাফের বধ্যভুমি থেকে ১৮ ডিসেম্বর তাঁর বড় ভাই এজাহার হোসাইন সনাক্ত করেন।পড়ে শহীদ আবদুল হামিদকে চকরিয়ায় দাপন করা হয়।

সূত্রঃ ‘স্মৃতি ও শ্রুতিতে একাত্তর’
৫টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মুসলিম কি সাহাবায়ে কেরামের (রা.) অনুরূপ মতভেদে লিপ্ত হয়ে পরস্পর যুদ্ধ করবে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪৯




সূরাঃ ৩ আলে-ইমরান, ১০৫ নং আয়াতের অনুবাদ-
১০৫। তোমরা তাদের মত হবে না যারা তাদের নিকট সুস্পষ্ট প্রমাণ আসার পর বিচ্ছিন্ন হয়েছে ও নিজেদের মাঝে মতভেদ সৃষ্টি করেছে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদে মসজিদে মোল্লা,ও কমিটি নতুন আইনে চালাচ্ছে সমাজ.

লিখেছেন এম ডি মুসা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সকাল ১০:২৩

গত সপ্তাহে ভোলার জাহানপুর ইউনিয়নের চরফ্যাশন ওমরাবাজ গ্রামের এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। লোকটি নিয়মিত মসজিদে যেত না, মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়েনি, জানা গেল সে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী ছিল, স্বীকারোক্তিতে সে... ...বাকিটুকু পড়ুন

গল্পঃ অনাকাঙ্ক্ষিত অতিথি

লিখেছেন ইসিয়াক, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ দুপুর ১:১২

(১)
মাছ বাজারে ঢোকার মুখে "মায়া" মাছগুলোর উপর আমার  চোখ আটকে গেল।বেশ তাজা মাছ। মনে পড়লো আব্বা "মায়া" মাছ চচ্চড়ি দারুণ পছন্দ করেন। মাসের শেষ যদিও হাতটানাটানি চলছে তবুও একশো কুড়ি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগে বিরোধী মতের কাউকে নীতি মালায় নিলে কি সত্যি আনন্দ পাওয়া যায়।

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১৮

ব্লগ এমন এক স্থান, যেখানে মতের অমিলের কারণে, চকলেটের কারণে, ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে অনেক তর্কাতর্কি বিতর্ক কাটা কাটি মারামারি মন্তব্যে প্রতিমন্তব্যে আঘাত এগুলো যেনো নিত্য নৈমিত্তিক বিষয়। ব্লগটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগার'স ইন্টারভিউঃ আজকের অতিথি ব্লগার শায়মা

লিখেছেন অপু তানভীর, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ রাত ১১:০৫



সামুতে ব্লগারদের ইন্টারভিউ নেওয়াটা নতুন না । অনেক ব্লগারই সিরিজ আকারে এই ধরণের পোস্ট করেছেন । যদিও সেগুলো বেশ আগের ঘটনা । ইন্টারভিউ মূলক পোস্ট অনেক দিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×