পঞ্চগড়ে, মন্দিরের পুরোহিত হত্যা ও নানা সময়ে ইসলামভিন্ন ধর্ম অনুসারীদের সম্পত্তি গ্রাসসহ নানা অন্যায়ের প্রতিবাদে আমেরিকার জ্যাকসন হাইটসে সংগঠিত হয় “হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ” এর প্রতিবাদ সভা। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সেত পশংসনীয় কাজ। কিন্তু সেই প্রতিবাদ যদি হয় ভুল মানসিকতার তবে হিতে বিপরীত হবার আশঙ্কায় শঙ্কিত হতেই হয়। (সভায় আলোচনার লিংক )
১৯২৭ সালের শিখা পত্রিকায় লেখা থাকত-
জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ
বুদ্ধি সেখানে আড়ষ্ঠ
মুক্তি সেখানে অসম্ভব
উল্লেখিত পরিষদের পরিচালক শ্যামল চক্রবর্তীর বক্তব্যে বলা হয়- বাংলাদেশে গরু জবাই বন্ধের আইন করা উচিত। একদল গরুর মাংস খেতে চায়, ধর্মীয় নিষেধও নেই। অন্যদল গরুকে মাতা জ্ঞান করে তাই এর হত্যা রোধ করতে চায়। অনেক হিন্দু ও বাংলাদেশের উপজাতিসহ কিছু অন্যধর্মাবলম্বী মানুষ শুকুরের মাংস খায়।মুসলনরা দাবি করতে পারে, ইসলাম ধর্মের নিষিদ্ধ জিনিস যেন কেউ না খায়। কারন তাদেরকেও অন্য ধর্মের নিয়ম, যেমন গরু হত্যা না করা মানতে হচ্ছে। ধর্মটা তাহলে রাষ্ট্রীয় বলপ্রয়োগ নির্ভর হয়ে যাচ্ছে। অথচ ধর্ম পালন যেকোন ব্যক্তির ইচ্ছাধীন। অনিচ্ছায় ধর্ম পালন সম্ভবও নয়। এর প্রধান কারণ- ধর্মে, বিশ্বাস, ভালোবাসা ও ভক্তি সর্বপ্রথম দরকার। তবুও নাহয় এ আইন করে দেওয়া হল। বল প্রয়োগ করে তা মানানোও হল। কিন্তু যে রাষ্ট্র এত কিছু করল তার পরিণতি কি হবে? সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাড়বে বৈ কমবে না। শ্যামল চক্রবর্তীর প্রতিবাদ সভা, তার চেতনে কিংবা অচেতনে প্রতিশোধ সভায় পরিণত হয়েছে বলে আমি ধারণা করছি। সমাধানের চেয়ে জটিলতা বৃদ্ধির পথই খুলেছে বেশি। কি উদ্ভট সমাধান- গরু জবাই বন্ধ করেল সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা কম হবে। এই বুদ্ধি নিয়ে ঐক্য পরিষদের পরিচালক হলে অনৈক্য বাড়বে বৈ কমবেনা।
হ্যা, পুরোহিত হত্যা, সংখ্যালঘু সম্পত্তি দখল এসব অন্যায় ও নিন্দনীয় কাজ। কিন্তু এগুলো ধর্মীয় চেতনার কারণে হয়কি? তবলীগ ধর্মপ্রাণ গোষ্ঠী, আমার জানামতে ইসলাম ধর্মের প্রচারেই ব্যস্ত থাকে। এদেরকে কি কখনো এমন কাজ করতে দেখা গেছে? মনে হয়না। যার এসব কর্মের সাথে জড়িত, খোজ নিলে জানা যাবে এরা ইসলাম ধর্মটাও সঠিকভাবে পালন করেনা হয়ত। যারা এসব খুন ও লুট—তরাজের সাথে জড়িত, তারা বেশিরভাগই হল রাজনৈতিক ও স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি। এরা শুধু দেখে কাকে শোষণ করা যায় তা। তাই এদের কবল থেকে মুসলমানরাও রেহাই পায়না।মুসুলমানেরও লাশ পড়ে, সম্পত্তি বেহাত হয়। ০২/০৭/১৬ তারখে ঝিনাইদাহুতে মসজিদের মোয়াজ্জিন নিহত হয়। কিন্তু যখন কোন হিন্দুর উপর অন্যায় হয়, তখন অন্যায়কারীর লোভী ও নষ্ট মানসিকতার দিকে ইঙ্গিত না করে ধর্মের দিকে ইঙ্গিত করা হয়। এদেশে মুসলমান বেশি। তাই সংখ্যাগতভাবে অন্যায়কারী মুসলমান হওয়াটা স্বাভাবিক। কিন্তু নিশ্চিত হওয়া দরকার তারা যা করে আদৌ ইসলাম ধর্মের জন্য করে না ব্যক্তি স্বার্থের জন্য করে। শ্যামল চক্রবর্তী আরও বলেন, সখ্যালঘুদের উপর অত্যাচারের বিচার হয়না। কিন্তু এদেশে কোন বিচারটা হয়? তনু হত্যার বিচার হয় নাই, নারায়ণগঞ্জে ৭ খুনের বিচার হয় নাই, আরও কত বিচার হয় নাই তার খবর কে রাখে। এটা একটা সামাজিক অস্থিরতা, এর মাঝে ধর্মকে টেনে মানুষের মাঝে ভেদাভেদ সৃষ্টির কারণ দেখিনা।
তবে সরকার ও রাষ্ট্র তার দায় এড়াতে পারেনা।
বলছিলাম পরিচালক, শ্যামল চক্রবর্তীর কথা। তিনি বলেন ১৯৭২ এ মন্দিরের জায়গা দখল করে পার্ক করা হয়। কাজটা ভাল হয়নি নিশ্চয়। তখন নিশ্চয় আওয়ামীলীগ সরকারই ক্ষমতায়। তিনি এও বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের সাধারন সম্পাদক ছিলেন তিনি। এখন মোহ কেটে গেছে তাই সত্যি বলছেন। তখন কি তাহলে এসব নিন্দনীয় কর্মের মোহে তিনি ছিলেন? যাক, এই খুচরো প্রসঙ্গ তুলা থাক।
পরিচালক, শ্যামল চক্রবর্তীর আরও বলেন, চাকমা, মারমা, ইত্যাদি উপজাতিদের বাঙ্গালী হতে বলাটা অনুচিত। হতে পারে। কেন তারা বাঙ্গালী হবেন, যেখানে তাদের নিজস্ব ভাষা আছে। যারা বাংলায় কথা বলে ও বাংলা সংস্কৃত অনুসরণ করে তারাই বাঙ্গালী। কিন্তু উপজাতিদের বাংলাদেশী হতে বাধা কোথায়? তারা বংলাদেশী হোক।
চিন্তাহীন মানুষের মত চায়ের কাপে তুফান তুলার মত তিনি বলেন, পাহাড়ী অঞ্চল থেকে বাঙ্গালী যেন নির্মূল করা হয়। কিন্তু পাহাড়ীরা কি তাহলে শহরে দিকে আসবেনা? তাদের শিক্ষা তথা নানা উন্নয়নের পথ বন্ধ হয়ে যাবে যদি পাহাড়ীদের পাহাড়েই সীমাবদ্ধ রাখা হয়। আর তারা যদি শহরমুখী হয়ে উন্নয়নের পথে চলে, বাঙ্গালীও থাকুক পাহাড়ে। পুরো দেশজুড়ে সবার সমান বসবাসের অধিকার বজায় থাকুক। যা দরকার তা হল মৈত্রীসহাবস্থান, পৃথক দেয়াল নয়। সুস্থ ধারায় এর জন্যই সরকারের প্রতি আবেদন কর উচিত। তার বক্তব্যকে রাষ্ট্র ভাঙ্গনের অথবা রাষ্ট্র বিদ্রোহের ইঙ্গিতে ফেলা যায়। তবে আজ থাক।
“সংখ্যালঘু” একটা হিসাব কিংবা গণনায় ব্যবহৃত শব্দমাত্র। এটাকে নেগেটিভলি হাইলাইট না করলেও হয়। অসাম্প্রদায়িক সংবিধানে সকলের সমতার অধিকার প্রতিষ্ঠাই দরকার।
“হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ” এই ব্যানারটি দেখলেই মনে হয় অন্য কোথাও থেকে আলাদা বোঝাতে চাইছে। হিন্দুর সাথে বৌদ্ধ থাকলে, এদের সাথে মুসলমান থাকার বাধাটা কেন? এর চেয়ে ভাল হয় একটা ধর্মীয় ঐক্য পরিষদ করি, যেখানে সকল ধর্মের মানুষ থাকবে এবং ধর্ম মন্ত্রণালয় লক্ষ্য রাখবে যেন কোথাও বৈষম্য নাহয়। আমি জানি তা কঠিন কিন্তু সঠিক পথে না হাটলে পরিস্থিতি কঠিনতর হবে।
গুলশান, হলি আর্টিসানে, আইএস কর্তৃক আক্রমণের ৩ দিন আগে এই লেখাটি লেখা। প্রাসঙ্গিকতায় কিছু বলতে হয়। ইসলামিক স্টেট নাম দিলেই কেউ ইসলামের প্রতিনিধি হয়ে যায়না। ইসলামের কোথাও এমন নিরীহ মানুষ হত্যার নির্দেশ দেয়নি। ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করতেও বলা হয়নি। অথচ এসব কোনকিছু এরা মানবেনা। অন্যায় যেমন কোন ধর্মের সমর্থন পায়নি, তেমন অন্যায়কারী কোন ধর্মের নয়। অবিচারই তার ধর্ম। ধর্মে মানবিকতার বহির্ভূত কিছু থাকতে পারেনা। আইএস কি জানেনা, তাদের কৃতকর্মের জন্য যৌক্তিক বা অযৌক্তিকভাবে ইসলাম কলঙ্কিত হচ্ছে। এরা বাহ্যিকতায় ইসলামিক হলেও অন্তরে কি আল্লাহই ভাল জানেন। সত্যই যদি ইসলাম ধর্মে এদের মমতা থাকত তাহলে একে কলঙ্কিত করতনা। ইসলাম ধর্মের পথ প্রদর্শক নবী করিম সাঃ কখনোই ইসলাম প্রচারের জন্য মানবতার উর্ধ্বে মানবহত্যা ও বলপ্রয়োগকে প্রশ্রয় দেয়নি। এরা প্রকৃতপক্ষে ক্ষমতালোভী বিচ্ছিন্ন মানবতা বিরোধী। এই ক্রান্তিকাল আমাদের ধর্ম নিয়ে ভেদাভেদের সময় নয়। ধর্ম অন্তরে বিশ্বাসের বিষয় তা অভ্যন্তরেই থাক। পৃথিবীপৃষ্ঠে জয়ী হোক মানবতা।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা জুলাই, ২০১৬ সকাল ১০:৪৬