প্রসঙ্গের উপস্থিতিটা আজ তুলা থাক।
সৌন্দর্য অর্থ সর্বস্ব এ সমাজে দিনদিন অস্থায়ী হয়ে ঊঠছে। অস্থায়ী বলছি কেননা, আজ যা আমার কাছে সুন্দর বোধ হচ্ছে কাল তা সৌন্দর্যবিহীন। অথবা আমার কাছে যা সুন্দর অন্যের কাছে তা নয়। অথবা একই জিনিস ভিন্নস্থানে ভিন্নবোধের উৎপত্তি ঘটায়। অর্থাৎ সৌন্দর্য স্থান, কাল, পাত্রভেদে উপস্থিত কিংবা অনুপস্থিত।
সৌন্দর্য হল তাই যা মস্তিস্কে বিরূপ উত্তেজনার সৃষ্টি করে না বরং মনের মধ্যে একধরনের প্রশান্তির উৎপত্তি ঘটায়। এটা একধরনের সুখ যা স্বল্পস্থায়ীত্বের কিংবা দীর্ঘস্থায়ীত্বের হতে পারে। সুখটা যতক্ষন পাব ততক্ষন তাকে আমার সুন্দর মনে হবে।
সৌন্দর্যের উৎপত্তিস্থল দুটিঃ প্রথমটি হল বস্তুগত (Concrete), দ্বিতীয়টি হল ভাবগত (Abstract)। প্রথমক্ষেত্রে সৌন্দর্য প্রধানত আমাদের চক্ষুদর্শন নির্ভর। কারণ মানবদেহের ইন্দ্রিয়গুলোর মধ্যে চোখ সবচেয়ে দ্রুত কর্মক্ষম। পাহাড় ও অরণ্য, আরও সহজ উদাহরণ সুন্দরী তরুণী কিংবা সুদর্শন তরুণ। তাদের রং, সুগঠিত নাক, কালোচুল, শারিরীক কাঠামো ইত্যাদি একধরনের সৌন্দর্যের অবয়ব। কিন্তু এরা চক্ষুদর্শন নির্ভর। এরা প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হতে বাধ্য। কারণ, এর সবকিছুই আলোর প্রতিফলন, প্রতিসরণ ইত্যাদির নিয়ম মেনে চলে। আর্থাৎ সৌন্দর্যের আধার কোন পরিবেশে কোথায় রয়েছে, আলোর সাথে তার কৌনিক অবস্থান ইত্যাদির উপর নির্ভর করে স্নায়ুতন্ত্রে ভুল বোধোদয় ঘটাতে পারে। অর্থাৎ আপাত দৃষ্টিতে যা সুন্দর মনে হচ্ছে তা হয়ত আদৌ সুন্দর নয়। বিপরীতটাও হতে পারে।
ভাবগত (Abstract) উৎপত্তিস্থল, যা মানসিকতা ও মনের গভীরতার উপর নির্ভর করে। অনেক সময় একে দৃশ্যের অন্তরালে থাকা অদৃশ্য সৌন্দর্যের অনুধাবনও বলা যায়। উদাহরণস্বরূপ, মানুষের ব্যবহার, তার মানসিকতা, মননশীলতা, তার দর্শন এরা হল Abstract সৌন্দর্য্যের আধার। কোন কোন মানুষের ব্যবহার আমাদের মধ্যে এক ধরনের সুখের জন্ম দেয়। সেই ব্যবহারটাই এক ধরনের সৌন্দর্য। ভাবগত সৌন্দর্য হল একটা গভীর উপলব্ধি থেকে অনুভূত সুখ।
প্রাসঙ্গিকতায় একটি গল্প বলি- রাত তখন ১২/১ টা। আমি মগবাজার মোড়ে দণ্ডায় মান। ফিরতে হবে পলাশী, পকেটে টাকা মাত্র বিশটি। কোন রিক্সাচালক যেতে রাজি নয়। এমন সময় ৫০ উর্ধ্ব এক রিক্সাচালকের সাথে কথা হল। সে দাবি করল ৫০ টাকা। আমি স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে বললাম, চাচা পকেটে আছে মাত্র ২০ টাকা, ৫০ কোথা থেকে দিব? বলেই আমি হাঁটতে উদ্যত হই। তিনি আমার দিকে তাকালেন একবার, তারপর বললেন উঠুন। আমি বললাম, চাচা আমি হেটেই যাব; ২০ টাকায় পলাশী যাওয়া যায় না তা আমি জানি। উঠ বাবা, তোমার অনেক কষ্ট হবে, অনেকখানি রাস্তা। একজন রিক্সাচালক যখন আপনি থেকে তুমি করে বলে, তখন আর কোণ দ্বিতীয় জবাব খুঁজে পাওয়া যায়না, অন্তত আমি পাইনি। যাত্রাপথে কথায় কথায় চাচা বললেন, তার এক ছেলে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। আমার মত বিপদে তার ছলেও পড়তে পারত। তার এই মানবিক উপলব্ধির চিন্তাবোধ আমার মধ্যে একটা সুখের জন্মদেয়, চিন্তার সুসজ্জিত এই বিন্যাসটাই একটা সৌন্দর্য। উল্লেখ্য, আমি চাইলে তাকে পলাশী এসে ২০ টাকার বদলে, ৪০/৫০ টাকাই দিতে পারতাম। দিইনি। কেননা এতে তাকে অর্থসর্বস্ব জীবনের উপাদান ছাড়া আর কিছুই ভাবা হত না। আমার কাছে মনে হয়েছে তাকে বাড়তি (আপাত দৃষ্টিতে) টাকা দেয়ার অর্থ তার আবেগঘন মানসিকতাকে অবমূল্যায়ন ও অপমান করা। তাকে পয়সার হিসেবে বিচার করা।
প্রসঙ্গে ফিরে যাই, মানুষের জীবদেহ স্নায়ুতন্ত্র নির্ভর বলে আমরা বস্তুগত সৌন্দর্যকে অস্বীকার করতে পারব না। অর্থাৎ, বস্তুগত সৌন্দর্য দ্বারাই সর্বপ্রথম তাড়িত হব। এই তাড়ণা থেকে আমরা সৌন্দর্যের দিকে এগিয়ে যাব, সন্নিকটে আসব। এরপর বাধ্যতামূলকভাবে আসবে ভাবগত সৌন্দর্য (দু একটি বিশেষ ক্ষেত্রে এর আগমন আগেও ঘটতে পারে)। তবে কখনো কখনো এই ভাবগত সৌন্দর্যের উদয় নাও হতে পারে (নির্ভর করবে মানসিকতার উপর)। এই ভাবগত সৌন্দর্য যখন উদয় হবে তখন স্থায়িত্বের বুনিয়াদ শক্ত হবে, কেননা এর অনুভব পুরোটাই মানসিকতা নির্ভর, যার পরিবর্তন স্থান, কাল, অবস্থান দ্বারা খুব দ্রুত প্রভাবিত হয় না। অর্থাৎ, বস্তুগত সৌন্দর্যটা মানুষের মধ্যে খুব বেশি সময় ধরে ক্রিয়াশীল থাকতে পারে না, অন্যকথায় হয়ত বিষয়টাকে চটকদার বলা যায়। কিংবা আমরা শুধু একটা ভালো লাগাও বলতে পারি। ভাবগত সৌন্দর্য যখন উপস্থিত হয়, তখন বিষয়টা ভালোবাসার হয়, স্থায়ী হয় (ভালোলাগার আতিশায্যটাই ভালোবাসা, এই বিষয়ে “জীবনের কিছু প্রয়োজনীয় কথা” প্রবন্ধে আলোচনা করব)। উদাহরণ দিয়ে বিষয়টা একটু পরিস্কার করি। গহীন অরণ্য, সবুজের সমারোহ অনেকেরই ভালো লাগে, খুব সুন্দর মনে হয়। কিন্তু কিছুদিন থাকার পর, একই তীব্রতার গহীন সবুজ অরণ্য আর ভালো নাও লাগতে পারে। কিন্তু দৃষ্টিনির্ভর সবুজের সমারোহের বাইরেও যদি অরণ্যের গভীরতাকে অনুভব করা যায়, তার নৈঃশব্দকে অনুভব করা যায়, অন্ধকার অরণ্যের একাকীত্বের রোমাঞ্চকে অনুভব করা যায়, যদি অনুভব করা যায় অরণ্য পরিবেশ চক্রের আমিও একটা উপাদান, যে অনুভূতিগুলোর সবগুলোই মানসিকতা নির্ভর, গভীর উপলব্ধির ফলাফল, তাহলে গহীন অরণ্য শুধু আমার ভালোলাগা নয়, বরং ভালোবাসা। অর্থাৎ অরণ্যের সৌন্দর্যটা আমার মধ্যে স্থায়ীভাবে অবস্থান করছে। সুদীর্ঘ সময় ধরে জীবনে অরণ্যের উপস্থিতি আমাকে সুখ দিয়ে যাবে। আর তাই এই অরণ্য দীর্ঘকাল আমার কাছে সৌন্দর্য হয়ে থাকবে।
জানি আপনারা মানুষ নিয়ে ব্যস্ত, মানুষের ভিত্তিতেই উদাহরণ দিই এবার। আমার যদি কোন মানুষকে দৃষ্টিনির্ভর সুন্দর মনে হয় তাহলে তার কাছে হয়ত যাব। অথবা দৈনন্দিন স্বাভাবিক চলাফেরা ও পরিস্থিতির কারণে অন্য কোন একটা মানুষের সাথে আমাকে কিছুটা সময় অতিবাহিত করতে হয়। যখন বস্তুগত সৌন্দর্যের কারণে আমি তার নিকটবর্তী হই তখন দুটি বিষয় হতে পারে, এক, তার এই সৌন্দর্যকেই শুধু বুনিয়াদ রেখে অর্থাৎ ভাবগত সৌন্দর্য অনুভব না করে, তার সাথে থেকে যেতে পারি। এটা একধরনের ভালো লাগা, কোন গভীর অনুভূতি নেই। অনেকটা রোজ ভাত খাওয়ার মত অভ্যাসের বিষয়। দুই হতে পারে, তার মানসিকতা, চিন্তার বিন্যাস ইত্যাদির প্রতি গভীর অনুভূতি যার ফলাফল ভালোবাসা, সৌন্দর্যের স্থায়িত্ব। বিষয়টাকে প্রেমের সাথ গুলিয়ে ফেলবেন না (ভালোবসা ও প্রেম এই বিষয়ে “জীবনের কিছু প্রয়োজনীয় কথা” প্রবন্ধে আলোচনা করব)। দ্বিতীয়ক্ষেত্রে, স্বাভাবিকভাবে আমার পরিবেশে যার বাস, তার প্রতি চলাফেরায় একটা দৃষ্টিনির্ভর সৌন্দর্যের আগমন ঘটতে পারে, এখানেই সীমাবদ্ধ থাকতে পারে অথবা বস্তুগত সৌন্দর্যের পর ভাবগত সৌন্দর্যের আগমন হতে পারে, অথবা বস্তুগত সৌন্দর্যের প্রয়োজন ছাড়াই ভাবগত সৌন্দর্যের প্রভাব পাওয়া যেতে পারে। যেদিক দিয়েই বিষয়টা বিবেচনা করি না কেন, কোন মানুষকে আমার স্থায়ী সৌন্দর্য্য মনে হবে তখনই যখন তার প্রতি আমার একটা মানসিকতা নির্ভর গভীর অনুভূতি কাজ করবে। তখন তার সৌন্দর্যটা আমার দর্শন ইন্দ্রিয়ের উপর নির্ভর করবে না, কেননা পুরো বিষয়টা মানসিক, অর্থাৎ, মানুষটি আমার আশেপাশে বা পরিবেশের মধ্যে না থাকলেও সে আমার কাছে সৌন্দর্যই থেকে যাবে। এবং আমার স্মৃতিতে তার উপস্থিতি একটা সুখের উৎস হবে। বিষয়টা হল সে আমার বস্তুজগতে না থাকলেও ভাবগত জগতে খুব দৃঢ়ভাবে সৌন্দর্য হিসেবে থাকবে।
এ প্রসঙ্গে বলে রাখছি, ১৮০০০ মাখলুকাতের মধ্যে একমাত্র মানুষেরই মস্তিষ্ক আছে যার একটা সুবিন্যস্ত মানসিকতা আছে। কোন মানুষের প্রতি আমার অনুভূতি যখন ভাবগত সৌন্দর্য পর্যন্ত পৌছে যায় তখন তার বস্তুগত সৌন্দর্য আর প্রয়োজন হয় না। অন্য কথায় বলা যায়, ভাবগত সৌন্দর্য্যের উপস্থিতির পর বস্তুগত সৌন্দর্য্য কোন কারণ ছাড়াই দীর্ঘকাল উপস্থিত থেকে যায়। আর এইভাবেই মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্ক দীর্ঘকাল সুখময় হয়ে উঠে।
আমার এক বন্ধুর একটা কথা মনে পড়ছে, খুব ভালো লেগেছিল কথাটা। কথাটা স্বামী-স্ত্রী সমপর্কে। বলেছিল- শরীর দুটো মানুষকে কতক্ষণ একসাথে রাখবে? বড়জোড় ১০/৩০/৬০ মিনিট। ২৪ ঘন্টার মধ্যে বাকি ২৩ ঘন্টা কি নিয়ে দুজন মানুষ একসাথে থাকবে? প্রশ্নটা খুব প্রাসঙ্গিক মনে হচ্ছে এখন। হ্যা ওই দুটো মানুষ একসাথে থাকবে যদি তাদের মধ্যে একে অপরের প্রতি ভাবগত সৌন্দর্যের উপস্থিতি থাকে। এই স্থিতিশীল সৌন্দর্য ছাড়া তারা একসাথে থাকতে পারবে না। জীবনকে হয়ত টেনে নিয়ে যেতে পারবে মৃত্যু পর্যন্ত। কিন্তু এটা ঠিক বেচে থাকা নয়, শুধু জীবিত থাকা।
দুটো মানুষ যেভাবে যেই পরিস্থিতিতেই কাছাকাছি আসুক না কেন, একটা পর্যায়ে বস্তুগত সৌন্দর্য অস্থায়ী বলে তাকে আর সুন্দর মনে হয় না, কিংবা সুন্দর হলেও তা আর অনুভূত হয় না। বস্তুগত সৌন্দর্যটাই এমন। তাই শুধু এই বস্তুগত সৌন্দর্য নির্ভর সম্পর্কগুলো পরবর্তীতে সম্পর্ক অবনতির একটা সুযোগ রেখে যায়। কিন্তু বস্তুগত সৌন্দর্য্য থেকে কিংবা না থেকে, যদি ভাবগত সৌন্দর্য উপস্থিত থাকে সম্পর্কের মাঝে তাহলে সারা জীবন দুটো মানুষ একসাথে সুখে থাকার সম্ভাবনা বেশি।
আমাদের যখন কোন জিনিসকে কিংবা কোন মানুষকে সুন্দর মনে হয় তখন আসলে সেই গভীর উপলব্ধি উদ্ভুত ভাবগত সৌন্দর্যের গভীরতা কতটুকু তা বুঝা দরকার। অন্যকথায় বস্তুগত সৌন্দর্য আমাদের সহজাত বৈশিষ্ট্য ও অস্থায়ী বলে, বস্তুগত সৌন্দর্যের চেয়ে ভাবগত সৌন্দর্যের প্রতি অধিক যত্নশীল ও অধিক মনযোগী হওয়াই জীবনের জন্য উত্তম।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই অক্টোবর, ২০১৬ সন্ধ্যা ৭:৩৫