somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বাংলাদেশের নিভৃতচারী কয়েকজন বরেণ্য বিজ্ঞানীর সংক্ষিপ্ত জীবনী

২২ শে জানুয়ারি, ২০১৯ দুপুর ২:৩৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
অধ্যাপক ড . জামাল নজরুল ইসলাম



অধ্যাপক ড . জামাল নজরুল ইসলাম ছিলেন একজন পদার্থবিদ, গণিতবিদ, জ্যোতির্বিজ্ঞানী, বিশ্বতত্ত্ববিদ ও অর্থনীতিবিদ। তবে মহাবিশ্বের উদ্ভব ও পরিণতি বিষয়ে মৌলিক গবেষণার জন্য বিশেষভাবে খ্যাত তিনি। বলা হয়, বাংলাদেশের বিজ্ঞানীদের মধ্যে মৌলিক বিজ্ঞানে তার মতো অবদান আর কারও নেই। ১৯৩৯ সালে ঝিনাইদহে বাবার কর্মস্থলে জন্মগ্রহণ করেন বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী প্রয়াত অধ্যাপক ড. জামাল নজরুল ইসলাম। জামাল নজরুল ইসলামের স্কুলজীবন শুরু হয় কলকাতায়, সেখান থেকে চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলে কিছুদিন, শেষে পাকিস্তানের লরেন্স কলেজ থেকে সিনিয়র কেমব্রিজ পাস করেন। বিএসসি সম্মান ডিগ্রি অর্জন করেন কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে। এরপর বৃত্তি নিয়ে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিতে ট্রাইপজে তিন বছরের কোর্স দুই বছরে শেষ করেন। ১৯৬০ সালে কেমব্রিজ থেকেই মাস্টার্স। ১৯৬৪ সালে এখান থেকেই প্রায়োগিক গণিত ও তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর ড. ইসলাম অত্যন্ত দুর্লভ ও সম্মানজনক ডক্টর অব সায়েন্স বা ডিএসসি ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন। ছাত্রজীবনে তাঁর সমসাময়িক ও আজীবনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন বিস্ময়কর বিজ্ঞান-প্রতিভা স্টিফেন হকিং। জামাল নজরুল ইসলাম ১৯৬৩ থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ডক্টরাল ফেলো ছিলেন। ১৯৬৭ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত কেমব্রিজ ইনস্টিটিউট অব থিওরেটিক্যাল অ্যাস্ট্রোনমিতে গবেষণা করেছেন। ১৯৭১-৭২ দুই বছর ক্যালটেক বা ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে ভিজিটিং অধ্যাপক ছিলেন। তিনি ১৯৭৩-৭৪ সালে লন্ডনের কিংস কলেজে ফলিত গণিতের শিক্ষক, ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয়ে সায়েন্স রিসার্চ ফেলো এবং ১৯৭৮ থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত মনে সিটি ইউনিভার্সিটিতে অধ্যাপনা করেছেন। এর মধ্যে জামাল নজরুল ইসলামের অনেক গবেষণা নিবন্ধ বিখ্যাত সব বিজ্ঞান জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে এবং ১৯৮৩ সালে তাঁর গবেষণাগ্রন্থ দ্য আল্টিমেট ফেইট অব দ্য ইউনিভার্স কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত হলে সারা বিশ্বের কসমোলজিস্টদের মধ্যে হইচই পড়ে যায়। দ্রুত বইটি পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়। পরের বছর কেমব্রিজ থেকেই প্রকাশিত হয় ক্লাসিক্যাল জেনারেল রিলেটিভিটি। তাঁর গবেষণা আইনস্টাইন-পরবর্তী মহাবিশ্ব গবেষণায় বিরাট অবদান রেখেছে। তিনি এই ধারায় গবেষণা অব্যাহত রেখে পরবর্তীকালে লেখেন ফার ফিউচার অব দ্য ইউনিভার্স বা মহাবিশ্বের দূরবর্তী ভবিষ্যৎ। কেমব্রিজ এবং পশ্চিমে শিক্ষার গবেষণা ও অধ্যাপনায় থাকাকালে তাঁর বন্ধু ও সুহৃদমহল গড়ে ওঠে বিশ্বের সেরা বিজ্ঞানীদের নিয়ে। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন তাঁর শিক্ষক ফ্রিম্যান ডাইসন, পদার্থবিজ্ঞানী রিচার্ড ফাইনম্যান, ভারতের সুব্রহ্মনিয়াম চন্দ্রশেখর, পাকিস্তানের আবদুস সালাম, ভারতীয় অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন ও অমিয় বাগচী, তাঁর সহপাঠী জয়ন্ত নারলিকার, ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ জিম মার্লিস প্রমুখ।

১৯৮৪ সালে প্রফেসর ইসলাম তাঁর জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিলেন। পশ্চিমের উন্নত দেশে ৩০ বছরের অভ্যস্ত জীবন, সম্মানজনক পদ, গবেষণার অনুকূল পরিবেশ, বিশ্বমানের গুণীজন সাহচর্য এবং আর্থিকভাবে লোভনীয় চাকরি ছেড়ে দুই মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে দেশে ফিরে এলেন। এলেন একেবারে নিজ জেলা চট্টগ্রামে। অতি দামি চাকরি ছেড়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত বিভাগে যোগ দিলেন মাসিক তিন হাজার টাকা বেতনে। এবং সারাজীবন সেখানেই চাকরি করে গেছেন , চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদগ্রহণের আহবান ও তিনি অত্যন্ত বিনয়ের সাথে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন , নিভৃতচারী এই বিজ্ঞানী কখনোই আলোচনায় থাকেননি , ২০১৩ সালের ১৬ মার্চ মধ্যরাতে এ মহান বিজ্ঞানী আমাদের ছেড়ে গেছেন।

ড. ওয়াজেদ মিয়া



ড. ওয়াজেদ মিয়া বাংলাদেশের একজন খ্যাতনামা পরমানু বিজ্ঞানি , গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বামী। তিনি বাংলাদেশ পরমানু শক্তি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান । তিনি ১৬ফেব্রুয়ারী ১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দ রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার ফতেহপুর গ্রামে জন্ম গ্রহন করেন। গ্রামের প্রাইমারি বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত পড়ে, পীরগঞ্জ থানার হাইস্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত অধ্যয়ন শেষে তিনি ১৯৫২ সালে রংপুর জিলা স্কুলে সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি হন। ১৯৫৬ সালে সেখান থেকেই তিনি ডিসটিনকশন সহ প্রথম বিভাগে মেট্রিকুলেশন পাশ করেন। ১৯৫৮ সালে রাজশাহী সরকারি কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় বিজ্ঞান শাখায় প্রথম বিভাগে দ্বিতীয় স্থান লাভ করেন। ১৯৬১ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের স্নাতক (সম্মান) পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে দ্বিতীয় স্থান লাভ করেন । ১৯৬২ সালে স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হন। ১৯৬৭ সালে লন্ডনের ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৬৩ সালের ১ এপ্রিল তিনি তৎকালীন পাকিস্তান আণবিক শক্তি কমিশনের চাকরিতে যোগদান করেন। ১৯৬৩-’৬৪ শিক্ষা বছরে তিনি লন্ডনের ইম্পেরিয়াল কলেজের ‘ডিপ্লোমা অব ইম্পেরিয়াল কলেজ কোর্স’ কৃতিত্বের সঙ্গে সম্পন্ন করেন। ১৯৬৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে যুক্তরাজ্যের ‘ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয়’ থেকে পদার্থ বিজ্ঞানে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করলে তাকে ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হিসেবে ঢাকার আণবিক শক্তি গবেষণা কেন্দ্রে পদস্থ করা হয়।তিনি ১৯৬৭ সালের ১৭ নভেম্বর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জ্যেষ্ঠ কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ১৯৬৯ সালে ইতালির ট্রিয়েস্টের আন্তর্জাতিক তাত্ত্বিক পদার্থ বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্র তাকে এসোসিয়েটশিপ প্রদান করে। এই সুবাদে তিনি ১৯৬৯-’৭৩ ও ১৯৮৩ সালে ওই গবেষণা কেন্দ্রে প্রতিবার ৬ মাস ধরে গবেষণায় নিয়োজিত ছিলেন। ১৯৬৯ সালের নভেম্বর থেকে ১৯৭০ সালের অক্টোবর পর্যন্ত তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন শহরের ড্যারেসবেরি নিউক্লিয়ার ল্যাবরেটরিতে পোস্ট ডক্টোরাল গবেষণায় নিয়োজিত ছিলেন। ১৯৭১ সালে এদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং এর আগে ও পরের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তার উপস্থিতি ছিল উল্লেখযোগ্য।
১৯৭৫ সালের ১২ মার্চ থেকে ২৪ আগস্ট পর্যন্ত তিনি তৎকালীন পশ্চিম জার্মানির কার্লসরুয়ে শহরের ‘আণবিক গবেষণা কেন্দ্রে’ আণবিক রিঅ্যাক্টর বিজ্ঞানে উচ্চতর প্রশিক্ষণ লাভ করেন।১৯৭৫ সালের ১ অক্টোবর থেকে ১৯৮২ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তিনি ভারতের আণবিক শক্তি কমিশনের দিল্লির ল্যাবরেটরিতে গবেষণায় নিয়োজিত ছিলেন। তিনি অনেক জাতীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান বিষয়ক সম্মেলনে যোগদান করেন। তার অনেক গবেষণামূলক ও বিজ্ঞান বিষয়ক প্রবন্ধ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পত্র-পত্রিকায় এবং সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়েছে। বিশিষ্ট পরমাণু বিজ্ঞানী ড. ওয়াজেদ মিয়া ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর দীর্ঘ সাত বছর নির্বাসিত জীবন কাটান। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক স্তরের পদার্থ বিজ্ঞান, ফলিত পদার্থ বিজ্ঞান ও প্রকৌশলের ছাত্রদের জন্য দুটি গ্রন্থ রচনা করেছেন ড. ওয়াজেদ মিয়া আণবিক শক্তি কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে ১৯৯৯ সালে অবসর নেন। অত্যন্ত নিভৃতচারী এবং সজ্জন এই ব্যাক্তি ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে থেকেও কোনোদিন আলোচনায় আসেননি , তার উদ্যোগে বঙ্গবন্ধু ঢাকার অদূরে সাভারে বাংলাদেশের পরমাণু শক্তি গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্থাপনের উদ্যোগ নেয় যা দেশের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান স্থাপনা , বর্তমানে বাস্তবায়নাধীন রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎ প্রকল্পের স্বপ্নদ্রষ্টা ছিলেন তিনি , ২০০৯ সালের ৯ই মেঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে ৬৭ বছর বয়সে তার মৃত্যু হয়।

ড. মাকসুদুল আলম



ড. মাকসুদুল আলম, বাংলাদেশের ইতিহাসে গর্বের এক নাম। জীববিজ্ঞানের জগতে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। যিনি তাঁর গবেষণা ও আবিষ্কার দিয়ে কৃষিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে গেছেন। তিনটি উদ্ভিদ ও ছত্রাকের জিনোম সিকুয়েন্সিং করে যিনি স্থান নিয়েছেন সেরা সেরা কিছু বিজ্ঞানীর তালিকায় , ড. মাকসুদুল আলমের জন্ম ১৯৫৪ সালের ১৪ ডিসেম্বর, ফরিদপুরে। বেড়ে ওঠা পিলখানায়। গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাই স্কুল থেকে মাধ্যমিক এবং ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে স্বাধীনতার পর মাকসুদুল আলম পাড়ি দেন রাশিয়ার মস্কো স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ে। তিনি ১৯৭৯ সালে রাশিয়ার মস্কো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাইক্রোবায়োলজিতে এমএস ডিগ্রী লাভ করেন। একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৮২ সালে মাইক্রোবায়োলজিতে পিএইচডি লাভ করেন। ১৯৮৭ সালে জার্মানির ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইনস্টিটিউট বায়োকেমিস্ট্রিতে পিএইচডি ডিগ্রী লাভ করেন। উচ্চশিক্ষা শেষে যোগ দেন যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৯৭ সালে আবিষ্কার করেন ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া হেলো ব্যাকটেরিয়ামের জীবনরহস্য। সেই থেকে শুরু। তাঁর নামের সঙ্গে একের পর এক নিয়মিত যুক্ত হতে থাকে নানা প্রাণরহস্য উন্মোচনের কৃতিত্ব। তিনি ২০১০ সালে পাটের জীবনরহস্য উন্মোচন করে দেশে-বিদেশে সাড়া ফেলে দেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের হয়ে পেঁপে, মালয়েশিয়ার হয়ে রাবার ও বাংলাদেশের হয়ে পাট ও ছত্রাকের জীবনরহস্য উন্মোচন করেন। বিজ্ঞানী মাকসুদুল আলম-এর নেতৃ্ত্বে বিজ্ঞানীদের দলটি “ম্যাক্রোফমিনা ফাসিওলিনা” নামক ছত্রাক নিয়ে গবেষণা করেন। এ ছত্রাকটি উদ্ভিদের বিভিন্ন ধরনের ক্ষতি করে থাকে যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য রোগ হলো ব্লাইট। এই ছত্রাকের আক্রমণের ফলে উদ্ভিদের আক্রান্ত অংশ শুষ্ক ও বিবর্ণ হয়ে যায়| এই রোগে আক্রান্ত উদ্ভিদের শিকড় পঁচে যায় বা ধীরে ধীরে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। পাটসহ প্রায় ৫০০ উদ্ভিদের স্বাভাবিক বিকাশকে এই ছত্রাক বাধা প্রদান করে। ২০১২ সালে তাঁর দল পাটের জন্য এই ক্ষতিকর ছত্রাকের জীবনরহস্য উন্মোচন করায় উন্নত পাটের জাত উদ্ভাবনের দিকে আরেক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যায় বাংলাদেশকে। ড. মাকসুদুল আলম প্রথম চমক দিয়েছিলেন পেঁপের জীবনরহস্য ভেদ করে। যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াইতে নানা রোগের কারণে ভীষণ ক্ষতির শিকার হচ্ছিলেন পেঁপেচাষীরা। মুক্তির প্রাণপণ চেষ্টা করছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞানীরা। ফল মিলছিলো না। মাকসুদুল আলম এ গবেষণায় সফল হয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন। এবার তাঁর কাছে ডাক আসে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে, রাবারের জীবনরহস্য উন্মোচনের। প্রকল্পের অর্থ বরাদ্দ দিয়ে গবেষণার সর্বময় ক্ষমতা দেওয়া হয় তাঁকে। এখানেও তিনি যথারীতি সফল। মস্কো, হাওয়াই, মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুর বা দক্ষিণ আফ্রিকার ডারবান বিশ্ববিদ্যালয়ে মাকসুদুলের নেতৃত্বে গবেষণার পর গবেষণায় আলোকিত হতে থাকে প্রাণের বিচিত্র জীবনরহস্য।

নভেম্বর ২০০৯-এ প্রথম আলোর এক ক্রোড়পত্রে প্রকাশিত হয় তাঁর কৃতিত্বগাথা: ‘পেঁপের পর রাবারের জিন-নকশা উন্মোচন করলেন বিজ্ঞানী মাকসুদুল আলম: উন্মোচিত হোক আমাদের পাটের জিন-নকশা’। তাতে চোখ পড়ে কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীর। মাকসুদুলকে তিনি দেশে ফিরে আসার আহ্বান জানিয়ে দায়িত্ব দেন পাটের জীবন-নকশা উন্মোচনের। তাঁর পাট ও ছত্রাকের জীবনরহস্য ভেদের কাজ শুরু হয়েছিল ২০১০ সালে। সে গবেষণায় ছিল এ দেশের প্রায় ৩০ জনের এক গবেষকদল। এর মূল নেতৃত্বে ছিলেন মাকসুদুল আলমসহ মোট পাঁচজন গবেষক। তিন বছর মেয়াদের সে প্রস্তাবিত গবেষণার ফল তাঁরা বের করে আনেন এক বছরের মাথায়। মাকসুদুল আলমের জন্য মাসে ১৬ লাখ টাকা পারিশ্রমিক ধরা হয়েছিল। তিন বছরে যার পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় পৌনে ছয় কোটির টাকা। কিন্তু সে পারিশ্রমিক তিনি গ্রহণ করেননি। দেশের তরুণ প্রজন্মের মধ্যে জিন বিজ্ঞানী তৈরীর কাজও অনেক দূর অগ্রসর হয়েছিলো। পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটের আওতায় একটি বায়োটেকনোলজি সেন্টার স্থাপিত হয়েছে। এক ঝাঁক তরুণ জিন বা জিনোম বিজ্ঞানীও তৈরী করে গেছেন তিনি। মহৎ এই বিজ্ঞানী ২০১৪ সালের ২০ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াইয়ে কুইন্স মেডিকেল সেন্টারে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।

ড. শাহ মোহাম্মদ ফারুক
শাহ মোহাম্মদ ফারুক একজন বাংলাদেশী বিজ্ঞানী এবং ভিব্রিও কলেরীর একজন অগ্রগণ্য গবেষক। শাহ মোহাম্মদ ফারুক ১৯৫৬ সালে যশোর জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। যশোর জিলা স্কুল ও ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজে পড়াশোনা শেষ করে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর প্রাণরসায়ন ও অণুপ্রাণবিজ্ঞান বিভাগ থেকে ১৯৭৮ সালে বিএসসি ও ১৯৭৯ সালে এমএসসি ডিগ্রি অর্জন করেন। ড. ফারুক ১৯৮৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও অণুপ্রাণবিজ্ঞান বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন। পরবর্তীতে তিনি ঢাকা বিশবিদ্যালয়ের চাকুরী থেকে অব্যাহতি নিয়ে আইসিডিডিআরবিতে যোগদান করেন তিনি ১৯৮৮ সালে যুক্তরাজ্যের রিডিং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন। অত্যন্ত মেধাবী এই বিজ্ঞানী বর্তমানে সিনিয়র সায়েন্টিস্ট হিসেবে আইসিডিডিআরবিতে কর্মরত আছেন , উনার গবেষণালব্ধ ফলাফল ইতিমধ্যেই বিশ্ববিখ্যাত নেচার জার্নাল ছাড়াও আরো অনেক নামকরা জার্নাল এ প্রকাশিত হয়েছে

ড . আবেদ চৌধুরী



আবেদ চৌধুরী একজন বাঙ্গালী জিনবিজ্ঞানী, বিজ্ঞানলেখক এবং কবি। ১৯৫৬ সালের ১ ফেব্রুয়ারি মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া উপজেলার কানিহাটি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। আবেদ চৌধুরী আধুনিক জীববিজ্ঞানের প্রথম সারির গবেষকদের একজন। তিনি পড়াশোনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে, যুক্তরাষ্ট্রের অরেগণ স্টেট ইনিস্টিটিউট অফ মলিকুলার বায়লজি এবং ওয়াশিংটন স্টেটের ফ্রেড হাচিনসন ক্যান্সার রিসার্চ ইনিস্টিটিউটে। ১৯৮৩ সালে পিএইচ.ডি গবেষণাকালে তিনি রেকডি নামক জেনেটিক রিকম্বিনেশনের একটি নতুন জিন আবিষ্কার করেন যা নিয়ে আশির দশকে আমেরিকা ও ইউরোপে ব্যাপক গবেষণা হয়।
তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনিস্টিটিউট হেলথ, ম্যাসাচুসেট্‌স ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি এবং ফ্রান্সের ইকোল নরমাল সুপিরিয়রের মতো স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা ও গবেষণা করেছেন। তার সাম্প্রতিক আবিষ্কার হচ্ছে সোনালী মিনিকেট চাল যা ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে

ড. জাহিদ হাসান



ড. জাহিদ হাসানের মতো আন্তর্জাতিকভাবে প্রখ্যাত এবং সম্মানিত কোন পদার্থবিজ্ঞানী বাংলাদেশিদের মাঝে দ্বিতীয়টি নেই। অনাগতকালে আমরা তাঁর নাম অত্যন্ত শ্রদ্ধা এবং গর্বভরে স্মরণ করব বলে আশা রাখি। যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে ড. জাহিদ হাসানের নেতৃত্বে একদল গবেষক মুল তত্ত্বের ৮৫ বছর পর আবিষ্কার করেছেন ভরহীন কণা- ভাইল ফার্মিয়ন। এর ফলে আগামী প্রজন্মের ইলেক্ট্রনিক প্রযুক্তিতে যুগান্তকারী বিপ্লবের সম্ভাবনা আছে। কারণ, এই ভরহীন কণার রয়েছে কোন ক্রিস্টালের ভিতর দিয়ে বাধাহীনভাবে চলার অস্বাভাবিক ক্ষমতা। এ বিষয়ে জাহিদ হাসান মিডিয়াকে বলেছেন, এই আবিষ্কার কাজে লাগিয়ে তৈরি করা নতুন প্রযুক্তির মোবাইল ফোন ব্যবহারের সময় তা সহজে গরম হবে না। কারণ, এই কণার ভর নেই। এটি ইলেক্ট্রনের মতো পথ চলতে গিয়ে বিক্ষিপ্ত হয়না। ১৯৮৬ সালে ধানমন্ডি সরকারী বালক উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষায় সম্মিলিত মেধা তালিকায় দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন জাহিদ হাসান। ১৯৮৮ সালে ঢাকা কলেজ থেকে এইচএসসিতে প্রথম স্থান অধিকার করেন তিনি। এরপর চলে আসেন আমেরিকায়। নোবেল পুরস্কার বিজয়ী তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানী স্টিফেন ভাইনভার্গের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ নিতে অধ্যয়ন করেন ইউনিভার্সিটি অফ টেক্সাস অস্টিনে, বিষয় হিসাবে বেছে নেন প্রিয় বিষয় পদার্থ বিজ্ঞান। সেই ছোটবেলা থেকেই এই বিষয়ের প্রতি জাহিদ হাসানের আকর্ষণ, দশম শ্রেণিতে পড়ার সময় নিজেই লিখে ফেলেন বই-‘এসো ধূমকেতুর রাজ্যে’। অস্টিনে আন্ডারগ্র্যাজুয়েট শেষে চলে যান স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স এবং পিএইচডি করতে। পদার্থ বিজ্ঞানে পিএইচডি চলাকালেই তাঁর নামডাক পদার্থ বিজ্ঞানের দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে, কাজ করেন বহু নামী দামি নোবেল বিজয়ীদের সাথে এবং এক পর্যায়ে প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষকতার অফার পান। প্রথম আলোর ইন্টার্ভিউতে তাঁর নিজের ভাষায়, ‘আমি একটা বক্তৃতা দিতে গেছি প্রিন্সটনে। বক্তৃতা শেষেই তারা আমাকে প্রিন্সটনে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ জানায়। কোনো জীবনবৃত্তান্তও তৈরি ছিল না। পিএইচডিও শেষ হয়নি।’ পিএইচডি শেষ করেই আইনস্টাইন, নিলস বোর, ওপেন হাইমারের বিশ্ববিদ্যালয় প্রিন্সটনে যোগ দেন, শুরু করেন অসাধারণ রিসার্চ। এরই মধ্যে প্রায় ২০ জন শিক্ষার্থী তাঁর তত্ত্বাবধানে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেছে। প্রকাশ করেছেন ১০০ এর বেশি জার্নাল পেপার, যার ১৬,০০০ এর মতন সাইটেশান হয়ে গেছে, যা কোন মামুলি ব্যাপার নয়। এইসব পেপারের প্রায় সবগুলোই ছাপা হয়েছে নেচার, সায়েন্স, ফিজিক্যাল রিভিউ, ফিজিক্স টুডের মতো বিখ্যাত সব সায়েন্স জার্নালে। অত্যন্ত প্রতিভাবান না হলে এসব বিখ্যাত জার্নালে এই মানের পাবলিকেশন এত স্বল্প সময়ে সম্ভব নয়। ১৯৯৮ সাল থেকে এই পর্যন্ত ইউএসএ, ইউরোপ এবং এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ২২৫ এর অধিক কনফারেন্স/সেমিনার/লেকচার দিয়েছেন। কাজ করছেন CERN ল্যাব, ব্রুকহেভেন ন্যাশনাল ল্যাব, লরেন্স বার্কলে ল্যাবের মত বিখ্যাত সব ল্যাবরেটরিতে।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০২০ সন্ধ্যা ৭:৫২
১৯টি মন্তব্য ১৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×