১।
উনিশ শতকের গোঁড়া থেকে বিংশ শতক পর্যন্ত আমেরিকার পররাষ্ট্র বিষয়ক নীতি আবর্তিত হয়েছে ' মনরো ডকট্রিন ' কে কেন্দ্র করে । ' মনরো ডকট্রিন ' হল ১৮২৩ সালে আমেরিকার পঞ্চম প্রেসিডেন্ট জেমস মনরোর কংগ্রেসে দেয়া একটি লিখিত ভাষণ । এর মূল কথা হল _ মার্কিনীরা ইউরোপে কোন হস্তক্ষেপ করবেনা এবং একই ভাবে ইউরোপিয়ানরাও মার্কিনীদের বিষয়ে নাক গলাবেনা ! বলাই বাহুল্য যে , সে সময় বিশ্বসাম্রাজ্যবাদের হর্তা - কর্তা ছিল মূলত ব্রিটিশরা । মার্কিন উপনিবেশ হারানোর ক্ষয় - ক্ষতি ইতিমধ্যে তারা কাঁটিয়ে উঠেছে অস্ট্রেলিয়ায় ঘাটি গেড়ে । ফলে মার্কিনীদের ঘাঁটানোর আর কেউ থাকলনা । তারা পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে রইল গোটা একশো বছর । এই সময়ে মার্কিনীরা নিজেদের মতো করে এগুতে লাগলো , শিল্পায়ন , নগরায়ন , বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উৎকর্ষতার ফলে বিংশ শতাব্দীতে তারা আত্মপ্রকাশ করল বিশ্ব সভ্যতার নিয়ন্ত্রক হিসেবে !
আমার বিশ্বাস বাংলাদেশের মানুষ শান্তিকামি । আমরা যুদ্ধে বিশ্বাস করিনা ! আমরা সম্প্রিতি ও সংহতির মাঝে বাঁচতে চাই । আমরা বাইরের কোন রাষ্ট্রের উপর হস্তক্ষেপে আগ্রহী নই , এবং তার সাথে সাথে ভিনদেশী সাম্রাজ্যবাদ ও নয়া - উপনিবেশবাদের অধীনে ও থাকতে রাজি নই । বিশ্বায়নের যুগে একেবারে বিচ্ছিন্ন হওয়া সম্ভব কিনা সেটা হুট করে বলা শক্ত । ফলে একশো বছর শান্তিতে থাকা আমাদের জন্য মরীচিকা ! অন্তত তিনটা কাজ করা যেতে পারে _
১। বিশ্বব্যাংক , আইএমেফ , বিদেশী এনজিও , খ্রিষ্টান মিশন , সহ সমস্ত অর্থলগ্নিকারি ও ঋণদানকারী প্রতিষ্ঠান এর কার্যক্রম বন্ধ করে দিতে হবে ।
২। ভারি শিল্পকারখানা গড়ে তুলতে হবে । অন্তত প্রাথমিক স্তরে এই তিনধরনের কারাখানা তৈরি প্রয়োজন , ক _বৃহৎ বিদ্যুৎ নির্মাণ প্রকল্প ( কুইক রেন্টাল না )। খ _ ইস্পাত শিল্প কারখানা । গ_ ক্ষুদ্র যন্ত্রপাতি তৈরির কারখানা ।
৩। বাংলাদেশ ও বঙ্গপসাগর অর্থনৈতিক ও সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে এশিয়ার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভোগোলিক স্থান । এই বিষয়টি মাথায় রেখে পার্শ্ববর্তী দেশের সাথে জিওপলিটিক্স টা বুঝে এবং সেই মতো কাজ করতে পারলেই ভারতীয় সম্প্রসারনবাদ বন্ধ করা যাবে ।
২ ।
বাংলাদেশের প্রধানতম সমস্যা কোনটি ? কোরাপসন নাকি অপ্রতুল জ্বালানী শক্তি ?ট্রাফিক জ্যাম নাকি কীটনাশক বা সার ? উহু ! আমাদের সবচে বড় সমস্যাটা হল আমরা স্বপ্ন দেখতে পারিনা । আমরা একটা ডিপরেসড জাতি । বাসে ঝুলতে ঝুলতে , চায়ের দোকানের খুপচিতে , বা ডাইনিঙে ঢেকুর তুলতে তুলতে আমরা রাষ্ট্রীয় হতাশার গল্প করি ।হতাশা আমাদের ডিএনএ প্রতিলিপিতে পার্মানেন্ট স্থান করে নিয়েছে ।
জাতিকে মাথা তুলে দাড়াতে হলে রাষ্ট্রীয় হতাশা কে অবশ্যই ঝেটিয়ে বিদায় করতে হবে । এর জন্য প্রয়োজন সংস্কার ;মনস্তাত্ত্বিক সংস্কার ! এই সংস্কারের জন্য প্রয়োজন সাংস্কৃতিক বিপ্লব !আমরা একটা শক্তিশালী সাংস্কৃতিক বিপ্লবের স্বপ্ন দেখি যা গোটা বিশ্বব্যবস্থাকে কাপিয়ে দেয়ার ক্ষমতা রাখে ।
বিপ্লবের কি আদৌ কোন প্রয়োজনীয়তা আছে ? বিপ্লবের জন্য আমরা কি প্রস্তুত ? বিপ্লবের ধরন কি হবে ? আদর্শ কি হবে ?- এই প্রশ্ন গুলো গুরুত্বপূর্ণ ।সমগ্র রাষ্ট্র তার সাথে সাথে বিশ্ব ব্যবস্থা সম্পর্কে পরিস্কার ধারনা না থাকলে এই বিষয়ে সঠিক উত্তর দেয়া মুস্কিল !তবে আমি শুধু এই টুকু বলতে চাই _ বিপ্লবের প্রয়োজনীয়তা ছিল , আছে এবং থাকবে !
এই মুহূর্তে আমাদের প্রয়োজন _ সঠিক পরিকল্পনা আটা । নিজেদের সামর্থ্য , সম্ভবনা এবং সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে পুঙ্খানু পুঙ্খানু পরিসংখ্যান তৈরি করা ।
আমাদের একটা পঞ্চাশ বছর মেয়াদি দীর্ঘ পরিকল্পনা নিতে হবে । পঞ্চাশ বছর পর আমারা নিজেদের কোথায় দেখতে চাই সেটা পরিস্কার হওয়া জরুরি । মজার বিষয় হল , পাঁচসালা বা পঞ্চবার্ষিক যে পরিকল্পনা করা হয় , এককালে সেটা ও করা হতো প্যারিসে বসে , হার্ভার্ডের পিনিকগ্রস্থ অধ্যাপকদের দ্বারা । পশ্চিমা অর্থনীতি হল ' অর্থ , মরনাস্র আর ঋণের ' অর্থনীতি । আমাদের অর্থনীতি হল - ভাত , মাছ , আর পাঁটের অর্থনীতি । আমাদের অর্থনৈতিক পরিকল্প হার্ভার্ড পিএসডি রা ঠিক করলে বুঝ কি অবস্থা হবে ? কথাটা এই কারনেই বললাম , যে পঞ্চাশ বছরি পরিকল্পনা করার জন্য আমাদের সেই মেধা আছে কিনা ? উহ , এ কাজটা অসম্ভব শক্ত । একইসাথে রাজনীতি , অর্থনীতি , সমাজ , ধর্ম , বিজ্ঞান ,অসংখ্য বিষয়ে অভিজ্ঞতা থাকা সুপারকম্পিউটার টাইপ থিঙ্কট্যাংকার দরকার । কিভাবে পাব ?
পৃথিবীর সবচে মূল্যবান সম্পদ হল _ বিশ্ববিদ্যালয় । উন্নত দেশের বিশ্ববিদ্যালয় গুলো দেখ_ কতখানি এগিয়ে আছে । আমরা এগুতে পারছিনা । যে কোন বিষয়ে উচ্চ ডিগ্রি পর্যন্ত ফ্যাসিলিটি তথা গবেষণাগারের অভাবে সম্ভব হয়না । সরকার কে চোখ বন্ধ করে বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর উন্নয়নে মনোযোগ দিতে হবে , বাজেটের পরিমান বাড়াতে হবে সর্বোপরি সমগ্র শিক্ষা বেবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে ।রিলিজিয়ন এবং সেকুলারিজম নিয়ে যে কুতকুত খেলা চলছে , এটা বন্ধ করতে হবে । একটা দেশের উন্নতি সে দেশের বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর কোয়ালিটির সাথে সমানুপাতিক ।
টাকা তো নাই ! তাহলে কি ঋণ নিতেই থাকব ?
আমাদের সেই আর্থিক সঙ্গতি এবং কারিগরি দক্ষতা নেই । কিন্তু এই ঋণ ঋণ খেলার মধ্যে থাকলে যে সম্ভবনা টুকু আছে সেটিও শেষ হয়ে যাবে । এখন আমরা কি করব ? এটা অল্প কথায় বলা কঠিন ! বিকল্প কি করা যায় তা বলার আগে কেন ঋণের সাথে জড়াতে অনিচ্ছুক সেটা ব্যাখ্যা করা যাক । ১। অর্থনীতি নির্ভরশীল হয়ে যায় , ২। গণতান্ত্রিক বেবস্থা ব্যাহত হয় ,৩। নয়া -উপনবেশবাদ ঘাটি গাড়ে ৪। বাজার দখল হয় বিদেশী পণ্যে ৫। নিজস্ব ভারী শিল্পকারখানা গড়ে উঠেনা । খেয়াল করলে দেখবে , বড় ঋণ দানকারী সংগঠন গুলো পৃথিবীর কোথাও ভারীশিল্প ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করেনা , করলেও এতোরকমের শর্ত থাকে যে রাষ্ট্র বেহাল অবস্থায় পড়ে ! একবার কোন রাষ্ট্র যদি পশ্চিমা ঋণের খাতায় নাম লেখায় তবেই শেষ ! এবার বিকল্প কাজের কথা বলা যাক _ ১। জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন কে শক্তিশালী করা ২।চীন - জাপান বছর খানেক আগে নিজেদেরমুদ্রায় কেনা কাটা করেছে , সেই ভাবে চীন , জাপান , বা রাশিয়ার সাথে দ্বিপাক্ষিক অর্থনৈতিক চুক্তি করা যায় কিনা তা খতিয়ে দেখা, বিশেষ করে বিনিময় বাণিজ্য করা যেতে পারে । ৩। অভ্যন্তরীণ কৃষি বিপ্লব ঘটানো ৪। সামরিক ও প্রযুক্তিগত সহযোগিতার জন্য জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী দেশগুলুর মধ্যে বিনিময় চুক্তি করা যায় কিনা তা ও খতিয়ে দেখা উচিৎ ।
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে ডিসেম্বর, ২০১৪ রাত ৮:০২